গ্রীষ্মের চরম দুপুর। ডেবরা গ্রামীণ হাসপাতালের ইমারজেন্সী বিভাগে সেদিন নিরন্তর রোগীর ভিড়। বুকে ব্যথা, পিলের জ্বর, পান্ডুরোগ থেকে শুরু করে সাপে কাটা আর মানুষে কাটা, সঅঅব। ঘটনাচক্রে একা কুম্ভ আমি।মগজাস্ত্রের অবসন্ন প্রয়োগের মাঝেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন বছর তিরিশের এক উদবিগ্ন ভদ্রমহিলা। সাথে অসমবয়সী প্রৌঢ় স্বামী।
“ডাক্তারবাবু,গতকাল রাত্রে খাবার পর হঠাৎই চেয়ারে এলিয়ে গেলেন। পুরো শরীর সাদা হয়ে গেল। চোখের মণি উপরে উঠে উনি তো পুরো নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমার তো ধড়ে প্রাণ ছিলো না। তারপর কিছুক্ষন পর চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে সব আবার ঠিক হয়ে গেল”।
অভ্যস্ত হাতে প্রৌঢ়ের প্রেশার মাপতে মাপতে স্বভাববিরুদ্ধ বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম- তো কাল রাতে আনলেন না কেন? ভদ্রমহিলা আমতা আমতা করে বললেন- বাড়ির অমতে বিয়ে। কেউ সাথে থাকে না।
এদিকে হাসপাতালের স্টাফ অনিমা ম্যাডামের হাতে সেলাই করার যন্ত্রপাতি। “মানুষে কাটা” রোগীর ক্ষতস্থানের সেলাই হবে। চকিতে প্রৌঢ়ের ইসিজির অর্ডার করে সেলাইয়ে মন দিলাম। দরদর করে ঘামতে ঘামতে একের পর এক সেলাই দিচ্ছি আর চিৎকারে ভরে যাচ্ছে গোটা ইমারজেন্সি বিভাগ। হাতে রক্ত মাখা গ্লাভস, সিস্টার দিদিমনিদের একের পর এক রোগীকে কর্তব্যযোগে ইঞ্জেকশন, স্যালাইন সেবা। তার মাঝে স্ট্রেচারের ক্যাঁচোর-কোঁচোর। এ আমাদের অভ্যস্ত রোজনামচার চিত্র হলেও নিন্দুকের ভাষায় সত্যিই স্বাস্থ্যসেবার নামে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ।
তার প্রমাণও পেলাম হাতে নাতে। প্রৌঢ়ের অনভিজ্ঞ স্ত্রী মাথা ঘুরে হঠাৎই পপাতধরনীতল। চারিদিকে গেল গেল চিৎকার। হাতের নিডল ফেলে ছুটলাম ভদ্রমহিলার দিকে। পাশ থেকে আওয়াজ এলো – ডাক্তারগুলো কম্মের নয়।
আজকাল অবশ্য এসব নিন্দেমন্দ না শুনলে নিজেকে ডাক্তার বলে মনে হয় না। সবাই ভদ্রমহিলাকে ঘিরে নিজের চিকিৎসাজ্ঞানের সাড়ম্বর স্বীকৃতিতে ব্যস্ত। ভিড় ঠেলে ভদ্রমহিলার পা দুটো উপর দিকে তুলে ধরলাম। মুহূর্তে জ্ঞান ফিরলো।
ইপ্রাথমিক অপ্রস্তুতির পর সকলের বিস্ফারিত উৎসুক চোখের মাঝে বিস্রস্ত পরিধান সামলে নিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন “আসলে রক্ত দেখে মাথাটা ঘুরে গেলো ডাক্তারবাবু”।
ততক্ষণে ইসিজি কমপ্লিট। প্রৌঢ়ের ইসিজিতে হৃৎস্পন্দন অত্যন্ত কম ও হার্টব্লক সেকেন্ড ডিগ্রি। অর্থাৎ বড় হাসপাতালে স্থানান্তর করে পেসমেকার বসাতে হতে পারে। প্রয়োজনীয় ওষুধ খাইয়ে প্রৌঢ়ের জন্য এম্বুল্যান্স ডাকা হলো। ভদ্রমহিলার কোনও ওষুধের প্রয়োজন নেই। আশ্বস্ত করে এম্বুল্যান্সে তুলে দিয়ে বাকি থাকা সেলাইয়ে মন দিলাম।
কিছুক্ষন পর ভিড় পাতলা হলো। অনুসন্ধিৎসুদের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় ফিরে এলাম।
প্রৌঢ়ের বা তাঁর স্ত্রীর দুজনের রোগের প্রাথমিক পোশাকি নাম “সিনকোপ” অর্থাৎ ক্ষণিকের জ্ঞানলোপ। কারণ বহুমাত্রিক। হৃৎযন্ত্রের গোলযোগ, মস্তিষ্কের স্ট্রোক, রক্তশর্করার তারতম্য, ফুসফুসের রক্তস্রোতে বাধা, বিভিন্ন ধরনের খিঁচুনি, রক্ত লবণের তারতম্য, ইত্যাদি চুড়ান্ত রোগের প্রাকলক্ষণ যেমন হতে পারে, তেমনি ভেসোভেগাল অ্যাটাক, সাইকোজেনিক সিনকোপের মত মৃদু কারণেও ক্ষণিকের জ্ঞানলোপ হতে পারে।
সিনকোপের উপস্থাপনাও বিবিধ। হাসপাতালের ভয়াবহ অপরিচিত পরিবেশে রক্ত দেখে ভদ্রমহিলার জ্ঞানলোপ বা কাশতে কাশতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা প্রস্রাবের সময় অতিরিক্ত চাপ দিতে গিয়ে জ্ঞান হারানো আসলে ভেসোভেগাল অ্যাটাকের প্রকারভেদ। এক্ষেত্রে নার্ভজনিত কারঋণে রক্তবাহী ধমনীর প্রসারণ ও হৃৎস্পন্দন কমে যাওয়ার কারণে রক্তচাপের হ্রাস হৃৎযন্ত্র থেকে রক্তকে ঠেলে মস্তিষ্কে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। ফলস্বরূপ জ্ঞানলোপ। এমতাবস্থায় রোগীকে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে পা দুটি ওপরে তুলে ধরুন। মুহূর্তেই ফিরবে জ্ঞান।
আবার ধরুন অনেকক্ষণ বসে বা শুয়ে থাকার পর হঠাৎ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ক্ষণিকের জ্ঞান হারানোর অভিজ্ঞতাও অনেকেরই আছে। একে বলে অর্থোস্ট্যাটিক সিনকোপ। রক্তাল্পতা, ডিহাইড্রেসান, রক্তচাপ কমানোর বিবিধ ওষুধ, কারণসুধার সেবন এই সিনকোপের কারণ হতে পারে।
এবার আসি প্রৌঢ়কে কেন তড়িঘড়ি রেফার করলাম তার ব্যাখ্যায়।
হৃৎযন্ত্রের গোলযোগে সিনকোপ মূলতঃ তিন প্রকার। হৃৎস্পন্দনের বিশৃঙখলা, হার্টঅ্যাটাক বা হৃৎযন্ত্রের গঠনগত রোগের কারণে কার্ডিওজেনিক সিনকোপ হতে পারে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা প্রাণ ফেরাতে পারে রোগীর। ২৪ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে কার্ডিয়াক সিনকোপের সঠিক চিকিৎসা না হলে সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে রোগীর জীবনহানি ঘটতে পারে অব্যবহিত পরেই।
কিন্তু ডাক্তারবাবু, মেডিসিনের গূঢ় তত্বে না গিয়ে ছাপোষা বাঙ্গালী তাহলে কি করবেন?
হঠাৎ জ্ঞান হারানো ব্যক্তিকে মেঝেতে শুইয়ে পা দুটো ওপর দিকে তুলে দিন। মুখে গ্যাঁজলা বেরোতে থাকলে মুখটা একদিকে পাশ ফিরিয়ে দিন। দেখবেন যেন দাঁতের মাঝে জিভ ঢুকে আঘাত না পান। এসময় ভুলেও মুখে জল দেবেন না। তাতে শ্বাসপথে জল ঢুকে মৃত্যু অবধি হতে পারে। এরপরেও জ্ঞান না ফিরলে ডাক্তারবাবুই ভরসা।
পরিশেষে বলি প্রতিটি সিনকোপের কারণ অনুসন্ধান জরুরি। কারন সিনকোপ কোনও রোগ নয়। রোগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তাই আসল রোগের নির্ণয় ও তার উপযুক্ত চিকিৎসা অবশ্যকাম্য।