সকালবেলা জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি রোদ ঝলমলে নীল আকাশটায় কিছু সাদা মেঘের দল উড়ে বেড়াচ্ছে। হাওয়াটা বেশ ঠাণ্ডা, স্নোফলের আর মাত্র মাস দুয়েক বাকি। চায়ের কাপে এক চুমুক লাগিয়ে গুনগুন করছি “কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না”। হঠাৎ মনে হলো, কথাটার মধ্যে তো একটা নিউরোসাইকোলজিকাল পার্সপেক্টিভ আছে। সত্যিতো, মাঝে মাঝে কিছু আবেগ, কিছু ইম্পালস্, কিছু লারনড বিহেভিয়ার কিভাবে যেন আমাদের লজিক্যাল থট অর্থাৎ চিন্তাশক্তিকে আড়াল করে ফেলে, আমরা দিক হারিয়ে ফেলি। চট্ করে বাকি গানটা আওড়ে ফেললাম। তারপর আমার এক অত্যন্ত প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর গাওয়া এই গানটা ফোনে শুনতে শুরু করলাম। শুনতে শুনতে মনে হলো যে গানের কথাগুলোর মধ্যে যেমন প্রেম, নিবেদন এইসব রয়েছে, তেমনি রয়েছে একটা না পারার কথা, একটা অসহয়তা, একটা কাঙ্খিত দুর্বলতার আভাস। একটু সময় চিন্তা করে মনে হলো এও যেন সেই মনেরই একটা গল্প।
আমরাতো কত কিছু করতে চাই, পারি কি? অনেক বলেন “পারার চেষ্টা করো কি”। আচ্ছা, চেষ্টা শব্দটার সাথেও তো কাজের অর্থাৎ অ্যাকটিভলি করার একটা যোগ আছে, তাই না? আর সেটাওতো ইন্ডিভিজুয়াল স্কিলের ওপর নির্ভর করে। তাহলে যে মানুষটি অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না বা যিনি নিজেকে অনেকভাবে বুঝিয়েও দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করতে পারছেননা বা যাঁর রাগের পারদ নামছে না, তিনি যে চেষ্টা করছেন না এইটা কেন ভাবা হয়? আজকাল গুগুল ডাক্তারের উপদেশ পেয়ে আর সোশ্যাল মিডিয়ার গবেষণা পত্র পড়ে অনেকেই মেডিক্যাল ডক্টর, বিশেষজ্ঞ বা গবেষক। তাই, অনবরত পোস্ট ব্লগের থেকে ধার করে অনেক পসিটিভিটির বুলি আওরান, কার কি ট্রেট, কাকে ঠিক কোন পার্সোনালিটির ক্যাটেগরিতে ফেলা যায় এইরকম আরো অনেক কিছু ঠিক করে নেন তারা। ফলে যারা নিজেদেরকে নিয়ে একটু সমস্যায় আছেন, তারা সাজেশন পেতে পেতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। “তোমার আবার কিসের দুঃখ, তোমার তো সব আছে”, “চিন্তা করো না, চিন্তা করে কিছু লাভ হয় না”, “রাগটা কমাও, এতো রাগ ভালো নয়” “বি পজিটিভ অলয়েস” এই কথাগুলো শুনতে শুনতে তাঁদের কানে তালা দেবার জোগাড়। শুধু তাই নয়, তাঁদের চেষ্টায় ঘাটতি আছে বলে তাঁদের আরো ডিমটিভেট করা হয়। ফলে তাঁরা নিজেদেরকে আরো গুটিয়ে ফেলেন, নিজেদের সমস্যা নিয়ে নিজের গুমরে চলেন।
আসলে মানসিক সমস্যার কনস্ট্রাক্ট হিসেবে সকলের সামনে একটা দুর্বল অসহায় বেহিসাবি আবেগতাড়িত মানুষের ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু অতিরিক্ত কনফিডেন্স, অতি দুর্দণ্ড প্রতাপশালী কিংবা খুব ক্যালকুলেটিভ বাস্তববাদী মানুষেরাও সমস্যায় পড়েন, তাঁদেরও যে মানসিক স্বাস্থ্যহানি হয়, সেই ব্যাপারে অধিকাংশের ধারণা নেই, তাঁদের বহিঃপ্রকাশটা আলাদা বলে সহজে গোচরে আসেনা। এটাও খানেকটা দুর্বল আর সবলের ইমপ্যাক্ট ইমব্যালেন্সের মতন। আসলে আমরা মন নিয়ে কথা বলি, হিউম্যান বিহেভিয়ার নিয়ে কথা বলি, কিন্তু তার ফিজিওলজিক্যাল আইডেন্টিটাকে মান্যতা দিই না। আজকের দিনেও এমন অনেক পেশাদার মানুষ আছেন যাঁরা মনের জৈবিক ব্যাখ্যাকে উপেক্ষা করেন। আর তাই “মেন্টাল হেলথ অ্যাওয়ারনেস” বেড়েও বাড়ছে না।
অবসাদের ক্ষেত্রে মূলতঃ ব্রেনের দুটি নিউরোকেমিকাল (সেরোটোনিন এবং নরএপিনেফ্রিন)-এর কমতি হয়। ফলে তারা যে যে কাজে নিযুক্ত সবেতেই গোলমাল হয়। উৎকন্ঠার ক্ষেত্রে গাবা-গ্লুটামেট বলে দুটো নিউরোকেমিকালের সামঞ্জস্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ চাইলেই যেমন সুগার, কোলেস্টেরল বা ব্লাড প্রেসার কমিয়ে ফেলা যায় না, তেমনি আজ বললে কালই কারোর এই নিউরোকেমিকালের পরিমাণ পরিবর্তিত হয়ে যায় না। তাছাড়া মানব শরীরের অত্যন্ত জটিল অঙ্গ হল এই মস্তিস্ক, এক নেটওয়ার্ক থেকে আরেক নেটওয়ার্ক এমন জালের মধ্যে রয়েছে যে মন ভালোর তারে টান দিলে রিওয়ার্ড ইম্পালস ঢুকে পরে, চিন্তার তারে হাত দিলে ভয়, দুঃখ, পুরোনো স্মৃতিতে হাত হরে। এরকম আরো অনেক অনেক টানাপোড়েনের মাঝে দাঁড়িয়ে আমাদের মন, কোন একটা ট্রেটকে ইন্ডিভিজুয়ালি দেখা যায় না। বুদ্ধি বিচক্ষণতা আবেগ সবকিছুর ইলেকট্রিক তৈরি হচ্ছে একসাথে প্রতি নিয়ত। তাকে বোঝা বা বদলে ফেলা কি অতো সহজ?
তাহলে কি যেমন চলছে তেমন চলুক বলে ছেড়ে দেওয়া উচিত? নিশ্চয়ই নয়। বর্তমান গবেষণার মূল লক্ষ্য হলো এই প্রতিটি ট্রেট বা অসুস্থতার হিউম্যান মডেলিং। অর্থাৎ কিভাবে ল্যাবোরেটরিতে ডায়াগনোসিস করা সম্ভব। যেকোন মানুষের রক্তপরীক্ষার মাধ্যমে তার জেনেটিক মেকাপ কি, সেটা বুঝে তার কি কি অসুস্থতার ভালনারেবিলিটি রয়েছে সেটার কাজও চলছে। আর ট্রিটমেন্টৈর ক্ষেত্রে চলছে পারসোনালাইসড থেরাপি। অর্থাৎ একজনের সমস্যাটা তার মতন করে সমাধানের চেষ্টা, তার কোন কোন ট্রেটের কিভাবে বদল ঘটেছে, সমস্যার বেসিক জায়গাগুলো কি, সেইসব অ্যানালাইস করে তার থেরাপিউটিক প্ল্যান তৈরি করা। সুগার প্রেসার কোলেস্টেরলের ওসুধ যেমন চলতে থাকে, সাথে সাথে লাইফস্টাইল চেঞ্জের কথাও বলেন ডাক্তারবাবুরা, মনের ক্ষেত্রেও সেভাবেই এগোতে হয়। মনের অসুখ বা অসহায়তার ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা করতে হয় সেটা হলো প্রবলেম আইডেন্টিফিকেশন, অর্থাৎ কি হচ্ছে (ঠিক যেমন সুগারের ক্ষেত্রে হঠাৎ মাথা ঘোরা, ওয়েট লস, লিথার্জি), তারপর বুঝতে হবে “কেন”। এই “কেন” র উত্তরটা অনেক সময়ে নিজে নিজে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং এর সাহায্যে নিতে হবে। সুগার প্রেসার কোলেস্টেরল বর্ডার লাইন হাই থাকলে যেমন ওষুধের আগে কয়েকদিন হাঁটাহাঁটি করা, ডায়েট এবং রুটিনড লাইফস্টাইল মেন্টেন করার পরামর্শ দেওয়া হয়, তাতে অনেক সময় রিস্টোরেশনও হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও সঠিক পদ্ধতিতে কাউন্সেলিং নরমাল বা নিউরোসাইকোলজিকাল হেল্থ ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু সমস্যা যদি দেরিতে ডিটেকটেড হয় অর্থাৎ যখন নিউরোকেমিকালের বেশ ভালো তারতম্য শুরু হয়েগেছে, জালের কাঠামো স্থায়ীভাবে বদল শুরু করে দিয়েছে, তখন কিন্তু হাই সুগার প্রেসার কোলেস্টেরলের মতন এক্ষেত্রেও অসুধ খেতে হবে। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং এবং ওসুধ মানে এক কথায় কম্বিনেশন থেরাপি করাতে হতে পারে। এই অ্যাডভান্সড স্টেজ থেকে আগের অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে।
আজকের দিনে সারা বিশ্ব জুড়ে অ্যন্টি ড্রাগ ক্যাম্পেনিং চলছে, অর্থাৎ ওষুধের বিকল্প। গবেষণায় নানা ধরনের ভেষজ উঠে আসছে, যোগ ব্যায়াম, মিইজিক থেরাপি, ডান্স থেরাপির মতন অকোপেশনাল থেরাপিও পপুলার হচ্ছে। তবে এসবের প্রগ্ৰেস স্লো। অর্থাৎ সময় দিতে হবে। যাঁরা সমস্যায় আছেন তাঁরা যেমন চেষ্টা করছেন তাঁদের কাছের মানুষদেরও ধৈর্য ধরতে হবে। “তোমার দ্বারা হবে না, ইনকরজেবল” এই শব্দগুলো না বলে “আগের থেকে ভালো পারছো, এইটা একটু অন্যভাবে ভেবে দেখো” এইগুলা বললে সেই ভালো না থাকা মানুষটি একটু আশার আলো দেখতে পান। লার্নিং এর বিভিন্ন পথ আছে, তার একটা হলো কন্ডিশনিং। অপারেন্ড কন্ডিশনিং বলে কাউকে রিওয়ার্ড দিলে তার সেই কাজটা করার ইচ্ছে জন্মায়। যাঁরা অবসাদ উৎকন্ঠা বা অন্য কোন অসহায়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদেরকে কি আমরা “হ্যাঁ তুমি পেরেছো”, “বাহ্ এটা তুমি সুন্দর করলে”, “এইটা তোমার গুণ” এইগুলো বলতে পারি না? ভালো থাকার ইচ্ছে জন্মায় নিজেকে ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে। নিজের সমস্যা নিয়ে জর্জরিত একজন মানুষের কাছে সমস্যার সমাধান করতে না পারার কষ্ট, গ্লানি, বিরক্তি নিজেকে ভালো রাখার পরিপন্থী হয়ে ওঠে। আমরা না হয় তার না পারার বোঝা আর নাই বা বাড়ালাম। তাঁরাও তো চান ভালো থাকতে। অবসাদের মধ্যে দিন কাটাতে কাটাতে দুঃখের সাথে বন্ধুত্ব করতে কে চায়? প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা করে শরীর মনকে ব্যতিব্যস্ত করে নিজের জীবনীশক্তি নষ্ট করতে কি কারোর ভালো লাগে? মন যখন শরীরের বেনিয়মের শিকার, মস্তিস্কের শতসহস্র জাল যখন দলা পাকিয়ে যায়, জট ছাড়িয়ে আবার জাল বুনতে সময় লাগে। আমরা তাঁদের একটু সময় দি, নিদেন পক্ষে তাঁদের না পারার গল্পের নীরব শ্রোতা হই????
আকাশে এখন কালো মেঘ, চা ঠাণ্ডা হয়েগেছে। জুমে মিটিং অ্যলারম বাজছে।রেডি হতে হতে গানটা আবার শুনতে থাকলাম, হঠাৎ সিগমুন্ড ফ্যয়েডের একটা কোট মনে এলো “everywhere I go, I find a poet has been there before me”.
বাংলা ক্যালেণ্ডারের পাতায় চোখ পড়ায় দেখি আজ ২২শে শ্রাবন।