-এক যে ছিল টিকটিকি।
– ছিল তো ছিল। বেশ ছিল। তাতে আমার কী?
– আছে আছে। তোমার ব্যাপারও আছে। মন দিয়ে শোনোই না, বাড়িমশাই!
– অ্যাই, ফের ওই পুরোনো বস্তাপচা নামে ডাকচিস? কতবার না বলিচি, বাড়িমশাই না, আমাকে মিঃ প্রাসাদ বলে ডাকবি?
– আচ্ছা বাবা, আচ্ছা, ঠিকাছে। মিঃ প্রাসাদ! নাও হল তো এ’বার। তবে গল্পটা ফের শুরু করি?
– হ্যাঁ রে, আমার ব্যাপার কী আছে বলছিলি। কী সে’টা?
– তবে উল্টো দিক দিয়ে শুরু করি, শোনো। এক যে ছিল দেওয়াল।
– এই, ঠিক এই জন্যেই তোর বলা গল্প শুনতে মোট্টে ইচ্ছে করে না। এই হচ্ছিল এক, পরের মুহূর্তেই আর এক। এই বললি টিকটিকি। পরমুহূর্তেই দেওয়াল!
★
আসলেই ব্যাপার তাইই। দেরি করে শুরু করা গল্পের আগা মাথা ঠিক থাকে না। অথচ শেষ করতে হবে বলে তাড়া থাকে খুব। খুবই।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। জন্মে অবধি টিকটিকিটা, গাছের ডালে, গুহায় কন্দরে ঘুরত। আর স্বপ্ন দেখত ভারি চমৎকার একটা দেওয়ালের। সাফ সুরৎ, রঙিন, চকচকে। যাকে বলে ওয়েল মেন্টেইনড আরও কীসব যেন! এই দেওয়াল খোঁজার নেশাতেই নানান বাড়িতে হানা দিত সে। ভুলভাল সব বাড়ি। কোনও বাড়িতে গিয়ে দেখল, মানুষ নেই, জড়ো করা শুধু ম্যানেকুইন। কোনও গুদাম হয় তো। কোনও বাড়িতে দেওয়াল জোড়া মাকড়সার ঝুল। মালকিন গেছে সেকেন্ড ওয়াইফ রেস্তোরাঁয় জয়ব্রতর সঙ্গে আলোআঁধার খেলতে। কোনও গুহা সন্দেহের ধোঁয়া লেগে দেওয়াল কালো। তার মধ্যেই কারও সঙ্গে এক্কাদোক্কা পলাশ খেলার গোপন প্ল্যান ফিসফিসিয়ে উঠছে। টিকটিকিটার কী বলব, গা একেবারে ঘুলিয়ে উঠত। আর সেই রঙ্গিনী দেওয়ালেরা, তরঙ্গিণী দেওয়ালেরা? তারাও তাদের খেলুড়ে সমেত টিকটিকিটাকে একেবারেই যাচ্ছেতাই অপমান টপোমান করে… বুঝলে কী না!
★
– অ্যাই, টিকটিকি মানে তো গোয়েন্দা। মানে ঝানু দুষ্কৃতকারীরা তো বটেই আমপাঠকও তো গোয়েন্দাদের তাইই বলে। তুই কি গোয়েন্দা?
– আমি? গোয়েন্দা? হাসালে মিঃ প্রাসাদ। গোয়েন্দা হবার কোন গুণটা আমার আছে, বলো তো? হ্যাঁ, তবু গোয়েন্দাই বলতে পারো। এই যে দেওয়ালে দেওয়ালে ঘুরে বেড়াই!
– তুই কি হালের ফেসবুকের ওই ওয়াল না দেওয়াল, তার কথাই সাঁটে বলছিস না কি?
– তা’ একরকম তাই ধরতে পারেন আজ্ঞে! কিন্তু স্যার, বলছিলাম কী, বেলা পড়ে যাচ্ছে। এট্টুস বাদেই সনঝে পেরিয়ে রাত্তির নামবে। গল্পটা বলে ফেলি?
– বলবি? তা বল। কিন্তু কোন গল্পটা বলবি, টিকটিকির না দেওয়ালের?
– দু’জনেরই। একসঙ্গে।
★
সেই ক্লান্ত নির্বোধ আর কুদর্শন টিকটিকি একটা ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে গেল, ঝাঁ চকচকে নতুন এক ঘরে। সেই যে’খানে দেওয়াল অ্যাক্রিলিক পেইন্ট মেখে সুচিক্কণ আর অভিজাত, মেধাবী আর ঝাক্কাস!
এ’খানে কিঞ্চিৎ বিজ্ঞানকথা বলতে হবে। তা’ হল টিকটিকির চলন ইতিহাস। টিকটিকি কী ভাবে দেয়াল বেয়ে হাঁটে? তার পায়ের সেই হাওয়া সংক্রান্ত কলা কুশলতা কিন্তু মসৃণ দেওয়ালে আরও বিকশিত হবার কথা।
কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এই দেওয়াল সরীসৃপটিকে প্রত্যখ্যান করল। মোটে চিনতেই চাইল না। যেটুকু বা চিনল, সেটা বিদ্রূপে আর করুণায়।
তবু সেই একরোখা, প্রকৃত প্রস্তাবে ঘ্যানঘেনে টিকটিকি জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সেই দেয়ালে দৌড়োদৌড়ি করতে চাইল। করলও
ফলে অনিবার্য ভাবে তার পতন হয়। মৃত সেই প্রাণীটিকে কিছু পরে বাইরে ফেলে দেওয়া হয়।
দেওয়ালে, সেই অতি মসৃণ দেওয়ালে তখন খেলা করছে তার নিজস্ব ভালোবাসাগুলির পার্থিব ও অপার্থিব ক্যালেন্ডার ও ছায়াচিত্র।
★
– তোর ফালতু গল্প বলা কি শেষ? এবারে যা তোর টিকটিকি আর দেওয়াল নিয়ে!
– দেওয়ালকেও নিয়ে যাব? মিস্টার প্রাসাদ স্যার!
– আরে করিস কী, করিস কী? দেওয়ালটা যে আমারই, ভুলেই গেসলাম। যা, শুধু তোর ওই নোংরা ইয়েটাকে নিয়ে বিদেয় হ দেখি!