২০১৫ সালে ডেবরা হাসপাতালে যখন জয়েন করি তখন হাসপাতাল এত ঝাঁ চকচকে সুপার স্পেশালিটি হয়নি। হাতে গোনা কয়েকজন স্বাস্থ্য কর্মী নিয়ে আমাদের রোজনামচায় রোগের চিকিৎসার সাথে সাথে প্রত্যাশা আর অপ্রতুলতার টানাপোড়েনেই কেটে যেত বছরভর। জ্বর থেকে জন্ডিস। সাপে কাটা থেকে মানুষে কাটা। আশু-পরিণত হাতে পূর্ণোদ্যমে চলত চিকিৎসার চেষ্টা।
এমনই এক সকালে রাউন্ডে গিয়ে দেখি বছর পনেরোর এক ছেলে কোনের এক বিছানায় শুয়ে। চুলে মোরগ ঝুঁটির নব্য কেতা। অজানা বিষ খেয়ে গতকাল ভরতি। পাশে ঠাকুমা বসে। মাথার মোরগ ঝুঁটিতে হাত বুলিয়ে সস্নেহে জিজ্ঞেস করলাম-এতটুকু ছেলে। পড়াশোনায় মন না দিয়ে চুলে এ আবার কিসের ছাঁট দিয়েছিস?
ঠাকুমা শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন-খবরদার ডাক্তারবাবু, ঐ চুল কাটা নিয়ে বকাবকির জেরেই বিষ খেয়েছে এ গুণধর। চুলে হাত দেবেন না মোটেই। বিস্ময়ে, আতঙ্কে হাত সরিয়ে নিয়েছিলাম ওর চুল থেকে।
গ্রামবাংলায় অভিমানী থেকে মনোযোগ প্রত্যাশী সকলের মরমী অস্ত্র চাষাবাদে প্রয়োগ করার বিষ। লিঙ্গ ভেদে শিকার মহিলারাই বেশি। সুদীর্ঘ এর ইতিহাস। বৈচিত্র্য তার প্রকারভেদে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিষের বোতল কেউ সঙ্গে আনেন না। ফলে কোন ধরনের বিষ খেয়েছে, তা বোঝাই দায় হয়ে ওঠে।
আমাদের অতিব্যস্ত রোজনামচায় বিষ খাওয়া রোগী যেন তাই গোদের ওপর বিষফোঁড়া। রোগের সাথে অসম লড়াইয়ের মাঝে উৎকট ঝামেলাই বটে। বিভিন্ন ধরনের বিষ। বিভিন্ন তার রোগ লক্ষ্মণ। চিকিৎসাও ভিন্ন হওয়াই কাম্য। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের পাঠ্য অনুসারে সব বিষ আমাদের চেনাও ছিলো না। তার উপর বিষের কম্পোজিশন না জেনে চিকিৎসা অনেকসময়ই অন্ধকারে কামান দাগা। উদ্বায়ী বিষ (কেরোসিন,কর্পুর), কোরোসিভ এজেন্ট (ফিনাইল,অ্যাসিড) ছাড়া প্রায় সবেতেই পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট দিয়ে গ্যাস্ট্রিক লাভাজ (স্টমাক ওয়াশ)। অ্যাট্রোপিন আর প্যাম। পরিশেষে অ্যাট্রোপিন সাইকোসিস। হাত পা বেঁধেও রাখতে বাধ্য হয়েছি অনেকসময়। নির্দিষ্ট গাইডলাইন প্রায় অপ্রতুল তখন।
এ ঝঞ্জাটের থেকে মুক্তি পেতে পড়াশোনা করলাম বিস্তর। পরিশেষে অন্যদেশের এক টক্সিকোলজিষ্টের সাথে আলাপে নির্দিষ্ট গাইডলাইন পেলাম হাতে। বিষের কম্পোজিশন জানতে পারলেই নির্দিষ্ট চিকিৎসা শুরু করলাম আমরা। অরগানোফসফরাসের ক্ষেত্রে অ্যাট্রোপিন আর প্যাম। কার্বামেটে প্যাম নয়। ডেল্টামেথ্রিনে খিঁচুনি প্রতিরোধ। এরাইথয়েডের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য চিকিৎসা। পর্যাপ্ত,পরিমিত অ্যাট্রোপিনের ব্যবহার। প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নল-জল-কলের উপযুক্ত ব্যবহার ডেবরা হাসপাতালে ম্যাজিক ঘটালো। বিষ খাওয়া রোগীর মৃত্যু প্রায় বন্ধই হয়ে এলো বলা চলে। এরপর ২০১৭ সালে এলো রাজ্যের নির্দিষ্ট গাইডলাইন। আর জি কর হাসপাতালে শুরু হলো হেল্পলাইন সার্ভিস। জেলায় জেলায় মডিউল ভিত্তিক চিকিৎসকদের ট্রেনিং দেওয়া হলো।
বিষ খাওয়া রোগীর রোগপ্রকাশ প্রতিক্ষেত্রেই ভিন্নধর্মী। অরগ্যানোফসফরাস বা কার্বামেটে চোখের মণির সংকোচন, অতিরিক্ত লালাক্ষরণ, অতিরিক্ত ঘাম। ধুতরা জাতীয় বিষে আবার ঠিক তার উলটো। তাই এ চিকিৎসায় চটজলদি হাসপাতালে নিয়ে এসে বিশেষজ্ঞের হাতে চিকিৎসা জরুরি। মুখ থেকে ফেনা কাটলে মুখ একদিকে কাত করে মুখগহ্বর যতটা সম্ভব শুকনো কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিন। বিষের কম্পোজিশন জানাতে পারলে সঠিক চিকিৎসায় প্রাণ বাঁচার সম্ভাবনা বেশি। সবক্ষেত্রে স্টমাক ওয়াশ নয়। কেরোসিন জাতীয় উদ্বায়ী বিষে স্টমাক ওয়াশ অ্যাসপিরেশান ঘটিয়ে মৃত্যু ঘটাতে পারে। অজ্ঞান অবস্থায় মুখে কিছু দিলেও এ বিপদ হতে পারে। ফিনাইল বা অ্যাসিড জাতীয় কোরোসিভ এজেন্টের ক্ষেত্রেও স্টমাক ওয়াশ ক্ষতির ব্যাপকতা বাড়ায়।
স্টমাক ওয়াশের সময় অদক্ষ হাতে নাক দিয়ে নল পরানোর সময় খাদ্যনালীর বদলে শ্বাসনালীতে নল ঢুকেও মৃত্যু হতে পারে।
প্রতিক্ষেত্রেই পরনের জামাকাপড় বদলে জল দিয়ে রোগীর শরীর ধুয়ে ফেলা উচিত। এতে চামড়া পথে বিষের শোষণ কম হয়।
জোর করে প্রস্রাব (ফোর্সড ডাই- ইউরেসিস) করিয়ে রক্তে মেশা বিষের পরিমাণ কমাতে মূত্রনালীতে ক্যাথিটার পরিয়ে ডাই-ইউরেটিকের প্রয়োগ করা উচিত।
এবার বলি গোড়ায় দমনের প্রসঙ্গে। অনুমোদিত বিক্রেতা ও অনুমোদিত ক্রেতা ছাড়া বিষের বিক্রির উপর নিয়ন্ত্রণ জরুরী। বিষের রক্ষণাবেক্ষণে ক্রেতার অতিরিক্ত নজরদারি কাম্য। চাষাবাদে বিষ প্রয়োগের সময় শরীর ঢাকা কাপড় পরা উচিত। মুখে মাস্ক। মাথায় টুপি। চোখ ঢাকা চশমা। বিষ প্রয়োগের অব্যবহিত পরেই স্নান জরুরী।
যদিও দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র দিয়েও আত্মহত্যার প্রব্তাণ কম নয়। সিঁদূর, আলতা,তুঁতে,পারদ, সীসা এমনকি মশা মারার ধপ ও খেয়ে আসতে দেখেছি। করণীয় সবক্ষেত্রেই এক। চটজলদি হাসপাতালে নিয়ে আসা। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসায় প্রা্ণ বাঁচবে নিশ্চিত।
পরিষেশে বলি, আত্মহত্যার প্রবণতা একধরনের মানসিক রোগ। প্রতিটি রোগীরই সুস্থ হবার পর মানসিক চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া একান্ত কাম্য। আর পাঁচটা রোগের মতই এ রোগও সঠিক চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সেরে ওঠে। সর্বোপরি কাছের মানুষদের সংবেদনশীলতার বিকল্প হয় না।