(ক) বিন্দুবাসিনীর কথা
বিন্দুবাসিনী কি আর জানে না যে চোরেরা মিথ্যে কথা বলে। ধরা পড়ার আগে মিথ্যে বলে, পরে মিথ্যে বলে, আবার থানা কোতোয়ালিতে গিয়ে মিথ্যে কথা বলে। সর্বক্ষণ মিথ্যে বলে। তবুও যেটা সত্যি সেটা বলতে চায় না।বউ-বাচ্চা নিয়ে তাকে সংসার পালন করতে হয়। তারা গতরে বেশি খাটতে চায় না।
আর কে না বলে মিথ্যে কথা? এক একজন এক এক রকমের মিথ্যে কথা বলে। বড়ছেলে আয়ুষ্মান যখন চাকরি করতে আমেরিকার পথে পাড়ি দিচ্ছে। তখন বলল, – মা তুমি চিন্তা ক’রো না। প্রজেক্ট শেষ হলেই আমি চলে আসব।
তার প্রজেক্টগুলো এখনও এই দশ বছরের পরেও সমান তালে চলেছে।
ছোটছেলে অম্বর, সে তো এমন একটা দেশে চলে গেল যেখানে নাকি মিথ্যে কথা বলার চল নেই। সেই জাপান থেকে সেও কখনও সখনও ফোন করে বলে, – ফিরে আসব মা, যে কোন দিন। সেই দিনটার মুখ আর চোখে ভাসে না ।
তবে কি তাঁর ছেলেরাই এরকম কথা বলে। মেয়ে ধোয়া তুলসিপাতা?
জামাই প্রসূন দিল্লিতে সাইথ ব্লকে চাকরি করে। বড় অফিসার। তারা বিয়ের প্রথম প্রথম বেশ কয়েক বার এসেছিল। এখন বলে, – জান মা টুসকি নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে। কি করে যাই বল ?
একটু আগে অল্প ঝড় আর সাথে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। এখন কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। এই বাড়ির দোতলার ঘরে তিনি একা থাকেন। অবশ্য আর দ্বিতীয় কোন প্রাণী তো এখানে থাকার মত নেই। সব মিলিয়ে ঘর তো কম নয়। নয় নয় করে ছোট বড় পাঁচ ছয়টি ঘর আছে উপর নীচ মিলিয়ে। এটা তাঁর স্বামীর তৈরি বাড়ি। লোকটা সরকারি কন্ট্রাক্টর ছিল। সৎ অসৎ দুভাবে দুহাতে রোজগার করেছিল। তবেই না আলিপুরের মত অভিজাত এলাকায় এই বাড়িটা করতে পেরেছিল। তবে টাকা থাকলেই তো সব সবসময় সব কিছু হয়ে ওঠে না। সে একজন মন্ত্রীর বদান্যতা পেয়েছিল ।
নিচে গেট খোলার আওয়াজ তিনি পাননি। এসময় রাতের মেয়েটা আসে। সে আরো একটু আগে আসে হয়তো ঝড়বৃষ্টিতে দেরি করে ফেলেছে। তিনি মনে মনে আশ্বস্ত হলেন। তল পেট ভারি হয়ে আছে অনেকক্ষণ। যদিও বেডপ্যানটা একটু চেষ্টা করলে হয়ত হাতে পেয়ে যাবেন। কিন্তু এখনও এতদিন পরেও এই জিনিসটা ব্যবহার করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। বরং হাত ধরলে তিনি অথর্বের লাগোয়া ওয়াশরুমটায় যেতে পারেন। একা দাঁড়ানোর ক্ষমতাতো নেই। কবেই হারিয়েছেন। ইদানিং যোগ হয়েছে শ্বাসকষ্ট। একটা অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ডাঃ বক্সি, তাঁর পারিবারিক চিকিৎসক। জল জমেছিল বুকে। ছেঁদা ফুটো করে জলটা বার করাতে এ যাত্রা বেঁচে গেলেন। তবে নিত্য সঙ্গী হয়ে গেল এই সিলিন্ডার নল আর জলের বোতলে অক্সিজেনের বুদবুদি।
অম্বর ছোটবেলায় খুব অ্যাকোয়ারিয়াম পছন্দ করতো। ঘন্টার পর ঘন্টা রঙীন মাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো। তার বাবার উৎসাহ কম ছিল না। সেই জলের ভিতরে খুব হাওয়ার বুড়বুড়ি কাটতো। মনে মনে হাসল বিন্দুবাসিনী । অক্সিজেনের বুদবুদি কম হলে বুকে একটু টান টান ভাব আসে আর মাথাটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে যায়। যেমন এখন হচ্ছে। সিলিন্ডারটা আজ পাল্টাতে হত।
বুল্টি বলে যে মেয়েটা তালদি থেকে আসে সে বলেছিল, – মাসিমা যা আছে দু’ঘন্টা চলে যাবে।
এরপর সে ঝড়ের পূর্বাভাস দেখে আগাম বেরিয়ে যায়। রাতের মেয়েটা আসে সোনারপুর থেকে। সে এলে আর অসুবিধা হবে না।
তার অপেক্ষাতেই ছিলেন বিন্দুবাসিনী। একটু আচ্ছন্ন বোধ হচ্ছে। চোখ বুজে আসছে। মাথার ভিতরে কুয়াশা জমাট বাঁধছে। স্নায়ুতন্তুুতে বুদ বুদ কম হলে এই আচ্ছন্নতা আসে।
পিছন দিকে কি খুট করে আওয়াজ হল? ঘরের মৃদু আলো, যেটা বুল্টি জ্বালিয়ে দিয়েছিল , সেটা কি নিভে গেল। চোখের পাতা জোর করে খুলতে সামনের দেওয়ালে কি কোন ছায়া ভেসে উঠলো,
– কে ? কে ? জবা এলি?
দেওয়ালে গাঁথা ছায়া একটু সরে গিয়ে আবার স্থির হল।
– আলো জ্বাল, ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
জবার কাছে একটা চাবি থাকে গেটের ও এভাবে অনেক সময় আসে। চুপচাপ ঢুকে পড়ে।
গলায় কি কিছু আটকে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে কেন?
– ও জবা, আলোটা জ্বাল। আমার দম আটকে যাচ্ছে। আমি টয়লেটে যাব।
গলা খাঁকারি দিয়ে একটা পুরুষ অথচ মেয়েলি গলা মৃদুস্বরে বলল, – আমি জবা নই । বিল্বতলায় থাকি। ভুল করে ঢুকে পড়েছি।
– তুই যেই হ, একটু আলোটা জ্বাল। দরজার ডানদিকে সুইচ আছে ।
– আমি জানি, আমিই তো নেভালাম।
– সে যাই হোক, জবা তোকে পাঠিয়েছে? আজ রাতে ডিউটি করতে? খুব ভালো হয়েছে? রাতে বিরেতে ছেলেরা থাকলে একটু ভয় ভীতি কম নয়। যা চোর ডাকাতির কথা শুনি জবার মুখে।
– আমি ধরলে কি আপনি উঠতে পারবেন?
– জবা বলেনি তোকে। আমি কি নিজে উঠতে পারি। পাঁজাকোলা করে ধরলে কোনক্রমে উঠে টয়লেটে যেতে পারি। তাও ঝাপসা দেখি। চোখে তো ছানি পেকে গেছে অনেকদিন। তুই মুখে কেন কালো কাপড় বেঁধে আছিস? তোর কি সর্দি কাশি? ঠিক আছে একটু তফাতে থাক।
এই লোকটা কাজ জানে, সে বিন্দুবাসিনীকে ধরে আবার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার পাল্টে দিল।
চাবিটা ঘুরিয়ে দিয়ে বুদ বুদি বাড়িয়ে দিল। গোল্ডফিসগুলো হাওয়ার বুদবুদি বাড়লে যেমন খুশি হত, ছটফটে হত, তেমনি বিন্দুবাসিনী তার পক্ষাঘাতগ্রস্ত শরীর নিয়েও একটু উজ্জীবিত হলেন।
– আমার কফি খেতে ইচ্ছে করছে। রান্নাঘরে যা। আমার ছেলে বলে মা, সাহেবরা রাতে কফি খায়।
– আমি পারি কফি, কতটা করব?
– কেন তুই খাবি না? তোর রাতের খাবার বুল্টি প্লেটে রেখে দিয়েছে। মাইক্রোওভেনে গরম করে নিবি, এক মিনিট। ওঃ, হো। তুই কি মেশিন চালাতে পারিস?
– অল্প স্বল্প পারি।
– কেন বাড়িতে আছে?
– কি যে বলেন মাসিমা? আচ্ছা আপনাকে দিদি ডাকব? অনেকে মাসিমা শুনলে মনঃক্ষুণ্ন হয়।
– বাব্বা, এতো সাহিত্যের ভাষা। তুই তো শিক্ষিত ছেলে। ঘাটের ডাক এসেছে, এখন মাসিমা কি ঠাকুমা পিসিমা সবই এক। যাঃ আর বকাস না এবার কফি খাওয়া।
সে রান্নাঘরে চলে গেল, সে কি চেনে ঘরদোর ? তরতরিয়ে দিব্যি চলে গেল।
বিন্দুবাসিনীর মনে হল কতদিন বাদে তিনি এত কথা বললেন। নিজের মত করে। বুল্টি আর জবা খুবই ভাল। তবে তারা দুজনেই একটু চুপচাপ একটু গোমড়া। না জিজ্ঞেস করলে কোন কথা বলে না।
কফি পান করতে করতে বিন্দুবাসিনী ভাবছেন একে কে পাঠিয়েছে? জবা না বুল্টি? ছেলেটা কিছু বলেনি। লোক নয়, ওকে এখনও ‘ছেলেটা ‘ বলা যায়। তাঁর বড় ছেলের বয়সই তো চল্লিশের কাছাকাছি। সে তুলনায় এ খুব বেশি বয়স্ক নয়।
– তুমি কি, সরি আপনি কি বসতে পারেন না?
– তুমি বললে আমি খুশি হব। জবা-রা আমাকে তুমিই বলে। আমি বলিয়েছি।
– আচ্ছা।
– তুই জানিস না, তোকে বলেনি ওরা?
– না মানে, বলেছে, তবে.. ।
– তবে কি পুরো বলেনি তাইতো। আজ পাঁচ বছর হলো আমি এভাবে শুয়ে আছি। না না শুরুতে আরো খারাপ ছিলাম। উডল্যান্ডে ভর্তি ছিলাম। টানা একমাস। বড়ছেলে এসেছিল আগে, মেয়ে জামাই এসেছিল। জাপান থেকে ছোট এল অনেক পরে। জলের মত টাকা খরচ করে আমাকে বসাতে পারল। তবে দাঁড় করাতে পারল না। কথা জড়িয়ে যেত এখন একটু পরিষ্কার হয়েছে।
– অনেক টাকার ব্যাপার।
– সে আর বলতে। তবে অসুবিধা হয় নি। ছেলেদের বাবা অনেক টাকা রেখেছিল আমার জন্য। ছেলেদের খরচ করতে হয়নি।
– তুমি ক’টায় খাও? দেখলাম রান্নাঘরে তোমার খাবার ঢাকা আছে।
– গরম করে দিবি সুপ আর ব্রেড আর একটু দুধ। রোজ খাই।
– ভালো লাগে?
– একদমই না। কোন রকমে গিলে নি।
– আজ একটু ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। একটু শীত শীত ভাব আছে। তোমার জন্য কি অন্য কিছু করে দেব? খিচুড়ি বা ঐ ধরনের কিছু?
– ইস্,কতদিন খিচুড়ি খাইনি। তুই পারবি করতে?
– আমি অল্প পারি। পানশিলা-সোদপুরে একটা জেরিয়াট্রিক কেয়ার সেন্টারে কাজ করতাম। ওখানে জুতো সেলাই থেকে চন্ডি পাঠ সবই শিখেছিলাম। বুড়ো বুড়িরা থাকতো।
– তো!
– উঠে গেল। ভাড়া নেয়া জায়গা। বাড়িওয়ালার ঐ সব নোংরা বুড়ো ধুড়ো পছন্দ হল না। তুলে দিয়ে স্যানিটারি দোকানের গোডাউন বানালে। ওখানেই শেখা।
– কি কি পারিস ?
– সে অনেক কাজ। ডাক্তারি থেকে সুইপারি। সবই করতে হত।
– বেশ তুই রান্না কর। কোথায় কি আছে দেখে নিস।
– একটা কথা বলব, কোথায় কি আছে যদি একটু দেখিয়ে.. । না না থাক খুঁজে নিচ্ছি।
বিন্দুবাসিনীর মনে হল, গত পাঁচ বছর তো তিনি ওখানে ঢোকেননি ঢুকতে পারেননি। সে কি আর চেনা জায়গা আছে? তবে ভূগোল কি অত সহজে বদলে যায়। মেয়ের বাঁ পায়ের গোঁড়ালিতে একটা জড়ুল আছে। সেটা কতদিন দেখেননি তা বলে কি তিনি ভুলে গেছেন?
সকালে কাজের লোক আসে। সে রান্না করে। বুল্টি এবং জবার রান্না সেই করে দেয়। সে বাজার করে। আর অম্বরের এক বন্ধু বড় রাস্তার কাছে যে ব্যাঙ্ক আছে সেখানে চাকরি করে । চেক লিখে ওর কাছে এদের কারো হাত দিয়ে পাঠালে সে অফিস ফিরতি পথে টাকাটা দিয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে তাঁর সই করার হাতটা সচল আছে।
(২) গোবিন্দর কথা
বড়লোকের রান্নাঘর। কিচেন বলে। কোথায় কি আছে বোঝা মুসকিল। তবে আলো জ্বালাতে চার পাশটা বড় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ওভেন আছে, মাইক্রোওভেন আছে গ্যাস আছে। ওপরে ঘুলঘুলি দিয়ে ধোঁয়া বেরোনর জায়গা আছে। আর গরীবের রান্নাঘরে যেমন ঝাঁকে ঝাঁকে আরশুলা থাকে এখানে তেমন নজর পড়ছে না। কৌটো আর ড্রামের ঢাকনা খুলতে খুলতে সব এক এক করে নজরে এল। সহজপাচ্য খাদ্যের সহজ উপকরণ। হাতড়ে হাতড়ে বেরল সবই। সিঙ্কে জল আছে কিন্তু গোল বাঁধল ডাউস উনুনটাকে নিয়ে। এর চারখানা জ্বালামুখ। কি ভাবে যে অগ্নিসংযোগ করে?
– কিরে গোবর্ধন খুঁজে পেলি?
বুড়ি কি কপাল পড়তে পারে? তার নাম জানল কি করে। অবশ্য তার নাম গোবিন্দ। গোবিন্দ নস্কর। গোবিন্দ মানেই তো গোবর্ধন। উত্তর দিল, সে গলা তুলে বলল,
– সবই তো পেয়েছি। তবে এই চুলাটাই যা গোল বাধাল। এই কূটকচালি বুঝতে পারছি নে।
– তা ঠিক, বহুদিন আগের কেনা। অনেকবার কারুকার্য হয়েছে ওর ওপরে। তবে আমি যদি একবার যেতে পারতাম।
– তুমি আর কি করে উঠবে? কোলে করে তুলতে হব।
– দেখ, আমার মাথায় ঘোলা ভাবটা কমেছে একটু। তুই এই জলের বুড়বুড়ি এট্টু বন্ধ কর।
– তারপর ?
– নীচের তলায় চলে যা, সিঁড়ির নীচে দেখবি ভালো করে। হয়ত একটা চাকা দেওয়া চেয়ার পাবি। বাইরে গেলে ওরা আমাকে ওটাতে বসিয়ে ঠেলে নেয়।
– মন্দ না।
গোবিন্দ তর তর করে বারান্দার শেষে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
– ওরে আলো জ্বালা, ডানদিকের দেয়ালে।
গোবিন্দ কি আর তা জানে না। এ বাড়ির ভূগোল তার মুখস্থ। কতবার সিলিন্ডার দিতে এসেছে। ওপরে উঠেছে নীচে নেমেছে। রায় ফার্মেসী তো বলে দিয়ে খালাস।
গোবিন্দ যেমন সুযোগ পায় অক্সিজেন, ওষুধ ডেলিভারি দেওয়ার। তেমনি সে সুযোগে থাকে। তিলজলায় তার ওস্তাদ বাকিবুল বলে,
– তোকে কেউ সন্দ করবে না রে। তুই পাক্কা রেইকি করে আসবি। হাতে খড়ি তো হয়েছে আবার ভয় কিসের?
সিঁড়ির নীচে পেয়ে গেল যন্ত্রটা। ধূলো পড়ে আছে। একটু মুছে নেয়া দরকার। অসুস্থ মানুষ। শ্বাসকষ্ট হয়। নাকে ধূলো গেলে আবার বিপত্তি। ডাক্তার গাঙ্গুলী বলতেন, ‘সব অ্যালারজেনের প্রভাব, মুখোশ পরলে রোধ করা চায়।’
গোবিন্দর মুখোশ আছে মুখে। তবে অন্য কারণে ।
এখন পাখা চলছে। এ সি বন্ধ আছে।
ডান হাত দিয়ে নিজেই নাকের ভিতরে ঘোসানো নলটা খুলে দিলেন । যা কিছু কাজ শরীরের এই দক্ষিণ অংশ দিয়েই সারতে হয়। অবশ্য বিশেষ কাজ করার প্রয়োজন হয় না। বুল্টি জবারা বেশির ভাগ কাজ করে দেয়। গায়ের চাদরটা হাঁটু অবধি সরিয়ে আর নামাতে পারল না।
– তুমি শুয়ে থাক, আমি দেখছি।
বিন্দুবাসিনী নিজে কোনদিন চেষ্টা করেন নি। সত্যি নামা যায় কি না, দেখেননি। ব্যায়াম করাতে আসত যে মেয়েটা সে সব সময় বলত, চেষ্টা করুন, চেষ্টা করুন। নতুন করে হাঁটা শিখুন। হয়নি শেখা। তাঁর বড়লোক মৃত স্বামী আর আরো ধনী ছেলেদের টাকা সব মিলিয়ে বরাবর তিনি জড় পদার্থের মত বিছানাতেই শুয়ে থেকেছেন।
ঠ্যালা গাড়িটা দুহাতে তুলে এনে ছেলেটা বিছানার পাশে রাখল। মুখে এখনও তার মুখোশ। অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। সরাসরি তাকাচ্ছে না। এক একজন বোধ হয় হয় এমনি। এতটাই লাজুক মুখ তুলে তাকায় না। দেখে না।
বিন্দুবাসিনীর বাঁ হাত বাঁ পা কেমন তুলতুলে, কাপড়ের খোলে তুলো ভরা অঙ্গের মত। শুকনো ডালের মত ঝুলে থাকে। অনেক চেষ্টার পরও বিন্দুবাসিনী নিজে এক পাও নামতে পারলেন না।
– তুই ধর, না হলে পারব না।
গোবিন্দর পেটে খুব খিদে। ওস্তাদের কথা মত আজ সে চেষ্টা করেছিল চায়ের দোকান থেকে একখানা কোয়ার্টার পাঁউরুটি বাঁহাতে সরাতে। বুঝতে পারেনি চা দোকানদারের বছর আষ্টেকের ছেলেটা একটু দূরে রাস্তার খোয়ার ঢিপিতে খেলছিল আর নজর রাখছিল বাপের দোকানে। সে ছুটে এসে হামলে পড়তেই আর পথ পায়নি গোবিন্দ। জীবন বাঁচাতে পাঁউরুটি ফেলে ভোঁকাট্টা দৌড়ে একটা চলন্ত ট্রামে উঠে পড়ে। পেছনে ছেলেটা তখনও ‘চোর, চোর’ বলে চেল্লাচ্ছে।
পেটে যে সব সময় ভালো করে কিছু পড়ে তেমনও নয়। ছোটবেলায় রেল-পুলিশ তিন তিনবার ধরে ছেড়ে দেয়। কয়লা কাঠ টুকটাক মালপত্র সরাত তাদের রেল কলোনির দুষ্টু বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে।
বাবা ডেলি লেবারের কাজ করত, আর মা পরের বাড়ি বাসন মাজতো। দু’জনে সত্ত্বর মরে গিয়ে তাকে ছোট টালির একটা ফাঁকা ঘর দান করে দিল। যার সে একাই মালিক। তবে সে পড়তে ভালোবাসত। যখন দশ ক্লাসে পড়তে স্কুলে যেত, সরস্বতী পূজোর পয়সা জোগাড় করতে রেল ইয়ার্ডে রেক থেক চার বন্ধু মিলে ভোজ্য তেল সরিয়ে ছিল কয়েক ড্রাম। কপাল খারাপ। ধরে, জি আর পি-তে কেস দেয়। কয়েকদিন হাজত বাসের পর সে যখন বস্তিতে ফিরে আসে তখন কম বেশি সবাই জেনে গেছে গোবিন্দ নস্কর চোর। মাঝে মাঝে থানায় হাজিরা দিতে হয়।
যেদিন প্রথম অক্সিজেন সিলিন্ডার দিতে আসে এই বাড়িতে, জবা তখন ডিউটিতে ছিল। আর সেই থেকে এই বাড়ি তার টার্গেট। আজ যে রাতে জবার ডিউটি ছিল সে জানে। তবে এও শুনেছে শিয়ালদা সাউথ লাইনে রেলের ওভার হেড তার কেটে পড়াতে ট্রেন বিভ্রাট, কয়েক ঘন্টা ধরে চলে। জবা আর আসেনি রাতের ডিউটিতে।
(৩) আবার বিন্দুবাসিনী
শরীরের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই তাঁর । তবে কেমন যেন মনে হল তিনি পারবেন। এক পায়ে ছোট বেলায় এক্কা দোক্কা খেলেছেন। একপায়ে ভর করে কিৎ কিৎ কেটেছেন। তিনি বিছানার রেলিঙের লোহার ডান্ডা ধরে ঝুলে পড়লেন ।
– আরে কর কি, কর কি ?
তারপর তাঁকে প্রায় পাঁজাকোলা করে চলমান চেয়ারে বসিয়ে কিচেনের দিকে ঢেলে নিয়ে চললেন। নিজেকে বেশ কেমন অন্য রকম লাগছে বিন্দুবাসিনীর ।
একটা হাতেই চেয়ারটার চাকা ঘুরিয়ে তিনি খেলনা গাড়ির মত কিছুটা সরাতে পারলেন। নিজেই বেশ আনন্দিত হয়ে পড়লেন নিজের কৃতিত্বে। এই তো চাকা ঘুরছে।
তবে গোবিন্দ এই পক্ষাঘাতগ্রস্ত মহিলাকে বেশি সুযোগ দিল না। ঠেলে গাড়িটা রান্নাঘরের দরজা অবধি নিয়ে গেল।
কতদিন বাদে বিন্দুবাসিনী আজ এখানে এলেন। স্বামীর বানানো মনের মত করে সাজানো বিন্দুবাসিনীর রান্নাঘর। সব কিছু দামি দামি জিনিসপত্র দিয়ে তৈরি। শুধু পেটের খিদে মেটানোর পাকগৃহ নির্মাণের জন্য কত খরচা করেছিল সে। অবশ্যই তার সামর্থ্য ছিল, বলত, – আমাদের বেহিসাবি টাকা, বলতে পারো চুরির টাকা।
বুঝতে অসুবিধে হত বিন্দুবাসিনীর। তবুও এই সৎ ও অসৎ উপায়ে রোজগার করা টাকায় এই বাড়ি, ছেলেমেয়েদের বড় করা সবই হয়েছে। মেয়ের বিয়ে দেওয়া। বন্দি বিন্দুবাসিনী আরো আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ল তাঁর পছন্দের রান্নাঘরটিতে। ভগবানের কি অবাক নির্দেশ পছন্দের সন্তানরাও সব পর হয়ে গেল আর দূরের হয়ে গেল তার সাধের রন্ধনশালা।
চশমাটা নিজের পরনের পোশাকপ্রান্তে পরিষ্কার করে নিয়ে দেখলেন কোথায় কি আছে। ওভেনের অটো ইগ্নিশানটা এখনও ঠিক আছে। অবাক হয়ে গেলেন। মানুষগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেও জড় ওভেন তো দিব্যি আছে। -তুই বাকিটা পারবি?
গোবিন্দ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লে তিনি, ‘ঠিক আছে’, বলে নিজে চাকা ঘুরিয়ে গাড়িটা একটু পিছিয়ে নিলেন। একটুখানি পিছিয়ে এনে তিনি খোলা বারন্দার দিকে ধীর গতিতে নিজেকে নিয়ে চললেন। আর খুব অবাক হলেন। তিনি কি সত্যিই এতদিন অপারগ ছিলেন? নিজের শক্তি তো কখন যাচাই করে দেখা হয় নি। গ্রীল দেয়া লম্বা বারান্দায় মৃদু আলো। বাগানের লম্বা ঝাউ গাছের ছায়া এসে পড়েছে। বাতাসে গাছটি আন্দলিত হওয়ায় বারান্দায় তার ছায়া নড়ে চড়ে খেলা করছে। আঃ,কতদিন এখানে আসেননি তিনি। আরো খানিকটা গড়িয়ে গেলে সিঁড়ির ধাপ। নীচে নামার ও ছাদে ওঠার। এগিয়ে আবার পিছিয়ে এলেন।
(৪) আবার গোবিন্দ
টুক করে গোবিন্দ বিড়ালপায়ে ঘরে ঢুকে দেখে নিল। টেবিলের ওপরে রবারের ব্যান্ডে মোড়া কিছু টাকা। কাঁচের আলমারির কাছে । লকারের চাবিও। এখান থেকেই কালো চশমাটা সে ঝেঁপেছিল। আরিঃব্বাশ একটা বালা টাইপের কিছু। থাক বাপধন পরে দেখা যাবে। অনক সময়।হাতে। ফিরে গেল রান্নাঘরে।
রান্নাঘর থেকে হাঁক দিচ্ছে গোবিন্দ, – তুমি কোথায় গেলে? পড়ে যাবে তো !
রাতে অল্প খেলেন। সমান্যই খেলেন বিন্দুবাসিনী। এবার ওষুধ খেয়ে শোওয়ার পালা। ইচ্ছে করে ঘুমের বড়ি আজ খেলেন না।
ডাক্তারবাবুরা বলেছেন বাঁ দিকটা পুরো ঠিক হওয়া অসম্ভব, তবে চেষ্টা করলে চলন সই হয়ে যাবেে। এমন তথ্যও আছে যেখানে রুগী লাঠি ছাড়া দিব্যি নিজের সব কাজ করতে পারছে। সেটাও কি সত্যি ?
ছেলেটাও সত্যি বলছে না। কে বা আর সত্যি কথা সহজে বলে? ছেলেটা আগেও এসেছে অক্সিজেন গ্যাস দিতে। তার তৎপর কাজ বিন্দুবাসিনীকে মনে করিয়ে দেয় সেবারও সে তার শ্বাসকষ্টে সাহায্য করেছিল।
আর সেবার একটা সানগ্লাস হারিয়েছিল। সেটা যার সেই জবা বলেছিল, – ঐ চোরটাই হবে।
ও নাকি রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানে ওকে দু’এক দিন দেখেছে। বিশ্বাস করেননি বিন্দুবাসিনী। মজার কথা ও যে চোর নয় সেটা ও একটুআগে প্রমাণ করে দিল। কিছু টাকা এবং একটা গহনা রাখা ছিল আলমারিতর কাছে। ও তাকিয়েও দেখেনি।
(৫) দু’জনার কথা, বসে মুখোমুখি
– কে আছে তোর বাড়িতে?
– আমি আর একটা আমার বিড়াল ছানা, বুলবুলি।
– আর?
– দেওয়ালে আছে ঘুসঘুসে জ্বরের মতো অপ্রচ্ছন্ন ছোট ফুলকাটা কাঠের ফ্রেমে আমার মা-বাবা, তাদের কোলে শিশু আমি।
– তুই কি কবিতা লিখিস?
– আমার পেটে খুব খিদে। আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর আমার কোন সংযম নেই।
– তুই ঠিক বলছিস না। অনেকেই সত্যি বলে না।
– সত্যির কি খুব দরকার আছে ? দারোগা বলে না সত্যি, মোক্তার বলে না, উকিল বলে না, জজ বলে না। তো চোর কি করে বলে, সত্যি?
– আমি জানি তুই চোর না। যশোদা মা ননীচোরা বললেও আসলে ননীচোরা তো চোর নয়।
– আমি তোমার বাড়িতে চুরি করতেই এসেছিলাম।
– পৃথিবীর কোন চোর সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হয়, রে?
– আমার পেট ভরলে ভীষণ ঘুম পায়। মা বলতো, ‘তোর রাবণের ক্ষিদে আর কুম্ভকর্ণের ঘুম। আমার ঘুম পাচ্ছে।
– তুই ঘুমিয়ে পড়, ঐ সোফাটায়। আমি তোকে পাহারা দিই।
– তুমি কি পুলিশে দেবে?
– তোকে সকালে উঠে আবার যেতে হবে ওষুধ, গ্যাস ডেলিভারিতে। কতলোকের শ্বাসকষ্ট হয়। এখন ঘুমিয়ে নে।
– এই শরীরে পুলিশের মার আর সহ্য হবে না।
– পালানোর চেষ্টা করিস না। এখন ঘুমিয়ে পড়।
– কতদিন পরে এত ভালো খেলাম। আমি আর চোখ খুলে রাখতে পারছি না।
– আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়। কাল জবাকে বারণ করে দেব, রাতে না আসতে। দিনে দুই ভাগ করে করবে।
–‘এ চরাচরে নিশিদিন
কার পথ চেয়ে থাকি,
কৃষ্ণ কৃষ্ণ তুমি যা কর,
বাকি সবই ফাঁকি।‘ –চোর গোবিন্দ গুনগুন করে সংশোধনাগারে শেখা গানের এক কলি গাইল।
বিন্দুবাসিনী বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বুঝলেন বুদবুদগুলো ঠিক যতটা ওঠার ততটাই উঠছে জল ভরা বোতলের ভিতরে।
(শেষ)










