গল্পটা আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও রিকমবিন্যান্ট DNA টেকনোলজির তখনও হাঁটি-হাঁটি-পা-পা দশা। এমন পটভূমিতে, ১৯৭২ সালে, এক বাঙালি যুবক আমেরিকার পেটেন্ট অফিসে অদ্ভুত একটা পেটেন্ট দায়ের করতে এলেন।
যুবকটি নিউইয়র্কে GE কোম্পানীর রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে কাজ করেন এবং তিনি ল্যাবরেটরিতে সিউডোমোনাস গোত্রের একটি ব্যাক্টেরিয়ায় কিছু এমন জিনগত পরিবর্তন করেছেন, যাতে সেটি এই তৈলদূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর হয়। তখন অবধি জানা চার ধরনের ব্যাক্টেরিয়া যারা পেট্রোলিয়ামের জটিল হাইড্রোকার্বন ভাঙতে সক্ষম, তাদের প্রতিটির প্লাসমিড (যার মধ্যে DNA এর প্রতিলিপি থাকে)-কে এক সাথে একটি ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে এনে গেঁথে ফেললেন। ফলে, ঐ চারটে অরিজিনাল ব্যাক্টেরিয়ার স্ট্রেনের চেয়ে অপরিশোধিত তেল ভাঙতে দশ-একশো গুণ পারদর্শী নতুন এক ব্যাক্টেরিয়া পাওয়া গেল। তিনি এই নতুন ব্যাক্টেরিয়াটির নাম দিলেন সিউডোমোনাস পুটিডা (The Superbug )।
এইখানে আমরা একটু জেনে রাখি, অপরিশোধিত তেল দূষণের গুরুত্ব টা ঠিক কোথায়?
সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উপরে মানুষের নানান ক্রিয়াকলাপের কারণে তৈলদূষণের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বিভিন্ন সময়ে ট্যাংকার জাহাজের দুর্ঘটনা থেকে ছড়িয়ে পড়া অপরিশোধিত তেল বা পরিশোধিত জ্বালানি থেকে আলাস্কা, মেক্সিকো উপসাগর, গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ, ফ্রান্স, সুন্দরবন সহ বিস্তীর্ণ জায়গার মেরিন ইকোসিস্টেমের ভয়াবহ ক্ষতির নজির রয়েছে। এইধরনের দুর্ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া তেলের পরিমান কয়েকশ টন থেকে কয়েক লক্ষ টন পর্যন্ত হয়, যদিও শুধুমাত্র সংখ্যা দিয়ে ক্ষতির আসল পরিমাণ বোঝা অসম্ভব। স্থলভূমির চেয়েও সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদের উপর এই তৈলদূষণের প্রভাব অনেক গুণ বেশি ধ্বংসাত্মক। তার কারণ, এই ‘অয়েল স্পিল’ কয়েকশ নটিকাল মাইল অবধি পাতলা আস্তরণ হিসেবে ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন কী সৈকত অবধি পৌঁছে গিয়ে সামুদ্রিক পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, মাছ, প্ল্যাংকটন ও অন্যান্য জীবকে মেরে ফেলতে পারে।
শুনতে আশ্চর্য লাগবে, ২০০৪ সাল থেকে লুসিয়ানা উপকূলের ১২ মাইল দূরে হারিকেন ঈভানে ডুবে যাওয়া একটি তৈল উৎপাদক প্ল্যাটফর্ম থেকে দৈনিক ৩০০-৭০০ ব্যারেল তেল লিক হয়ে সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়ছে এবং অনুমান করা হচ্ছে গোটা একুশ শতক জুড়ে এটির তেল ছড়িয়ে পড়া অব্যাহত থাকবে।
যাইহোক, আমরা ফিরে যাই সেই মোড়ে, যেখানে গল্পটা ছেড়ে এসেছিলাম।
তো, জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড সেই ‘Oil-eating’ ব্যাক্টেরিয়াটির আবির্ষ্কতা হিসেবে বাঙালি যুবাকে রেখে GE কোম্পানির তরফে আমেরিকান পেটেন্ট আপিসে আপিল করা হল।
এই পেটেন্টের আবেদনে মূল দাবি ছিল তিনটি।
এক, তিনি কী ভাবে ব্যাক্টেরিয়া টি তৈরি করেছেন অর্থাৎ প্রক্রিয়াটির পেটেন্ট;
দুই, প্রক্রিয়ার কাঁচামাল অর্থাৎ, ব্যাক্টেরিয়া এবং ক্যারিয়ার মেটেরিয়াল দিয়ে তৈরি ইনোকুলামটির পেটেন্ট;
তিন, উৎপাদিত মডিফাইড ব্যাক্টেরিয়ার স্পিশিস টির পেটেন্ট।
প্রথম দুটি দাবি পেটেন্ট দেবার জন্য গৃহীত হলেও তৃতীয় দাবিটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। কারণ, তৎকালীন পেটেন্ট আইন অনুযায়ী প্রকৃতিতে মেলে এমন কোন জীবিত জিনিস পেটেন্ট করা যেত না।
Board of Patent Appeals & Interference -এও খারিজ হয়ে গেল আবেদন। পাল্টা আবেদন গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ও পেটেন্ট আপিল আদালতে। সেখানে রায় গেল বাঙালির পক্ষে। এবার, পেটেন্টস এবং ট্রেডমার্ক কমিশনার সিডনি এ. ডায়মন্ড ঐ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করলেন। ১৭ই মার্চ, ১৯৮০ তে সুপ্রিম কোর্ট “Diamond v. Chakrabarty” কেসের শুনানি শুরু করলেন এবং ১৬ই জুন, ১৯৮০ তে সেই মামলার নিষ্পত্তি হল এক ঐতিহাসিক রায়ে৷ আদালত বাঙালি গবেষকের পক্ষে রায় দিলেন এই বলে যে, “A live, human-made micro organism is patentable subject matter under 35 U.S.C.$101. Respondent’s micro-organism constitutes a “manufacture” or, “composition of matter” within that statute.” ১৯৮১, ৩১শে মার্চ…দীর্ঘ ৯ বছরের লড়াই শেষে USPTO বাধ্য হলো বাঙালি গবেষকের আবিষ্কার কে পেটেন্টের স্বীকৃতি দিতে। রাতারাতি আন্তর্জাতিক খ্যাতির আলোকবর্তিকায় পৌঁছে গেলেন ঐ গবেষক।
পেটেন্টের ইতিহাসে এই লড়াই একটা ল্যান্ডমার্ক, কারণ পরবর্তী কালে আরও অনেক জেনেটিক্যালি মডিফাইড অণুজীব বা অন্যান্য জীবের পেটেন্ট পাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছিল এই রায়ের মাধ্যমে। সারা পৃথিবীর মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পেটেন্টের জগতে ঘটে যায় এক মৌলিক পরিবর্তন।
অনেকেই এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন কে সেই গবেষক? হ্যাঁ, প্রোফেসর আনন্দমোহন চক্রবর্তীর কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ।
শ্রী আনন্দ চক্রবর্তী, মাইক্রোবায়োলজি এবং ইমিউনলজির বিশিষ্ট অধ্যাপক, গত মাসের ১০ তারিখে পাড়ি দিলেন না ফেরার দেশে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২। বীরভূমের সাঁইথিয়ায় জন্ম। কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স ও পিএইচ ডি। ১৯৬৫ সালে বায়োকেমিস্ট্রিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করার পরে পাড়ি জমান University of Illinois Urbana-Champaign (UIUC)। স্ত্রী কৃষ্ণাও তখন সদ্য ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিস থেকে পি এইচ ডি শেষ করেছেন। UIUC তে প্রোফেসর ইরভিন গুনসালাসের ল্যাবেই সিউডোমোনাস ব্যাক্টিরিয়ার প্রতি তাঁর আগ্রহের সূচনা। পরবর্তী ৫০ বছর ধরে এই ব্যাক্টেরিয়াটির ওপরেই একের পর এক দুর্দান্ত গবেষণার কাজ চালিয়ে গেছেন তিনি।
আরবানায় ছয় বছর শেষে ডঃ চক্রবর্তী নিউইয়র্কে প্রখ্যাত জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানীতে যোগ দেন। তারা তখন এনভায়রনমেন্ট মাইক্রোবায়োলজির গবেষণার দিকে প্রথম পদক্ষেপ শুরু করেছে। তৈলদূষণ রোধকারী বায়ো-এজেন্ট হিসেবে এই ল্যাবেই ডঃ চক্রবর্তী তৈরি করেন ব্যাক্টেরিয়াটি। বাকি গল্প আগেই বলা হয়ে গেছে।
১৯৭৯ এ প্রোফেসর চক্রবর্তী ইলিনয় কলেজ অব মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন এবং ২০১৮ সালে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা কমিটি ও পেটেন্ট ল কমিটিরও প্রধান ছিলেন।
মনুষ্য দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ রোধের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর ৬০ বছরের প্রভূত গবেষণা বিজ্ঞানকে ঋদ্ধ করেছে। ব্যাক্টেরিয়া থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রোটিনের ক্যান্সার, ভাইরাস বা অন্যান্য পরজীবী প্রতিরোধের ক্ষমতা তুলে ধরেছেন তিনি। তিনি সিউডোমোনাস অরুজিনোসা ব্যাক্টেরিয়াটি থেকে Azurin নামে একটি প্রোটিন আবিষ্কার করেন, যার টিউমার প্রতিরোধী ক্ষমতা আছে। এই কাজ কেমোথেরাপির এক উল্লেখযোগ্য দিক উন্মোচনে সহায়তা করে।
২০০৭ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন।
তাঁর অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীরা জগৎ জুড়ে বিভিন্ন ল্যাবে তাঁর কাজ ও চিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। অণুজীববিজ্ঞান এবং জৈব রসায়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই বাঙালি বিজ্ঞানীর অবদান বর্তমান ও ভাবী প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষকদের কাছে অনস্বীকার্য হয়ে রইবে।
ছবি :
১. প্রোফেসর আনন্দ মোহন চক্রবর্তী
২. মেক্সিকো উপসাগরে তৈল দূষণে মৃত ডলফিন
৩. তৈল দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত সামুদ্রিক পাখি