প্রায় মাঝরাত্তিরে মরতে বসল বুড়িটা৷ বুক ধড়ফড়িয়ে নাড়ি চড়চড়িয়ে একেবারে হদ্দমদ্দ মরতে লাগল মাঝলা বুড়ি৷ পূর্ণ বুড়ি হবার ঠিক আগের বয়স মাঝলার৷ আর কদিন বাদে ভরা বুড়ি হয়ে যাবে সে৷ তবু সেরাতে তার ফের বেঁচে ওঠার সাধ এমনি চওড়া হলো যে বিছানা থেকে আরো অসুস্থ স্বামীটিকে হিড়হিড় করে টেনে তুলে দৌড় দিল হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে৷ শীতের রাতে পাথর হয়ে থাকা জ্যান্ত কুকুরগুলোকে একটার পর একটা লাথি ঝেড়ে দ্রুত পা চালাল মাঝলা৷ যত তাড়াতাড়ি পারলে জগতের সব মরনাপন্নের আগেই হাসপাতালে পৌঁছানো দরকার তার৷ তারপর বাঁচবে বলে কচি কচি ডাক্তারগুলোকে প্রায় পাগল করে তুলল৷ একটাই খেউর তার — আমায় বাঁচাতে পারেন?
ডাক্তার বললেন— আরে মাসি অসুবিধেগুলো বলুন৷
মাঝলা চেঁচাচ্ছে তখন — এখানে সেখানে কত অঙ্গে কত প্রতঙ্গে অসুবিধে আমার জানেন? শিগগির বাঁচান আমায়৷
ঠিক সেই মুহূর্তেই পাশের টেবিলের যুবতী যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছেন ৷ মাঝলা বুঝতে পারছে যুবতীর আগে দরকার ই সি জি৷ বাঁচাটাও যুবতীরই কাজে লাগবে৷ তাও দৌড়োল টুকটুক৷ সারাজীবন ভ্রষ্ট হয়ে নষ্ট থেকে মধ্যযামিনীতে বাঁচার জন্য রেস খেলে যাচ্ছিল হায়াহীন বুড়ি৷ ইতিমধ্যে বাড়ি থেকে বুড়ো বাপকেও টেনে এনেছে হাসপাতাল৷ বাপের বুকে জীবনের জন্য আছাড় খেতে লাগে মাঝলা –ও বাবা তুমি জন্ম দিয়েছ — বড় করেছ – বাঁচাবার দায় তোমার আগে৷ তুমি থাকবে বেঁচে – আমি চলে যাব -এ কেমন বিচার তোমার বাবা? বাঁচবার ঘোরে বেলাজটা বলেই চলে –ও বাবা আগে হদ্দ বুড়ি হই – তবে মরতে দিও৷ কী কেলেঙ্কারি!
ডাক্তার দুটো ব্লাড টেস্ট দিলেন৷ ঠিক পনেরো মিনিট বাদে৷ CC U এ বড় ডাক্তারকে দেখাতে হবে রিপোর্ট৷ ঠিক পনের মিনিট বাদে৷ দশ মিনিট থেকেই স্বামীকে তাড়া দিচ্ছে খুনখুনে বুড়ি| হাঁপাতে হাঁপাতে ব্লাড সম্পল নিয়ে স্বামী গেলেন ICCU তে৷ আবছায়া করিডর৷ ওয়ার্ডে ছায়া বেশি আলো কম৷ সার সার মৃত্যুপথযাত্রী৷ শুধু মনিটরে বোঝা যায় প্রাণ আছে কিংবা যাচ্ছে৷
ওরে বাবা! কত সময় চলে যাচ্ছে গো! উত্তেজিত মস্তিস্কে স্বামীটি কিছুতে ঠাহর করতে পারছেন না নির্দিষ্ট ডাক্তারের বসার জায়গা৷ হঠাৎ দেখেন শীর্ণ হাতটি তুলে ডাক্তারের বসার জায়গাটি নির্দেশ করে দিচ্ছেন এক বৃদ্ধ| কথা বলার শক্তি চলে গ্যাছে তাঁর৷ পায়খানায় মাখামাখি তাঁর শরীর৷ স্বামী দেখতে লাগলেন অবাক হয়ে –বৃদ্ধের মনিটরটির ফলাফল খুব খারাপ৷ জীবনরেখা একবার পাহাড়ের মতো উঁচিয়ে ওঠে তো পরক্ষণেই মালভূমি৷ হাত কাঁপছিল বৃদ্ধের৷ তবুও –তবুও বারবার, বারবার করে নাড়তে লাগলেন সেটি — যাতে অন্যকে বাঁচানোর জেদটা না শ্লথ হয়ে যায়৷ কী নির্ভুল কী জরুরি সে হাত নাড়া৷ যতক্ষণ না স্বামী খুঁজে পান ডাক্তার, কি কষ্ট করেই না ঘাড়টুকুকে বেঁকিয়ে রাখতে চাইছিলেন বৃদ্ধ৷
বৃদ্ধকে মাঝলা দেখেনি| সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে স্বামীর মুখে শুধু গল্প শুনেছিল সেই রাজপুত্রের৷ খানিক কেঁদেওছিল৷ অপর্যাপ্ত এক কান্না৷
ও আমার প্রিয় মাঝলা বুড়ি৷
বাঁচতে চাস?
কিন্তু কেমন করে বাঁচতে হয় জানিস না? দ্যাখ – কেমন করে মরতে মরতে ছকছকিয়ে বাঁচল মলমূত্রমাখা মানুষ!
ওরে ধস্ত আধবুড়ি
জীবনের মায়া চেঁছে নে৷
লালসা বৃক্ষতলে পুঁতে দে৷
দীন বাঁচে সর্বকালে৷
হীন মরে ক্ষণে ক্ষণে৷
গল্পটা একটি পেখমহারা ময়ূরের৷