আজকাল অনেক কিছুরই বিন্দুবিসর্গ মাথায় ঢুকছে না। হতে পারে, দোষটা আমার মস্তিস্কেরই। কারণ, বাকি সকলেরই নিশ্চয়ই মাথায় ঢুকছে। সরকারের বড় তরফ, ছোট তরফের এক একটা কর্মকাণ্ড দেখছি আর প্রায় ভিরমি খাচ্ছি..অথচ, জনগণ কি সুন্দর রাম-রহিম এর মাহাত্ম্য বা অপমাহাত্ম্য নিয়েই বিভোর..!! যাহোক, সর্বশেষ হোঁচট খেলাম গতকাল স্বাস্থ্য দফতরের দুই উচ্চ পদস্থ আধিকারিক (DHS এবং DME, দুজনে আমলা হলেও ডাক্তার)এর সই করা এক বিজ্ঞপ্তি….’সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে অবশ্যই স্বাস্থ্যসাথী কার্ড লাগবে..’। তারা অবশ্য জানাচ্ছেন, পশ্চিম বাংলার ২•৩ কোটি পরিবার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড পেয়েছেন। ২০১১ লোকগণনায় আমাদের রাজ্যে পরিবারের সংখ্যা ছিল ২•০৪ কোটি। আগের দুই দশকে সংখ্যাটা বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ২৫ ও ২৯ শতাংশ। কিছু মানুষের CGHS, West Bengal Health Scheme বা ESI কার্ড আছে। সব কিছু হিসাব করলে, দেখা যাচ্ছে প্রায় সব পরিবার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড পেয়ে গেছে। তাহলে, সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা পরিষ্কার দুটি বিষয়ে.. উদ্দেশ্য(purpose) এবং সম্ভবপরতা(feasibility) সংক্রান্ত।
স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প শুরু হয় ২০১৬ সালে,পরিবার পিছু বার্ষিক ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমার জন্য.. যেখানে Premium সরকারই দেবে। প্রাথমিক ভাবে বিমা সংস্থার মাধ্যমেই এই প্রকল্প চলতো। বিভিন্ন সময়ে National Insurance, United India Insurance, Bazaz Allianz, IFFCO-TOKYO, Oriental Insurance এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু, ভোটের আগে কোনও কোম্পানীর সহায়তা ছাড়াই সরকার সরাসরি (direct) payment এর রাস্তায় যায়। প্রকল্প শুরুর সময়ে targeted population ছিল lower income group, যা ভোটের আগে সার্বজনীন রূপ পায়। ফলতঃ, বর্তমানে সরকারি তহবিল থেকে নানা টালবাহানা সত্বেও সরকারের স্বাস্থ্যসাথী খাতে দৈনিক খরচ প্রায় ৮ কোটি বা মাসে আড়াই শ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বার্ষিক আনুমানিক তিন হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে কয়েকটা ‘খটকা’ আছে। ২০২১-২২ এ স্বাস্থ্যখাতে গ্রামীণ পরিষেবায় বরাদ্দ ২৮৩২ কোটি টাকা এবং শহরাঞ্চলের জন্য ৪৯৩২ কোটি টাকা। এর থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে গেলে, কতটা পড়ে রইলো? যদিও, বাজেট বক্তৃতায় কোভিড infrastructure নির্মাণ ও স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের জন্য ৩৮০০ কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা পূর্বোক্ত বাজেট পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত না বাইরে, সেটা ঠিক পরিষ্কার নয়।
কিন্তু, তাহলে সরকার চাইছে কি? যে, স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে ধীরে সুস্থে হাত তুলে নিতে? উৎসাহ দিতে বা পরোক্ষে বাধ্য করতে মানুষকে বেসরকারি পরিষেবার দ্বারস্থ হতে? ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমা বিনা প্রিমিয়ামে পেয়ে যারা অতি উল্লসিত, তারা কি ভেবে দেখবেন যত অভিযোগই থাকুক, বিনামূল্যে standard treatment এর যে সুবিধা এতকাল ধরে পশ্চিম বঙ্গের মানুষ পেয়ে এসেছে, তার অবলুপ্তি না হলেও সীমিতকরণ (restricted) হলে, ফলাফল কি আদৌ শুভ হওয়া সম্ভব??
দু একটা বাস্তব সমস্যার কথাও উল্লেখ করা উচিত। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার রোগীর একটা বড় অংশ ভর্তি হয় এমার্জেন্সি মারফত। জরুরি প্রয়োজনে আসা রোগীর স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থাকলেও সঙ্গে নিয়ে আসা সবসময়ে সম্ভব? কার্ড থাকলেও তার তথ্য বিবিধ কারণে সংগ্রহ করা সম্ভবপর নাও হতে পারে। অনেক জায়গাতেই তো ‘নেট’ পরিষেবার সমস্যা প্রায়শই ঘটে। বলা হয়েছে, কার্ড না থাকলে কার্ড বানিয়ে দেওয়া হবে। কার ভিত্তিতে? আধার কার্ড? আধার কার্ডের নম্বর কজনের মনে আছে?স্মার্ট ফোনে অনেকে save করে রাখে। সেটা না থাকলে বা স্মার্টফোনই না থাকলে?? বাস্তবিকপক্ষে, গোটা admission process টাই অতি জটিল এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো.. সময়সাপেক্ষ হয়ে উঠবে। আমাদের স্বাস্থ্যকর্তারা emergency duty কতদিন আগে করেছেন জানি না..কিন্তু যারা বহু বছর ধরে করেছেন বা করছেন, তারা জানেন এমার্জেন্সিতে প্রতিটি মূহুর্ত কত মূল্যবান। এমনিতেই, রোগী এমার্জেন্সি তে আসা এবং ফলপ্রসূ(effective) চিকিৎসা শুরু হওয়ার যে অন্তর্বর্তী সময়, তা অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন কারণে প্রলম্বিত। এটাকে আরও টেনে বাড়ালে কিন্তু তার ফলাফল হতে পারে মারাত্নক।
তাছাড়া, এত কাণ্ড করে সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দেখিয়ে ভর্তি করে তারপর কি হবে? হাসপাতাল প্যাকেজ অনুযায়ে টাকা কাটবে? পরিবার পিছু তো বছরে বরাদ্দ মোট ৫ লক্ষ টাকা। সেটা শেষ হয়ে গেলে? সরকারি হাসপাতালে অনেক ক্ষেত্রেই তো costly treatment বিনা পয়সায় হয়। ৫ লক্ষ টাকার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলে? টাকা না থাকলে চিকিৎসাই হবে না সরকারি/বেসরকারি দ্বিবিধ ক্ষেত্রেই??
আরও কয়েকটা জিনিস বলা উচিত..
• অন্য রাজ্য থেকে কোনও কারণে আসা মানুষ এই রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাবে না?
• পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয় অসুস্থ ব্যক্তিদের অনেক সময়েই হাসপাতালে নিয়ে আসে ভর্তির জন্য। এখন কি হবে?
• বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে দুর্ঘটনাজনিত এমার্জেন্সিতে প্রাথমিক পরীক্ষা পাঁচ হাজার টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সেক্ষত্রে, অর্থ না থাকলে refusal এর ঘটনা আরও বাড়বে (এমনিতেই যথেষ্ট বেশী)।
স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিমার ভূমিকা অনেক উন্নত দেশেই স্বীকৃত। কিন্তু, তার জন্য দরকার যথেষ্ট প্রস্তুতি এবং স্বচ্ছতা (transparency)। ইচ্ছে মতো রাতারাতি নোটিস দিয়ে এতদিন ধরে চালু পদ্ধতিকে খুশিমত পাল্টিয়ে দিলে আর যাই হোক, মানুষের কল্যাণ হওয়া সম্ভব নয়। তবে, কি আর করা যাবে.. সবই তো দয়া করে দেওয়া হচ্ছে। Beggars আর কবে থেকে choosers হলো? তাই, মানুষ যা পাচ্ছে তাতেই খুশী। আর, আর যাদের প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার কথা তারা সবাই পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতেই ব্যস্ত!!! সুতরাং…..
একটাই প্রশ্ন খোঁচা দিচ্ছে। ‘কাগজ নেহি দেখায়েঙ্গে’ আন্দোলনের তাহলে কি হলো? এ তো কাগজ ছাড়া ন্যূনতম চিকিৎসাও মিলবে না। ঘুড়িয়ে কি NRC চালু হয়ে গেলো???