আরজিকর মেডিকেল কলেজের আজকের আন্দোলন ক্যাম্পাস গণতন্ত্রের আন্দোলন, এই আন্দোলন পশ্চিমবাংলার সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষকে পাশে চায়।
শুনেছিলাম আরজিকর মেডিকেল কলেজে ছাত্র-ছাত্রী ও জুনিয়র ডাক্তারদের যে আন্দোলন চলছে তা নাকি তৃণমূলের দুই লবির মধ্যেকার দ্বন্দ্বের ফল। এমনটা হয়তো শুনেছেন আপনারাও। আর সে কারণেই আন্দোলন থেকে দূরত্ব বজায় রাখছেন।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম ও জয়েন্ট প্লাটফর্ম অফ ডক্টরস ওয়েস্ট বেঙ্গল-এর পক্ষ থেকে আমরা আরজি করে যাতায়াত শুরু করি দিন দশ পনেরো আগে থেকে। আর ভুল ভেঙে যায়। দেখি যে ছাত্র-ছাত্রী এবং জুনিয়র ডাক্তারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মাস তিনেক আগে থেকে আন্দোলন শুরু করেছিলেন হোস্টেল কমিটি, স্বচ্ছ স্টুডেন্টস কাউন্সিল, হাউসস্টাফশিপ নির্বাচনে স্বচ্ছতা এবং মেয়েদের হোস্টেলে সুস্থ পরিবেশ মূলত এই চারটি দাবি নিয়ে। সাধারণ দাবি-দাওয়া নিয়ে এই আন্দোলন এক অচলায়তনের সম্মুখীন হয়, যার নাম প্রিন্সিপাল।
প্রিন্সিপাল কলেজে নাকি পুলিশ নিয়ে ঘোরেন, তাঁর ওঠানামার লিফট আলাদা, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হলে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়, দেখা করতে গেলে শিক্ষক চিকিৎসকদেরও দু-তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। আলোচনায় উত্তেজিত হলে তিনি নাকি চার অক্ষর পাঁচ অক্ষরের বাক্যবাণ ছোড়েন।
তাই দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করার জন্য ও আন্দোলনরতদের সামনে আন্দোলন জোরদার করা ছাড়া উপায় থাকে না। তেসরা অক্টোবর থেকে অনশন শুরু হয়। অনশন ভাঙার জন্য বাড়িতে খবর দেওয়ার নাম করে দু গাড়ি এক গাড়ি পুলিশ পাঠানো শুরু হয়। পুলিশ গিয়ে হুমকি দেয় ছেলে বা মেয়ে অনশন থেকে না উঠলে বাবা-মা শাস্তি পাবেন।
প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা প্রিন্সিপাল ও কলেজ কাউন্সিলের সদস্যদের ঘেরাও করে 9 অক্টোবর। প্রিন্সিপাল ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পোস্টার ছিঁড়ে ছুড়ে মারেন অনশনকারীদের দিকে। পরের দিন ভোররাতে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঘুমন্ত অনশনকারীদের জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দৌড়ে পালান। এরপর প্রিন্সিপাল অপসারণের দাবি ছাড়া আন্দোলনকারীদের কাছে কোন উপায় ছিল না।
এরপরে শিক্ষক চিকিৎসকদের একাংশ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বার বার দেখা করে বলতে থাকেন অনশন তুলে নিতে, প্রিন্সিপাল অপসারণ ছাড়া তাদের বাকি দাবি মেনে নেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য ভবনে ডিরেক্টর অফ মেডিকেল এডুকেশনের আহ্বানে মিটিং হয়, সেখানে কলেজ কাউন্সিলের প্রতিনিধি এবং আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি ছাড়া উপস্থিত ছিলেন রোগী কল্যাণ সমিতির সভাপতি বিধায়ক চিকিৎসক। সেখানে আজকের মূল দাবি অর্থাৎ অধ্যক্ষ পরিবর্তনের দাবি নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না।
এরমধ্যে ছাত্র-ছাত্রীরা আরজিকর মেডিকেল কলেজের পাশে বেলগাছিয়া ব্রিজের উপর ফুটপাথে মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানান। যান চলাচল বা পথচারীদের চলাচলে কোন ব্যাঘাত না ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণ এই প্রদর্শনে হামলা করে শাসক দলের স্থানীয় গুন্ডারা।
আন্দোলনকারীদের পাশে সিনিয়র ডাক্তারদের সংগঠনগুলি এবং অন্যান্য মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও জুনিয়র ডাক্তাররা দাঁড়াতে থাকেন। এবার ভয় দেখানোর জন্য আলাপ আলোচনার নামে মোহিত মঞ্চে এক সভায় ডেকে পাঠানো হয় আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের। সেই সভায় প্রশাসনের প্রতিনিধি নয়, শাসকদলের এক চিকিৎসক সংসদ এবং চার বিধায়ক উপস্থিত ছিলেন, বিধায়কদের মধ্যেও দুজন চিকিৎসক, একজন আবার মেডিক্যাল কাউন্সিলের উচ্চ পদাধিকারী। সেই উচ্চ পদাধিকারী শিক্ষানবিস ডাক্তারদের ভয় দেখান যে আন্দোলন করলে রেজিস্ট্রেশন নাম্বার আটকে দেওয়া হবে।
17 ই অক্টোবর এর এই বৈঠক থেকে ফিরে এসে আলাপ-আলোচনা করছিলেন আন্দোলনকারীরা। সেখানে সংহতি জানানোর জন্য তাঁরা আহবান করেন জয়েন্ট প্ল্যাটফর্মের প্রতিনিধিদের। দুজন প্রতিনিধি অল্প সময় তাঁদের সাধারণ সভায় থেকে সমর্থন জানান। পরের দিন এক তৃণমূল নেতা এই দুই প্রতিনিধির বিরুদ্ধে টালা থানায় অভিযোগ জানায় যে এঁদের উস্কানিতেই আন্দোলন উঠছে না না হলে নাকি সমঝোতা হয়েই গেছিল।
আসলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ভাঙার একটা উপায় ভীতি প্রদর্শন। ভীতি প্রদর্শন করে যে ভয় দেখানো যায়না তা প্রমাণ করে দিয়েছেন সিনিয়র ডাক্তাররা। জয়েন্ট প্লাটফর্ম অফ ডক্টরস এর পাঁচটি সংগঠন–অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ, ডক্টরস ফর ডেমোক্রেসি এবং হেলথ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও মেডিকেল কলেজ রেসিডেন্ট ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন, ইউনাইটেড ডক্টরস ফেডারেশন, মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার এবং বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও জুনিয়র ডাক্তাররা সেদিনই অর্থাৎ 18 ই অক্টোবর বিকাল চারটায় জমায়েত হন অনশনস্থলে। প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগকে উপেক্ষা করে চিকিৎসক সমাজের এই সমর্থন আন্দোলনকারীদের মনোবল আরো মজবুত করে।
আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের এবং সংবাদমাধ্যমের প্রচার যে আন্দোলনের জন্য নাকি সাধারণ মানুষের পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে। তাঁরা এই কথা বলছেন না যে আন্দোলন যখন চলে না তখনো মানুষ প্রয়োজনীয় পরিষেবা পায় না। আর আন্দোলনে আছেন প্রধানত ইন্টার্নিরা, পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনিরা কিন্তু পরিষেবা চালিয়েই যাচ্ছেন, পরিষেবা দিচ্ছেন সিনিয়র ডাক্তাররাও। আর চিকিৎসকরা জানেন তাঁদের আন্দোলনের শেষ অস্ত্র কর্মবিরতি, যে অস্ত্রকে যখন তখন ব্যবহার করা যায় না। তাই তাঁরা কর্মবিরতির সময়ও প্যারালাল আউটডোর চালান, এমার্জেন্সি স্কোয়াড গঠন করেন।
সেদিনের সভায় উপস্থিত সবাই বিজয় অব্দি আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া শপথ নেন, পাশাপাশি রোগীদের কিভাবে পরিপূর্ণ পরিষেবা দেওয়া যায় তা নিয়েও পরিকল্পনা শুরু করেন।
বর্তমানে আমরণ অনশনে পাঁচজন, একজন জ্বর নিয়ে আজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
আরজি করে পরিষেবাও চলছে, চলছে আন্দোলনও।
শাসক পক্ষ বলছে ছাত্র ছাত্রীদের দাবি মেনে অধ্যক্ষকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই যে 2018 র মেডিকেল কলেজের হোস্টেল নিয়ে আন্দোলনে যখন সমাধান সম্ভব হচ্ছিল না তখন কিন্তু অধ্যক্ষ ডা উচ্ছল ভদ্রকে সরিয়ে ডা অশোক ভদ্রকে অধ্যক্ষের পদে বসানো হয়, তিনি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সমঝোতা করেন। এমনটা আরজি করে না হওয়ার কোন কারণ নেই।
2018-র মেডিকেল কলেজের আন্দোলন বা 2019-এর এন আর এস -এর আন্দোলন বিজয়ী হতে পেরেছিল কেননা সে দুটি নিজ নিজ কলেজের সীমানা থেকে বেরিয়ে বাংলার গণতন্ত্র প্রিয় মানুষের আন্দোলন হয়েছিল।
তেমনটা চাই আরজি করেও, অচলায়তন ভাঙার জন্য সিনিয়র ডাক্তার জুনিয়র ডাক্তার মেডিকেল ছাত্র অন্যান্য কলেজের ছাত্র-ছাত্রী সাধারণ মানুষ সবার ঢেউ চাই। সেই ঢেউএর ধাক্কাতেই বাধার পাহাড় ভেঙে পড়বে।
বাংলার মানুষকে, বিশেষ করে কলকাতার গণতন্ত-উচ্চারী মানুষদের, এই ন্যায্য আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে হবে। সম্মিলিত এই তৃতীয় পরিসর আজ ভীষণ জরুরী।
আবার মানুষের আন্দোলনের পাশেও ডাক্তারি পড়ুয়া বা ডাক্তারদের দাঁড়াতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা যথেষ্ট মার খেয়েছে। আমরা নিস্পৃহ থেকেছি। এই বিভাজন সরকার এবং রাষ্ট্র একান্তভাবে চায়।
পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষের সংখ্যা সংখ্যা হাতের কড় গুনে বলা যায়।প্রত্যেকেই এক একটা সুবিধাবাদী দলের অনুগামী।এবং তারা সেই দলের অ্যাজেন্ডাটাই গণতন্ত্রের ধ্বজা বলে’ মনে করে।
প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাঁওতাবাজি করে’ সাধারণ মানুষকে দরিদ্রতর করে’ রাখা,যাতে মানুষ আস্তে আস্তে সমস্ত ইজ্ম থেকে দূরে গিয়ে ক্ষুধাইজম আর ক্রমশঃ পশ্চিমী ক্ষুদ্র সংসারটুকু নিয়ে কিছু ভাবতে ভুলে যায়।