যেখানেই যাব, ছোটো মেয়ে রানী যেতে চায়। স্কুটার নিয়ে চেম্বারে যেতে গেলেও সে এসে হাজির। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেরত পাঠাই। আজ Batch-98 for Needs এর পক্ষ থেকে MSWS- এর বিবেকানন্দ আশ্রমে একটি মেডিক্যাল ক্যাম্প ছিল। বাড়ির খুপরি শেষ করে দুটো রুটি পেটে পুরে বেরচ্ছি, ছোটো মেয়ে রানী এসে হাজির। বলল, ‘বাবা, কোথায় যাচ্ছ? আমিও যাব।’
বললাম, ‘রোগী দেখতে যাচ্ছি। তুই গিয়ে কী করবি?’
রানী বলল, ‘আজ তো রোববার। আজ তোমার বিকালে চেম্বার নেই। অতএব তুমি যেখানেই যাও, রোগী দেখতে যাচ্ছ না। মিথ্যা বলছো কেন? দাঁড়াও আমি মাকে বলে দেব, তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলেছ।’
রেগে মেগে বললাম, ‘ব্যাটা মাতৃভক্ত মর্কট, আমি মোটেও মিথ্যা বলিনি। ঠিক আছে চল। কিন্তু গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবি। একদম বিরক্ত করবি না।’
আমাদের ব্যাচের প্রসূন এসে গেছিল। চলার পথে কতো বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছি। স্কুলের পুরোনো বন্ধুদের দেখলে তাই আজকাল ভীষণ ভালো লাগে। পার্থ আর গৌর’ও যাবে। সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লাম। অত্যন্ত দুর্গম রাস্তা। তাড়াতাড়ি যাওয়াই ভালো।
রানীকে স্কুটারের সামনে দাঁড় করালাম। যেতে যেতে বললাম, ‘সাতের ঘরের নামতাটা বল।’
রানী বলল, ‘বেড়াতে যাওয়ার সময় কেউ নামতা বলে?’
‘বেড়াতে কোথায় যাচ্ছি! আমরা তো রোগী দেখতে যাচ্ছি। ঠিক আছে ওখানে কী লেখা আছে পড়।’
একটা ঘরের উপর বড়ো বড়ো করে লেখা “নতুন পাড়া স্পোর্টিং ক্লাব”। রানী এক নজর দেখেই বলল, ‘বাবা, লেখা আছে নতুন পাড়া পোস্ট অফিস ক্লাব।’
‘ওটা পোস্ট অফিস ক্লাব নয় জাম্বুবান, ওটা স্পোর্টিং ক্লাব।’
‘মোটেও না। ওটা পোস্ট অফিস লেখা ছিল। তোমার চোখে চশমা, তুমি কম দেখো।’
স্কুটার ঘুরিয়ে সেই জায়গায় এলাম। বললাম, ‘ভালো করে দেখ।’
রানী দেখে শুনে বলল, ‘তুমি এতো জোরে চালাচ্ছিলে, আমি ভালো ভাবে দেখতেই পারিনি। আমি মাকে বলে দেব তুমি বড্ড জোরে গাড়ি চালাও।’
হাজার হোক, নিজের ছোটো মেয়ে। মাঝ রাস্তায় স্কুটার থেকে নামিয়েও দেওয়া যায় না। অগত্যা আবার চলতে শুরু করলাম।
খানিকদূর গিয়ে দেখি পৌরসভার একটা পানীয় জলের গাড়ি। তার গায়ে বড় বড় করে লেখা পানীয় জল। বললাম, ‘ওটা কী লেখা আছে পড়।’
রানী বলল, ‘লেখা আছে পানিহাটির জল। আচ্ছা বাবা আমরা কি পানিহাটি চলে এসেছি?’
আমি উত্তর দিলাম না। মেয়েটি মহা ফাঁকিবাজ। পুরোটাও পড়ছে না। একটা দুটো অক্ষর পড়েই মনগড়া শব্দ বলে দিচ্ছে। একে শিক্ষিত করা আমার কর্ম নয়।
নোয়াই খালের পাশের রাস্তায় যখন নামলাম, রানীকে একটু বিচলিত মনে হল। খালের পাশ দিয়ে ভাঙাচোরা সরু রাস্তা। একেকটা গর্তে পড়লে মনে হয় এই বুঝি রাস্তা ছেড়ে খালে নেমে যাব। রানী বলল, ‘বাবা তুমি সাবধানে চালাও। আমার উপর রাগটাগ করে আমাকে খালে ফেলে দিও না। তাহলে কিন্তু আমি মাকে বলে দেব।’
অবশেষে প্রায় ভাঙা কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে আশ্রমে পৌঁছলাম। ব্রিজটায় প্রচুর ফুটো ফাটা। দেখে শুনে পা ফেলতে হচ্ছে। না হলে নোয়াই খালের জলে স্নান করে বাড়ি ফিরতে হবে।
পৌঁছেই রোগী দেখা শুরু করে দিলাম। মধ্যমগ্রাম “এস বি আই” ব্যাংকের গুরুগম্ভীর ম্যানেজার প্রসূন রোগীদের নাম লিখছে। পার্থ প্রেশার মাপছে। আমি রোগী দেখছি। গৌর ওষুধ দিচ্ছে। MSWS –এর নির্মলদা, দেবদা, পম্পা বৌদি ও অন্যরা আমাদের সাহায্য করছে। সপ্তর্ষি একটু পরেই সাইকেল নিয়ে হাজির হলো ও ছবি তুলতে শুরু করল।
মেডিক্যাল ক্যাম্পের রোগীদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রায় ৯০% রোগীর কোমরে ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা থাকে। সবাইকে প্রায় একই ওষুধ দেওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রানী বুঝে গেল কোন ওষুধ দেওয়া হবে। ও রোগী দেখার পর ওষুধ বের করে গৌরকে দিচ্ছে। না মিললে ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে আমাকে বলছে, ‘বাবা তুমি ঠিকঠাক দেখছো তো?’ এবং সেটা রোগীদের সামনেই বলছে। তাঁরাও সেটা শুনে কেমন সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতি।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে আসছে। হলুদ বাল্বগুলো সন্দেহজনক ভাবে টিম টিম করে জ্বলছে। সেই রহস্যময় অন্ধকারে আমি আরো রহস্যময় রোগের ইতিহাস শুনছি। কার ছেলে কেরলে গিয়ে আর ফিরে আসেনি, কার পর পর দুটো মৃত বাচ্চা হয়েছে- যে বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ এখনও সে শুনতে পায়- এরকম অনেক গল্প। যে গল্প গুলো আমার লেখা উচিৎ ছিল, কিন্তু না লেখার জন্য একেবারে হারিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।
সুমনদা একজনকে ধরে বিনামূল্যে সুগার ও হিমোগ্লোবিন মাপার ব্যবস্থা করেছে। আমাদের ভিড় আস্তে আস্তে কমছে আর রক্তের ঘরের সামনে ভিড় বাড়ছে।
একেবারে শেষ রোগী দেখছি। মাঝবয়সী বেশ মোটাসোটা মহিলা। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সমস্যা কী?’
বললেন, ‘পেটের মধ্যে শুধু লড়েচড়ে ডাক্তারবাবু।’
আমি তখন রোগী শেষ হওয়ার আনন্দে মশগুল। বললাম, ‘যা ভুঁড়ি বানিয়েছেন, নড়বে না তো কী হবে?’
মহিলা অবাক হয়ে বললেন, ‘ভুঁড়ি? ভুঁড়ি কোথায় দেখলেন? আমি তো গর্ভবতী।’
একেবারে ছড়িয়ে ফেলেছি। ডায়াগনোসিস পুরোপুরি ভুল। বেশ লজ্জিত হয়ে বললাম, ‘কত মাস চলছে?’
‘ছয় মাস।’
ব্যাস, বল এবার আমার কোর্টে। বললাম, ‘ছয় মাসে কারো এতো বড়ো পেট হয়? ওটা ভুঁড়ি ছাড়া আর কী?’
মহিলাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। বললেন, ‘মোটেও ভুঁড়ি নয়। সবার কী সমান হয়। আমার আগের বাচ্চা নয় মাসে হয়েছিল। তখনই ওজন ছিল তিন কেজি নয়শো। এবার পুরো মাস পোহালে শিওর পাঁচ কেজি হবে। আরো বেশীও হতে পারে। তাহলে আমার নাম গিনেস বুকে উঠে যাবে।’
ক্যাম্পের পর গরম পরোটা আর গরম সয়াবিনের তরকারি আয়েশ করে খেলাম। যিনি রক্ত টানতে এসেছেন, তাঁর সামনে বিশাল লাইন। কখন রক্তটানা শেষ করবেন কে জানে? রাত নামার সাথে সাথে ভালোই ঠাণ্ডা পড়ছে।
ভদ্রলোক সোয়েটার না আনলে খবর আছে।