মাঝে মাঝে এক একটা দিন আসে, আবছায়া স্বপ্নের মতো মনে হয়। সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি, এ সকাল বাস্তবিকই রাতের চেয়েও অন্ধকার। প্রায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির শব্দে এক অদ্ভুত মাদকতা আছে। তার সাথে গা-শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া। এ আবহাওয়ায় কাঁথা আর পাশবালিশের অমোঘ আকর্ষণ উপেক্ষা করা বড্ড কঠিন। তবু অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে পড়তেই হয়। সপ্তাহে এই একটা দিন অনেকটা রাস্তা উজিয়ে চেম্বার করতে যেতে হয়। নিজেকে প্রায় টানতে টানতে ব্রাশ আর টুথপেষ্ট হাতে নিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড় করাই। সেখানেও আর এক প্রস্থ হাঁ করে বাইরে তাকিয়ে থাকি। সামনের মাঠটায় জল জমেছে। অনবরত বৃষ্টিতে রকমারি আলপনা। পেঁপে গাছটা ভিজছে, কলতলা ভিজছে, সামনের শিব মন্দিরটা ভিজছে। নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর দৃশ্যপট। তবু সেসব দেখতে গিয়েই দেরি হয়ে যায়। যেন বা দেখে ফেলবার বড় তাড়া! হাতের ব্রাশ হাতেই থেকে যায়। ঘড়ি বলছে সাতটা দশ।
অন্যান্য দিন সকাল থেকেই বাড়ির পাশের চেম্বারটায় ভিড় জমে। মানে, ছোট ডাক্তারের চোখে ‘ভিড়’ বলতে যা বোঝায় আর কী… আজ এত বৃষ্টিতে সেই চেনা ভিড়টা নেই। হাতে গোনা জনা কয়েক বাচ্চা এসেছে। যারা এত দুর্যোগ মাথায় করে এসেছে স্বাভাবিকভাবেই তাদের অসুস্থতা বেশ গুরুতর। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, শ্বাসকষ্ট, বারবার বমি, সাংঘাতিক পেটে ব্যথা… এইসব রোজনামচা। সেসব উপশমের খানিক চেষ্টা করাটরা হ’ল। বাইরে গাড়ি আছে। সারথিও তৈরি। কিন্তু এত বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়া উচিত হবে কিনা ভাবছি। রাস্তাও তো বড় কম নয়! আমিই বেরোতে পারছি না, বাচ্চাদের নিয়ে বাবা-মা কী করে আসবেন? অথচ, সপ্তাহে মাত্র একটা দিনই যাই। অতয়েব, না গেলেই নয়। যাঁরা সারা সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করে থাকেন, যে করেই হোক তাঁদের ভরসার দাম দিতেই হবে। বেরিয়ে পড়লাম।
এখন আর বেরিয়ে পড়ায় কাদা প্যাচপেচে, ঘাম জবজবে ভোগান্তি নেই। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আরামে বসে জানলার কাচে বৃষ্টির জলছবি দেখা মাঝে মাঝে অলৌকিক স্বপ্নের মতো মনে হয়। ফুটো, ঢোলা প্যান্ট পরা একটা বাচ্চা ছেলে সে স্বপ্ন ফুঁড়ে জেগে ওঠে। জেগে ওঠে একটা বাঁশকাঠির মতো চেহারার ব্রণওলা কিশোর। তারা বিশ্বাসই করতে চায় না, আমারও একটা গাড়ি থাকতে পারে! নিজের গাড়ি! তাও বছর দুয়েক হ’ল! পাবলিক বাসের ভিড়ে চ্যাপ্টা, হাঁটু অব্দি প্যান্ট গোটানো কিশোর ঘাড় নাড়তে নাড়তে অবিশ্বাসের হাসি হেসে মিলিয়ে যায়।
গাড়ি হাইওয়েতে এসে পড়েছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অনেক কম। হু হু করে পিচকালো রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছি। হেডফোনে দেবব্রত বিশ্বাস। আবার সেই বাচ্চা ছেলেটাকে মনে পড়ছে, যে মনে করতো রবীন্দ্রসঙ্গীত মানেই সব প্যানপ্যানানি, একঘেয়ে সুরের গান। বাবা বলতো, বুঝতে শিখলে একদিন এই গানই সবচেয়ে ভালো লাগবে দেখিস। বুঝতে এখনো কি পারি? তবু কখন যেন সেই ‘প্যানপ্যানানি গান’ শরীরের আর পাঁচটা অঙ্গের মতো হয়ে গেছে। বহুদিন অব্দি, দেবব্রত বিশ্বাসের গানও ভালো লাগতো না। অথচ এখন রবীন্দ্রসঙ্গীতে জর্জ বিশ্বাসের গানের পর বাকি সব পানসে লাগে। বয়স হচ্ছে? হবে বা।
কংসাবতী টইটম্বুর। ঘোলাটে জল উপচে পড়ছে। গোদাপিয়াশালের জঙ্গল পেরোনোর সময় দেখি, স্কুলের ছেলেমেয়েরা চলেছে। এক-একটা ছাতায় দু’জন করে। এত বৃষ্টিতে একটা ছাতা কতটুকু আড়াল দিতে পারে? দু’জনেই চুপ্পুস হয়ে ভিজছে। আজ সত্যিই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে উজাড় করার দিন। সেই বাচ্চা ছেলেটা স্মৃতির রাস্তা ছুঁয়ে হাঁটছে। সেও এমন বর্ষণমুখর দিন। তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। কাঁধে স্কুলব্যাগ। ছেলেটা ছাতা মাথায় দিয়ে ফিরছে। হাঁটু অব্দি কাদা ঘাঁটতে ঘাঁটতে। ঝড়ের তোড়ে ছাতা উল্টে যাচ্ছে বারবার। অগত্যা ছাতা বন্ধ করে ভিজতে ভিজতেই ফিরছে। বাড়ি ফিরে নির্ঘাৎ হাঁচি-কাশি শুরু হবে। এমনিতেই যা অ্যালার্জি সর্দির ধাত! এসব দিনে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নামে। হ্যারিকেনের আলোয় ঘাড় গুঁজে বই খুলে বসে ছেলেটা…
শালের বন জুড়ে বৃষ্টির কী অসহনীয়, সুতীব্র সৌন্দর্য! অনেক তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছি। চোখ বুজে আসছে। তবু জোর করে তাকিয়ে আছি। এ বর্ষামঙ্গল উপভোগ না করলেই নয়। এক কাপ ধোঁওয়া ওঠা লিকার চায়ের অভাব বোধ করছি। দেখতে দেখতে শালবনীর রেলগেট পেরিয়ে এলাম। চেম্বারে গিয়ে বসলাম। ভাবছি, আজ বোধহয় কেউ আসবে না। তবু একটু পরে বৃষ্টিটা ধরে আসতে গুটি গুটি করে বেশ কয়েকজন বাচ্চা এল। চন্দ্রকোনা রোডে যখন পৌঁছোলাম তখন মোটামুটি আকাশ পরিষ্কার। সকালের মাতাল বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। মোটামুটি রোগীর ভিড়।
রোগী দেখে এবার ফেরার পালা। তমাল ব্রিজের ওপর উঠলেই মনে হয় এক্ষুনি ভেঙে পড়বে। আজ সাড়ে পাঁচ বছর এ রাস্তায় যাতায়াত করছি। এই ব্রিজে উঠলে এখনো ভয় হয়। এত বড় বড় মালবোঝাই গাড়ির চাপ এই ভগ্নদশা সেতু বয়ে চলেছে কী করে কে জানে! মেদিনীপুর সিটি কলেজটা পেরিয়ে বাঁদিকে এই অসামান্য সুন্দর গাছটার দিকে রোজ তাকাতে তাকাতে যাই। গোড়া থেকেই সবুজ ডাল উঠে গেছে। পাশে একটা বসার বেদী। রোজ নামবো ভাবি, সুযোগ হয় না। আজ নেমে ছবি তুললাম। এরকম তেঁতুল গাছ এর আগে দেখিনি। একটা তেঁতুল গাছের ছবি তুলতে নেমে পড়েছি আবার সেটা ফলাও করে বলে বেড়াচ্ছি ভেবে হাসছেন? তা হাসুন। আমিই কি নামতে চেয়েছি ছাই? ওই যে প্যান্ট গোটানো, শীর্ণকায় কিশোর… আসলে তো নেমেছে সেই।
ফোনটা বেয়াক্কেলের মতো বেজে উঠলো। বাড়ির পাশের চেম্বার থেকে। “ডাক্তারবাবু, এখন কোথায়? সকালে বেশ কয়েকজন পেশেন্ট আসতে পারেনি। এখন সব আসবে বলছে। আর কতক্ষণ লাগবে?”
স্পিডোমিটারে আশি। কিশোর আপাতত বেপাত্তা।