দিন ছয়েক হ’ল, ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা ডিঅ্যাক্টিভেট রাখতে হয়েছিল। স্ট্রেসজনিত কারণে।
ইংরেজী লেখাটা আমার কাছে দিনকয়েক আগেই পৌঁছেছিল। পরে অনুবাদ করবো ভেবে রেখেছিলাম।
নিজের স্ট্রেস দূর করবার জন্য আরেক চাপের কাহিনীই লিখে দিলাম । বড্ড বড়amela Wible লিখেছেন, The Washington Post এ।
“One million Americans lose their doctors to suicide each year.”
এর অর্থ কি? কতজন ডাক্তারের কথা উনি বললেন, বোধগম্য হয়নি আমার।
বাকি লেখাটার অনুবাদ করে লিখছি। পামেলার জবানীতেই।
———————————————-
“Healers, after all, also need healing.
পাঁচ বছর আগে আমি একজন ডাক্তারের আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর পরে তাঁর স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলাম। আঠারো মাসের মধ্যে তৃতীয় ডাক্তারের সুইসাইডের ঘটনা ঘটলো।
প্রত্যেকেরই একটাই জিজ্ঞাস্য ছিল। কেন? কেন? কেন?
আমার অনুসন্ধিৎসু মন বার বার বলছিল, আমাকে এর কারণ খুঁজে বার করতেই হবে।
আমি, কাজ শুরু করলাম। ঐ স্মরণসভায় আমি দশজন ডাক্তারের লিস্ট পেলাম, যারা আত্মহত্যা করেছে। আজ, আমার রেজিস্ট্রিতে ৭৫৭ জন ডাক্তারের নাম লিপিবদ্ধ আছে।
আমি বিভিন্ন জায়গায় এই নিয়ে কথা বলা ও লেখালিখি শুরু করলাম। রেসপন্সও পেতে থাকলাম বহু জায়গা থেকে। অনেক ডাক্তার ও মেডিক্যাল ছাত্র, যারা বিড়ম্বনার শিকার, তারা আমাকে লিখে অথবা ফোন মারফৎ । আমি নিজে একটা ডি ফ্যাক্টো আন্তর্জাতিক সুইসাইড হটলাইন খুললাম। এরকম আত্মহত্যাপ্রবণ প্রায় হাজারখানেক ডাক্তারের সাথে আমি কথা বলেছি, তাদের সুইসাইডাল নোটগুলি নিয়ে একটা বইও লিখেছি; আরো আরো অনেকগুলি ফিউনারেলৎ, অর্থাৎ মৃত্যু পরবর্তী অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছি, তাদের আত্মীয় বন্ধুদের সাথে কথা বলেছি, কোনরকমে বেঁচে যাওয়া ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেছি। এককথায়, গত পাঁচ বছরে, যতক্ষণ আমি জেগে থেকেছি, আমি এই একটাই কাজ করে গেছি। ঐ ‘কেন? কেন? কেন?’র উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে গেছি। অপরাধবোধ, হেনস্থার শিকার ও নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলার মতো কারণগুলিই সর্বাধিক। যদিও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসল কারণ আড়ালেই থেকে গেছে, সেই 1858 সাল থেকেই। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে যে ছবি আমরা দেখতে পাই, তা আজও বিরাজমান।
অনেক ডাক্তারের অভিজ্ঞতায় তার সারা জীবনে সে প্রায় আটজন ডাক্তারবন্ধুকে এইভাবে নিজেকে শেষ করে দিতে দেখেছে।
মহিলা ডাক্তারের তুলনায়, পুরুষরা এইক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে, আমার রেজিস্ট্রি যা বলছে,অনুপাতটা ১:৭ । সুইসাইডের পদ্ধতিতেও রিজিওন্যাল এবং জেণ্ডার ভেরিয়েশন রয়েছে। মেয়েরা পছন্দ করেছে ওষুধের ওভারডোজ; সেক্ষেত্রে পুরুষেরা লাইক করেছে আগ্নেয়াস্ত্র। অধিক উচ্চতা থেকে লাফিয়ে ঝাঁপ দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে নিউ ইয়র্ক সিটিতে, আর, ভারতবর্ষে দেখা গেছে সিলিং ফ্যান থেকে নিজেকে ঝুলিয়ে শেষ করার ঝোঁকটা খুব বেশি।
আমি দেখেছি, ভেনু হিসেবে, হাসপাতাল প্রাঙ্গণটাই এদের প্রথম পছন্দ। রেস্টরুমে ওভারডোজ নেওয়া, বা লাফিয়ে পড়া বা ছাদ থেকে ঝুলে পড়া বা পার্কিং লটে নিজেকে গুলিবিদ্ধ করা,সবেতেই। এর মধ্যে একধরণের আবেগ জড়িত্ রয়েছে বলে মনে হয়। নিজের প্রিয় কর্মক্ষেত্রকে ভালোবেসেই সেখানে নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার মধ্যে হয়তো কোন বার্তা রয়েছে!
বাহ্যিকভাবে সুখী, হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল, মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশতে পারে, এরকম ডাক্তারকেও এই একই পথে হাঁটতে দেখলাম। কেউ ডিজনিল্যাণ্ড থেকে জাস্ট ঘুরে এসেছে, কেউ ফ্যামিলির সবার জন্য ক্র্যুজ বুক করে এসেছে, কেউ আবার একটা জটিল অপারেশন করে হাসিমুখে নিজের টিমকে শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছে একটু আগে, অথচ ঘন্টাখানেক পরেই দেখা গেল, সে আর নেই। অপরকে হাসিয়ে আনন্দ দিয়ে নিজের হতাশা চেপে রাখতে, নীরবে নিজেকে ভোগাতে এদের জুড়ি মেলা ভার।
এদের ফ্যামিলি মেম্বাররাও রিস্কের ঊর্দ্ধে নয়। ক্যাটলিন, একজন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী, অবসাদে ভুগছিল, হিলিয়াম ইনহেল করে মৃত্যুবরণ করে। তার মা’ও একই পথ অনুসরণ করে। ক্যাটলিনের স্বামীর অনুযোগ ছিল, মেডিক্যাল স্কুল আমার অর্দ্ধেক পরিবারকে শেষ করে দিলো।
আত্মহত্যাপ্রবণ ডাক্তাররা খুব অল্পসংখ্যায় খুনিও। তিনজন ডাক্তারকে জানি, যারা নিজেকে শেষ করবার আগে নিজের কন্যাকে, নিজের বিকলাঙ্গ সন্তানকে আর প্রেমিকাকে খুন করেছে। শতকরা হিসেবে এই ঘটনা মাত্র ১%।
রোগিমৃত্যু, ডাক্তারকে বিচলিত করে। অনেক ডাক্তারই, চিকিৎসাজনিত ভুল্ভ্রান্তি না থাকলেও নিজেকে ক্ষমা করে উঠতে পারেনা, ফলশ্রুতি হিসেবে, নিজেকে শেষসীমায় ঠেলে নিয়ে যায়।
চিকিৎসাত্রুটিজনিত মামলার ফল অনেক সময় খুব ভয়াবহ হয়ে ওঠে। মানুষমাত্রেই ভুল করে। কিন্তু, একটা ডাক্তার যখন ভুল করে, যখন তাকে ভরা এজলাসে সবার সামনে তিরস্কৃত করা হয়, যখন টিভি ক্যামেরার সামনে হেনস্থা করা হয় বা সংবাদপত্রে যখন তাকে নিয়ে অপমানসূচক বিবৃতি দেওয়া হয়, সেই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারলে, ফল ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
অ্যাকাডেমিক ডিস্ট্রেস অনেকসময় কারণ হয়ে ওঠে। আশানুরূপ ফল না হওয়া, পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্টাডি, রেসিডেন্সি, প্রতিটি ধাপেই হতাশার বীজ লুকিয়ে আছে।
ডাক্তারি করতে গেলে মানুষের কটুক্তি, ব্যঙ্গ হজম করতে হয়। ঘুমের অভাব ঘটে। অনেকসময় 24 ঘন্টা বা তারও বেশি সময় একটানা খাটতে হয়, রেসিডেন্টদের আশিঘন্টা প্রতি সপ্তাহে রোগির পরিষেবা দিতে হয়। না পারলে,তাদের “অদক্ষ” তকমা লাগিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে পাঠানো হয়, সেখানে স্টিম্যুলেটিং মেডিসিন দিয়ে তাদের “দক্ষ” করে তোলা হয়। ঘুমের অভাবজনিত কারণে তাদের অনেকেই মনে করে, য, তারা নিজের অজান্তেই ভুল চিকিৎসা করে রোগির ক্ষতি করে ফেলবে। সেই আশঙ্কায় তারা নিজেদেরই শেষ করে ফেলে।
অনেক ব্রিলিয়ান্ট ও সহানুভূতিশীল ডাক্তার, পনেরো মিনিটের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া সময়ে রোগির সবকিছু দেখে উঠতে পারেনা। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এদের ‘ইনএফিসিয়েন্ট’ এবং ‘লো প্রোডাক্টিভ’ তকমা লাগিয়ে দেয়। ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলির বাড়বাড়ন্ত এবং গভর্ণমেন্ট ম্যাণ্ডেট এইসব ট্যালেন্টেড মানুষগুলিকে গুঁড়িয়ে শেষ করে ফেলে, যারা প্রকৃতই রোগিবৎসল।
বাণিজ্যিক মেডিক্যাল ইন্সটিট্যুটগুলিতে সবকিছুতেই ডাক্তারকে দোষারোপ করবার অভ্যাস আছে। পরিকাঠামোর ত্রুটি ঢাকতে ডাক্তারদের ‘Burnout’ করা হয়ে থাকে। পেশাগত মানসিক স্বাস্থ্যভঙ্গের কারণে যখন এরা শাস্তিপ্রাপ্ত হয়, তখন এরাও হোপলেস এবং ডেসপারেট হয়ে ওঠে।
যে সকল ডাক্তারদের মেন্টাল হেলথকেয়ার প্রয়োজন, তারা আবার, সে পথে পা মাড়ায়না। তাদের ধারণা, এই কথা গোপন থাকবেনা, ফলে সে সবকিছুই হারাবে। সমস্যা আরো গম্ভীর হয়ে ওঠে।
ডাক্তারদের যেটা হয়, তা হল, ‘On-the-job post traumatic stress disorder. যারা এমার্জেন্সি মেডিসিন প্র্যাকটিশ করেন, তাদের ক্ষেত্রেই এটা বেশি দেখা যায়। একজন ডাক্তার, যিনি আত্মহত্যার বিফল চেষ্টা করেছিলেন, তার কথাতেই শোনাই।
–আমার স্ত্রী একদিন আমাকে বলেছিল, এমার্জেন্সিতে মানুষের সবচেয়ে খারাপ দিনে মানুষ সবচেয়ে ভালোটাই আশা করে তোমাদের কাছে। দিনের পর দিন। আমি তবুও হ্যাপি এবং সন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু ঐ দিনটাই আমার সবচেয়ে বাজে এবং জীবনের শেষ দিন হতে যাচ্ছিল।
এক বালিকাকে একদিন এমার্জেন্সি রুমে দেখি, ওর ফ্লু হয়েছিল। ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দিই। 30 ঘন্টা পরে ওকে আবার আনা হয়। সিভিয়ার রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস। কিছু করতে পারিনি। মেয়েটি মারা যায়। আমাদের এমার্জেন্সি রুমে একটা দেয়াল লিখন আছে…এখানে যদি কোন রোগি মারা যায়, তাহলে বুঝবেন, তার সাথে আমাদের আত্মারও কিয়দংশে মৃত্যু হয়েছে…..।
আমি বাড়ি ফিরে আসি। অনেকগুলি ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করি। কিন্তু বেঁচে যাই।
আমার সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছে, ঐ মেয়েটির ঘটনাটাই একমাত্র কারণ নয়, দিনের পর দিন স্ট্রেস নিতে নিতে, আঘাত সইতে সইতে আমার মনের অবস্থা কিনারায় গিয়ে ঠেকেছিল।
এখন আমি কাজে যেতে ভয় পাচ্ছি। অথচ, এই এমার্জেন্সি মেডিসিনই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান। আমার পরিচিতি, আমার কনফিডেন্স।—
অন্যান্য সকলের মতোই আমাদের, ডাক্তারদেরও পার্সোনাল প্রবলেম রয়েছে। আমাদেরও ডিভোর্স হয়, কাস্টডি ব্যাটল হয়, infidelity অর্থাৎ প্রেমে বিশ্বাসভঙ্গ হয়, প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম নেয়, আমাদেরও আত্মীয়বিয়োগ হয়, আরো কত কী। কিছুক্ষেত্রে এইসব কারণে প্রফেশনাল বিপদ আরো বাড়ে বই কমেনা কিন্তু, আমাদেরকে বাইরে বেরোতে হয়, অন্যের সমস্যাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজের সমস্যা সমাধানের সময় হয়ে ওঠেনা দিনের পর দিন। এমনিতেই, রোগির বাড়ির লোক ডাক্তারের ব্যক্তিগত ঝঞ্ঝাটকে ধর্তব্যের মধ্যে আনতে অভ্যাস্ত নয়। আমি অবাক হয়ে যাই, নন-মেডিক্যাল লোকজন যখন বলে, যে সাধারণ লোকেদেরই মেন্টাল সমস্যা থাকতে পারে, ডাক্তারদের কী করে ঐ সমস্যা হয়?
ডাক্তারি পেশার বেশ কিছু লোক মনে করে, ‘সুইসাইড বাই ডক্টর্স’ কোন ইস্যুই নয়। একবার, আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েসন আমাকে এই নিয়ে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমিও প্রস্তুত হচ্ছিলাম। নির্দ্ধারিত সময়ের কিছু পূর্বে হঠাৎই আমার আমন্ত্রণ বাতিল করা হয় (disinvited)। আমাকে জানানো হয় যে, জনগণ এই টপিকে আনকমফর্টেবল বোধ করছে, তাই বিষয়টি আলোচনার বাইরে রাখা হল।
এতসব তথ্য জোগাড় করে তারপরে আমার বিশ্বাস যে, যদি এই বিষয়টির ওপরে আলোকপাত না করা হয়, তাহলে, এই ঘটনা আরো বাড়তেই থাকবে। আমাদের সচেষ্ট হতে হবে, অ্যাওয়ারনেস বাড়াতে হবে। কতখানি চাপের মধ্যে একজন সুদক্ষ ডাক্তার গড়ে ওঠে, সেটা মানুষকে বুঝতে হবে। মেডিক্যাল ইন্সটিট্যুটের পরিচালকমণ্ডলীকে সেইরকম পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, ডাক্তারদের স্ট্রেস ফ্যাকটর, সেই অনুযায়ী তাদের মেন্টাল হেলথের দিকে নজর দিতে হবে।
‘Do No Harm’ এই নামে একটি তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন, Emmy পুরষ্কার বিজয়ী পরিচালক রবিন সাইমন। এই ছবিটির মাধ্যমে আমরা সবাইকে এই বিষয়ে সচেতন করতে চাই।
—————————————————-
খুব ভালো। ডাক্তার বাবু দেরও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা হওয়া ভালো।