স্ট্রেস (Stress) শব্দটি একবিংশ শতকের মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খবরের কাগজ থেকে ব্রডকাস্ট মিডিয়া, সবেতেই বিভিন্ন ‘কলাম’-এ বা অনুষ্ঠানে স্ট্রেস নিয়ে বিভিন্ন লেখালিখি বা বক্তব্য চোখে পড়ে। ১০ টা-৫ টার অফিস জীবনে যাঁরা ব্যতিব্যস্ত কিম্বা কোনও প্রফেশানাল কোর্সের সাথে যাঁরা জড়িত, যাঁরা বিভিন্ন কোম্পানিতে-কর্পোরেটে কাজ করছেন, তাঁদেরও ‘স্ট্রেস ম্যনেজমেন্ট’ নিয়ে প্রচুর সময় দিতে হচ্ছে! ‘খুব স্ট্রেসড লাগছে!’ বা ‘স্ট্রেসে আছি!’ এই কথাগুলো আমাদের রোজকার সংলাপে বেশ জোরের সঙ্গেই উপস্থিত।
প্রথমেই প্রশ্ন আসে, এই স্ট্রেস কী?? স্ট্রেসের আক্ষরিক অর্থ হল পীড়ন (tension)। ১৯৩০ সালের আগে অবধি এই শব্দটি অনেক বেশি ফিজিক্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বস্তুর ভার নেওয়ার ক্ষমতার সাথে জড়িত ছিল! বিংশ শতকের শেষ থেকে স্ট্রেস শব্দটি ধীরে ধীরে মডার্ন সাইকোলজির পার্ট হিতে শুরু করে।
স্ট্রেস-কে অনেক রকম ভাবে ব্যখ্যা করা যায়-কোনও নতুন পরিস্থিতি বা ঘটনার জন্যে আমাদের শারীরিক ভাবে, অনুভূতিতে, চিন্তাভাবনায় এবং আচরণে এক গুচ্ছ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। স্ট্রেস হল এমন এক মানসিক ও শারীরিক অবস্থা যেখানে কোনও ব্যক্তি মনে করে তার ক্ষমতা ও দক্ষতার দিয়ে এই বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলানো আর সম্ভব নয়! যেসব বিষয় বা ঘটনা এই রকম পরিবেশের তৈরি করে তাদের আমরা বলি স্ট্রেসর (stressor)।
এই স্ট্রেসর আমাদের জীবনে নানা রকম ভাবে থাকতে পারে! কখনো অল্প সময়ের জন্যে, কখনো বেশি সময় ধরে। আর্থিক কোনও ক্ষতির সম্মুখীন হলে, প্রিয়জনের মৃত্যু হলে, পেশাগত জায়গায় কাজের সমস্যা থাকলে, পারিবারিক ঝামেলা চলতে থাকলে, সম্পর্কগত টানাপোড়েন সবেতেই স্ট্রেস হতে পারে। কখনও কখনও এই স্ট্রেস কারও কাছে ট্রমা (trauma) হয়ে উঠতে পারে! ট্রমা আর স্ট্রেস কিন্তু এক নয়! সহজ ভাষায় ট্রমাকে বলা যেতে পারে আকস্মিক গভীর বড় ধরণের এক স্ট্রেস! ট্রমা নিয়ে আলোচনা এই লেখার ব্যাপ্তির বাইরে।
এখন যেকোনো পরিবর্তিত ঘটনা বা পরিস্থিতি আমাদের একটা উদ্বেগ বা চিন্তার জন্ম দেয়, যা আমাদের সেই কাজ বা ঘটনাটি অতিক্রম করতে সহায়তা করে। যেমন পরীক্ষার আগে বা পরের দিন অফিসে কোনও প্রেসেন্টেশান থাকলে আমরা যদি একটু ‘চাপ না খেতাম; অর্থাৎ চিন্তিত না হতাম তাহলে কি আমরা বই নিয়ে পড়তে বসতাম, নিজেদের প্রেসেন্টেশানের প্রস্তুতি নিতাম?? অর্থাৎ একটা দূর অবধি এই চিন্তা ভালো আমাদের মনোযোগ, ইচ্ছে, কর্মক্ষমতা অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলে একে বলে ইউস্ট্রেস (eustress- ‘eu’ অর্থে ভালো)। পরীক্ষার আগে তাই একদম চাপ না নেওয়া আমাদের প্রস্তুতির ক্ষতি করে।
প্রত্যেকের এই ইউস্ট্রেসকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা সহ্যসীমা বা ক্ষমতা আছে। যা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়। যখন এই বহন করার ক্ষমতার বাঁধ আলগা হয়ে যায়, তখন এই ইউস্ট্রেস, ডিসস্ট্রেস (distress)-এ পরিণত হয় এবং তখনই সমস্যার শুরু। একটি বিষয় নিয়ে স্বাভাবিক চিন্তা তখন দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়। আমাদের কর্মক্ষমতা কমে আসে, আচরণগত সমস্যা তৈরি হয়। স্ট্রেস বলতে আমরা সাধারণত এই ডিসস্ট্রেসকেই বুঝি!
কেউ স্ট্রেস-এ থাকলে তার শরীরে বিভিন্ন কেমিক্যাল, নিউরোট্রান্সমিটার, হরমোন এদের ভারসাম্য গুলো ধীরে ধীরে নষ্ট থাকে। আমাদের ইমিউন সিস্টেম খুব বেশি রকম প্রভাবিত হয় স্ট্রেসের জন্যে। স্ট্রেস থেকে বিভিন্ন মানসিক রোগ (mental disorder) তৈরি হতে পারে। আবার মানসিক রোগ ছাড়াও একজন লোক যিনি স্ট্রেসে রয়েছেন তার কিছু শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ তখন প্রকাশ পায় যেমন-
মানসিক স্বাস্থ্যজনিত লক্ষণ– মনোযোগ দিতে না পারা, দুশ্চিন্তা বাড়া, ভুলে যাওয়া। অনুভূতিগত ভাবে খুব বিরক্ত থাকা, খিটখিটে মেজাজ হয়ে যাওয়া। আচরণ গত দিক থেকে নিজের যত্ন না নেওয়া, রেগে গিয়ে হঠাৎ হঠাৎ কটূক্তি করে ফেলা, নেশায় আসক্ত হয়ে পড়া।
শারীরিক লক্ষণের মধ্যে বেশি ঘাম হওয়া, হার্টরেট বেড়ে যাওয়া, ওজনের পরিবর্তন ঘটা, রক্ত চাপ বেড়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়া, যৌন চাহিদা ও ঋতুচক্র এর অনিয়মিতা তৈরি হতে পারে।
কোনও এক নতুন স্ট্রেসর এসে হাজির হলে আমরা প্রথমে নির্ধারণ করি এটি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, একে বলি হয় primary appraisal (প্রাইমারি অ্যাপ্রেইসাল)-প্রাথমিকভাবে এই স্ট্রেসের মূল্যনির্ধারণ। এরপর আমরা ভাবতে শুরু এই স্ট্রেসের সঙ্গে আমরা কী কী ভাবে মোকাবিলা করতে পারি, আমাদের কী কী প্রস্তুত রয়েছে আর কী কী নেই- একে বলি secondary appraisal (সেকেন্ডারি অ্যাপ্রেইসাল) অর্থাৎ আনুষাঙ্গিক মূল্যনির্ধারণ। এই সেকেন্ডারি অ্যাপ্রেইসাল একদিকে আমাদের coping skill (কোপিং স্কিল) মানে নতুন উপযোগী আচরণ, চিন্তা ভাবনা বিভিন্ন কার্যকরী ব্যবহারে আমাদের দক্ষ করে তোলে, যা স্ট্রেসফুল পরিস্থিতিতে কাজে লাগে অন্যদিকে যদি এই কার্যকরী কোপিং স্কিল তৈরি না হয় তাহলে ডিসস্ট্রেস এর জন্ম দেয়!
স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা রয়েছে-
(১) নিজেকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ (self-obseravtion) – এখানে নিজের ব্যবহার,আচরণ ও অনুভূতির উপর সঠিকভাবে আলোকপাত করতে হবে। ঠিক কোন পরিস্থিতি নিজের কাছে স্ট্রেসফুল হয়ে উঠল, ঠিক কোন অনুভূতি তৈরি হল-খারাপ লাগা, কষ্ট পাওয়া নাকি বিরক্ত হওয়া, তারপর কী আচরণ করেছি বা অন্য কী করা যেতে পারত! এগুলো রোজ খাতায় সময় ধরে ধরে লিখে রাখতে হবে, কমপক্ষে পরপর সাতদিন এক সপ্তাহ ধরে। এই কাজটা নিয়মিত করলে নিজের সচেতনতার মধ্যেও নিজেকে চেনার একটা বোধশক্তি তৈরি হয়। বিভিন্ন ধরণের অ্যাপ, স্মার্টফোন এর এর মাধ্যমেও এটি আজকাল করা সম্ভব।
(২) মন হালকা করার প্রশিক্ষণ (relaxation training)* – বিভিন্ন ধরণের রিল্যাক্সেশান থেরাপি আমাদের স্ট্রেসকে মোকাবিলা করতে সাহায্য করে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল deep breathing technique (ডিপ ব্রেথিং টেকনিক), abdominal breathing (অ্যাবডোমিনাল ব্রেথিং) অর্থাৎ বুকেরর বদলে পেট দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া, শরীরে বিভিন্ন মাংসপেশীর শিথিলিকরণ যেমন- নিজেকে রিল্যাক্স করার জন্যে একটা বাক্য বা অনুচ্ছেদ লেখা এবং সেই সময় শুধু হাতের মাংসপেশিগুলো কাজ করবে, তাই তার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া আর শরীরের অন্যান্য জায়গায় মাংসগুলো ধীরে ধীরে শিথিল রাখার চেষ্টা করা। বিভিন্ন গান শুনে, মেডিটেশান করেও এটা করা সম্ভব।
(৩) চিন্তা ভাবনার পুনর্গঠন (cognitive restructuring) – কিছু কিছু মানুষের কোনও পরিস্থিতি বা ঘটনা ব্যাখা করার ক্ষেত্রেই চিন্তা ভাবনার স্তরে বিভিন্ন রকমের পক্ষপাতদুষ্ট বা বিকৃতকরণ আচরণ দেখা যায় এবং তা থেকেই সমস্যার তৈরি হতে পারে। যেমন সবসময় নেতিবাচক দিকটি আগে দেখা, এক বিষয়ের উপর দাড় করিয়ে অন্য সমস্ত বিষয়কে ব্যাখা করার চেষ্টা, কোনও ছোট জিনিসকে বড় করে দেখবার প্রবণতা এগুলোকে একসঙ্গে বলে চিন্তাভাবনার বিকৃতিকরণ (cognitive distortion)। খুব ধীরে ধীরে স্ট্রাকচারড পদ্ধতিতে এগুলো পরিবর্তন করা হয়, যা সময় সাপেক্ষ ও প্রয়োজনীয়.
(৪) সুনির্দিষ্ট সমস্যা ও তার সমাধান (problem solving) – এটির প্রথম ধাপ হল নিজের আচরণ ও অনুভূতির সমস্যা গুলো শনাক্ত করা, বুঝতে শেখা ও মান্যতা দেওয়া। তারপর যতগুলো সম্ভব বিকল্প সমাধান বা উপায় ভেবে ফেলা। পরের ধাপে বিকল্প সমাধান পদ্ধতিগুলোর ফলাফল নিয়ে বিবেচনা করা এবং সবশেষে সবেচেয়ে উপযোগী ও কার্যকরী পদ্ধতিকে সমাধান সূত্র হিসেবে জটিল পরিস্থিতে প্রয়োগ করে ফেলা।
(৫) সময়ের সদ্ব্যবহার (time management) – স্ট্রেস ম্যনেজমেনটের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হল এটি। সারাদিনের একটা সুন্দরসূচি যদি আমাদের তৈরি করা থাকে তাহলে খুব সহজে এটি করা যায়। আমাদের কোন কাজটা গুরুত্বপূর্ণ (important) এবং কোন কাজটা জরুরি অর্থাৎ খুব শিগগিরি করে ফেলতে হবে (urgent) এইটা গুছিয়ে নিলেই, কোন কাজে কখন কতটুকু সময় দেবো তার একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হবে এবং সময় নিয়ে কাড়াকাড়িও কমবে।
এই পাঁচটি জায়গা বাদ দিয়েও কিছু জিনিস আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অন্তর্ভুক্ত করার দরকার রয়েছে। সারাদিনে অন্তত ৩০ মিনিট নিজের জন্যে বরাদ্দ রাখা, বেশি পরিমাণে জল, সতেজ সবজি ফল এই গুলো বেশি করে খান, নিয়মিত শরীর চর্চা, রাতে সময় করে ঘুম, সারাদিন বাড়িতে না থেকে একটু বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসা- সেরকম হলে ছাদে গিয়ে হেঁটে আসুন, নিজের অনুভূতিগুলো লোকজনকে শেয়ার করুন, জোরে হাসুন, আনন্দ করুন জীবনের ছোট ছোট আনন্দ অনেক বড় ব্যাধি আটকে দিতে পারে।
সবশেষে এটাই বলার কাজের সঙ্গে মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন, যান্ত্রিক এই সভ্যতায় স্ট্রেসহীন জীবন হবে এই আশা করাটা ভুল, আমাদের জীবনে স্ট্রেস আসবেই, আমরা কীভাবে এর সাথে যুঝতে পারছি একে মোকাবিলা করতে পারছি সেই কোপিং স্কিল শেখাটাই গুরুত্বপূর্ণ। স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট মানে তাই শুধুমাত্র কষ্ট কমানো নয় বরং আজকের অসম পৃথিবীতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সফল মূল্যায়ন করে নিজেকে আরও সক্ষম করে তোলাই এর মূল লক্ষ্য।