প্রত্নতত্ত্ব
এক সরলমতি ইউরোপীয় বালক মিশরে বেড়াতে গিয়ে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘বাবা, মিশরে তো পিরামিড আছে। কিন্তু আমাদের দেশে নেই কেন?’
রসিক ভদ্রলোক উত্তরে বলছেন, ‘আসলে পিরামিড তো ভীষণ বড় আর ভারী। তাই ওগুলো তুলে নিয়ে যাওয়া যায় নি।’
ইউরোপ, আমেরিকায় তো বটেই, এখন চীন এবং অন্যান্য এশীয় দেশেও বেশ কিছু ধনী ব্যক্তি আছে যাদের শখ হল দেশবিদেশের বিভিন্ন দামী ও দুস্প্রাপ্য প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করা। সে আইনি-বেআইনী যে কোনো পদ্ধতিতে। যে কোনো মূল্যে। এদের জন্যেই বিশ্বব্যাপী বেআইনী প্রত্নবস্তুর চাহিদা, বিলিয়ন ডলারের বাজার।
এ তো গেল ব্যক্তিগত চুরির উদাহরণ। এর থেকেও অনেক বড় মাপে সরকারি স্তরে প্রত্নবস্তুর লুন্ঠন। পৃথিবীর এমন কোন মিউজিয়াম নেই যেখানে মিশর, ভারতবর্ষ, আফ্রিকা এমনকি চীনের দুর্মূল্য প্রত্নবস্তু প্রদর্শিত নেই। এগুলোর মধ্যে কতগুলো উপহারস্বরূপ প্রাপ্ত, আর কতগুলো যুদ্ধ এবং ঔপনিবেশিক শাসনের সুযোগ নিয়ে লুন্ঠিত? খোঁজ নিলে দেখা যাবে লুন্ঠিত প্রত্নবস্তুর সংখ্যা অনেক অনেক বেশী। এমন অবস্থা যে, সব লুন্ঠিত প্রত্নবস্তু কোনোদিন ফেরত দিতে হলে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, নেদারল্যান্ডের অনেক মিউজিয়ামকে মাছি তাড়াতে হবে।
শুধু চুরিই নয়। এর সাথে আছে বাটপাড়ি এবং ভন্ডামি। বার্লিনের নিউয়েস মিউজিয়ামের (Neues-New-নতুন) ‘ট্রয়’ বিষয়ক সংগ্রহশালায় (সম্ভবতঃ দোতলায়) গেলে দেখা যাবে সেখানে এক জায়গায় ট্রয় নগরীর খোঁজে আধুনিক তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমে আনাতোলিয়া অঞ্চলে ব্রিটিশ ও জার আমলের রুশরা তুরস্ক সরকারকে না জানিয়ে যে বেআইনী খননকাজ চালিয়েছিল তার ব্যাপক সমালোচনা করে নৈতিকতার পাঠ দেওয়া আছে।
অথচ হাইনরিশ স্লীম্যান নামে যে জার্মান অপেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক তুরস্ক রাজশক্তিকে ভুল বুঝিয়ে অসংখ্য দামী প্রত্নবস্তু প্যারিস ও বার্লিনে পাচার করে, শেষে তুরস্কের হাতে ধরা পড়ে মাত্র দশ হাজার ফ্রাঙ্ক জরিমানা দিয়ে নিস্তার পেয়ে গেছিলেন- সেকথা বেমালুম চেপে গিয়ে তাকে প্রায় জাতীয় বীর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, পাশেই অলটেস (Altes-Old-পুরোনো) মিউজিয়ামের মিশর বিভাগে রয়েছে অসংখ্য স্তম্ভ, ওবেলিস্ক, হায়রোগ্রিফিক লিপি লেখা পাথরের টুকরো, মমি এবং আরও কত কি! কোনোটাই তো মিশর সরকারের থেকে থেকে উপহার পাওয়া বা কিনে আনা বলে লেখা নেই। মানে স্রেফ চুরি অথবা লুঠ।
কোহিনূর, ময়ুর সিংহাসন, টিপু সুলতানের তরবারি- এসবের কথা আর না-ই বা বললাম! সবাই জানে।
গবেষণাপত্র
আমরা, যারা জীবনে পারতপক্ষে মৌলিক গবেষণার ধার কাছ দিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাই নি, বা সুযোগ পেলেও কঠিন পড়াশোনার ভয়ে যাই নি- তারা আত্মরক্ষার্থে এবং গবেষকদের নীচে নামিয়ে দিতে একটা কথা বলে থাকি। গবেষণা মানে আর কি! গো-এষণা। বকলমে গোরু খোঁজা। এখন এই গোরু খুঁজতে গিয়ে অন্যের গোরুকে নিজের গোয়ালে নিয়ে আসার ফন্দিফিকির যারা জানেন, তারা হলেন সত্যিকারের ‘মহাপুরুষ’।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু-র আবিষ্কৃত বেতার তরঙ্গের উপর ভিত্তি করে ইতালীয় গুইলেলমো মার্কোনি এবং জার্মান পদার্থবিদ কার্ল ফার্দিনান্দ ব্রন ১৯০৯ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। অথচ জগদীশচন্দ্র কিছুই পান নি। একে পরাধীন দেশের বিজ্ঞানী, তদুপরি সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের কথা চিন্তা করে তাঁর কোনো আবিষ্কারের কোনো পেটেন্ট তিনি নেন নি। যক্ষারোগের জীবাণুর আবিস্কারক রবার্ট কখ বা ইনসুলিনের আবিষ্কারক ফ্রেডরিক ব্যান্টিংও তাঁদের আবিষ্কারের পেটেন্ট নেন নি, অথবা পান নি। কিন্তু সেটা তাঁদের নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।
মার্কোনি ছিলেন অত্যন্ত ধূর্ত। তিনি কিন্তু সেসব রাস্তায় হাঁটেননি। অন্যের আবিষ্কার চুরি করে তাঁর নেওয়া ব্রিটিশ পেটেন্টের দৌলতে তিনি বহু বছর ধরে কোটি কোটি ডলার আয় করেছেন। শুধু তাই নয়- না মার্কোনি, না ব্রন – দুজনের কেউই তাঁদের নোবেল বক্তৃতায় জগদীশচন্দ্রের নামটুকু পর্যন্ত উচ্চারণ করেন নি। এজন্য নিজেদের দেশেই তাঁরা খুব সমালোচিত হয়েছিলেন।
দর্শনশাস্ত্রের মেধাবী ছাত্র, অধ্যাপক যদুনাথ সিংহ-র প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ গবেষণাপত্রের বেশ কয়েকটা অংশ হুবহু টুকে দিয়ে স্যার সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান লেখেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘ইন্ডিয়ান ফিলজফি’। এই নিয়ে মামলা আদালত অবধি গড়িয়েছিল। পরবর্তীকালে প্রভাবশালীদের চাপে সে মামলা চাপা পড়ে যায়। অধ্যাপক যদুনাথ সিংহ তখনো অধ্যাপক হন নি। তাঁরও চাকরির পাওয়ার প্রয়োজন ছিল।
অত্যন্ত মেধাবী বিজ্ঞানী স্যার কে এস কৃষ্ণান-এর সাথে যৌথভাবে করা গবেষণার ফলাফল ‘রামন এফেক্ট’। যার উপর ভিত্তি করে নোবেল পেয়েছিলেন স্যার সি ভি রমণ। কিন্তু শেষ মূহুর্তে গবেষণাপত্রটি বিজ্ঞানী নিলস্ বোর, রাদারফোর্ড প্রমুখের কাছে পাঠানোর সময় অধ্যাপক কে এস কৃষ্ণান, অধ্যাপক সুকুমার চন্দ্র সরকার প্রভৃতিদের নাম বাদ পড়ে যায়। আর নিলস্ বোর কে কেবলমাত্র স্যার সি ভি রামণ-ই চিনতেন। বাকীরা নয়! সুতরাং….
তথ্যচুরি
সিঙ্গাপুরে ফেলোশিপে গেছি। একটা জটিল অপারেশন করছেন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক। অপারেশনের মাঝপথে একটা যন্ত্র ব্যবহার করার সময় বিশেষতঃ আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘এইটা হল আসল যন্ত্র (আমেরিকায় তৈরী)। তোমরা তো তোমাদের দেশে এর নকলগুলো ব্যবহার করে অভ্যস্ত। এখন আসলটা দেখে নাও।’
কথাটা শুনে গা জ্বলে উঠল। কিন্তু প্রতিবাদ করার উপায় নেই। বিভাগীয় প্রধান। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেলে ঝামেলায় পড়ব। তাছাড়া, তাঁর কথাগুলো পুরোপুরি মিথ্যেও নয়। তবে দেশের দিকে ইঙ্গিত না করলেও পারতেন। অনেক পরে, আমার ফেয়ারওয়েলের দিন তিনি নিজেই সেদিনের সেই উষ্মার কারণ প্রকাশ করে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। ততদিনে সম্পর্ক অনেক ভালো। যাই হোক, তাঁর সেই উষ্মার কারণ ছিল আমাদেরই মত তাঁর এক ফেলো। তবে তিনি হলেন মহাপুরুষ। সেই যুগেই ওই হাসপাতালের সব কিছু ছিল ডিজিট্যাল। সেই মহাপুরুষ তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের বিশেষ বিশেষ কিছু কেসের রেকর্ড হস্তগত করেন। সারস্বত জগতে যা চুরির সমতুল্য। যতদিনে তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে, ততদিনে পাখী উড়ে দেশে ফিরে গেছে।
অনেক বছর আগে হায়দ্রাবাদের এক চক্ষু হাসপাতালে কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্তকারী দল যায়। যৌথ গবেষণার নামে সেখান থেকে আমেরিকার একটি সংস্থায় তথ্য পাচার হয়ে যাচ্ছিল। হায়দ্রাবাদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টা বুঝতে পারেন নি, না কি জেনে বুঝে সম্মতি দিয়েছিলেন- বলা মুশকিল। যাই হোক, তদন্তকারী সংস্থার সতর্কীকরণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। বন্ধ হয় সেই যৌথ গবেষণা। তবে এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এভাবেই নিরন্তর পাচার হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।