খুপরি থেকে মুক্তি পেয়ে রাত নটা নাগাদ মধ্যমগ্রাম চৌমাথার সুভাষ ময়দানে গেলাম। কাল থেকে বই মেলা। দিনের বেলা সময় পাব না। আজ রাতেই আমাদের স্টলটা সাজিয়ে ফেলা জরুরি।
সবে কালী পুজো গেছে। মাঠটা এবড়ো খেবড়ো হয়ে আছে। পেরেক আর কাঠের টুকরোয় ভর্তি। তার মধ্যেই স্কুটার নিয়ে নেমে পড়লাম। যা হওয়ার হবে। এমনিতেই স্কুটারের পেছনের চাকাটায় মনে হচ্ছে চোরা লিক হয়েছে। দুদিন অন্তর অন্তর হাওয়া কমে যাচ্ছে। রোজই হাওয়া দেওয়ার সময় ভাবি আজকেই সারাব। তারপর একবার খুপরিতে ঢুকে পড়লে সব ভুলে যাই।
সঞ্জীবদা, পার্থ ও ছোটো মেসো ইতিমধ্যেই আমাদের বুকস্টলে উপস্থিত হয়েছে। খানিকক্ষণের মধ্যে ফর্মালিনে চোবানো ভুজঙ্গ নিয়ে সঞ্জয়দাও হাজির। পাশের স্টলই বুকস জাংশনের প্রবীরদার। প্রবীরদা বইমেলা করে বেড়ানো অভিজ্ঞ লোক। অধিক সন্ন্যাসী হলে যা হয়, আমাদের কাজ টুকুস টুকুস করে এগোতে লাগল।
তা কাজ ধীরে সুস্থেই এগোক, তাতে সমস্যা নেই। এখন তো আর রোগীরা অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হবে না, ঝগড়াও করবে না। চারজনে মিলে একটা বইয়ের র্যাকের নাটবল্টু আটকে খাড়া করতেই এক ঘন্টা সময় লাগলাম।
কাল ভোরে আবার মেডিকেল ক্যাম্প আছে। শুভজিত সে জন্য একপেটি ওষুধপত্র নিয়ে মেলাতেই হাজির। সমস্যা নেই, স্কুটারের সামনে ওষুধের পেটি ধরে যাবে। সঞ্জীবদা তাড়া দিচ্ছিল। রাত এগারোটা বাজতে চলল। এবার তাড়াতাড়ি করতে হবে। কাল আবার ক্যাম্পের জন্য ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠতে হবে।
ছোটোমেসো বলল, ঠিক আছে, স্টলের সামনে ত্রিপলটা টানিয়ে ফেলি তাহলে। বাকি কাজ কাল করা যাবে। দুপাশে দুটো বড়ো পেরেক পোঁতা দরকার।
মেসো নিজেই চেয়ারের উপর উঠে একটা ইট দিয়ে ঠুকে ঠুকে বাঁশে পেরেক ঢোকানোর চেষ্টা শুরু করল। এক একবার পেরেকের পিছনে ইটের বাড়ি মারছে আর স্টলের ভেতরের টিউব লাইট গুলো কেমন দপ দপ করছে।
ইট দিয়ে ঠোকা ঠুকি চলছে, গল্প চলছে, লাইটের দপ দপানি চলছে, মোবাইলে ছবি তোলা চলছে- শুধু পেরেকটাই যা বাঁশে ঢুকছে না। বললাম, মেসো তুমি নামো, আমি একবার দেখি। তুমি ঠিক ঠাক হাত পাচ্ছ না।
প্লাস্টিকের চেয়ারে উঠলাম। পেরেকটা এক হাতে শক্ত করে ধরে ইট দিয়ে গুছিয়ে একটা বাড়ি মারলাম। দুড়ুম করে একটা শব্দ হলো আর সাথে সাথে মেলার সব স্টলের সব আলো নিভে গেল। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
মেসো ফিস ফিস করে বলল, বুমবাই, তুই এটা কী করলি? মানে কী ভাবে করলি?
কী ভাবে করেছি সেটা কি আমিও জানি? তবে কিছু একটা করেছি, এ ব্যপারে নিশ্চিত। আমার পেটের মধ্যে গুড়গুড় করছিল। সঞ্জীবদা বলল, তুই শিওর শট সার্কিট করে দিয়েছিস।
বইমেলার মাঠে অনেক মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বলছে। পার্থ বলল, ডাক্তারবাবু, আপনি বোধহয় শুধু বইমেলা নয়, পুরো মধ্যমগ্রামটাকেই অন্ধকার করে দিয়েছেন।
তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই, মেলার বাইরে চৌমাথাও অন্ধকার। বিজ্ঞাপনের বোর্ডগুলোর আলো নিভে গেছে। একটা পেরেক পুঁততে গিয়ে গোটা শহর অন্ধকার হয়ে যেতে পারে? এটাও সম্ভব?
ঠিক তিন মিনিট পরে দপ করে সব আলো একসাথে জ্বলে উঠল। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। উফ… এভাবেও লোডশেডিং হতে হয়।
পেরেক পোঁতার আর সাহস পেলাম না। কোনোরকমে দড়ি দিয়ে বেঁধে ত্রিপল টানালাম। ওষুধের পেটি স্কুটারে তুললাম। স্টার্ট দিয়ে দেখি স্কুটার এগোচ্ছে না। সিকিউরিটির লোকটা একগাল হেসে বলল, ডাক্তারবাবু, আপনার পেছনের চাকায় তো হাওয়া নাই। দাড়ান, ঠেলে বের করে দিচ্ছি।
স্কুটার বড়ো রাস্তা দিয়ে ঘটাং ঘটাং করে চলেছে। কুকুররা ঘুম ভেঙে ছুটে আসছে। কামড়ালে বই মেলা মাথায় উঠবে। দেখি, যদি রাত বারোটায় কোথাও হাওয়া দেওয়া যায়। কাল চাকার লিক সারাবই।
আপাতত আপনাদের সকলকে আমন্ত্রণ মধ্যমগ্রাম চৌমাথার বই মেলায় প্রণতি প্রকাশনী ও ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির অশোকনগর শাখার সম্মিলিত স্টলে। বই মেলা চলবে ৪ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত, বেলা ৩ টে থেকে রাত ৯টা।