(১)
প্রক্টোস্কোপ এমন একটা যন্ত্র, কেউ যদি এর ব্যবহার জানে, খোলা আকাশের নিচে বেওয়ারিশ ভাবে পড়ে থাকলেও হরগিজ সে এতে হাত দেবে না। তাই সার্জারির আউটডোরে খুব ক্যাজুয়ালি এটা রাখা থাকে। কখনও কিডনী ট্রে-তে, কখনও বা বেসিনের ট্যাপের তলায়। কিন্তু জেলা হাসপাতালের আউটডোর থেকে এই প্রক্টোস্কোপই একদিন উধাও হয়ে গেল।
পরেরদিন প্রক্টোস্কোপের অভাবে সার্জন ডাঃ বড়ুয়া খুব সমস্যায় পড়লেন। পাইল্স, ফিসার, ফিশ্চুলা রোগীদের ভালো করে এক্সামিন না করেই বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আউটডোরের শেষে ভাবতে বসলেন, সরকারি জেলা হাসপাতালে নতুন প্রক্টোস্কোপ কেনা মানে লম্বা একটা প্রসিডিওর। সুপারের কাছে লিখিত দরখাস্ত করতে হবে। তারপর সেই দরখাস্ত সিএমওএইচ অফিসে যাবে। সেখান থেকে অ্যাপ্রুভাল এলে টেণ্ডার ডাকা হবে। দরপত্রে যে ইন্সট্রুমেন্ট সাপ্লাই কোম্পানি সবচেয়ে কম দর হাঁকবে তার কাছ থেকেই প্রক্টোস্কোপ কেনা হবে। সবমিলিয়ে মিনিমাম একমাসের গল্প।
(২)
সদর হাসপাতালে যোগ দেওয়ার পর খুব অল্পদিনের মধ্যেই ডাঃ বড়ুয়ার সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকে এখন তাঁর অসংখ্য ফ্যান-ফলোয়ার্স। এরা বেশিরভাগই তাঁর হাতে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগী এবং রোগীর পরিজন। ডাঃ বড়ুয়া এই সুযোগটা কাজে লাগালেন। তিনি হাইলাইট করে একটা ফেসবুক পোস্ট দিলেন:”আমার প্রক্টোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রক্টো এখন যার কাছে আছে তার কোনো উপকারে আসবে না। কিন্তু ওটা ছাড়া আমি খুব অসহায়। ভুলবশতঃ কেউ যদি প্রক্টোকে নিয়ে গিয়ে থাকেন তো দয়া করে ফেরত দিয়ে বাধিত করবেন।”
এক মিনিট পর থেকেই ঝপঝপ করে স্যাড রিয়্যাকশন আসতে শুরু করল। কমেন্ট সেকশন নানারকম মন্তব্যে ভরে উঠলো… “দুশ্চিন্তা করবেন না ডাক্তারবাবু, প্রক্টো অক্ষত শরীরে ফিরে আসবে” ; “ঈশ্বর উপর থেকে দেখেছেন, উনি প্রক্টোকে রক্ষা করবেন” ; “প্রক্টোর অপহরণকারীদের কঠিনতম শাস্তি হোক” ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরপর একজন প্রশ্ন করল, “প্রক্টোকে শেষ কোথায় দেখা গিয়েছিল?”
ডাঃ বড়ুয়া লিখলেন, “বেসিনের উপর ট্যাপের তলায়।”
তার নিচে আরেকজন কমেন্ট করল, “তার মানে ও চান করছিল। গায়ে কোনো জামা ছিল না। আহারে! বেচারা শীতে খুব কষ্ট পাচ্ছে বোধহয়।”
স্থানীয় দারোগা লিখলেন, “আচ্ছা ডাক্তারবাবু, প্রক্টোর কি কারও সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল?”
ডাঃ বড়ুয়া জবাবে জানালেন,”হ্যাঁ, তা ছিল বৈকি!”
দারোগা কমেন্ট করলেন, “কার সাথে?”
ডাঃ বড়ুয়া ইংরেজি হরফে ‘গুহ্যদ্বার’ লিখতে গিয়ে Guhadar লিখে ফেললেন।
দারোগা জানালেন, “আপনি টেনশন করবেন না। কালই আমরা গুহ দা’র বাড়িতে তল্লাশি চালাবো।”
ডাক্তার বড়ুয়া রিপ্লাই দিলেন, “না না একটা সামান্য যন্ত্রের জন্য এতকিছু করার দরকার নেই।”
দারোগা লিখলেন, “ডাক্তারবাবু, এখনকার ছেলেপুলেদের সামান্য যন্ত্র বলবেন না। এরা একেকটা কঠিন যন্ত্র!”
ডাঃ বড়ুয়া দেখলেন এ তো ভারি জ্বালা। সবাই উল্টো ট্র্যাকে হাঁটছে। এরকম চললে একমাস কেন একবছরেও প্রক্টোস্কোপ উদ্ধার হবে না। তাই এবার তিনি গুগল থেকে প্রক্টোস্কোপের একটা পিকচার ডাউনলোড করে ছবিসমেত আবার ফেসবুকে পোস্ট করলেন।
(৩)
পরেরদিন সকালে একজন প্লাম্বার ক্যারিব্যাগ হাতে ডাঃ বড়ুয়ার সাথে দেখা করতে এলো। চেম্বারে ঢুকে ক্যারিব্যাগের ভেতর থেকে একটা স্টিলের চকচকে বস্তু বার করে বলল, “দেখুন তো ডাক্তারবাবু, আপনি যা খুঁজছেন তা এটা কিনা?”
ডাক্তার বড়ুয়া চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে বললেন, “এই তো আমার প্রক্টো! কিন্তু এটা তোমার কাছে কীভাবে গেল?”
প্লাম্বার যুবক বলল, “আপনার আউটডোরের ট্যাপকলে ঠিকঠাক জল আসছিল না বলে কাল বিকেলে সারাতে এসেছিলাম। দেখি যন্ত্রটা বেসিনে পড়ে আছে। ভাবলাম হাসপাতালের কোনো অকেজো জিনিস বলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। অমনি প্যাকেটে ভরে নিয়ে গেলাম। রাতে আপনার ফেসবুকে পোস্ট করা ছবিটা দেখে বুঝতে পারলাম ভু্ল হয়ে গেছে। তাই ফেরত দিতে এলাম।”
—-খুব ভালো করেছ ভাই।
—- কিন্তু ফেসবুকে আপনি লিখেছেন এটা অন্যদের কোনো উপকারে আসবে না। এটা কিন্তু ঠিক কথা নয়। এরকম কাজের জিনিস খুব কম হয় ডাক্তারবাবু। পুরো ডবল অ্যাডভান্টেজ!
—- তার মানে?
—- ফেরত দিতে মন একদমই সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু পোস্টে লেখা দেখলাম আপনি এটা ছাড়া অসহায়। তাই টানাপোড়েন শুরু হয়ে গেল। গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলাম মা আর ঠাকুমাকে পরেও এটা কিনে দেওয়া যাবে, কিন্তু আপনাকে অবিলম্বে ফেরত না দিলে আপনি খুব সমস্যায় পড়বেন।
—- “এটা দিয়ে তোমার মা-ঠাকুমা আবার কী করলেন!” ডাক্তার বড়ুয়া আঁতকে উঠলেন।
—- ঠাকুমার পান ছেঁচার ডাঁটিটা অনেকদিন হলো হারিয়ে গেছে। বুড়ির একটাও দাঁত নেই। পান চিবিয়ে খেতে পারে না। তাই ভেতরের অংশটা বুড়িকে দিয়ে দিলাম। অনেকদিন বাদে বুড়িকে পান পিষে খেতে দেখলাম। বিশ্বাস করুন, ফোকলা হাসি দিয়ে দু’হাত তুলে আমায় আশীর্বাদ করল। আর জেরিক্যান থেকে বোতলে সরষের তেল ঢালতে সুবিধা হচ্ছে বলে মা বাইরের অংশটা রান্নাঘরে রেখে দিয়েছিল।
এইকথা শোনার পর ডাঃ বড়ুয়া প্রক্টোস্কোপটা প্লাম্বারের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে উন্মাদের মত চিৎকার করে বললেন, “দূর হ হতচ্ছাড়া!”
😃😃😃