মেডিক্যাল কলেজে হোস্টেলে একটা জিনিস শিখেছিলাম, সিনিয়রের প্রতি অগাধ আনুগত্য। সিনিয়রের কথা অমৃত সমান, সে পড়াশোনার ক্ষেত্রে হোক বা জীবনের চলার পথে। উভয় ক্ষেত্রেই যে সিনিয়রের অন্ধ অনুসরণ নরকের পথ সুগম করে সেটা পরে অনুধাবন করেছি।
যাইহোক, ফোর্থ ইয়ারে একদিন একদল সিনিয়র ডেকে হুকুম করলো, যা ক্যান্টিনে গিয়ে দেখ ডিএসএ মিটিং করছে। তোরা সারা বছর ঘর বন্ধ করে ঘুমাস, আর ওরা সারা বছর মিটিং করে ভোটের প্রিপারেশন করছে, পরের ভোটে তোদের কোনো আশা নেই আর!! যা এখনি ওদের গিয়ে তুলে দিয়ে আয়…
সিনিয়রের কথা মুখ থেকে পড়ার আগেই আমরা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কিছু হোস্টেলের ছেলে মিলে গেলাম মিটিং থেকে মানুষজনকে তুলে দিতে। কারণ মেডিক্যাল কলেজ আমরা এমসিটিএমসিপি দলের ছাত্রছাত্রীরাই বাঁচিয়ে রেখেছি, অন্য দলের হাতে গেলেই সর্বনাশ!! গিয়ে দেখলাম আমরা কচিকাঁচার দল কথা বলতে গেছি সাদা দাড়ি, সাদা চুলের একটা লোকের মিটিংয়ের মাঝে। গেছি যখন ঝগড়াঝাটি তো করতেই হয়, নিজেদের ইয়ারের লোকজনের সাথে বাক্যবিতণ্ডা করে আমরা ফিরে এলাম। হোস্টেলে ফিরে মানস বলল ওই বুড়ো লোকটা নাকি আইয়ের হেড, আমাদের সিওর ফেল করিয়ে দেবে।
যাইহোক, পরে ডিএসএর নিজের ইয়ারের লোকেদের কাছে জানলাম, লোকটা আদৌ ভোট নিয়ে কোনো মিটিং করতে আসেনি। মেডিক্যাল কলেজের ভোটের বাইরে তার জীবনে খেয়েদেয়ে প্রচুর কাজ রয়েছে। না, তিনি আইয়ের এইচ ও ডি হিমাদ্রী স্যারের মতো দেখতে হলেও মানুষটা আলাদা 
ইনি ডা. পুণ্যব্রত গুণ, মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী এবং সমাজকর্মী।
পুণ্যদা (স্যার বললে ক্ষেপে যান) যেসময় মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করেন, ওই সময় একখান সরকারি চাকরি করে এতদিনে একখান সুন্দর ব্যাংক ব্যালান্স নিয়ে অবসর জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু সবার তো আর সুখ সহ্য হয় না। তাই তিনি কখনও ছত্তিশগড়ে, কখনও চেঙ্গাইলে শ্রমিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে চলেছেন। বুনিয়াদি স্বাস্থ্য নিয়ে চর্চা, গ্রামবাংলার মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে অবিরত কাজ করে চলেছেন।
তখন কলেজের শেষের দিক। মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তারদের খুনি বলার ধৃষ্টতা করা শুরু করেছেন। কলম তুলেছি প্রতিবাদে। সর্বস্তরে পেয়েছি শুভাকাঙ্ক্ষীদের বারণ। কেউ বলে আগে পিজি পা, তারপর বলবি, কেউ বলে আগে পিজি পাস কর, তারপর বলবি, কেউ বলে আগে ডিএম পাস কর, এখন বলছে – ফ্যমিলি ম্যান হয়ে গেছিস, সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলিস না। কী লাভ!! এই কথাটা কোনোদিন যিনি বলেন নি, তিনিই পুণ্যদা। প্রতিনিয়ত উৎসাহ যুগিয়েছেন। ডক্টরস ডায়ালগে লেখার জন্য হাঁটুর বয়সী আমার সাথে যোগাযোগ করতেন নিজে থেকে। কখনো ফেসবুকে গান দিয়েছি, সেটাও দেখি ওয়েবসাইটে স্থান পেয়েছে। আমাদের বয়সের ব্যবধান, কলেজে আমার ইউনিয়নের পরিচয় – কোনোটাই আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে অন্তরায় হয়নি।
তারপর মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ শুরু হলো। প্রতিবাদী মিছিলে, কখনও সুবর্ণ বণিক হলে ভাষা দিবসের প্রোগ্রামে। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের প্রিয় পুণ্যদা, সে পঞ্চাশ বছরের লোকেরও দাদা, কুড়ি বছরের ছোকরারও দাদা
অবশ্য এত অফুরন্ত কর্মোদ্যম যার, তার দাদা হওয়াই সাজে…
অভয়া আন্দোলনে যখন জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলন টেনে নিয়ে যাচ্ছে, অধিকাংশ সিনিয়র ডাক্তার তখন নিজের চাকরি বাঁচাতে, নিজের সংসার বাঁচাতে, নিজের প্র্যাকটিস বাঁচাতে ব্যস্ত। কেউ কেউ তো হঠাৎ নিজে বিখ্যাত হওয়ার ধান্দায় আন্দোলনের মাঝে উদয় হয়েছেন! কিন্তু আরজিকরে প্রথম দিন থেকে যাঁকে দেখেছি ধর্মতলার অনশন মঞ্চ পেরিয়ে আজও অভয়া মঞ্চের বিভিন্ন মিছিলে তিনি পুণ্যদা। আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছি হয়তো মনে মনে, দাদা লড়ে চলেছেন…
মেডিক্যাল কলেজে অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে আমরা কলেজটা তুলে দিয়েছিলাম নির্মল মাজির বেশে তৃণমূল নামক এক সর্বগ্রাসী শক্তির হাতে। দিতে চাইনি হয়তো, কিন্তু সেটা হয়তো হওয়ারই ছিল। কিন্তু আমরা তৃণমূলী ইনফিল্ট্রেশনের প্রতিবাদ করিনি, কারণ সেটা আমাদের জন্য সুবিধা হয়েছিল ইউনিয়ন ধরে রাখতে। সেই ইউনিয়ন আজ তৃণমূলকে দূর করে দিয়েছে, আমাদের সেই পাপ আজ ধুয়ে গেছে। আমরা কি কোনোদিন ভেবেছিলাম ডিএসএ কোনোদিন ইউনিয়ন পাবে!
সেরকমই আমরা আজও ভাবতে পারিনা অভয়া বিচার পাবে। কিন্তু পুণ্যদার মত কিছু মানুষ লড়ে যান ক্রমাগত এই আপাত অসম্ভবের দেওয়ালকে ঠেলে… আজ সেই মানুষটার জন্মদিন। আগামী দিনে দাদার লড়াই আরো জোরালো হোক, প্রতিবাদ আরো দৃঢ় হোক এই প্রার্থনা করি….
দাদার সাথে আমার কোনো ছবি নাই। একখান ওয়েবিনার করেছিলাম, সেটার ছবিই থাক…
২১ নভেম্বর ২০২৫ ফেসবুকে প্রকাশিত।









