সাইকেল চোর
অনেকদিন পরে রাস্তায় সাইকেল চোর দেখলাম। আজকাল টাকা দিয়ে কেনা সাইকেল আর ক’টা! তাও যে কয়েকটা আছে তার বেশীরভাগই রেসিং সাইকেল। আর নয়তো স্কুটি অথবা বাইক। শুনেছি নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী রোজ সাইকেল চালিয়ে অফিস যান। ইউরোপে বড় বড় রাজপথ বাদে প্রতিটা রাস্তায় আলাদা সাইকেল ট্র্যাক আছে। তবে আপাততঃ সে প্রসঙ্গ থাক।
সেদিন আমার পুরনো পাড়ায় গেছি। সন্ধ্যার আবছায়ায় রাস্তার মোড়ে মিষ্টির দোকানের সামনে বেশ বড় একটা জটলা। কয়েকটা চেনা মুখ। খুব উত্তেজিত। ‘সাইকেল চোর ধরা পড়েছে। এখানে খুব ভীড়। যেতে পারবে না।’
পাড়ার ছেলেরাই ভীড় ফাঁকা করে আমাকে পার করে দিল। যেতে যেতে দেখলাম মিষ্টির দোকানের সামনে সিঁড়িতে খালি পা, শতছিন্ন পোষাকের এক যুবক হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। একজন তার কান মুচড়ে ধরে আছে। চারদিক থেকে তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ ধেয়ে আসছে তার দিকে। বললাম, ‘এ কি করছ? পুলিশে দাও। ওরা যা করার করুক।’
আমার কথায় কেউ খুব একটা পাত্তা দিল বলে মনে হল না। আজকাল কে কার কথায় পাত্তা দেয়! তবে যে লোকটা অভিযুক্তের কান মুচড়ে ধরে ছিল, সে সেটা ছেড়ে দিল। আমার তখন রোগী দেখার তাড়া ছিল। এগিয়ে গেলাম।
ভুবনেশ্বর
মন্দির শহর ভুবনেশ্বর আজকাল বড় বড় চোরদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা আর জিজ্ঞাসাবাদের কেন্দ্র। আদালতের রায়ে করদাতাদের দেওয়া লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে তাদের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে আনা হচ্ছে। সাইকেল চোর বা রুটি চোরেরা কিন্তু এতটা ভাগ্যবান নয়। তারা বড়জোর হাটুরে মার খাওয়ার পরে সরকারী হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মেঝের এক কোনে জায়গা পেলেও পেতে পারে। তাদের জন্য পিজি হাসপাতালের এসি কেবিন বুক করা থাকে না। ওসব থাকে একশ বা হাজার কোটির চোরদের জন্য। প্রসঙ্গে ফিরে আসি, ভুবনেশ্বরে লিঙ্গরাজের পদস্পর্শে পাপস্খালন করে কোনো কোনো চোর আবার দিল্লীর সংসদ ভবনে পৌঁছে মহাপ্রভুর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে- এমনও দেখা গেছে। তার মানে কি দাঁড়ালো- আজকাল বঙ্গের লালবাতিওলা ভিআইপি চোরদের সংশোধনাগার হল ভুবনেশ্বর, যেখানে গিয়ে তারা সংশোধিত হয়ে সব কালিমা ধুয়ে আবার ধপধপে পোষাকে ফিরে আসে।
পিএইচডি
আগের লেখাতেই বলেছি, গবেষণাপত্র নকল করাটা একটা আর্ট। সবাই সেটা পারে না। তবে মন্ত্রীমশাই-এর ব্যাপারটা আলাদা। তিনি একবার মুখ ফুটে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে, পিএইচডি করতে চান- অমনি গাইডদের লাইন পড়ে গেল। আর কে না জানে- এসব ক্ষেত্রে যে পেয়াদা, সে-ই হাকিম। অন্য ক্ষেত্রে পিএইচডি ছাত্র গাইডের বাড়ির বাজার করে, রেশনের দোকানে লাইন দেয়। নিদেনপক্ষে গাইডের ব্যাগ বয়ে গুরুদক্ষিণা দেয়। আর তেমন তেমন পিএইচডি ছাত্রীর সাথে থীসিস নিয়ে গভীর আলোচনাটা গাইড সারেন দীঘা বা মন্দারমনি, নিদেনপক্ষে রায়চকে। কিন্তু মন্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বভাবতঃই নিয়মটা উল্টো। সুতরাং, মন্ত্রী পিএইচডি হলেন আর গাইড উপাচার্য । আর বাঁধানো থীসিস বইতে ধরা রইল চুরির উপাখ্যান। সাধে কি আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব ক্রমপর্যায়ে হাজারের মধ্যেও আসে না!
পুকুর চুরি
কলকাতায় এককালে অসংখ্য জলাশয় ছিল এ বিষয়ে কলকাতার বয়স্ক মানুষেরা নিশ্চয়ই আমার সাথে একমত হবেন। কিন্তু এখন সেগুলো হাতে গোনা যায়। পুকুরগুলো গেল কোথায়?
উত্তরটা আপাতঃভাবে খুব সহজ। প্রোমোটাররা সেগুলো বুজিয়ে ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখুন, এই বোজানোর প্রক্রিয়াটা কি এক দিনে শত শত শ্রমিক আর যন্ত্রপাতি নিয়ে হয়েছে? তাহলে তো টিভিতে দেখাতো, চারদিকে ঢি ঢি পড়ে যেত। দু-একজন মাথামোটা প্রোমোটার ছাড়া এভাবে সত্যিই কেউ পুকুর বোজায় না।
তাহলে ব্যাপারটা কিভাবে ঘটে?
উত্তর হল, প্রোমোটারের নজরে যে সরকারি বা বেওয়ারিশ পুকুর আছে, তাতে অন্য নির্মিয়মান ফ্ল্যাট বাড়ির জঞ্জাল-ইঁটের টুকরো, কংক্রীট ইত্যাদি চুপচাপ, ধীরে ধীরে ফেলা হতে থাকে। এতে চট করে মিডিয়া বা মানুষের নজর পড়ে না। কিন্তু পুকুর ছোট হতে থাকে। তাছাড়া, আশেপাশের বাসিন্দারাও তখন তার উপর বাড়ির জঞ্জাল ফেলতে থাকে। আসলে, সাদা দেওয়ালে পানের পিক দেখলে সেখানে থুতু ফেলা বা পেচ্ছাপ করাটা আমাদের স্বভাব অথবা বলা ভালো জাতীয় অধিকার।
(ও যখন ফেলেছে, তখন বলতে পারেন নি? এখন আমাকে বলছেন! আগে ওকে আটকান মশাই, তারপর আমাকে বলবেন, ইত্যাদি)।
যাই হোক, এভাবেই কয়েক বছরের মধ্যেই দশ-বিশ বিঘার পুকুর দু-বিঘা হয়ে যায়। তারপর, নোটের বান্ডিল চলাচলের মাধ্যমে ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাটবাড়ি ও শপিংমল মাথা তোলে। আমরা হাসি হাসি মুখে সেখানে বাজার করতে যাই বা ফ্ল্যাট কিনে ইয়েমাই এর টাকা মেটাই। কালক্রমে, বছর দশ-বারো বাদে- যখন সেই বাড়ির একদিক বসে যায় আর ফ্ল্যাটের দেওয়ালে চিড় ধরে- তদ্দিনে ভেগে যাওয়া অদৃশ্য প্রোমোটারের উদ্দেশ্যে আমরা গালি দিয়ে নিজেদের দোষস্খালন করি।
পকেটমার
অনেকদিন আগের ঘটনা। তখনো স্মার্টফোনের যুগ আসে নি। চক্ররেলে সেদিন ভীষণ ভীড়। বিবাদী বাগ থেকে ট্রেনটা ফিরছে দমদম। বাগবাজার আসতেই হঠাৎ চিৎকার ‘চোর, চোর। পকেটমার, পকেটমার। ধর,ধর।’ এক জাঁদরেল মহিলার আর্তনাদে পকেটমার বাবাজি ধরা পড়ে গেল। একজন বলল,
‘আমার ব্যাগ চিরে ফাঁক করে দিয়েছে।’ আর একজন আর্তনাদ করল, ‘আমার মানিব্যাগ?’
এসব ক্ষেত্রে পকেটমারের কপালে সাধারণতঃ গণধোলাই বরাদ্দ থাকে।
কিন্তু ভজগৌরাঙ্গ বাবু রসিক লোক। চিৎকার শুনে তিনিই পকেটমার পাকড়েছেন। সুতরাং শেষকথা তাঁর। এদিক-ওদিক থেকে দু-চার পিস চড়-থাপ্পড় পড়ার পর তিনি বললেন, ‘থামুন, থামুন। এদের পুরো দলটাকে ধরা দরকার।’
কালো, চিমসে মার্কা, বেঁটেখাটো একটা লোক প্লাটফর্মের শেষে মাথা নীচু বসে আছে।
‘অ্যায়, তোর নাম কি?
‘সনু।’
‘আমার মানিব্যাগ কোথায়।’
‘গুল্লু-র কাছে।’
কথাবার্তায় বোঝা গেল গুল্লু ওদের দলেরই এক মেয়ে সদস্য। চোরাই মাল পাচার করাই ওর কাজ। গন্ডগোল দেখে বাগবাজারে রানিং-এ নেমে পালিয়েছে।
শনিবার বিকেল। অনেকেরই বাড়ি ফেরার তেমন তাড়া নেই। মজা দেখার জন্য কেউ কেউ বলল, ‘কি করে এরকম নিঃসাড়ে ব্যাগ কাটলি দেখা দেখি।’
মোটাসোটা ভজগৌরাঙ্গবাবুর খপ্পর থেকে বেরিয়ে সনু বলল,
‘তবে একখান লাউ নিয়ে আসেন।’
পকেটমারি দেখাতে লাউ কি কাজে লাগবে- তা কারও বোধগম্য হল না। তবে বাগবাজারের বাজার থেকে একখানা আস্ত কচি লাউ চলে এল।
‘একটা রুমাল দ্যান কর্তা।’
রুমাল বেরোলো।
‘এবার দেখুন কালু ওস্তাদের খেল।’
সবাই সমস্বরে বলল, ‘কালু ওস্তাদ কে?’
‘সে আমাদের সবার গুরু। মুচিবাজার ডালপট্টিতে থাকে। বয়স হয়েছে। তাই এখন আর অপারেশনে বের হয় না। শুধু ট্রেনিং দেয়।’
তারপর সনু যা খেল দেখাল, তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করা মুশকিল। লাউয়ের উপরে রুমালটা ভাঁজ খুলে পেতে রেখে তার ডানহাতের জোড়া করা তর্জনী আর মধ্যমা দ্রুত চালিয়ে দিতেই রুমালটা দুভাগ হয়ে উড়ে গেল। অথচ লাউ যে কে সেই। সামান্য দাগ অবধি পড়ে নি। তর্জনী আর মধ্যমার মাঝখান থেকে ব্লেডের ভাঙা আধখানা বের করে সনু বলল, ‘দেখলেন তো!’
দেখি, আমরা শুধুই দেখি। এভাবেই আমাদের ব্যাঙ্কের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায় বিদেশে। আমরা বিভোর হয়ে থাকি পার্থ-অর্পিতার কেচ্ছায়। ললিত মোদী-সুস্মিতা সেনের ফটোশুটে। তেরো হাজার কোটি গায়েব হওয়ার পরেও বহুদিন অবধি পাঞ্জাব ন্যাশন্যাল ব্যাঙ্কের হুঁশ হয় নি। যখন হল, ততদিনে পাখী উড়ে গেছে অ্যান্টিগুয়ায়।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে