২০০৫-এর কথা বলছি। তখন আমি মুর্শিদাবাদের আমতলা গ্রামীণ হাসপাতালে পোস্টেড। ডাক্তার মাত্র তিনজন, এদিকে রুগীর চাপ প্রচন্ড !
একদিন আউটডোরে বসে হিমশিম খাচ্ছি, এমন সময় লাইন ভেঙে এক মহিলা সামনে এসে হাজির। মহিলার বয়স বছর তিরিশেক হবে। চিমসে দেহ, জট পড়া চুল, পরনে শতচ্ছিন্ন একটা শাড়ি। সঙ্গে কোনো মানুষ নেই, শুধু একটা ছাগল। ছাগলটার গলায় দড়ি বাঁধা।
ছাগল নিয়ে হাসপাতালে আসাটা মুর্শিদাবাদে কোনো বিস্ময়কর ঘটনা নয়, অতএব আমিও বিস্মিত হলাম না ! তবে দেখে অবাক লাগলো যে লাইন ভেঙে আসা সত্ত্বেও লাইনে দাঁড়ানো লোকজন কোনো আপত্তি করছে না !
আমি রূঢ়ভাবে বললাম – “যাও গিয়ে লাইনে দাঁড়াও, যখন সময় আসবে দেখবো।”
ছাগলওয়ালী আমার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকাল, কিন্তু সরলো না। বরং লাইনে দাঁড়ানো অন্যান্যরা চেঁচিয়ে উঠল – “ডাক্তারবাবু ওকে আগে ছাইড়া দেন, কুনো অসুবিধা নাই।”
শুনে বেশ অবাক লাগলো। কি ব্যাপার রে ভাই ! এই চিমসে চেহারার জটাজুটধারী মহিলাটি কে, যে তাকে লোকজন এত খাতির করছে ?”
যাইহোক, পরীক্ষা করে দেখলাম যে মহিলার ডান পায়ে একটা বিরাট ‘abscess’ আছে। এ জিনিস ওষুধে সারবার নয়, অপারেশন করে পূজরক্ত বার করতে হবে। অতএব অ্যাডমিশন করে দিলাম।
মহিলার নাম এখনও মনে আছে, করিমন বিবি। সেদিন সন্ধ্যায় ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে গিয়ে দেখি বিবিসাহেবা দিব্যি বেডে শুয়ে আছেন, পাশে সেই ছাগলটা। দেখেশুনে রাগে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল ! দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললাম – “ছাগল নিয়ে শুয়ে আছো কি মনে করে ? এটা মানুষের হাসপাতাল, ছাগলের নয় !”
করিমন বিবি উদাস গলায় বলল – “তাইলে আমারে ছুটি দিয়া দেন, ছাগল নিয়া বিদায় হই।”
“ছুটি কি করে দেবো ? কাল তোমার অপারেশন করবো বললাম না ?”
“ছাগলরে ছাড়ুম না।” করিমনের সাফ জবাব !
আমি মোটামুটি হাল ছেড়ে দেওয়া গলায় বললাম – “তোমার ব্যাপারটা কি বলো তো ? লাইন ছাড়া দেখিয়ে নিলে, এখন আবার অবাধ্যতা করছো—–কি পেয়েছোটা কি ? আর লোকগুলোই বা তোমাকে এত খাতির করছিল কেন ?”
করিমন বিবি আগের মতোই উদাস গলায় বলল – “খাতির লয়, আমারে ভয় খায়।”
আমি দৃশ্যতই অবাক হয়ে বললাম – “কেন কেন ? ভয় খায় কেন ?”
করিমন বিবি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল – “আমি ডাইনি তো, তাই !”
বিস্ময়ের উপর বিস্ময় ! গ্রামদেশে ডাইনির কথা অনেক শুনেছি বটে, তবে আগে কখনও দেখিনি। এই তাহলে ডাইনির ছিরি ! হাসির চোটে আমার পেট গুড়গুড় করে উঠলো। বহুকষ্টে হাসি চেপে মুখে ছদ্ম গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললাম – “তা হঠাৎ ডাইনি হতে গেলে কেন? কি লাভ ডাইনি হয়ে ?”
করিমন দৃঢ়স্বরে বললো – “মেলা লাভ আছে। লোকজন ভয়-ভক্তি করে, না চাইতেই চাল, আলু, ট্যাহা-পয়সা দিয়া যায়। আগে আমারে পাগলী বইলা ক্ষ্যাপাতো, ডাইনি হওনের পর আর ক্ষ্যাপায় না। জানে আমি রেগে গেলে বাণ মাইরা দিবো।”
“সত্যিই তুমি বাণ মারতে পারো নাকি?” – আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
করিমন বিবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল – “এখনও পারি না, তয় যখন পুরাপুরি ডাইনি হয়ে যাবো তহন পারবো। ডাইনি হওয়া তো কোনো সহজ ব্যাপার নয়, অতি জটিল ব্যাপার ! অমাবস্যার রাইতে একখান ছাগল জবাই কইরা তার মুন্ডুটা নিয়া ঈশান কোন বরাবর হাঁটতে হইব। হাঁটতে হাঁটতে পরথম যে নদী পড়বে তার পাড়ে ছাগলের মুন্ডুটা পুঁতে দিব। হেই মাটির উপর আমার বাম হাতের বুড়া আঙুল কাইট্যা দশ ফোঁটা রক্ত ফেলতে হবে, ব্যস—-কাম শেষ !”
আমি জিজ্ঞেস করলাম – “এটাই কি তোমার সেই জবাইয়ের ছাগল?”
“হুঁ”।
“মানুষকে শুধু ভয় পাওয়ানোর জন্য এত ঝামেলা করবে ?”
করিমন বিবি মাথা নেড়ে বললো – “না, আরো বিষয় আছে। পুরাপুরি ডাইনি হওনের পর যা ইচ্ছা তাই করতে পারবো। যেমন ধরেন আমার ইচ্ছা হইলো সংসার করতে। তহন এমন বাণ মাইরবো যে মতির বাপ তার বৌরে ছাইড়া আমার কাছে ফিইরা আসবে। পা জড়ায়ে কানতে কানতে বলবে – ও বৌ, আমারে ফিরাইয়া লও।”
ডাইনি হওয়ার রহস্যটা এবার পরিষ্কার হচ্ছে! গলা নিচু করে জিজ্ঞেস করলাম – “মতির বাপ কে?”
করিমন বিবি বেশ আগ্রহ নিয়ে জবাব দিল – “আমার সাথে লোকডার বিয়া হইছিল। বিয়া হওয়ার ছ’মাসের মাথায় কঠিন অসুখে পইড়লাম, আমার চেহারা-ছবি গেল নষ্ট হয়ে। লোকডা আমারে নিয়া সুখ পাইতো না। ব্যাটাছেলে মানুষ, চেহারা-নষ্ট মেয়েছেলে নিয়া কি কইরা থাকবে বলেন? লোকডা তহন আমারে ছাইড়া আবার আরেক মাগিকে বিয়া করলো। একখান ছেলে আর দুইখান মেয়ে হইছে ওদের। পুলাডার নাম মতি, মাইয়া দুটার নাম কুসুম আর পুষ্প। ভারি সুন্দর দেখতে! পুলাপানগুলাকে নিয়ে বিরাট চিন্তায় থাকি! না দেইখ্যা থাকতে পারি না, আবার ভয় হয় যদি আমার নজর লাইগ্যা যায়! ডাইনির নজর অতি খারাপ জিনিস, বুঝলা ডাগতার?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম – “মতির বাপ তোমার কাছে চলে এলে ছেলেমেয়েগুলোর কি হবে? সেটা ভেবে দেখেছো ?”
করিমন বিবি উজ্জ্বল মুখে বলল – “হেইডা আমি আগেই ভাইব্যা রাখছি। ওদেরও জাদুটোনা কইরা টাইন্যা নিব। বৌটাও আইতে চাইলে আসুক। এক জন ‘এসট্রা’ মানুষ না হয় থাকলো, ক্ষতি তো কিছু নাই !”
“তা তোমার পুরোপুরি ডাইনি হওয়ার পরিকল্পনা আটকে আছে কিসের জন্য? ছাগলটাকে মারতে পারছো না বলে?”
“এখন পারতাছি না, তয় ইনশাল্লাহ পারবো। এক অমাবস্যার রাইতে ঘ্যাঁচাং কইরা কল্লা নামায়ে দিব, তারপর আর চিন্তা নাই।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম – “ছাগলটা কদ্দিন তোমার সাথে আছে?”
“তা ধরেন পেরায় দুই বছর হবে।”
“এতদিনেও কল্লা নামাতে পারলে না ?”
করিমন বিবি বিরক্ত স্বরে বলল – “ছাগলডা বিরাট শয়তান! একবার জবাই করবার লগে গলায় চাক্কু ঠেকাইছি, হে ভাবছে এইডা বোধহয় নূতন কোনো খেলা। আনন্দে লাফাইতে লাফাইতে আমার কোলে উইঠা পড়লো, হালা হারামির পুত!”
ছাগলটা বোধহয় গালাগাল শুনে বুঝে গেছে যে ওকে নিয়েই কথা হচ্ছে। ব্যা-ব্যা শব্দ করতে করতে করিমন বিবির কাপড় কামড়ে ধরলো। করিমন বিবি ছাগলটাকে ছাপার অযোগ্য একটা গালি দিয়ে বলল – “হারামজাদা সারাক্ষণ হাঁ কইরা আছে। খালি গেলা আর গেলা ! দিব একদিন বিসমিল্লাহ বইল্যা জবাই করে, তহন বুঝবি!”
জবাই হওয়ার আশঙ্কায় ছাগলটাকে বিশেষ বিচলিত বলে মনে হল না ! তার সম্ভাব্য হত্যাকারীর বুকে মুখ ঘষতে লাগলো।
দেখলাম করিমন বিবি তার ঝোলা থেকে একটা পাঁউরুটি বার করে ছাগলটাকে খাওয়াচ্ছে, আর খাওয়াতে খাওয়াতে তার গায়ে মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বড় সুন্দর সে দৃশ্য !
এমন পবিত্র দৃশ্য দেখার জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। মনে হল সে যোগ্যতা আমার নেই।
আমি ধীরে ধীরে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এলাম।
ভালবাসায় আপ্লুত হলাম । এই ডাক্তারদের মানুষ মারধোর করে – গালাগালি দেয় ? কে মানুষ আর কে অমানুষ সব গুলিয়ে যাচ্ছে ।
Wow.
এই রকমের কলম কয়েকটা মাত্র পৃথিবীতে আছে। অনেকেই খোঁজে। পায় মাত্রই কয়েকজন।
আপনাকে একটা কথা বলি লেখক সাহেব। ভালোবাসায় ভেজা এই কলমখানি খুব সাবধানে রাখবেন। যেন কিছুতেই না হারিয়ে যায়। মধ্যবিত্ত সময় যেন চুরি না করে নেয়।
হুমায়ূন আহমেদ স্যারের কাছে এই কলম একখানি ছিল। আজ জানলাম উত্তরাধিকারী এসে গেছে।
আমার বেলা দ্রুত পড়ে আসছে। আহা, সূর্য ডোবার আগেই কোনওদিন যদি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, কৃতার্থ হবো।
স্যার আমার বহুদিনের শখ আপনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করার। যদি সাক্ষাৎ পেতে পারি নিজেকে অতি সৌভাগ্যবান বোধ করবো।
কি অপূর্ব লেখা। পড়ে চোখে জল এলো।
সাংঘাতিক সুন্দর উপস্থাপনা।
বড় মধুর অভিজ্ঞতা।
ভিশন দুঃখ-যন্ত্রণার অনুভূতির ভাগ
????????
Darun lekha..Shotti bonophul r lekha pore mone hoto sudhu Doctor hoyechi bolei kato rokom oviggota pai amra..Aj tomar lekha pore etai mone holo j jai boluk,ami gorbito ami doctor jekhane tomar mato ekjon r lekha te dhora pore amader jibon
আমি এমনিতেই কিছুটা আবেগপ্রবন I অসাধারণ লেখা I দারুন অনুভূতির ভাগিদার আমরাও I
মুগ্ধতা একরাশ ! বনফুলের পর আরও কিছু ডাক্তারবাবুদের কলম মনে হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছে ! এমন আন্তরিক লেখাকে শ্রদ্ধা ও কুর্নিশ !
আহা, কি তৃপ্তি, এ লেখা ঘোর লাগিয়ে দেয়
Aha, ki sundor snehe bheja lekha. Likhte thakun… Amni ro likhte thakun. Onek subhokamona roilo.
Like!! I blog quite often and I genuinely thank you for your information. The article has truly peaked my interest.
Thanks so much for the blog post.