দক্ষিণের বারান্দায় ইজিচেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে অরিন্দম। এই বারান্দা, এই চেয়ার প্রায় ওর সত্ত্বার অংশ হয়ে গেছে। এতবার এসেছে ও এই ছোট্ট গ্রাম ঘেরা শহরটায়। তা নয় নয় করে চার দশক হল প্রায়। রাঙাপিসির বিয়েতে প্রথম আসা এই রাঙামাটির দেশে। মাধ্যমিকের ঠিক আগে আগেই। সেই শুরু। তারপর থেকে যখনই সময় এবং সুযোগ হয়েছে চলে এসেছে এখানে। কাজের প্রয়োজনে পৃথিবীর নানা প্রান্তে সাময়িক ঠিকানার সন্ধান করতে হয়েছে অরিন্দমকে কিন্তু মনটা পড়ে থেকেছে এই লালমাটির আঙিনায়। এবার এলো বেশ অনেকদিন পর। সারাটা বছর উন্মুখ হয়ে থাকে বর্ষার এই দিনগুলোয় এই অতিথিনিবাসের একান্ত নির্জনতার সঙ্গ পাওয়ার জন্য। সামনের জলাশয়ে সেই সকাল থেকেই নরম আদুরে রোদ আর ছায়া়ার অবিরাম লুকোচুরি। ছায়া কখনও বা হালকা রোদে মেশামেশি। যেন বা প্রগলভ সাঁওতাল কিশোরী। সামনের বাতাবি গাছটা ঝুঁকে পড়েছে ফলের ভারে। কাঠবিড়ালীটা সন্দিগ্ধ চোখে একবার ঘাড় ফিরিয়ে মেপে নিল অরিন্দমকে। গন্ধরাজের পাতায় মুক্তোর দানার মতো চিকচিক করছে জলের বিন্দু। সামনের জলের ঘেরাটোপে গলা বাড়িয়ে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে বিশালদেহী কাছিমটা। কালোরতন এই অতিথিনিবাসের প্রবীণতম সদস্য। ওর বয়স নাকি দেড়শ বছর। দশরথ বলে তারও বেশী।
বারান্দার ঠিক মাঝখান থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে জলের দিকে। সেখানে খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে বসে দশরথ। বাঁ পা ভাঁজ করে দালানে রেখে ডান পা সিঁড়িতে ছড়ানো। গত বিশ বছরে এই বসার ভঙ্গীর কোনও পরিবর্তন হয়নি। তবে ইদানীং শরীরের ওপরদিকটা সামান্য যেন ঝুঁকে গেছে। হাঁটার গতিও কিছুটা কমেছে আগের থেকে। বদলায়নি শুধু ওর হাসিটা। শীতে, গ্রীষ্মে, আনন্দে কি হতাশায় ওর এই স্মিতহাসির কোনও ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি অরিন্দমের। বয়স কত হল দশরথের? দুদশক আগে প্রথম আলাপের সময় শুনেছিল তিন কুড়ি পার। আজও সদ্যচেনা কাউকে একই কথা বলে দশরথ। এই জলাশয়, সামনের ফলের বাগান, বৃদ্ধ কাছিম, চারপাশের মেঘলা জঙ্গল এসবের সাথে যেন ওতপ্রোতভাবে মিশে রয়েছে দশরথ। বারান্দার টিয়াটার সঙ্গে কত কি বকবক করে ও। এমনকি ওর ডাক শুনে কালোরতনও জলের প্রান্তে এসে গলা বাড়ায় খাবারের প্রত্যাশায়। ওর বড়বাবা ভাদো নাকি পুষেছিল কালোরতনকে। তখন ছিল সাহেবদের শাসন। দুমকার সাহেব ইন্সপেক্টরের নজর পড়েছিল কালোরতনের ওপর। তারপর এমনই এক বর্ষার রাতে মাথায় প্রকাণ্ড এক মাটির জালায় কালোরতন আর একহাতে অকালে বাপ মা মরা দশরথকে নিয়ে রাঢ়ের এই গাঁয়ের সীমানায় পৌঁছেছিল ভাদো।
– তোমার ছোটবেলার কথা কিছু মনে পড়ে দশরথ? জিজ্ঞেস করে অরিন্দম।
– না বাবু। সে কি আজকের কথা। তিনকুড়ি কাল হল গিয়ে। বড়বাবার সাথে এসছিলুম, এইটুকুন খালি মনে আছে। কালোরতনের চেহারা তখোন এত্তোবড় হয় নাই।
– সেই থেকে এখানেই আছ?
– না বাবু। পেরথম পেরথম নদীর লগে বনের পাশে গোলপাতার একটা ভিটা বানাইছিল বড়বাবা। সিখেনে ছিলাম অনেকদিন।
– তাও কতদিন হবে?
– বিশ তিশ সাল তো হবেই বাবু। আমরা কি আর আপনাদের মতো পড়ালিখা জানি? ওই যে সন পূজার লগে বড় বান হলো সেই সনে মুইদের ভিটা গেল ভেসে। বড়বাবারে সেই যে কাশির ব্যামোয় ধরল, আর ছাড়ল নি। তারপর এই সরকারবাবু ধরলেক আমায়। কইলা “দশরথ তুই আমার লগে চল। আমার জমি, বাগান দেখাশোনা করবি। তুকে ঘর দিব। বিয়াশাদি করবি”। সেই থিকান এই বাবুদের ডেরাতেই থাকতেছি।
– তোমার সেই ছেলেবেলার গ্রামে ফিরে যেতে মন করে না দশরথ?
– মন করে না বইললে মিছা বলা হয় বাবু। একবার দুবার মন টানে, যাই পরে, দিখ্যা আসি গিয়া পুরাতন ভিটাখান। যিতাম গো বাবু, আমার ছিলাটা থাকলে অবশ্যই যিতাম। ওই শক্তিস্থলে একটা মানত চড়ায়ে আসতাম।
– শক্তিস্থলের কথা তোমার মনে আছে?
– কিছুক কিছুক আছে গো বাবু। ও বড় পবিত্ত স্থান বাবু, বড় পুণ্যির স্থান।
– তোমাদের দেশের লোক খুব মানে ওই জায়গাকে, তাই না?
– হ্যাঁ বাবু। খুব, খুব বলে কপালে জোড়হাত ঠেকায় দশরথ।
– কিন্তু কেন বলতো? আমাকে বলবে সেই গল্প? এই মেঘলা মায়ায় জঙ্গলছোঁয়া এই গাঁয়ের এক বিষণ্ন বিকেলে দশরথ যেন দেশকালের সীমা অতিক্রম করে এক আদি যুগপুরুষরূপে প্রতিভাত হয় অরিন্দমের মানসনয়নে। এদেশের এক সুপ্রাচীন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। যেন এক চলমান ইতিহাস।
– সে অনেকদিনের অনেক পুরনো কথা বাবু। ওই শক্তিস্থলে বটগাছের তলে বাবু চুনু মুর্মুর বেটা সিধো মুর্মুর ফাঁসি হইঞ্ছিল।
– আমিতো শুনেছি সিধুকে ব্রিটিশরা গুলি করে মেরেছিল।
– না বাবু না। সাহেবরা তাকে ফাঁসিই দিঞ্ছিল। চুনু মুর্মুর চার বেটা। সিধো, কানহু, চাঁদ আর ভৈরব। এক বেটিও ছিল তার। ফুলু মুর্মু। কেউ কেউ তারে ঝানু মুর্মুও ডাকে। সে ছিল মেয়েমানুষদের লীডর। উয়াদের ডাকে ভগ্নাডির মাঠে বাবু সিদিন হাজারে হাজারে লোক জড়ো হইঞ্ছিল তীর, ধনুক, টাঙি আর বল্লম লিয়ে। সিধো, কানহুদের সাথে সাহেবদের ডরায়ে দিঞ্ছিল শ্যাম পারগণা, বাজাল সরেনরাও।
– এই লড়াই শুরু হল কেমন করে?
– প্যাটের টানে বাবু, প্যাটের টানে। আমার পূবপুরুষরা বাবু ওখানে ছিল হাজার হাজার বছর ধরে। বন কেটে বসত। ইকটু ইকটু করে চাষের জমি বাগানো। অনেক অনেক মেহনতের কাম বাবু। জঙ্গলের মালিক তো ভগবান বাবু। ভগবানের জমিজিরেত আর জঙ্গলে থাইকত যতো পশুপাখি আর সাঁওতালরা। ভগবান তো কোনও ট্যাক্সো মাঙেন নাই। উয়ারা দিবেক কুথা থিকে বাবু?
– সাহেবরা ট্যাক্স চালু করল?
– হ্যাঁ বাবু। মাটির জন্য ট্যাক্সো, ধানের জন্য ট্যাক্সো। হাজার গাঁয়ের লোক জেরবার হইন গেল। শুখার সনে ধান হয় না। তবু রইক্ষা লাই। প্যাটের লগে দিকু মহাজনের কাছে ধারকর্জ বাইড়তে থাকে। ভগবানের দ্যাশে বাবু না ছিল টাকা, না ছিল পাপ।
– মহাজনরা খুব অত্যাচার করত শুনেছি?
– অইত্যাচার বলে অইত্যাচার। বড়বাবা কইত একদিকে জমিদার, মহাজনের নায়েব,সুজোয়াল আর এক দিকে পুলিশ।
– শুনেছি মহেশ দারোগার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এলাকার মানুষ। শেষ অবধি তার মৃত্যু হয় সিধুর হাতে।
– পাহাড়টিলা, জঙ্গলের সব সাদাসিধা লোক ছিল বাবু। উয়াদের মনে কুনও পাপ ছিলনি। দিকুরাই উয়াদের প্রাণে পাপ ঢুকাইন দিছে। প্যাটের ভাত কাড়ি লিছে। মেয়েমরদ সব্বার উপর দখলদারি লাগাইছে। তাই না জগোন্নাথ সর্দার একদিন খুন করি দিলা দিকু দীনদয়ালকে। তারপর গাঁয়ের পর গাঁ আগুন ছড়াই গিলা বাবু। হাজার হাজার মুর্মু, সোরেন, বাস্কে, কিস্কু, হেমব্রমরা পঁহুছ গেলা ভগ্নাডির মাঠে।
তারপরের ইতিহাস আরও অনেকের মতোই অজানা নয় অরিন্দমের। সাদা সাম্রাজ্যবাদের গুলি, বোমা, বন্দুকের অব্যর্থ নিশানায় স্তব্ধ হয়েছিল কয়েক হাজার কালো মানুষের হৃৎস্পন্দন। হঠাৎই জলের দিকে চোখ যায় অরিন্দমের। দীর্ঘ গলা ধীরে ধীরে শরীরস্থ করে মন্দ্রলয়ে জলের মধ্যে হারিয়ে যায় এই ইতিহাসের একমাত্র জীবিত সাক্ষী কালোরতন।
আকাশের শেষ আলোর রেখা ধীরে ধীরে অপসৃয়মান হয় আসন্ন সন্ধ্যার নিবিড় অবগুণ্ঠণে। চরাচরময় ঝিঁঝিঁর বৈচিত্র্যহীন কলরব। দূরে রাস্তার নিয়নের স্তিমিত বিভা। অতিথিনিবাসের আনাচকানাচে আলো জেগে ওঠে। ঘরমুখো ফিঙে কি বেনেবৌয়ের ডাকে অনাগত রাত্রির আগাম ঘোষণা। নীরব দশরথ যেন কিঙ্করের ভাস্কর্যের প্রতিমূর্তি। সময়ের ভারে বুঝিবা ঈষৎ ন্যুব্জ।
– কালোরতনকে দিখবেন বাবু আপনারা, যখন থাকব নি। দশরথের কথায় সম্বিত ফেরে অরিন্দমের।
– তোমার ছেলের কথা একদিন বলবে বলেছিলে দশরথ।
– আমার বড় কষ্টের জীবন বাবু। জনমভোর শুধু হারাইঞ্চি আমি। বুধনি চলি গিলা পোসব এর লাগালাগি। ওই বেটাটাই আমার একমাত্র ভরসা ছিল বাবু। পড়ালিখাও শিখালাম। কিন্তু তারপর থেকেই কেমন বদল হই গিলা। দশরথের গলা কান্নায় বুঁজে আসে।
– তুমি এবার ঘরে যাও দশরথ। সস্নেহে ওর হাত ধরে দাঁড় করাতে করাতে বলেন অতিথিনিবাসের পরিচালক অজয় সরকার।
শ্রান্ত, ধীর পদবিক্ষেপে সেই মূর্তিমান অন্ধকার হারিয়ে যায় উত্তরের পাঁচিলঘেঁষা টালির ঘরের অন্তরালে।
রাতে খাবার টেবিলে আবার অজয়ের সাথে দেখা হল অরিন্দমের। ওর জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে কথা শুরু করলেন অজয়ই। – বুঝলেন ছেলেটাকে একদম কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিল দশরথ। মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি কোনওদিন। ওর স্বপ্ন ছিল সনাতন লেখাপড়া শিখে বড়মানুষ হবে। তারপর একদিন সনাতনকে নিয়ে ও ফিরে যাবে সেই দামিন-কোহতে ভগনাডিহির শক্তিস্থলে। ছেলেকে চাক্ষুস করাবে ওর পূর্বপুরুষের অতীত গৌরব।
– তারপর?
– স্কুলের গণ্ডী পাড় হয়ে কলেজে পা রাখল সনাতন। ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ল নানারকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে । এক অদ্ভুত অস্থিরতা প্রকট হয়ে উঠতে থাকল ওর আচরণে। কিছুদিনের মধ্যেই আমূল বদলে গেল শান্ত, লাজুক ছেলেটা। মাঝেমধ্যেই ঘরে ফিরত না রাতে। ও নাকি সাঁওতালডির বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষদের মুক্তির আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। তারপর একদিন মধ্যরাতের অন্ধকারে এই অতিথিনিবাস ঘিরে ফেলল জেলাপুলিশ।
– সনাতন কি এখনও জেলে?
– না পুলিশ ওকে ধরতে পারেনি। কিভাবে যেন খবর পেয়ে পুলিশ পৌঁছনোর ঠিক আগে আগেই পাঁচিল টপকে ওই পিছনের জঙ্গলে পালায় সনাতন। পুলিশ এসে তছনছ করে ওদের ঘরদোর। কদিনের জন্য তুলে নিয়ে যায় দশরথকে।
– আর সনাতন?
– তাকে আর কেউ খুঁজে পায়নি আজ পর্যন্ত।
ঘরে ফিরে আবার ইজিচেয়ারে আশ্রয় নেয় অরিন্দম। নিঃশব্দে সিগারেট ধরায় একটা। অরণ্যচারী মানুষের অধিকারের ভাবনায় আচ্ছন্ন হয় তার চেতনা। হুলকে কেন্দ্রে রেখে একটা বৃত্ত রচনার চেষ্টা করে সে। সিধো, কানহু, বীরসা, বাজাল, সনাতন সবার অবস্থান সেই বৃত্তের পরিসীমার কোনও না কোনও বিন্দুতে। কিন্তু দশরথ? সে কি এই বৃত্তের অভ্যন্তরে না কি বাইরে? আদিবাসীদের সার্বিক উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে প্রায়শই নানান জায়গায় বলতে, লিখতে হয় তাকে। তবুও তার শিক্ষিত মস্তিষ্ক নাগাল পায় না দশরথের মতো মানুষদের মনের আনাচকানাচের। বস্তুত তার এইবারের এখানে আসার উপলক্ষ্যও তেমনই এক অনুষ্ঠান। আগামীকাল এখানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য নবনির্মিত বিদ্যালয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সে। কিন্তু কারা ‘পিছিয়ে পড়া’? যারা যুগযুগান্ত ধরে প্রকৃতিকে সস্নেহে লালন করছে তারা নাকি যারা এই অরণ্যমেধ যজ্ঞের ঋত্বিক তারা? নিজের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়না অরিন্দম।
– ঘুম থেকে উঠছেন বাবু? দরজার ওপারে দশরথের অবয়ব।
– আরে এসো দশরথ, ভেতরে এসো।
– আমার একটা আর্জি আছে বাবু আপনের কাছে।
– হ্যাঁ বল না দশরথ, নির্দ্বিধায় বল। আমি কি করতে পারি তোমার জন্য বল। অকৃত্রিম আর্তি ঝরে পড়ে অরিন্দমের গলায়।
– এই টাকাগুলান আপনি রাখেন বাবু। ইট্টু ইট্টু করে এ টাকা জমাইছি আমি।
– কিন্ত আমি কি করব এই টাকা নিয়ে?
– এ টাকা আমার কুনওদিন কুনও কাজে লাগবেনি বাবু। ইখানে সরকারবাবুদের ছায়ায় আছি, বাকি জীবনটা ইখানেই কাইটবেক আমার। ভগ্নাডির মাটিতে জনম আমার, আবার মাটিতেই মিলাইন যাব একদিন। আপনে আমার এই সামান্য রোজগার ইস্কুলে দিয়া দিবেন বাবু। আমি মুক্তি পাব বাবু। সিধো, কানহু, বীরসা, সনাতন সবাই তো মানুষের মুক্তিই চাইঞ্ছিল। লয় কি?
দশরথের কাঁধ ধরে দক্ষিণের বারান্দায় এসে দাঁড়ায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় অরিন্দম। বাইরের আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। অল্পস্বল্প মেঘ এখনও জমে আছে নৈঋত কোণে। পূবের দিকচক্রবালে নবীন আলোর উদ্ভাস। লম্বা গলা বাড়িয়ে আরও একটা প্রভাতকে সলাজ আমন্ত্রণ জানায় কালোরতন।