লোকে আমার গল্প শুনে বলে, “তোমার ঝুলিতে রাঁচির গল্পের মতো নিমহ্যানসের গল্প নেই? রাঁচির পেছনে লেগেছ, ব্যাঙ্গালোরকে রেহাই দিলে কেন? তুমি তো দেখছি সাংঘাতিক পার্শিয়াল!” অনেক ভেবে দেখি, যে আছে বটে নিমহ্যানস বা ব্যাঙ্গালোরের গল্প, বলিনি, এমনও না… কিন্তু তাতে রাঁচির গল্পের মতো স্বাদও নেই, ধারও না।
যেমন সেই দিনটা – যে দিন সন্ধেবেলা জিনা আর আমি বিদ্যাপতি নগরের বাড়ির বাইরে বসে কফি খাচ্ছি – এমন সময়ে খুব কাছ থেকে খটাশ খটাশ করে অদ্ভুত শব্দ হতে শুরু করল। আমি জিনাকে সবে বলেছি “কী রকম বন্দুকের শব্দের মতো শোনাচ্ছে…” এমন সময় আসেপাশের বাড়ির ছেলে–ছোকরারা ছুটে ছুটে ফিরছে, আর বলছে, “আন্টি, আঙ্কল, শিগগির ভেতরে যান, ওবাড়িতে ডাকাত পড়েছে – গুলি চলছে, শুনতে পাচ্ছেন না?”
ভালো করে কিছু বোঝার আগেই দেখলাম চেয়ার, টেবিল, কফির কাপ ফেলে ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে দিয়েছি। খানিক্ষণ বাইরে খট্ খট্ করে গুলি চলল, তারপর সব শুনশান।
জানলার ফাঁক দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি কী পরিস্থিতি, এমন সময়ে দরজার ঘণ্টা বাজল। সাবধানে উঁকি দিয়ে দেখি প্রতিবেশী একজন। সাহস পেয়ে দরজা খুলে বেরোলাম। উনি বললেন, “আরে, ডাঃ দেব, আপনাকে বলা হয়নি। আপনি নতুন লোক… এই যে সামনের বাড়িটা… ওটার গেট উলটোদিকে… এখানে থেকে দেখা যায় না। কিন্তু ওদের বাড়িতে বছরে দু’বার ডাকাত পড়ে। এমনিতে আমার আপনার সমস্যা কিছু হবে না, কিন্তু এরাও গুলি চালায়, ওরাও গুলি চালায় – তাই সেই সময়টা রাস্তায় না থাকাই ভালো।”
হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, ভদ্রলোক বাজারের ব্যাগ দোলাতে দোলাতে চলে গেলেন ওই বাড়িরই দিকে।
চার বছর ছিলাম রাঁচিতে – আটবার না হলেও অন্তত পাঁচ–ছয়বার ডাকাত পড়তে দেখেছি বাড়িটাতে। প্রত্যেকবারই ঘটনাবলী একই রকম।
তারপরে সেই দিনের কথা – যে দিন পাড়ার কিছু লোকের সঙ্গে বসে গল্প করছিলাম, জিনা দূরের একটা বড়ো ছ’তলা বাড়ি দেখিয়ে বলল, “ওই বাড়িগুলো কাদের কোয়ার্টার?”
“কোল ইন্ডিয়ার,” বলে ভদ্রলোক বললেন, “ওই যে বাড়িটা – ওটাতে কী হয়েছিল জানেন?” বলে শুরু করলেন, “ওই যে ওপরতলায় যেখানে অশ্বত্থের চারাটা উঠেছে, তার থেকে তিনটা জানলা বাঁয়ে… একটা নতুন বিয়ে করা দম্পতি থাকত – মেয়েটা বাঙালি, হাজব্যান্ড বিহারের। দু’জনেই ডাক্তার। একটা ছোট্ট বাচ্চা ছিল ওদের এক বছরের একটু বেশি। বাবা–মা ওই কোল ইন্ডিয়ার হাসপাতালে কাজ করত। পাশেই। বাচ্চাটার দেখাশোনা করত একটা কমবয়েসী আদিবাসী মেয়ে। একদিন কী হয়েছে, কী কারণে ওরা মেয়েটাকে কিছু বকাঝকা করেছে। সেদিন দুপুরে মা–বাবা ডিউটি থেকে ফিরে দেখে মেয়েটা নেই, বাচ্চাটাও নেই। একটু খোঁজাখুঁজি করেই বোঝা গেল মেয়েটা জামা–কাপড়, প্লাস মালিকের কিছু জিনিসপত্তর নিয়েই পালিয়েছে। বাচ্চাটারও খোঁজ নেই। পুলিশে খবর দেওয়া হল, সারা পাড়া তন্নতন্ন করে খোঁজাখুঁজি… কোত্থাও কিচ্ছু নেই… সারাদিনের পরে বর–বউ ঘরে ফিরেছে, সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি, বউ বলল, “একটু ভাতে–ভাত করে নিই…” বলে রান্নাঘরে গিয়ে প্রেশার কুকারটা নিয়ে বলেছে, “এতে কী ভরে রেখে গেছে? এত ভারি কেন?” বলে খুলে দেখে বাচ্চাটাকে কুচি–কুচি করে কেটে রান্না করে রেখে গেছে।”
আমরা খানিকক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। শেষে বললাম, “তারপর?”
তার আর পর নেই। ওই ডাক্তার দম্পতি চাকরি ছেড়ে চলে গেছে।
জিনা আর থাকতে পারল না। বলল, “কিন্তু ওই আয়ার কিছু হলো না? পুলিশ ধরেনি ওকে?”
ভদ্রলোক হেসে নাক দিয়ে একটা ফুৎ শব্দ করে বললেন, “পুলিশ? এই বিহারি পুলিশের দ্বারা কিছু হয়? কিস্যু হয়নি। কোনও সুরাহা হয়নি।
এখন মনে হয়, এ গল্পের সত্যতা জাচাই করলেই আজকাল যাকে বলে ফেক নিউজ, তা–ই দাঁড়াত। কিন্তু তখন, রাঁচির আবহাওয়ায়, একবারও মনে হয়নি মিথ্যে হতে পারে।
তারপরে সেই গাঢ় গোলাপি মারুতি ভ্যানটা। একদিন দেখি কাঁকে রোডের পাশে একটা ভ্যান রাখা আছে তার পিছন দিকটা ফুলের পাপড়ি–মেলার মতো করে ফেটে খুলে এসেছে। পুড়ে কালোও বটে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে ঘটনাটা এমন:
রাঁচিতে সন্ধেবেলায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় ইলেক্ট্রিসিটি যেত – সে গল্প আগে করেছি। রাঁচিতে কখন পেট্রল পাওয়া যাবে, বা যাবে না তারও কোনও ঠিক ছিল না। আমরা যারা কাঁকেতে থাকতাম, অনেক সময়েই পাঁচ কিলোমিটারের বেশি গিয়ে দেখতাম পেট্রোল পাম্প বন্ধ, বা সাপ্লাই নেই। যারা স্কুটার বা মোপেড চড়তাম, তারা সেই সময়ে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে ঝুপড়ি থেকে বে–আইনি পেট্রল কিনতাম, লিটারে দু’টাকা বেশি দিয়ে। কিন্তু সেই পেট্রোলে টু–টি, অর্থাৎ মোবিল মেশান’ থাকত’ বলে গাড়ি আর মোটরসাইকেলারোহীরা সেই দিয়ে কাজ চালাতে পারত না। তাদের বাড়িতে সবসময়েই পাঁচ কী দশ লিটার পেট্রোলের বন্দোবস্ত রাখতে হত।
সেই দিন সে বাড়িতে সন্ধেবেলা আড্ডা হচ্ছে, অনেক অতিথি অভ্যাগত সমাগম হয়েছে। এমন সময় মালিকের ভাইয়ের খেয়াল হয়েছে, আরে! মাত্র দশ মিনিট বাকি। এক্ষুনি কারেন্ট যাবে। আমি বরং এই ফাঁকে মারুতি ভ্যানটাতে পেট্রোল ভরে রাখি।
গিয়েছেন বাড়ির বাইরে, বাগান পেরিয়ে, গ্যারেজের সামনে – যেখানে ভ্যান দাঁড়িয়ে। জেরিক্যান থেকে পাইপ দিয়ে সাইফন করে পেট্রোল ভরছেন, এমন সময়, নির্দিষ্ট সময়ের পাঁচ মিনিট আগেই কারেন্ট চলে গিয়ে সব অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।
তাড়াতাড়ি হেঁকে বলেছেন, “শম্ভু, জলদি বাত্তি লানা!”
বৃদ্ধ শম্ভু কাঁপা হাতে লম্ফ জ্বেলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছে।
বাবু খোলা আগুন দেখে ঘাবড়ে গিয়ে কিছু না বলে দিয়েছেন দৌড়, জেরিক্যান, পাইপ, পেট্রোল সব ফেলে…
শুম্ভু মালিককে পালাতে দেখে নিজেও ছুটে পালিয়েছে – লম্ফটা মাটিতে ফেলে…
শব্দটা নাকি সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে কাঁকেতে আমার বন্ধুরা হস্টেলে শুনতে পেয়েছিল। আমি অবশ্য আধ কিলোমিটারের মধ্যে ছিলাম, কিন্তু কিছু শুনেছিলাম বলে মনে পড়ে না।
কিংবা হয়ত মনে করেছিলাম পাশের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে।
রাঁচিতে মানসিক রোগ চিকিৎসার হাসপাতাল থাকার ফলে রাঁচি সম্বন্ধে কলকাতা, তথা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা কি মত পোষণ করে, তা সর্বজনবিদিত। কাউকে রাঁচি যেতে বলা মানে তার মস্তিষ্কের অবিকৃত অবস্থা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। এবং এই মত, আশ্চর্যভাবে, সারা দেশেই বিস্তৃত। অথচ বড়ো বড়ো মানসিক রোগ চিকিৎসার হাসপাতাল দেশের সব বড়ো, মাঝারি বা ছোটো শহরেই রয়েছে – কলকাতায়, পুণেতে, আগ্রায়, এমনকি তেজপুরেও। অনেক ভেবে দেখেছি যে একমাত্র রাঁচিতেই ছিল ‘ইউরোপিয়ান মেন্টাল হসপিটাল’। সেই জন্যই রাঁচির খ্যাতি এত। সাহেব পাগল যেত বলেই রাঁচির সুনাম।
রাঁচিতে আমরা যে হাসপাতালে কাজ করতাম, সেটাই সাহেব রাজ্যে ছিল ইউরোপিয়। সাহেবী আমলে ওখানে নেটিভরা চিকিৎসা পেত না। তাদের জন্য ছিল আলাদা হাসপাতাল নেটিভ অ্যাসাইলাম। তবে হ্যাঁ, দেশি সাহেবদের জন্য, অর্থাৎ রাজা–রাজড়ার জন্য ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলামের বাইরে ছোটো ছোটো কটেজ বানান’ হয়েছিল। এই কটেজে পরিবার পরিজন, দাস–দাসী নিয়ে রাজা–রাজড়ারা চিকিৎসা পেতেন।
আমাদের সময়ে, বলা বাহুল্য, সাহেব–টাহেবের গল্প ছিলা না। সাধারণ ভারতীয় আর রাজবাড়ির লোক, সকলেই একাসনে চিকিৎসা পেত। আর বাইরের কটেজগুলো ক্রমে ভগ্নদশাপ্রাপ্ত হচ্ছিল।
সারা দেশে রাঁচি বললে যে রকম ফল হয়, রাঁচিতে কাঁকে বললে সেই রকম হত। কলকাতায় বসে লোকে বলে, বেশি পাগলামো করলে রাঁচি পাঠিয়ে দেব – রাঁচিতে বলে কাঁকে নিয়ে যাব। আমাদের এক উকিল বন্ধু ছিল, আমাদের প্রায়ই ডেকে নেমন্তন্ন খাওয়াত, কিন্তু কখনও যদি আমরা বলেছি, “একদিন আয় না, হস্টেলে?” বলত, “নেহি ভাই। ও নেহি হো সকতা। তুমি কাঁকে রোডে, বিদ্যাপতি নগরে, গান্ধীনগরে আমাকে নেমন্তন্ন করো, এমনকি চলো, আমরা কাঁকে পেরিয়ে পাত্রাতু যাই – সমস্যা নেই। কিন্তু ইট্ ক্যান্ নেভার বি সিন যে আমার গাড়ি কাঁকে চৌক থেকে ডান দিকে মোড় নিচ্ছে।”
কাঁকের হাসপাতালের ভেতরে যা হত, তা–ও খুব মজার। একদিন মেঘমন্দ্র ওয়ার্ডে কাজ করছে, কী একটা কথা স্টাফ নার্সকে বলতে হবে, ফাইল হাতে বেরিয়ে দেখে সেদিন ডিউটিতে রয়েছে মেল নার্স কুজুর। সব হাসপাতালে প্রথা অনুযায়ী মহিলা নার্সদের সিস্টার বলা হত, কিন্তু রাঁচির প্রথা অনু্যায়ী মেল নার্সদের বলা হত ব্রাদার।
মেঘমন্দ্র ডক্টর্স রুম থেকে বেরিয়ে দেখল কুজুর হাতে একটা সিরিন্জ নিয়ে ইন্জেকশন ভর্তি করে ইতিউতি তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ফাইল হাতে এগিয়ে গেল।
“ব্রাদার?”
ডাক শুনে তাকাবার অবকাশ তখন কুজুরের নেই।
“এক মিনিট, স্যার,” বলে চোখ–মুখ কুঁচকে একটা রোগীর দিকে তাকিয়ে বলল, “ইধর আও।”
রোগী এল। কুজুর তার হাত ধরে কাছে টেনে এনে খানিকক্ষণ তার মুখ দেখে বলল, “নেহি, তুম নেহি, তুম নেহি। যাও।”
মেঘমন্দ্র জানত, আমরা সকলেই জানতাম, কুজুর চোখে খুব কম দেখে, কিন্তু মানতে চায় না। ওর বক্তব্য, ও মিলিটারিতে যদি চশমা ছাড়া পনেরো বছর ডিউটি করতে পারে, তাহলে রিটায়ারমেন্টের পাঁচ বছর পরে রাঁচিতেও পারবে। কুজুর হেঁটে চলেছে, হাতে সিরিন্জ। পেছনে চলেছে মেঘমন্দ্র।
“ব্রাদার?”
“এক মিনিট, স্যার…” কুজুর আর একজন পেশেন্টের হাতের ডানা ধরে টেনে কাছে এনে চোখ কুঁচকে মুখ দেখে বলল, “নেহি, তুম নেহি।”
“ব্রাদার, আপ কোন্ সা পেশেন্ট ঢুন্ড রহে হো?”
“য়েহি, স্যার, য়েহিঁ হ্যায় কহিঁ… ইধার আও… নেহি, তুম নেহি…”
ক্রমশ কুজুর করিডোর–বারান্দা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে একজন পেশেন্টকে দেখে বলল, “হাঁ–াঁ–াঁ, ইধর বৈঠে হো?” বলে প্যাঁট করে ছুঁচ ফুটিয়ে দিল তার হাতে। তারপরে মেঘমন্দ্রের দিকে ফিরে বলল, “হাঁ, স্যার, বোলিয়ে।”
ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে মেঘমন্দ্র বলল, “রামশঙ্কর কো আজ সুঁই লাগনে কা হ্যায়। এক নেহি, দো অ্যাম্পুল দিজিয়েগা। আমি ফাইলে অ্যাডভাইজ লিখে দিয়েছি।”
“লেকিন রামশঙ্করকা তো সুঁই লাগ গিয়া!”
“কখন?”
সদ্য ইঞ্জেকশন দেওয়া রোগীর দিকে আঙুল তুলে ব্রাদার বলল, “য়েহি তো লাগায়া। আপকা সামনে।”
মেঘমন্দ্র (নিজের) কপাল চাপড়ে বলল, “ব্রাদার, ও রামশঙ্কর না, রামশঙ্কর এখনও ডক্টর্স রুমে বসে আছে। আমি বসিয়ে এসেছি।”
“রামশঙ্কর নেহি হ্যায়? হায় রাম! তো ইয়ে কোন হ্যায়? এই ব্যাটা বুদ্ধু কাহিঁকা, তেরা নাম কেয়া হ্যায়?”
লোকটা বলল, “রামতীরথ্।”
“দেখিয়ে কেয়া বাৎ, ম্যায় জানতা থা ইসকা নাম ভি রাম–সে কুছ হ্যায়… তু বাতায়া কিউঁ নেহি তু রামশঙ্কর নেহি হ্যায়?”
মেঘমন্দ্র বিরক্ত হয়ে বলল, “ব্রাদার আপনে উসসে উসকা নাম পুছা হি কব? ওর ফাইল বের করুন। ইঞ্জেকশন তো দিয়েছেন। ওর ডায়াগনসিস কী? কী ওষুধ চলছে? চলুন দেখি।”
“কুছ নেহি হোগা, স্যার। দো হফতা মে ইঞ্জেকশন কা অসর চলা যায়েগা।”
ফাইল খুলে দেখা গেল রামতিরথেরও একই ওষুধ – আগামীকাল ইঞ্জেকশন পাবার কথা।
একগাল হেসে ব্রাদার কুজুর বলল, “ম্যায় জানতা থা, জেয়াদা গলতি নেহি হুয়া।”
হাসপাতালের বিশাল উঁচু দেওয়ালের ভিতরে রোগীরা ছাড়া থাকে। ভিতরে বিরাট বিরাট খোলা জমিও আছে। সাহেবদের সময়ে তা হয়ত সুন্দর কেয়ারি করা বাগান–টাগান ছিল, কিন্তু স্বাধীন ভারতের বিহারী ওয়ার্ক কালচারের কল্যাণে তা জঙ্গলে পর্যবসিত হয়েছে। সেখানে অনেক সময়ে রোগীরা লুকিয়েও পড়ত, কিংবা চড়ত গাছে। আমি থাকাকালীন গাছে চড়া নিয়ে মজার ঘটনা ঘটেনি, দুঃখের ঘটনা ঘটেছে। আমার শোনা দুটো মজার কাহিনি বলি।
একবার মডস্লে ওয়ার্ডের সামনের একটা গাছে চড়েছে এক রোগী। কিছুতেই নামবে না। তাকে নার্স, ওয়ার্ড বয়, ডাক্তার – সক্কলে মিলে সাধ্যসাধনা করছে, তার হেলদোল নেই। সে ফুট তিরিশেক উঠে একটা চওড়া ডালে গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে।
এমনই কপাল, ওয়ার্ড স্টাফের মধ্যে যারা তখন ডিউটিতে ছিল, তারা কেউই গাছে চড়তে পারে না। তখন আলোচনা হলো কী করা হবে – আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ডিউটি বদলাবে, তখন আসবে আসলাম। আসলাম এলে আর সমস্যা নেই। টুক করে উঠবে গাছে, আর পুট করে পেশেন্টকে বগলদাবা করে ফেরত নিয়ে আসবে। এর মধ্যে লাঞ্চ এসে গেল। মডস্লে ওয়ার্ডের বড়ো ডাক্তার, ডাঃ হাকিম বলে গেলেন, “গাছের নিচে খাবার দাও। খিদে পেয়েছে, ঠিক নেমে আসবে। তখন ধরে নিও।”
তা–ই করা হল। কিন্তু ওয়ার্ড স্টাফেরা স্লিপ ফিল্ডারদের মতো ওঁৎ পেতে আছে দেখে রোগীর নামার লক্ষণ নেই। তখন নার্সের কথায় স্টাফরা একটু দূরে গেল। কভার, মিড উইকেট, লং অফ, থার্ডম্যান… রোগীর ভবি ভোলে না। একজন ডাক্তার বলল, “আরে, ও তোমাদের দেখতে পেলে থোড়াই নামবে। তোমরা লুকিয়ে থাকো।”
সেই কথা শুনে তারা গাছের আড়ালে, থামের পেছনে এমন নানা জায়গায় লুকিয়ে পড়ল। কিন্তু সময় বয়ে যায়, ওয়ার্ডের কাজ ব্যাহত হচ্ছে – তাই একজনকে পাহারায় রেখে (থামের আড়ালে), অন্যরা নিজেদের কাজে গেল, কিন্তু একশোজোড়া চোখ রইল গাছের ডালে… এই বুঝি এল… এই এল খেতে…
আসে না।
আধ ঘণ্টা বা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে, হঠাৎ একজন হাঁ হাঁ করে চেঁচিয়ে উঠেছে, “আ–া–া–া–রে, পেশেন্ট নেমে খাচ্ছে – ধর, ধর, ধর!”
আর ধর ধর, পেশেন্টের খাওয়া তখন শেষ, লোকে দৌড়ে কাছাকাছি আসার আগেই সে তড়াক করে এক লাফে আবার গাছের ডালে, সেখানে পৌঁছে, চেটেপুটে হাত পরিষ্কার করে দিব্যি বসে রইল।
সবাই নজরদারকে ধরল, “কী রে ব্যাটা? কী দেখছিলি?”
সে বলল, “আমি কী করব? এদিকে দুটো রোগী মারপিট করতে লেগেছে…”
এইবার আসলামের অপেক্ষা। খানিকক্ষণের মধ্যে আসলাম এসে গেল। আসার আগেই ঘটনার কথা শুনেছে ও – এসেই গাছতলায় গিয়ে জামা খুলে, জুতো খুলে গাছের গুঁড়ি ধরে ওপরে তাকাল রোগী কত উঁচুতে দেখার জন্য।
রোগী ফস করে একটানে ওর ধুতি খুলে, সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায়, ধুতির এক দিক গাছের ডালে বেঁধে, অন্য দিক নিজের গলায় জড়িয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়াল। লাফাবে।
আসলাম গাছ ছেড়ে তিন পা পিছিয়ে গেল।
রোগী গলা থেকে ফাঁস খুলে ডালে বসল।
আসলাম গাছের দিকে এক পা এগোল।
রোগী উঠে দাঁড়িয়ে ধুতির ফাঁসটা হাতে নিল।
আসলামের প্রচেষ্টার ইতি হল, খবর গেল ডিরেকটরের কাছে, উনি বলে পাঠালেন, একজন ওয়ার্ড স্টাফ যেন গাছের সামনেই থাকে সারাক্ষণ – যতক্ষণ রোগী না নামছে। তাই হল। স্টাফ, ডাক্তার, সবাই বলাবলি করতে লাগল, “রোগী যদি কোনও দিনই না নামে তাহলে?” কিন্তু সে প্রশ্ন কেউ ডিরেকটরকে জিজ্ঞেস করতে গেল না।
সারাদিন কাটল। সন্ধ্যা নামল। সবার ডিউটি শেষ হল। সবাই ফিরবার সময় একবার মডস্লের সামনে দিয়ে ঘুরে গেল। রোগী ভাবলেশহীন মুখে বসে আকাশ দেখছে।
রোদ পড়ে এল। মেট্রন হাঁকা–ডাকা শুরু করলেন, রাত্তিরে কে খোলা আকাশের নিচে বসে গাছের ডালে রোগী পাহারা দেবে?
এমন সময়ে, নির্বিকার মুখে ধুতিটাকে খুলে বগলদাবা করে গাছ থেকে নেমে এসে রোগী ওয়ার্ডে ঢুকে ধুতিটা পরে নিজের নির্দিষ্ট বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের যে পেশেন্টটা গাছে চড়ল, তার গল্পটা অত সহজে শেষ হয়নি। আগের জনের মতো সে অত ছোটো গাছে চড়েনি। হাসপাতালের ঠিক মাঝখানে বিশাল রেন–ট্রির মগডালে – অর্থাৎ মাটি থেকে অন্তত সত্তর আশি ফুট উঁচুতে উঠে বসেছিল। সেদিন হাসপাতালে কী ছুটি ছিল। সম্ভবত রবিবার। কিন্তু বেলা ন’টা দশটার মধ্যে লোকে লোকারণ্য। যত ডাক্তার – এমনকি যারা ক্যাম্পাসে থাকে না, তারাও ওই প্রাক–মোবাইল যুগে, রাঁচি, তথা কাঁকে, তথা সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউটের টেলিফোনের বাধা ঠেলে হাজির। বেলা দশটা নাগাদ, যখন সবার মাথার বুদ্ধি শেষ, কারণ রোগী এতই ওপরে উঠে গেছে, যে সব বড়ো ডাক্তারেরই মত, যে ওর পেছনে কাউকে গাছে ওঠানো উচিত নয়, কারণ অত ওপরে যদি একটা ঝটাপটি হয়ে দুজনে পড়ে যায় – তাহলে আস্ত থাকবে না একজনও। সবাই তখন ডিরেকটরের দিকে তাকিয়ে, আর ডিরেকটর চোখ মুখ কুঁচকে একদৃষ্টে পেশেন্টের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। অন্য সকলের ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেছে – তারা আর ওপরে তাকিয়ে থাকতে পারছে না, এদিকে ডিরেকটর এক মনে বোধহয় পেশেন্টকে হিপনোটাইজ করার চেষ্টায় রত, এমন সময় বাইরের গেট–এর সামনে প্রবল ঢং ঢং ঘণ্টা বাজিয়ে হাজির ফায়ার ব্রিগেডের একটা গাড়ি।
ভয়ানক বিরক্ত হয়ে ডিরেকটর বললেন, “আবার ফায়ার ব্রিগেডকে কে খবর দিল?”
ডাঃ লক্ষ্মণ বললেন, “আমি। ওদের গাড়িতে বিরাট সিঁড়ি থাকে – সে দিয়ে রোগীকে ধরা যাবে। না হলেও ওদের বিরাট বিরাট চাদর থাকে। গাছের তলায় সেই চাদর টেনে ধরে দাঁড়ালে কেউ যদি ওপরে ওঠে, তাহলে পড়ে গেলেও চিন্তা নেই।”
“চিন্তা নেই!” খিঁচিয়ে উঠলেন ডিরেকটর। “আপনি জানেন না, যে ফায়ার ব্রিগেড ওদের প্রত্যেক ঘটনার রিপোর্ট সরকারকে দেয়? এবার সরকার যখন জিজ্ঞেস করবে, পেশেন্ট গাছে কী করে চড়ল, তখন সেই উত্তরটা তো আমাকে দিতে হবে, না?”
কাজটা ভুল করেছেন জেনে ডাঃ লক্ষণের মুখ শুকিয়ে গেল। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। ফায়ার ব্রিগেডের বিশাল ট্রাক আস্তে আস্তে এসে দাঁড়িয়েছে কাছে। ফায়ার অফিসার এক লহমায় সমস্যাটা বুঝে নিয়ে বললেন, “চাদর আমাদের নেই। মই রয়েছে অবশ্য। তবে এই বাগানের মাঝে এত গাছ, তার ফাঁক দিয়ে তো ট্রাক গাছের নিচ অবধি আসবে না। আর এখান থেকে মই ওঠালে রোগীর ধারে কাছেও পৌঁছবে না। তবে অন্য একটা উপায় আছে। তার জন্য একটা চাদর তো লাগবে। আপনাদের হাসপাতালে বিছানার চাদর আছে নিশ্চয়ই? সিস্টারদের বলুন, সাত–আটটা চাদর সেলাই করে একসঙ্গে করতে।”
নিজের আগের ভুল শুধরে ডিরেকটরের চোখে আবার সম্মানের স্থান পেতে ডাঃ লক্ষ্মণ তেড়ে উঠলেন। “তাতে কী হবে? অত ওপর থেকে যদি কেউ পড়ে, তাহলে কি সেলাই করা চাদর তাদের ওজন রাখতে পারবে?”
“আহা, কেউ যদি অত ওপর থেকে পড়ে, সটান তো পড়বে না। গাছের ডালে ডালে ধাক্কা খেতে খেতে পড়বে। ফলে তাদের পড়ার স্পিড তেমন বেশি থাকবে না। সেলাই করা চাদরেই ধরে নেবে। চোট লাগবে না। অবশ্য গাছের ডালে ধাক্কা লেগে মাথা–টাথা ফেটে যেতে পারে – তা তো কিছু করার নেই!”
এমন চমৎকার, বিশদে প্রাঞ্জল করে কেউ বুঝিয়ে দিলে যতটা আশ্বস্ত হওয়া উচিত, ডাঃ লক্ষ্মণকে মোটেই ততটা দেখাল না। আড়চোখে একবার ডিরেকটরকে দেখে নিয়ে চুপ করে রইলেন।
ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সাড়া পড়ে গেল। সব নার্সরা হই হই করে কাঁথা সেলাইয়ের মতো ফোঁড় দিয়ে দিয়ে বিছানার চাদর জুড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দেখতে দেখতে আট–দশটা চাদর জুড়ে একটা বিশাল চাদর তৈরি হল। সেই চাদর এল গাছতলায়। দমকলের স্টাফ, হাসপাতালের কর্মচারী, সবাই চারদিক থেকে টেনে ধরে দাঁড়াল, আসলাম জুতো জামা খুলতে শুরু করল।
“আরে, আরে, রুকিয়ে, রুকিয়ে…” বলে আসলামকে থামিয়ে দমকল অফিসার বললেন, “কাউকে গাছে চড়তে হবে না।”
তবে?
“আমরা এই হোজপাইপ দিয়ে জল ছুঁড়ে ওকে স্থানচ্যুত করব। ও যখন পড়ে যাবে, তখন যাঁরা চাদর ধরে রয়েছেন, তাঁরা কপ করে ধরে নেবেন।”
অত উঁচুতে পৌঁছবে জল?
“আরে ফুল ফোর্স দিলে এই জল একশো কুড়ি ফুট অবধি ওঠে। জলের তোড়ে আগুন নেভাতে হয় না? আপনারা সবাই সরে যান, নইলে ভিজে যাবেন। শুধু যাঁরা চাদর ধরে থাকবেন, তাঁরা থাকুন।”
সবাই সরে গেল। জোরে ইঞ্জিন চালিয়ে হোজপাইপ তাক করে জল চালান’ হল।
তিনটে অসুবিধা দেখা গেল।
প্রথমত, পেশেন্ট পড়ে গেলে নিচের যে যে গাছের ডালে লেগে মাথা ফাটার ভয় ছিল, সেই সেই ডালগুলোই জলের তোড়টাকে কমিয়ে দিল। দ্বিতীয়ত, ওই তীব্রবেগে জল ছেড়ে চার–পাঁচজন দমকলকর্মী মিলেও জলের পাইপটা ঠিকমত তাক করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেল।
তৃতীয় সমস্যাটা এক–লাইনে চমৎকার সামারাইজ করলেন দমকল অফিসার। “আরে, ইয়ে পাগল হোনে সে কেয়া হোগা, বহোৎ সিয়ানা হ্যায়।”
কারণ জল যে দিক থেকে আসে, সে টুক করে অন্য দিকে সরে গিয়ে গাছের কাণ্ডের ওপাশে চলে যায়।
বিশাল ট্যাঙ্ক হলেও দমকলের জল ফুল ফোর্সে ছাড়লে শেষ হতে কয়েক মিনিট লাগে। এবং সেই নির্দিষ্ট মিনিটের পরে এই গাড়ির জলও শেষ হল। তখন সবাই দূর থেকে গুটি গুটি পায়ে ফিরতে শুরু করল। গাছের নিচে সম্পূর্ণ সিক্ত একটা বিশাল চাদর ধরে সম্পূর্ণ সিক্ত গুটিকতক লোক দাঁড়িয়ে, সেই গাছ এবং তার আসেপাশের গাছ থেকে তখনও ঝরঝর করে জল পড়ছে – যেন বৃষ্টি সবে থেমেছে, আর অতটা জলের কল্যাণে, লোকের পায়ে–পায়ে, গাছের নিচের জমি অনেকটাই কাদা–কাদা হয়ে গেল।
সবার মনে একটাই প্রশ্ন – পেশেন্ট কতটা ভিজেছে? ভিজে কী করছে?
যারা সামনের দিকে ছিল, তারা সভয়ে দেখল যে রোগী নির্বিকারভাবে তার ধুতির আড়াল সরিয়ে তার পার্সোনাল জলের সোর্স বের করে আনন্দে চারিদিকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে ওই গাছের ওপর থেকেই হিসু করতে শুরু করল।
সামনের লোকেরা আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেল। তার ফলে পেছন থেকে যারা ভীড় করে আসছিল, তাদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি হল, আর যারা তাদেরও পেছনে ছিল, তারা মনে করল যেন কী না কী মিস হয়ে গেল, তাই তারা আরও পা চালিয়ে কাছে আসার চেষ্টা করতে লাগল।
এবং সেই প্রস্রাবের ধারা, গাছের ডালে এবং পাতায় লেগে, ছিটকে ছিটকে দমকলের জলের কমে আসা ধারার সঙ্গে মিলে বর্ষার মতো নামতে লাগল নিচে দাঁড়ান লোকেদের ওপরে।
সামনের লোকেরা চেঁচিয়ে উঠল, “আরে, আরে! পিসাব কর রহা হ্যায়!” সেই শুনে একটা স্টাম্পিড শুরু হল, সবাই একসঙ্গে পালাতে চেষ্টা করে কাদায় হড়কে কয়েকজন পড়েও গেল। কাদায়, জলে, প্রস্রাবে মাখামাখি হয়ে, নাকাল হবার পরাকাষ্ঠায় অভিজ্ঞ হয়ে সবাই দূরে সরে গেল।
দমকলের ট্যাঙ্কের চেয়ে কম সময়েই প্রস্রাব বর্ষণও শেষ হল, কিন্তু ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সামান্য প্রস্রাব দমকলের বিশাল মেশিনকে হার মানিয়ে অনেক বেশি ক্ষতিসাধন করে থামল।
সিক্তবসন দমকলকর্মীরা বিদায় নিলেন, ডিরেকটর বললেন, “আমি চান করতে যাচ্ছি।”
ডিরেকটরের বিদায়ের সুযোগ নিয়ে অন্যান্য বড়ো ডাক্তাররাও চলে গেলেন স্নান করতে এবং যারা সত্যিই কাদা ইত্যাদি মেখেছিল, তারাও গেল।
আসলাম বলল, “যত্তসব বকনেওয়ালা। যেতে দিন সবাইকে। রোদে গাছটা একটু শুকোক। ততক্ষণ ওই চাদরটা মেলে রাখুন, শুকিয়ে যাক। তারপর দেখছি।”
বেলা বাড়ার পর শুকিয়ে যাওয়া চাদর ধরে ওয়ার্ড স্টাফ আর দারোয়ানরা দাঁড়াল – আর আসলাম গাছে উঠে বলল, “অ্যাই, চল, নেমে চল! নইলে এমন…”
পেশেন্ট সুড়সুড় করে নেমে আসলামের পেছনে পেছনে ওয়ার্ডে চলে গেল।
এই সব গল্পের সঙ্গে পাল্লা দেবে ব্যাঙ্গালোরের গল্প? হুঁঃ! রাঁচি ছাড়া কোন শহরে পাড়ার মুদির দোকানে পাউরুটি কিনতে গিয়ে ভালো করে দেখতে গিয়ে শুনতে পাব, “নিয়ে যান, নিয়ে যান… একেবারে ফ্রেশ রুটি। কাঁকে রোডে রাঁচির বেস্ট রুটি কিনতে পাওয়া যায়। সব বাসি রোটি সুবহ্ লে জাতা হ্যায় সিধা মেন্টাল হসপিটাল!” এবং সেই মেন্টাল হসপিটালে যেরকম রুটি পাওয়া যায়, তার কোনও তুলনা আমি অন্য কোথাও পাইনি। সবুজ রঙের পাউরুটি দেখেছেন কখনও? সম্পূর্ণ সবুজ? এমারেল্ড গ্রিন? আমি দেখেছি। ব্রেকফাস্টে আমার ওয়ার্ডে চোদ্দোজন রোগী সকলে প্লাস্টিকের প্যাকেটে ছ’টা করে স্লাইস রুটি পেয়েছে, ছয় চোদ্দোং চুরাশিটা রুটি, প্রত্যেকটাই গাঢ়, এমারেল্ড গ্রিন মার্কা সবুজ। তাতে কোনও সাদার অংশ নেই। আবার যত্ন করে প্রত্যেকটায় মাখন লাগান’। যে খাবার এনেছে, সে নির্বিকার চিত্তে সেগুলো বিলি করে চলেছে। রোগী, নার্স, কারওর আপত্তিতেই তার হেলদোল নেই। আমি তাকে বললাম, “এগুলো বিলি করছেন কেন? দেখতে পাচ্ছেন না, ছাতা পড়ে সবুজ হয়ে রয়েছে?”
সে বিহারি স্টাইলে সসম্ভ্রমে খেঁকিয়ে উঠল, “আমি কী করব? আমার কাজ তো খাবার দেওয়া। প্যাকিং কি আমি করেছি?”
(বিহারে বাস না করলে সসম্ভ্রমে খেঁকিয়ে ওঠা ব্যাপারটা জানা যায় না। বাঙালিরা সসম্ভ্রমে খেঁকিয়ে উঠতে পারে না।)
আমি বললাম, “আনলেন কেন? এগুলো যে পচা তা তো তিন মাইল দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে।”
সে বলল, “আমাকে বললে, আর নেই।”
আমি বললাম, “এগুলো নিয়ে আসুন আমার সঙ্গে।”
গেলাম ডিরেকটরের কাছে। তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ডিরেকটরের অফিসে ঢুকলাম একটা রুটির প্যাকেট হাতে নিয়ে। উনি চোখমুখ কুঁচকে ফাইল থেকে মুখ তুলে বললেন, “কেয়া বাৎ হ্যায়, ডাঃ দেব?”
বললাম, “স্যার, দেখিয়ে, চাইল্ড ওয়ার্ড মে ক্যায়সা ব্রেড আয়া হ্যায়। সারে কা সারে ব্রেড অ্যায়সা হি সরা হুয়া হ্যায়।”
ভাবলেশহীন মুখে ডিরেকটর বললেন, “মেরা পাস নেহি, ডাঃ আলম কা পাস জাইয়ে। হি ইজ ইন চার্জ অফ ফুড।”
চললাম ডাঃ আলমের অফিসের দিকে, সে হলো হাসপাতালের বিশাল ক্যাম্পাসের অন্য প্রান্তে। গিয়ে শোনা গেল তিনি আজ আসেননি। শরীর খারাপ। কী করা? ততক্ষণে অন্যান্য ডাক্তাররাও জানতে পেরেছে। এইবার তারা বিরক্তি প্রকাশ করতে শুরু করল, “কী দরকার আপনার এত আগ বাড়িয়ে কাজ করার? একটা কমপ্লেন লিখে ছেড়ে দেওয়া যেত না? তা না, লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে একবার ডিরেকটর, এর একবার আলমের অফিস… আব কেয়া কিজিয়েগা? আলম সাব–কা ঘর জাইয়েগা?”
আমার মাথা তখন গরম, দরকার হলে তা–ই যাব। আলমের বাড়ি তো ক্যাম্পাসেই। অফিস থেকে কিলোমিটার খানিক দূরে। নিয়ে আসছি মোপেড। এমন সময় দেখা গেল দূর থেকে আলম আসছেন হেঁটে।
কাছে আসতেই আলম আমার ওপরে ফেটে পড়লেন, “আপনার জন্য আমাকে অসুস্থ শরীর নিয়ে আসতে হল। শুনলাম পাউরুটিতে ছাতা পড়েছে বলে আপনি ডিরেকটরের অফিসে গিয়েছিলেন? ছাতাপড়া অংশটা ফেলে দিয়ে খাওয়া যেত না?”
ততক্ষণে বোধহয় আমার কান থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ছাতাপড়া রুটি খাওয়ার কথায় ডাঃ আলম ইনস্টিট্যুটের অন্যতম সিনিয়র শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও (অসম্ভ্রমে) চেঁচিয়ে বললাম, “আমি কী করব? আপনি ফুড ইনচার্জ। আপনি আপনার অফিসে নেই এবং আপনার কাজ কে দেখছে আপনার ডিপার্টমেন্টে কেউ জানে না। সকাল সাড়ে ন’টা বাজতে চলল, আমার ওয়ার্ডে ছোটো ছোটো ৫–৬ বছরের বাচ্চারা না–খেয়ে বসে রয়েছে। এবার এই পাউরুটিগুলো দেখে বলুন তো, কোন অংশটা ফেলে দিয়ে কোন অংশটা খাওয়া যাবে? শুনেছি আপনি নাকি খাবার খেয়ে পরীক্ষা করার পরে রোগীরা খাবার পায় – যে কারণে আপনার বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না। এবারে এই পাউরুটিগুলো খেয়ে দেখান দেখি?”
সম্পূর্ণ সবুজ পাউরুটি দেখে আলম আর আমাকে কিছু বললেন না। লোকটাকে বললেন, “মেরা পাস তো ইয়ে ব্রেড নেহি আয়া থা?” বলে আমার দিকে আর না তাকিয়ে সোজা হাঁটা দিলেন রান্নাঘরের দিকে। আমি ভাবলাম, আমি এতদূর এসেছি – শেষটাও দেখেই যাই। গেলাম পেছনে।
কিচেন কমপ্লেক্সে ঢুকে আলম ভাবলেশহীন কণ্ঠে ইন–চার্জকে বললেন, “আমির, ইয়ে কেয়া ব্রেড ভেজা?”
আমিরও ততোধিক ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল, “সরি স্যার (ওখানকার উচ্চারণে ‘সোরি’), গলতিসে চলা গিয়া।” বলে আর একটা ট্রে ওয়ার্ড বয়ের দিকে এগিয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ট্রে–টা তৈরিই ছিল।
ওয়ার্ড বয় ট্রে–টা কোলে নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল। আলম সাহেব আমাকে বললেন, “জাইয়ে ডাক–সাব। আপকা প্রোবলেম সোল্ভ্ হো গিয়া। আগে অ্যায়সা হোনে সে আপ সিধা মুঝে ফোন কিজিয়েগা। ম্যায় তো হুঁ হি আপলোগকা সেবা কে লিয়ে।” বলে আমিরকে বললেন, “চলো, ভাই। কুছ চায়–ওয়ায় তো পিলাও।”
সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউটে একটা সময় ছিল যখন রোগী পালালে পাগলা ঘণ্টা বাজত। পরবর্তীকালে ঘণ্টার জায়গায় এসেছিল সাইরেন। আমি যতদিনে ওখানে পৌঁছেছি, ততদিনে ঘণ্টা, সাইরেন কিছুই বাজত না। রোগী পালাত যত নিঃশব্দে, তার হারিয়ে যাওয়ার রিপোর্ট, তাকে খোঁজা, সবই হত ততই নিঃশব্দে। কিন্তু আগেকার লোকের মুখে শুনেছি তাঁদের অভিজ্ঞতা। তখন ঘণ্টা, বা সাইরেন বাজলে যে যেখানে আছে জড়ো হত হাসপাতালে। ডাক্তার, সাইকোলজিস্ট ইত্যাদি হোয়াইট কলাররা হাসপাতালের ভিতরে খুঁজতেন, আর স্টাফ যেত হাসপাতালের একমাত্র (আলু–পেঁয়াজ আনার) অ্যামবুলেনসে করে (যারা আলু পেঁয়াজের গল্প জানেন না, তাঁদের বলি, দুটো পয়সা খরচা করে ‘কত্তোবড় ক’ বইটা কিনে নিয়ে পড়ুন)। অ্যামবুলেনস যেত শুধু দুটো জায়গায়। এক নম্বর রেল স্টেশন, আর দুই, রাতু রোড বাসস্ট্যান্ড। যখন এই নিয়ম তৈরি হয়েছিল, তখন রাঁচি ছেড়ে যাবার আর কোনও পথ ছিল না। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আজকাল তো মেন রোড, বারিয়াতু থেকেও সব দিকের বাস ছাড়ে – ওগুলো কেন দেখা হয় না? আর রাঁচি শহরে বাড়ি এমন পেশেন্ট পালালেও কি একইভাবে রেলস্টেশন আর বাসস্ট্যান্ডে খোঁজা হয়?”
সদুত্তর পাইনি।
তেমনই কবে, কেন, কী ভাবে হাসপাতালের ভিতরে খোঁজার চল বন্ধ হল, তা আমি জিজ্ঞেস করেও জানতে পারিনি। আমার চার বছরেই বহু পেশেন্ট হারিয়ে গেছে বলে শহর খুঁজে, পুলিশ রিপোর্ট লিখিয়ে পরে হাসপাতালের মধ্যেই পাওয়া গেছে। কোন গাছতলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল – গুনতির সময় পাওয়া যায়নি।
যাই হোক, এটা সে গল্প নয়। এটা অরিন্দ্রজিতের গল্প। আমার শোনা–কথা। হিয়ারসে এভিডেনস পেশ করছি আবার। গাছের গল্পের মতো।
সেদিন অনেক রাতে সাইরেন বেজেছিল। শীত তখনও পড়েনি, কিন্তু পুজো শেষ হয়েছে, রাতের আকাশ পরিষ্কার, হিম পড়ছে। পূর্ণিমার রাত ছিল। বেশ ঠাণ্ডা – বিশেষ করে কলকাতার বাঙালি এবং ভুবনেশ্বরের ওড়িয়াদের কাছে তো বটেই। লোকে সোয়েটার, মাফলার, ইত্যাদি জড়িয়ে হাজির হল। জানা গেল যে পুরুষ রোগীদের মধ্যে একজন, তাকে সন্ধের গুনতিতে পাওয়া গেছিল, এমনকি রাত ১১টায় যখন ওয়ার্ড–বয় বিছানায় টর্চ মেরে মেরে গুনেছিল, তখনও ঘুমোচ্ছিল। কিন্তু রাত ১টার সময় টর্চের আলোয় দেখা যায় যে বিছানায় নেই। ওয়ার্ড–স্টাফ নিয়মমত বাথরুম, ওয়ার্ডের অন্যান্য ঘর এবং আসেপাশের এলাকায় টর্চ নিয়ে খুঁজে না–পেয়ে সাইরেন বাজিয়েছে।
ড্রিলের মতো দল ভাগ করাই থাকত। এক–একটা দলকে পাঁচ ব্যাটারির একটা করে টর্চ ধরিয়ে দেওয়া হলো। তারা হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে পড়ল খুঁজতে। কিছু লোকের সঙ্গে তাদের নিজেদের তিন, চার, বা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ।
হাসপাতালের ভেতরটা বিশাল। ঘুরে ঘুরে নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিটি গাছ, ঝোপ, কালভার্ট, অব্যবহৃত বাড়ির জানলা–ভাঙা ঘরের ভেতরে আলো মেরে মেরে খুঁজতে সময় লাগে।
সৌম্য জুনিয়র পোস্টের অন্যতম সিনিয়র ডাক্তার। অনেকদিন কাজ করছে সি.আই.পি–তে। ওর দল খুঁজে খুঁজে শেষে পৌঁছল মহিলা রোগীদের দিকের শেষ ওয়ার্ডে। চারিদিক খুঁজে ক্ষান্ত দিয়ে তারা ব্লয়লার ওয়ার্ডে সিস্টার্স রুমে ঢুকল। ক্লান্ত ছাত্রদের জন্য সিস্টার জল বসালেন, কফি বানানোর উদ্দেশ্যে। খুঁজিয়েদের দল কফির কাপ হাতে ওয়ার্ডের বাইরে বাগানে এল। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চারিদিক ধুয়ে যাচ্ছে যেন। ধূমায়িত কফিতে চুমুক দিয়ে সৌম্য সবে বলতে লেগেছে, “এই যে এই রকম পূর্ণিমার রাত্তিরে তিনটের সময় খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডায় কফি খাওয়া – এরকম অভিজ্ঞতা রাঁচি না এলে হত?” এমন সময় কেউ একজন হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “স্যার, সুনিয়ে…”
সবাই চুপ করে কান খাড়া করল। নৈঃশব্দ। সৌম্য সবে বলতে গেছে, “কেয়া ভাই, কেয়া হুয়া?” এমন সময় ছেলেটা আবার বলল, “ওইঃ…!”
এবারে আরও দু একজন বলল, “হাঁ, হাঁ, ম্যায় ভি সুনা।” সবাই আবার চুপ। খানিক বাদে সবার কানেই এল শব্দটা। একটা অদ্ভুত ক্যাঁচক্যাঁচ! একবার হয়েই থেমে গেল। আরও একটু পরেই আবার, ক্যাঁচক্যাঁচ! সবাই উৎকর্ণ। তার পরের বার শব্দটা হতে সৌম্য প্রায় ফিসফিস করে বলল, “ওয়ার্ড কা পিছে তরফ সে আ রহা হ্যায়।”
নিঃশব্দে সবাই কফির কাপ নামিয়ে রাখল। সৌম্য দুজনকে বলল ওয়ার্ডের ডান দিক দিয়ে ঘুরে যেতে। দুজনকে বলল বাঁ দিক দিয়ে ঘুরে যেতে। এবং নিজে (যেহেতু ও ‘আংরেজোঁ কে জমানে কা জেলর’ ছিল না) আর একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ওয়ার্ডের ভেতর দিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে পেছনের দরজা খুলল। সবাইকে বলা ছিল, যেই দেখবে ওয়ার্ডের পেছনের দরজা খুলছে, ওমনি আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে।
ঘাপটি মেরে সবাই প্রায় একই সঙ্গে পৌঁছল পিছনের বাগানে। ততক্ষণে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ বেড়ে গেছে বহু পরিমাণ। সবাই ছুটে একসঙ্গে বাগানে পৌঁছে থমকে দাঁড়াল।
রোগীদের জন্য বানানো দোলনায় দুলছে অরিন্দ্রজিৎ। সবাইকে একঝলক দেখে নিয়ে বলল, “পূর্ণিমার রাত্তিরে তিনটের সময় কফি খেতে খেতে শীতের আমেজে দোলনায় দোলা – আহা, রাঁচি না এলে কোনও দিন এই আনন্দ উপভোগ করতাম?”
এই রকম গল্প অন্য শহরে হতে পারে? অন্য হাসপাতালে? কেউ বলতে পারবে? পারলে পয়সা ফেরত! রাঁচি ইউনিভার্সিটি থেকে একজন ডাক্তার ডার্মাটলজি (চর্মরোগ) বিষয়ে এম.ডি. পাশ করে যখন সার্টিফিকেট আনতে গেলেন, দেখলেন লেখা আছে – এম.ডি. জেনারেল মেডিসিন। ক্লার্ককে বললেন, “আরে, আপ তো মুঝে এম.ডি. জেন্রল মেডিসিন কা সার্টিফিকেট দিয়ে হো। ম্যায় তো ডারম্যাট কিয়া।”
সার্টিফিকেটটা আড়চোখে দেখে নিয়ে নির্বিকার, ভাবলেশহীন কণ্ঠে ক্লার্ক সসম্ভ্রমে খেঁকিয়ে উঠে বলেছিল, “তো? প্রাব্লেম কেয়া হ্যায়? আচ্ছা হী তো দিয়া হ্যায়, না? জেন্রল্ মেড্সিন ইস্কিন্ সে কুছ খরাব হ্যায় কেয়া?”