মাথাটা আমার বেহেড খারাপ করে দিলদার| দিলদার আমার সবচেয়ে মজাদার ছাত্র| দিন শুরু করে সে কদম কদম বাড়ায়ে চল গান দিয়ে| তারপর সারাটাদিন প্রতিটি স্টেপে স্টেপে ওই একই গান গেয়ে চলে| আরে ভাই! লেটে ঢুকেছে ক্লাসে| সেদিনের মত প্রেয়ার শেষ| সবাই বসে গেছে মাটিতে| দিলদার কিন্তু ঢুকেই উটপাখির মত মুখ করে গেয়ে চলেছে—-“কদম কদম বাড়ায়ে চল|” সবার মাঝে একা দাঁড়িয়ে আমার দিলু|
ক্লাস শেষে বাথরুম যাচ্ছে| তাও ওই গান চলছে আর গানের তালে তালে পায়ের স্টেপ ফেলা চলছে| এই গানটি নিয়ে নিজের মনে এক ভাবরাজ্য গড়েছে দিলদার| একদিন জিজ্ঞেস করলাম —“হ্যাঁ রে দিলু, ট্রেনে উঠছিস—হিসু করতে যাচ্ছিস, সকালে চা খাচ্ছিস গেলাসে ফুঁ মেরে–তখনও কি এ গান গাইতে হয় রে? গানটার অপমান হয় না?”
আমার জড়বুদ্ধি বাচ্চাটির জবাব সেদিন আমায় স্তম্ভিত করে দিয়েছিল| বড় নির্বিকারে দিলদার সেদিন বলেছিল— ওই গান গাইতে গাইতে এবং কদম কদম স্টেপ ফেলে যে কোনো কাজ করতে তার মনে নাকি “ফাইন এক আরাম” হয়| যে কোনো কাজই তার তখন মনে হয়, নেতাজির সাথে বসেই করছে|
সত্যি বলতে কি, সেই দিন থেকে দিলদারকে কেমন এক শ্রদ্ধার চোখে দেখতে শুরু করেছি| মজা মস্তি বেশি করি না দিলুর অবিরাম ওই একই গান গেয়ে চলাকে| খালি মনে হয়, মজা করলেই তিরস্কার করবে দিলদার| কোনোদিন করেনি তিরস্কার| তবু ওরম মনে হয় আমার|
আজ দেখলাম, গুম হয়ে ক্লাসে ঢুকলো এবং থমথমে মুডের সাথে বেশ মানানসই করে যথেষ্ট স্লো মোশনে গানটা ধরলো| বললাম—-“কী হয়েছে? Slow motion এ গান ধরলি কেন আজ?” বললে — মা নাকি তাকে আজ continuous মেরে গেছে| নিজের ওপর অত্যাচারের কাহিনি বলায় সে সর্বদাই এনতার ইংরেজি বলে| এইসব সময়ে নিজেকে নাকি বিপ্লবী মনে করে| তাতে মারটা কম লাগে| আমি বললাম—“তাই? একটুও আদর করেনি?” অনেক ভেবে বললে—“কী করে আদর করে? আমিও তো বাঁদরামি continue করেছি|একটুও থামিনি| আমি কি এক মিনিটও গ্যাপ নিয়েছি বাঁদরামি থেকে? কখন করবে আমায় আদর? মাঝে মাঝে এত বোকা হয়ে যাও না মিস!” হেসে বললাম—-সত্যবাদী যুধিষ্ঠির! দিলদার গম্ভীর মুখে, না সত্যবাদী মানুষ|
“এটা আবার কে শেখালে রে দিলু?” দিলুবুড়ো বললে–“বিবেকানন্দ| সে আসে আমার কাছে| পাশে বসে থাকে চুপটি করে| নেতাজি, বিবেকানন্দ, ক্ষুদিরাম এরা সব আমার বন্ধু মিস|” দিলদারের খানিক আগের ইংরেজি বকরবকর কমে আসছিল| ফিসফিসিয়ে বলছিল সে তার বন্ধুদের কথা! গায়ে ছ্যাঁকা লাগছিলো আমার| ভয় করছিল ভর্তি শ্রেণীকক্ষে বসেও! পাশ ফিরলাম হুড়মুড়িয়ে| নাহ! কেউ নেই! শুধু দিলদার দেখে ওঁদের| ওঁরা দিলদারকে! বাহ!
দিলদারের বড়া দিল!
তারই চোখে মারি আজ ঝাঁকি?
★★লেখাটি তাঁদের দিলাম—-যাঁরা আজো বিবেক এড়াতে চান না|★★
গল্পটা ভালো হয়েছে লিখবো? না দিলদারের চোখে চেয়ে বলবো বড়ো দিলদার তুমি, ভালো থেকো ।দিলদার তুমি ভালো থেকো। ময়ূরীদেবী এই দিলদার জড়বুদ্ধি শিশু নয়, আমি মনে করি। যে বা যারা মহামানবের আদর্শের সাথে নিজের উপলব্ধিকে মেলাতে পারে – সেই তো সব থেকে ভালো বোঝে, এই দিলদার সবার থেকে ভালো বোঝে – সত্যের সাথে কিভাবে চলতে হয়। আমরা শুধু মহামানবের জন্মদিন পালন করি। এই দিলদার আজও এগিয়ে চলে সুভাষ চন্দ্র বোসের মতো, বিবেকানন্দের মতো সত্যের সন্ধানে। ভারতবসীর মনে একজন সৈনিক সন্ন্যাসী। অন্যজন সন্ন্যাসী সৈনিক, ক্ষুদিরাম এনাদের সকলকে একসুতোয় মালার আকারে গেঁথেছে।
দিলদারকে এতো ভালো করে বুঝলাম শুধু আপনার অনুভূতি, উপলব্ধি ভাষায় অনবদ্য ভাবে প্রকাশের জন্য।