গল্পের শুরুঃ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে অবহেলিত মনীষা; বিশিষ্ট চিকিৎসক, গবেষক ও বিজ্ঞান সাধক; কালান্তক কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কারক এবং বাংলার অত্যন্ত মেধাবী ও বরেণ্য সন্তান ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর জন্মের সার্ধ শতবর্ষে (১৮৭৩ – ১৯৪৬ খ্রি.) তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে একটি অকিঞ্চিৎকর গল্প।
চিকিৎসক পিতার কাছে অতীতের কালান্তক কালাজ্বরের নানারকম কাহিনী, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর কালাজ্বরের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াবিহীন অব্যর্থ ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামিন আবিষ্কার, আরেক বাঙালি মনীষা সুকুমার রায়ের কালাজ্বরে অকালমৃত্যুর কথা অনেকবার শুনলেও এম.বি.বি.এস. স্তরে সেভাবে কালাজ্বরের রোগী দেখার সুযোগ হয়নি। বরং এস.এস.কে.এম. হাসপাতালে মেডিসিনে হাউসস্টাফশিপ করার সময়ে ম্যাকেঞ্জি ওয়ার্ডে কালাজ্বরের কয়েকজন রোগীকে দেখেছি। এরপর ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’-এ ডি.পি.এইচ. করার সময় ‘স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিন’-এ ক্লাস করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন কালাজ্বরের রোগীকে দেখি। চেন্নাইয়ের ‘ন্যাশনাল ইন্সিটিউট অফ এপিডেমিওলজি’-তে থাকার সময় আমরা ব্যাঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ সায়েন্স’-এ কালাজ্বর নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিয়ে সমৃদ্ধ হই। পরে পাটনার আর.এম.আর.আই.এম.এস. পরিদর্শনের সময় ওয়ার্ড ভর্তি কালাজ্বরের রোগী দেখতে পাই। আর সেখানে ইনস্টিটিউটের সামনে দেখতে পাই ডাঃ ব্রহ্মচারীর আবক্ষ মূর্তি।
চুম্বকে কালাজরঃ অতি প্রাচীন কাল থেকেই রোগটি বিভিন্ন নামে মানব সমাজে ছিল ও আছে। দীর্ঘদিন এই রোগে ভুগলে গায়ের ত্বকের রং কালো হয়ে যায় সেই কারণে আমাদের অঞ্চলে কালো জ্বর, আর সেখান থেকেই বোধহয় কালাজ্বর (Black Fever বা Kala –azar) নামটি এসেছে। বিশ্বে ৯৮ টি দেশে কালাজ্বর পাওয়া যায় যার মধ্যে ভারতে রোগীর সংখ্যা সবচাইতে বেশি। তারপর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার আরও ১২ টি দেশে। কালাজ্বরের বৈজ্ঞানিক নাম Leishmaniasis। ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, পূর্ব উত্তর প্রদেশ এবং নেপাল ও বাংলাদেশে Visceral Leishmaniasis (VL) ও Post Kala-azar Dermal Leishmaniasis (PKDL); পাঞ্জাব, রাজস্থান ও গুজরাতে Cutaneous Leishmaniasis (CL) এবং রাজস্থানে Mucocutaneous Leishmaniasis (MCL) দেখতে পাওয়া যায়। ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রা বিশেষত তাদের সৈন্যরা যে সমস্ত ভয়ঙ্কর ক্রান্তীয় সংক্রামক রোগগুলিতে আক্রান্ত হত তার অন্যতম ছিল কালাজ্বর। সেই সময় গঙ্গা – ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের সাথে শয়ে শয়ে সৈন্য কালাজ্বরে ভুগত। মৃত্যু হার ছিল ৯০ %। অসমের চা বাগান, অবিভক্ত বাংলার যশোর ও বর্ধমান জেলা, দমদমের সৈন্য ব্যারাক, ওড়িশা প্রভৃতি ছিল কালাজ্বর সংক্রমণের একেকটি কেন্দ্র।
কালাজ্বরের কারণ অনুসন্ধান ও ওষুধ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান মিলিটারি সার্ভিসের ব্রিটিশ চিকিৎসকরা নিরন্তর গবেষণা চালাচ্ছিলেন। জানা গেল বুনো জন্তু, শেয়াল, কুকুর, ইঁদুর, ছুঁচো ইত্যাদি কালাজ্বরের জীবাণুর, যা এক ধরনের Protozoa, ধারক (Reservoir)। Phlebotomous argentipes নামক এক ধরনের ক্ষুদ্র বেলে মাছি (Sand Fly) এর বাহক (Vector)। এই নিশাচর রক্তভুক বেলে মাছিরা মাটির ঘর ও গোয়াল ঘরের মেঝে ও দেওয়ালের ফাটলে থাকে ও বংশ বৃদ্ধি করে। তাদের কামড়ের মাধ্যমে প্রোটোজোয়ার Flagellated Promastogotes form মানুষের দেহে প্রবেশ করে Reticulo – endothelium System কে গ্রাস করে নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলে। Macrophage এর মধ্যে জীবাণু গুলি Amastogote form এ থেকে যায়। রক্তের লোহিত ও শ্বেত কণিকা কমে যায়। জীবাণুর শরীরে প্রবেশ থেকে পূর্ণাঙ্গ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে (Incubation Period) এক থেকে চার মাস কখনও কখনও এক বছর লাগে। প্রবল জ্বর, লসিকা গ্রন্থির প্রদাহ, দুর্বলতা, রক্তাল্পতা, যকৃত ও প্লীহার বৃদ্ধি, ত্বকের রঙের কালচে পরিবর্তন ইত্যাদি VL কালাজ্বরের লক্ষন। ক্রমে তা বৃদ্ধি পেয়ে হৃদপিণ্ড, ফুসফুস প্রভৃতি অঙ্গে জটিলতা ঘটিয়ে মৃত্যু হয়।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসের ডাঃ লিশম্যান এবং ডাঃ ডোনোভান পৃথকভাবে প্রোটোজোয়াটি আবিষ্কার করায় সেটির নামকরণ হয় Leishmania donovani । ঐ
সার্ভিসের ডাঃ রনাল্ড রস, যিনি ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কার করে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে নোবেল পুরষ্কার পান, গবেষণা চালিয়ে লিশম্যান ও ডোনোভানের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা চালিয়েও ব্রিটিশ চিকিৎসক গবেষকরা কালাজ্বরের কার্যকর ওষুধ বের করতে পারছিলেন না। ইতিমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চার বছর শিক্ষকতা করে ডাঃ ব্রহ্মচারী কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিকেলে (বর্তমান নীল রতন সরকার মেডিকেল কলেজ) যোগ দিয়েছেন। পরাধীন দেশের যাবতীয় ঔপনিবেশিক অবহেলা ও বাধা এবং ন্যুনতম পরিকাঠামোর অভাবের মধ্যেও তিনি একটি ছোট ঘরে সাধারণ যন্ত্রপাতি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বিভিন্ন যৌগ কাজে লাগিয়ে তিনি কালাজরের কার্যকর ওষুধ বের করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। অবশেষে ১৯১৬ তে প্রস্তুত করলেন Urea stibamine (Carbostibamide)। এখানে ঠিকমত পরীক্ষা করারও সুযোগ ছিলনা, যেতে হল অসমের চা বাগানের ‘ কুলি কামিনদের ’ বস্তিতে। ১৯২০ নাগাদ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন অব্যর্থ ওষুধের আংশিক স্বীকৃতি পাওয়া গেল। কারণ ব্রিটিশরা একজন নেটিভ ডাক্তারের আবিষ্কার মেনে নিতে পারছিল না। অথচ তাঁর ওষুধ ছিল ৯০ % কার্যকর এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে তুলল। হিমালয়ের ওপারে চীনেও তাঁর ওষুধ নিয়ে চিকিৎসা শুরু হল। ১৯২২ সালে তিনি আবিষ্কার করলেন Dermal Leishmaniasis (এখন যাকে PKDL বলা হয়)। এই কালজয়ী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকের প্রসঙ্গে পরে আসছি।
গল্পের পরের অংশঃ জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীগুলির প্রাথমিক সাফল্যের পর শিথিলতার কারণে গত শতাব্দীর ৭০ এর দশক থেকে আমাদের দেশে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর প্রভৃতির প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায়। ১৯৯০ – ’৯১ থেকে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ও পূর্ব উত্তর প্রদেশের ৫৪ টি প্রাদুর্ভাবপূর্ণ (Endemic) জেলাকে নিয়ে কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী শুরু হয়। ২০২০ তে ভারত ‘ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস (MDG) ’ এ স্বাক্ষর করে। ২০০২ তে ‘ জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি (NHP) ’ এবং দশম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০০৭ এর মধ্যে দেশে কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণের (১০ হাজার জনসংখ্যায় এক জনের কম রোগী) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। পরে অবশ্য তা ২০১১ ও ২০১৫ তে দুবার বর্ধিত হয়। ২০০৩ এ কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী ‘ ন্যাশনাল ভেক্টর বোরন ডিজিস কন্ট্রোল প্রোগ্রাম (NVBDCP) ’ এর অন্তর্ভুক্ত হয়। GFATM অর্থ সাহায্য করে। ২০০৫ এ NVBDCP ‘ন্যাশনাল রুরাল হেলথ মিশন (NRHM) ’ এর অন্তর্ভুক্ত হয়। এদিকে ১৫ বছর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কাজ করে উত্তরবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার জনস্বাস্থ্যের দায়িত্ব নেই। বালুরঘাট শহরের জেলা লাইব্রেরির একতলার একটি অংশে তখন জনস্বাস্থ্য বিভাগ। একদিন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যালেরিয়া অফিসার রাজ্যে রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন। ইতিমধ্যে ভারত সরকার একটি দলিলে কালাজ্বর নির্মূলের কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন। কালাজ্বরের Nil রিপোর্ট দেখে একজন প্রবীণ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আমায় বললেন, “ আপনাকে অনেক কালাজ্বরের কেস দেখাতে পারি ”।
পরদিন সকালেই তাঁকে আমাদের জিপে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে আমরা গেলাম বালুরঘাট ব্লকের খাঁপুর গ্রামে। এই সেই ঐতিহাসিক গ্রাম যেখান থেকে অবিভক্ত ভারতের অবিভক্ত বাংলার তেভাগা কৃষক সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে হত কৌশল্যা কামারিনি, হোপাই মারডি, চিয়ার শাই শেখ প্রমুখ ২১ জন শহীদ কৃষক যোদ্ধার অবহেলিত শহীদ বেদী চোখে পড়ল। সেখানে প্রণাম জানিয়ে প্রথমে স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসকের সাথে কথা বলে একজন অভিজ্ঞ স্বাস্থ্য কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ঐ গ্রাম ও আশপাশের গ্রামের সম্ভাব্য বাড়িগুলিতে গেলাম। আমাদের হাতে ততদিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র চলে এসেছে – rK 39 Rapid Diagnostic Kit। অ্যালডিহাইড টেস্টের মত দীর্ঘসুত্রী ও অত্যধিক ফলস পজিটিভ রেজাল্ট সম্পন্ন কিংবা Splenic বা Bone Marrow Aspiration এর মত চরম বেদনাদায়ক নির্ণয় পদ্ধতির বিপরীতে এটি আঙ্গুলে সামান্য খোঁচা দিয়ে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে তাৎক্ষণিক পরীক্ষা। সন্ধ্যেয় ফেরার আগে ক্লিনিকালি পজিটিভ কেস গুলির মধ্যে থেকে পাঁচটি কেস কে rK 39 দিয়ে কনফার্মড করা গেল। এরপর বালুরঘাট বিমানবন্দরের পাশে একটি চার্চের ফেইথ হিলিং সেশানে আদিবাসী সমাবেশে বেশ কয়েকটি কালাজ্বরের কেস পেলাম। মিশনারী অফ চ্যারিটি হাসপাতালের সিস্টার কমলা, যিনি নিজে পাটনা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা একজন MD গাইনিকলজিস্ট, অনেকগুলি রোগীর সন্ধান দিলেন। অন্যান্য অঞ্চল থেকে, বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলি থেকে প্রচুর কেস নির্ণয় হচ্ছিল। প্রথম PKDL রোগীর সন্ধান পেলাম গঙ্গারামপুর ব্লকের একটি গ্রামে। জেলা হাসপাতালের একমাত্র ডারমাটলজিস্ট ডাঃ ব্যানারজী খুবই সাহায্য করলেন। রোগীকে ওনার কাছে নিয়ে যেতে উনি Sponge Biopsy করে Skin smear এর স্যাম্পেল দিলেন। জেলায় কোন ব্যাবস্থা নেই, সেটি মালদার একটি নামী প্রাইভেট ল্যাব এ পাঠানোর পর তাতে LD Bodies পাওয়া গেল।
এরমধ্যে খাসপুর ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দ্বিতীয় মেডিকেল অফিসার ডাঃ শেঠ একটি কাণ্ড করে বসলেন। একদিন রাতে ফোনে জানালেন যে একটি আড়াই মাস ধরে জ্বরে ভোগা পাঁচ বছরের ওঁরাও মেয়েকে ওর ঠাকুমা ভর্তি করেছে। এর আগে মেয়েটি জেলা হাসপাতালে ও একটি নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছিল। অনেক পরীক্ষা করেও কোন Diagnosis করা যায়নি, PUO (Pyrexia of Unknown Origin অর্থাৎ অজানা জ্বর) লিখে রেফার করা হয়েছিল। অনেকরকম Antibiotics দিয়েও জ্বর কমানো যায়নি। খুব দুর্বল, Severe Anaemia এবং Hepato-splenomegaly রয়েছে। ডাঃ শেঠ rK 39 দিয়ে পরীক্ষা করতে চায়। পরেরদিন rK 39 এবং কালাজ্বরের ওষুধ Inj. SSG (Sodium Stibogluconate) নিয়ে হাজির হলাম। ক্লিনিকালি দেখার পর rK 39 পজিটিভ হল। আমরা নজরদারি রেখে Inj. SSG চালু করব স্থির করলাম। ওখান থেকে খুঁজে খুঁজে তপন ব্লকের ঐ ওঁরাও পাড়ায় গেলাম। গরীব ভুমিহীন পরিযায়ী শ্রমিকদের বাস। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। নারী পুরুষ বেশিরভাগই ভিনরাজ্যে কাজে। বৃদ্ধ ও শিশুরা রয়েছেন। জানলাম এখানে অনেকদিন ধরে কালাজ্বর রয়েছে, অনেকে মারাও গেছেন। দুদিন পর খবর এল মেয়েটির জ্বর কমতে শুরু করেছে। ওষুধের কোর্স সম্পূর্ণ করে মেয়েটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরায় আমাদের আনন্দের শেষ নেই। বিষয়টি STM তাদের জার্নালে প্রকাশ করল। জেলায় এত এত কালাজ্বর নির্ণয় হওয়ায় স্বাস্থ্য ভবনে হৈ চৈ পড়ে গেল। আমাকে তলব করা হল।
খোদ রাজ্যের স্বাস্থ্য কর্তার চেম্বারে বিচার শুরু হল। পতঙ্গ বাহিত রোগের রাজ্য নোডাল অফিসারও ছিলেন। দুজনেই আমায় হাড়ে হাড়ে চেনেন। যক্ষ্মা প্রোগ্রামে থাকার সময় তাদের জেলার আনাচে কানাচে নিয়ে গিয়ে, প্রচুর সমস্যা তুলে ধরে খুব কষ্ট দিয়েছিলাম। প্রথমে একটু রাগারাগি করলেও বেশি কিছু বললেন না। বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন এত এত কেস দেখাচ্ছ কেন্দ্রকে কি জবাব দেব। একজন সহ স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে নির্দেশ দিলেন জেলায় গিয়ে সরে জমিনে দেখতে। তিনি এসে জেলা ঘুরে আমাদের সমর্থন করলেন। আর আমরাও নতুন নতুন রোগীকে নির্ণয় করে তাদের চিকিৎসা করে যেতে লাগলাম। আমাদের দেখাদেখি মালদা প্রভৃতি জেলা কেস রিপোর্ট করতে শুরু করল। সরকার বাহাদুর দেখলাম নিয়ন্ত্রণের সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা সীমান্ত গ্রামগুলিতে বাংলাদেশের সাথে সমন্বয় করে কাজের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কারণ ওদিকেও প্রচুর কেস। ঐ সময় আমাদের হাতে আরেকটি অস্ত্র এল। Tab. Miltafosine প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত হল। Inj. SSG নিতে রোগীদের খুব যন্ত্রণা হত। তাই অনেকে চিকিৎসা সম্পূর্ণ করতেন না। PKDL এর ক্ষেত্রে টানা ৯০ দিন ইঞ্জেকশন নিতে হত। এমনও হয়েছে স্বাস্থ্য কর্মী রোগীর বাড়িতে গিয়ে দেখেন দরজায় তালা ঝুলছে। ইঞ্জেকশনের ভয়ে রোগী সপরিবারে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অজ্ঞাতবাসে চলে গেছেন।
পরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এসে ক্যানিং ১ ও বাসন্তী ব্লকে বিশেষ কালাজ্বর নির্মূলকরণ অভিযানে অংশ নিয়েছি। তখন দেখেছি প্রাদুর্ভাবযুক্ত ব্লক স্তরে Kala-azar Treatment Supervisor (KTS) পদের সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসায় Inj. Amphotericin B যুক্ত হয়েছে। অনেক পরে কয়েক বছর আগে স্নাতকোত্তর ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলায় পরিদর্শনে গিয়ে মালদায় তখনও বেশ কিছু কেস দেখলাম। Kala-azar – TB – HIV Coexistent কেসও ছিল, যাদের মৃত্যু হয়। ওষুধের অনিয়মিত সরবরাহ সেখানে একটি গুরুতর সমস্যা।
কালাজ্বরের চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণঃ বর্তমানে নিম্নোক্ত চারটি কম্বিনেশনের প্রথম দুটির যে কোন একটি দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
১) Inj. Amphotericin B – এক মিলিগ্রাম / প্রতি কেজি ওজন মাত্রায় ৫% ডেক্সট্রোজ ইনফিউশনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা ধরে। একদিন বাদে একদিন। এরকম ১৪ টি ইঞ্জেকশন।
২) Inj. Liposomal Amphotericin B – ১০মিলিগ্রাম / প্রতি কেজি ওজন মাত্রায় ৫% ডেক্সট্রোজ ইনফিউশনে। একটিমাত্র ইঞ্জেকশন। ব্যয় বহুল।
৩) Inj. Emulsified Amphotericin B – ১৫ থেকে ২০ মিলিগ্রাম / প্রতি কেজি ওজন মাত্রায়। একটিমাত্র ইঞ্জেকশন।
৪) Tab. Miltafosine (২.৫ মিলিগ্রাম / প্রতি কেজি ওজনে) + Inj. Paromycin (১১ মিলিগ্রাম / প্রতি কেজি ওজনে) – ১০ দিন।
PKDL এর চিকিৎসা –
Tab. Miltafosine (ওজন অনুযায়ী ৫০ মিলিগ্রামের একটি বা দুটি ট্যাবলেট) – ২৮ দিন।
Inj. SSG (২০ মিলিগ্রাম / প্রতি কেজি ওজনে) – শিরায় বা মাংসপেশিতে X ৯০ – ১২০ দিন।
Inj. Amphotericin B – তিন থেকে চারটি কোর্স, তিন থেকে চার মাস ধরে।
Inj. Liposomal Amphotericin B (৫ মিলিগ্রাম / প্রতি কেজি ওজনে) – সপ্তাহে দুবার করে তিন সপ্তাহ।
Amphotericin B হৃদপিণ্ড, যকৃত ও বৃক্কের রোগে এবং Miltafosine শিশু, গর্ভবতী ও বৃদ্ধ দের দেওয়া যায় না।
বাহক বেলে মাছিদের নিয়ন্ত্রণে পাকা গৃহের ব্যাবস্থা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা সহ পরিবেশের উন্নতি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মশারি ব্যাবহার সহ ব্যাক্তিগত প্রতিষেধনের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। Integrated Vector Management নিয়ে খুব চর্চা চলছে। এছাড়াও বছরে দুবার Alphacypermethrin 5% wp দিয়ে ঘর ও গোয়ালঘরে দেওয়ালের ছয় ফিট উচ্চতা অবধি Indoor Residual Spraying (IRS) করা হয়।
ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীঃ এই বরেণ্য এবং বিস্মৃতপ্রায় দক্ষ চিকিৎসক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও বিরাট মাপের গবেষক ১৯ ডিসেম্বর ১৮৭৩ পরাধীন ভারতের বাংলা প্রদেশের বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলীর সারডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ডাঃ নীলমণি ব্রহ্মচারী ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের চিকিৎসক ছিলেন। মাতা ছিলেন সৌরভ সুন্দরী দেবী। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র তিনি জামালপুরের রেলের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে হুগলীর মহসীন কলেজ থেকে গণিত ও রসায়ন শাস্ত্রে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন। এরপর তিনি উচ্চ রসায়ন নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এম.এ. পাশ করেন। তারপর চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এম.বি. পরীক্ষার ফাইনালে মেডিসিন ও সার্জারি দুটি বিষয়েই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুডিফ ও ম্যাকলিওড মেডেল পান। তারপর এম.ডি. এবং পি.এইচ.ডি. করেন। তাঁর পি.এইচ.ডি. –র গবেষণা পত্র ছিল ‘ Studies in haemolysis ’। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ননীবালা দেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁদের তিনটি পুত্র সন্তান জন্মেছিল।
ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিস ভুক্ত না হয়েও তাঁর মেধা ও দক্ষতার কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল, মেডিকেল কলেজ কলকাতা, কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ (বর্তমান আর জি কর ), ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল, স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিন, আই.সি.এম.আর. এ চিকিৎসা, অধ্যাপনা এবং গবেষণার কাজে যুক্ত ছিলেন। মেন্টে এবং উইলিয়াম জোন্স মেডেল পান। ১৫০ টি গবেষণা পত্র লিখেছেন যার অনেকগুলি ল্যানসেট, ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল প্রভৃতিতে প্রকাশিত হয়। ভয়াল কালাজ্বরের প্রকোপ থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে তিনি কালাজরের ওষুধ তৈরির উপর মনোনিবেশ করেন। তারপর নিরলস গবেষণা চালিয়ে সেই সময়কার কালাজ্বরের যুগান্তকারী ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামিন আবিষ্কার করেন। যা ব্যাবহার করে লক্ষ লক্ষ রোগীর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়। কালাজ্বর নিরাময় অসম্ভব রোগ থেকে নিরাময় সম্ভব রোগে পরিণত হয়। কিন্তু ঔপনিবেশিক প্রশাসক ও সাম্রাজ্যবাদী দের নিয়ন্ত্রিত দুনিয়া তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে প্রস্তুত ছিল না। ১৯২৯ ও ১৯৪২ এ দু দুবার তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্যে প্রস্তাবিত হয়েও বাতিল হয়ে যায়। পরে কায়সার – ই – হিন্দ গোল্ড মেডেল, রায় বাহাদুর, নাইটহুড, ফেলো অফ রয়াল সোসাইটি, লন্ডন প্রভৃতি সম্মাননা পান। ১৯৩৬ এ তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ এ ভারতের প্রথম ব্লাড ব্যাংক স্থাপন করেন স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিনে।
এশিয়াটিক সোসাইটি, রেড ক্রশ, কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়, জাতীয় আয়ুর্বেদ বিজ্ঞান পরিষদ, চিড়িয়াখানা সহ বহু প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতাল, সেন্ট্রাল সেরামিক ইনসটিউট সহ বহু প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা করেন। দেশ স্বাধীনতা লাভের আগেই এই মহান বিজ্ঞানসাধক, মানবতাবাদী, বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং একনিষ্ঠ গবেষকের মৃত্যু হয়। তাঁকে যেন আমরা বিস্মৃত না হই। কেবলমাত্র পরনির্ভর না হয়ে চিকিৎসা গবেষণার উন্নত পরিকাঠামো গড়ে তুলি এবং মেডিকেল শিক্ষা ব্যাবস্থাকেও উন্নত করে তুলি যাতে আগামীদিনে প্রথম শ্রেণীর গবেষকরা উঠে আসেন।
১৪.০২.২৪