বাঁকুড়ার গ্রামের ছেলে শুভজিৎ। জয়েন্ট এন্ট্রান্সে প্রথম একশোয় র্যাঙ্ক করে মেডিক্যাল কলেজে পড়তে এসেছিল। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে প্রথম একশোয় আসতে গেলে যেটা লাগে তাকে মেধা বলে না, আগুন বলে। তাদের কেউ চামচে করে পড়াশোনা খাইয়ে দেয় না। বাকি পৃথিবীকে তাদের আঁচের হদিশ দেবে বলে তারা জ্বলে ওঠে। শুভজিৎ-ও তেমনি। একটু মুখচোরা। আপাতভাবে নজরে পড়ে না।
খুব বেশি হৃদ্যতা ছিলো এমনটা নয়। দু’ব্যাচের জুনিয়র। মেডিক্যাল কলেজের মেইন হোস্টেলটা অনেকটা ইংরেজি ‘E’ আকৃতির। ‘E’-র প্রথম বাহুটা একটু ভেতরের দিকে ঢুকে এসেছে। সেই ভেতরের দিকে ঢুকে থাকা অংশটায় শুভজিৎ থাকতো। সম্ভবত তিনতলায়। কখনও-সখনও রুমে যাওয়া আসা। দেখা হ’লে টুকটাক কথা হতো। একটা লাজুক হাসি ঝুলে থাকতো সবসময়। এক হোস্টেলে বেশ ক’বছর…
ডাক্তারি পাশ করার পর হঠাৎ করেই জীবনের গতি বেড়ে যায়। ততদিনে আন্ডারগ্রাজুয়েট হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছি। পোস্টগ্রাজুয়েট হোস্টেলে থেকে স্নাতকোত্তরের প্রস্তুতি নেওয়া। শিশু-চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা করতে ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড হেলথে চলে আসি। শুভজিৎ দিল্লী থেকে শারীরবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করে। ফোনে কিংবা মেসেঞ্জারে মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প কথা হয়। পরিচিত কোনও বাচ্চা অসুস্থ হলে আমার পরামর্শ নেয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে সচেতনতামূলক বিভিন্ন লেখালেখি করে শুভজিৎ। অপবিজ্ঞান আর অজ্ঞতার ভরা অন্ধকারে আলো জ্বালানোর লোকের বড্ড অভাব। শুভজিৎ সেই কাজটা করার চেষ্টা করে। লেখার পর কোথাও ছাপানো বা পোস্ট করার আগে আমাকে পাঠায়। কৃমি সংক্রমণ, স্কেবিস, জলবসন্ত ইত্যাদি নিয়ে লেখা পাঠিয়েছে। কোথাও ভুল হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করে। আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য মতো বলে দেওয়ার চেষ্টা করি। বলেছে “দাদা, তোমার থেকে অনুপ্রেরণা পাই।” আরও জানিয়েছে, এবার মন দিয়ে বাঁকুড়ায় নিজের গ্রামে জেনারেল প্র্যাকটিস করা শুরু করবে।
****
একটু ভুল লেখা হ’ল। এর সবটাই এখন অতীত। ‘আছে’ নয়, ‘ছিল’। শুভজিৎ আর নেই। ঠিক কী কারণে সে নিজেকে শেষ করে দিলো এখন সেসব কারণ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। শেষ বছরদেড়েক সেরকম যোগাযোগ ছিল না। গতকাল সকালে মেডিক্যাল কলেজের বন্ধুদের গ্রুপে খারাপ খবরটা পেয়ে চমকে উঠেছিলাম! শুভজিৎ…!!
অনেকেই ভাবেন, ডাক্তার হলে আর চিন্তা কী? কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স, হাইফাই লাইফ স্টাইল! অন্ততপক্ষে চল্লিশ বছর বয়সের আগে একজন জুনিয়র ডাক্তার কী পরিমাণ পরিশ্রম করেন এবং কী বেতন পান, সেটা জানলে অনেকেরই চোখ কপালে উঠবে। বাড়ির সাথে প্রায় সম্পর্ক ছিন্ন করে দ্বীপান্তরে বাস। নিজের জন্য সময়ের বড্ড অভাব। খাওয়া-দাওয়ার অবস্থা তথৈবচ। দুপুর গড়িয়ে খেতে বসতে বসতে ভাত ঠান্ডা, শক্ত হয়ে যায়। পান থেকে চুন খসলে এমনকি না খসলেও পদে-পদে গর্দান হারানোর ভয়। পাড়ার দাদা, লোকাল নেতা, গুগলপক্ক বাড়ির লোক… খাঁড়া উঁচিয়ে সব্বাই। অসংখ্য যন্ত্রণা, অগণিত মৃত্যু ছুঁয়ে দেখা। হার্ট পাম্প, অ্যাড্রিনালিন, স্যালাইন, শ্বাসনালীতে নল পরানো… যন্ত্রের মতো কাজ। কেউ ফেরে। কেউ ফেরে না। খসখসিয়ে ডেট সার্টিফিকেট লিখে এসে জুনিয়র ডাক্তার কী অবলীলায় চা সিঙ্গাড়া খায়। রাত্রে চাঁদ উঠে। নিদ্রামগ্ন পৃথিবীর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে জুনিয়র ডাক্তার রাত জাগে। তারপর পারিবারিক জীবনের টানাপোড়েন। আর পাঁচজনের মতোই।
শুভজিৎ-এর চলে যাওয়ায় আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের এক কানাকড়িও বদলাবে না। তথ্য জানাবে, ডাক্তারদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সাধারণ জনগণের তুলনায় আড়াই গুণ।