(এই ধারাবাহিকের একমাত্র তাত্ত্বিক রচনা—প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিসংবাদ’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর—অক্টোবর, ১৯৯৫-এ।)
২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯১-এর আগে ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশের বাইরে কম মানুষই শংকর গুহ নিয়োগীর নাম শুনেছিলেন। এই সময় নিয়োগীর নামের সাথে আরও দুটো শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলেন দেশের মানুষ—‘সংঘর্ষ ও নির্মাণ’।
সংঘর্ষ ও নির্মাণ ব্যাপারটা কি? সংঘর্ষ না হয় বোঝা গেল—সংগ্রাম? কিন্তু, নির্মাণ?
‘নির্মাণ’ নিয়ে নিয়োগীর গায়ে ‘শোধনবাদী’-র তকমা লাগিয়েছেন কেউ কেউ। কেউ বা বলেছেন নিয়োগী ‘ছত্তিশগড়ের গান্ধী’। গ্রামশি ভক্তরা আবার সংঘর্ষ ও নির্মাণের তত্ত্বে গ্রামশির চিন্তাভাবনার অনুসরণ খুঁজে বার করেছেন। (যদিও জানি, গ্রামশির কোনও লেখা পড়ার সৌভাগ্য নিয়োগীজীর হয়নি, তাঁর বিশাল পুস্তক-সম্ভারে গ্রামশির কোনও বই খুঁজে পাইনি আমরা।) বাংলার নকশাল নেতা আজিজুল হক ছত্তিশগড় শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রাথমিক ভাবে সাযুজ্যপূর্ণ কানোরিয়া শ্রমিক আন্দোলনকে নিয়ে ব্যঙ্গ-উপন্যাস (হাতি খোঁজে রাজা) লিখতে গিয়ে বারবার ব্যঙ্গের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন—সংঘর্ষ আউর নির্মাণ!
বিপ্লবী কবি সমীর রায় বলেছিলেন—‘অনেকে সংঘর্ষ ও নির্মাণের তত্ত্ব বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না।’ তাঁর মতে ‘সংঘর্ষ-নির্মাণের তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানে নতুন অবদান। মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-স্তালিন-মাওয়ের পরে সমাজবিজ্ঞানে এ তত্ত্ব নতুন আলোর দিশারী’।
১৯৮৯-এ এক সাক্ষাৎকারে নিয়োগী বলেছিলেন—‘সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য, অধিকার-অর্জনের জন্য সংগ্রাম আর ছোটো-ছোটো নির্মাণ, যা বিকল্প গড়ার ক্ষেত্রে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটাবে। আমরা এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই শোষণ-ভিত্তিক জনবিরোধী ব্যবস্থা পাল্টাবার লক্ষ্যেই সংঘর্ষ ও নির্মাণের রাজনীতির কথা আমরা বলছি’।
নিয়োগী মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী ছিলেন। তাঁর সমসাময়িক শ্রমিক নেতা এ কে রায় বলেন—‘দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের তিনধারা (অর্থাৎ সি পি আই, সি পি আই এম , সি পি আই এম এল)-র মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে শংকর গুহ নিয়োগী ছিলেন এক চতুর্থ ধারা। এই ধারা সমন্বয়ের’। অতীতের সমস্ত পরীক্ষা থেকে সারাংশ বেছে নিয়ে ছত্তিশগড়ের মাটিতে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের সৃজনশীল, সময়োপযোগী, স্থানোপযোগী প্রয়োগের প্রয়াস চালান তিনি আজীবন।
রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার বছর চল্লিশ পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের পথে হাঁটা শুরু করে। ১৯৪৯-এ চীন শোষণ-মুক্ত হওয়ার পর কুড়ি বছরও পেরোয় নি, শ্রমিক শ্রেণীর পার্টিতে বিচ্যুতি দেখে মাও ৎসে তুঙ-কে আহ্বান দিতে হয়—‘সদর দপ্তরে কামান দাগো’, শুরু হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব। মাও-এর মৃত্যুর পর চীনও সোভিয়েত ইউনিয়নের পথের পথিক। এই সব ঘটনা অন্যান্য সাচ্চা কমিউনিস্টদের মতো নিয়োগীকেও চিন্তিত করত—তাহলে পথ কি? রক্তক্ষয়ী বিপ্লব, মেহনতী মানুষের এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত ক্ষমতা কি বারবার ফিরে যাবে শোষকশ্রেণীর হাতে?
আসলে শোষক শ্রেণীকে বলপূর্বক উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা, অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ। অনেক অনেক কঠিন চেতনার পরিবর্তন। তাই শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রণী বাহিনী—কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের এক অংশে, জন-নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে পুঁজিপতি শ্রেণীর চিন্তাধারা, পথভ্রষ্ট হয় শ্রমিক রাষ্ট্র। এর বিরুদ্ধেও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালাতে হয়। মাও ৎসে তুঙ বলেন—একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব নয়, চাই হাজারো সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় পৌঁছতে।
নিয়োগীর অভিনত্ব এখানে যে, বিপ্লবের পর সাংস্কৃতিক বিপ্লব—এই ধারণা থেকে সরে এসে তিনি নতুন পরীক্ষা চালান। আগেকার নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলো থেকে তিনি অর্থনীতি পাল্টালেই সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে যাবে—এই ধারণা থেকে সরে আসেন। তাই শ্রেণীসংগ্রাম, সমাজ-পরিবর্তনের সংগ্রামের সাথে সাথেই সাংস্কৃতিক সংগ্রামের শুরুর ধারণা হাজির করেন তিনি। অর্থাৎ সংগ্রামের শুরু থেকেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শুরু।
১৯৭৭-এ ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের জন্মলগ্নের কিছুদিন পর থেকেই যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার শুরু, তা সূত্রায়িত হয়ে ‘সংঘর্ষ ও নির্মাণের রাজনীতি’ রূপে ১৯৮৭-তে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার কর্মনীতি হিসেবে গৃহীত হয়। নিয়োগী এক কোনও অভ্রান্ত তত্ত্ব হিসেবে দাবী করেন নি, বরং এক প্রকল্প (hypothesis) হিসেবে প্রস্তুত করেছিলেন।
ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার স্লোগান ছিল—‘সংঘর্ষ কে লিয়ে নির্মাণ, নির্মাণ কে লিয়ে সংঘর্ষ’। শোষণহীন সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে নিরন্তর সংগ্রাম আর সেই সংগ্রামের স্বার্থে নির্মাণ। বিপ্লব ছাড়া শোষণহীন সমাজ স্থাপন করা যায় না। কিন্তু ছোটো ছোটো পরীক্ষামূলক নির্মাণ কাজের মধ্যে দিয়ে শোষণহীন সমাজের এক একটা ছোটো অংশকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা যায়, যা দেখে মানুষ পরিবর্তনের লড়াইয়ে সামিল হওয়ার অনুপ্রেরণা পান।
দল্লী-রাজহরার পরীক্ষাগারে একের পর এক পরীক্ষা চলে—
- স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মসূচী শহীদ হাসপাতাল নতুন সমাজে স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেমন হতে পারে—চিকিৎসা-পদ্ধতিতে, স্বাস্থ্যশিক্ষায়, প্রতিষ্ঠান-পরিচালনায়, সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কে—তার ছবি তুলে ধরে।
- শিক্ষার কর্মসূচী—শ্রমিক সংগঠনের পরিচালনায় ছটা প্রাথমিক স্কুল এবং বয়স্ক শিক্ষা।
- নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রচারে ‘নয়া আঞ্জোর’ (ভোরের আলো)।
- নেশার ঘোর থেকে মেহনতী মানুষের চেতনাকে মুক্ত করতে শরাব-বন্দী আন্দোলন।
- খনিতে মেশিনীকরণের বিরুদ্ধে অর্ধ-মেশিনীকরণের বিকল্প স্থাপনের লড়াই, যাতে ভারতের মতো জনবহুল দেশে শ্রমিক-ছাঁটাই না করে উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণমান বাড়ানোর দিকনির্দেশ আছে।
- পরিবেশ আন্দোলনে বিকল্প হিসেবে ‘অপনা জঙ্গলকো পহচানো’ (নিজের জঙ্গলকে জানো) কর্মসূচী নেওয়া হয়, যা শোষণহীন সমাজের বননীতি কেমন হবে তার ধারণা দেয়।
—এমন অনেক আরও পরীক্ষা।
ছত্তিশগড়ের নির্মাণ-কাজগুলোর বৈশিষ্ট্য হল—
- গণসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বিকল্পের ধারণাগুলোকে সাকার করে তোলা হয়।
- মেহনতী জনতা প্রত্যক্ষভাবে বিকল্পগুলোকে স্থাপন ও পরিচালনা করেন।
- বিকল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ধাপে ধাপে স্থানীয় সাধনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, বহিরাগত অনুদানের ওপর নির্ভর করে নয়।
- শ্রমিক শ্রেণীর উদ্যোগে স্থাপিত বিকল্পগুলো অন্য শোষিত শ্রেণীর মানুষকে পরিষেবা দেয়।
- একদিকে বিকল্পগুলোকে দেখে মানুষ নতুন নতুন গণসংগ্রামের অনুপ্রেরণা পান, অন্যদিকে চলমান গণসংগ্রামের সঙ্গে সেগুলোর নিবিড় যোগাযোগ থাকে।
- নির্মাণ কাজগুলো নতুন চেতনার নতুন মূল্যবোধের মানুষ বানানোর কারখানা হিসেবে কাজ করে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে—শ্রেণী সংগ্রাম তীব্র হলে তো শোষকশ্রেণী রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে এই সব নির্মাণকে গুঁড়িয়ে দেবে। হ্যাঁ, প্রতিষ্ঠানগুলো গুঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু ওরা মানুষের সংগ্রামী চেতনাকে, নতুন মূল্যবোধকে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে না।
অনেকের ধারণা বিপ্লবী মানেই বুঝি লড়াই আর লড়াই। সংস্কারমূলক কাজ করার মানেই সংশোধনবাদী। তাই শোধনবাদী সংস্কারমূলক কাজ আর বিপ্লবী সংস্কারমূলক কাজের মধ্যেকার পার্থক্য বোঝা দরকার।
নিয়োগী এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। নির্মাণ কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য—স্বাস্থ্যকর্মসূচীর বর্ষপূর্তিতে যে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল, তার সারমর্ম তুলে ধরছি।
- শোধনবাদী সংস্কারের উদ্দেশ্য হল শোষিত-পীড়িত মানুষকে কিছু সুবিধা পাইয়ে দিয়ে শ্রেণী-দ্বন্দ্বকে অবদমিত করা। উল্টোদিকে বিপ্লবী সামাজিক সংস্কারের উদ্দেশ্য শ্রেণীদ্বন্দ্বকে তীব্র করা, শোষণ-ভিত্তিক ব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের ঘৃণাকে তীব্র করা। সংস্কার তার অন্তিম লক্ষত নয়, অন্তিম লক্ষ্য হল সমাজকে বদলানো। বিপ্লবী সংস্কার বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগ্রামের অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
- জনসংগ্রামের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু সমাজসংস্কারক শোধনবাদী সংস্কারের পরিচালক। বিপ্লবী সমাজসংস্কারের মূল উৎস হল শ্রমিক-কৃষকের রাজনৈতিক চেতনা, সংগঠিত শক্তি ও সৃজনশীলতা।
- বিপ্লবী সমাজসংস্কারক নিজের কর্মসূচীর অনিবার্য ব্যর্থতা সম্বন্ধে সচেতন থাকেন, কেন না যে সব সামাজিক সমস্যরা বিরুদ্ধে তাঁদের কর্মসূচী সে সব সমস্যার শিকড় থাকে বর্তমান সমাজব্যবস্থাতেই। ব্যবস্থার পরিবর্তন না করে সমস্যার সামান্যই সমাধান করা যায়।
সমাজতন্ত্রের দুর্গগুলোর একের পর এক পতন অন্য কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মতো নিয়োগীকে হতাশ করে নি। অন্যদের মতো বিপর্যয়ের কারণ খুঁজেই ক্ষান্ত দেননি তিনি, বরং বিপর্যয় মোকাবিলার রাস্তা খুঁজতে চেয়েছেন। সমাজবিপ্লবে পূর্বসূরী নেতাদের শিক্ষার আলোকে, সংগ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন ‘সংঘর্ষ ও নির্মাণ’ নিয়ে, শ্রেণীসংগ্রামের শুরু থেকে মেহনতী মানুষের চেতনা পরিবর্তনের সংগ্রাম করে নতুন মূল্যবোধের মানুষ তৈরী করতে চেয়েছেন নতুন সমাজের জন্য।
শ্রেণীসংগ্রামে নিয়োগীর অকালপ্রয়াণ সংঘর্ষ ও নির্মাণের পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু আমরা যারা সমাজটাকে বদলাতে চাই আর বদলানোর পর নতুন সমাজটাকে টিঁকিয়ে রাখতে চাই—নিয়োগীর মতো বড় মাপে না হোক, এই অসমাপ্ত পরীক্ষাকে নিজেদের সাধ্যমত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তো তাদেরই ওপর।