১.
আসিফা বিবির (নাম পরিবর্তিত) প্রসব যন্ত্রণা উঠেছিল অনেক আগেই। গোঁড়া পরিবারের মুরুব্বিদের ফতোয়ায় হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে বাড়িতেই প্রসব করানোর বন্দোবস্ত হয়।
বাচ্চা জন্মের পর কাঁদলো না। দাইয়ের থাপ্পড়, চাপাচাপি, টেপাটেপি কোনও কিছুতেই যখন কিছু হ’ল না তখন অগত্যা বাচ্চাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতেই হ’ল। বাচ্চা ততক্ষণে ঠান্ডা, নীল.. রক্তে গ্লুকোজ কমে তলানিতে। বাড়িতে প্রসব করানোর জন্য তেড়ে গালাগালি দিলাম। একটি নিষ্পাপ দেবশিশু কিছু মানুষের মধ্যযুগীয় গোঁড়ামির শিকার হবে কেন?
পরের দিন থেকেই বাচ্চার খিঁচুনি শুরু হ’ল। এবং, কোনও রূপকথার জন্ম না দিয়ে চারদিন বাদে বাচ্চাটা শেষমেশ মারা-ই গেল। ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে লিখতে মনে মনে বাড়ির লোকের মুন্ডুপাত করছি, গুটিগুটি পায়ে বাচ্চার মা কাঁচুমাচু হয়ে এসে দাঁড়ালো..
– ডাক্তারবাবু?
– হুঁ.. কাগজপত্র থেকে মুখ না তুলেই বললাম।
– এইগুলা রেখে দও ডাক্তারবাবু
দেখি বাচ্চার কিছু নতুন জামা, নতুন তোয়ালে, ওষুধপত্র সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়ে এসেছে আসিফা।
– এগুলো নিয়ে আমি কী করবো বলো?
– রেখে দও। মোর বাচ্চাটা ত বাঁচল নি। অন্য কুনো বাচ্চার ঘরে কিনতে না পারলে তাকে দিবে।
আসিফা চলে গেল..
নিজের ন’মাসের নাড়ি ছেঁড়া ধন হারানোর দিনেও অনেক কিছু শিখিয়ে গেল সে।
২.
জঙ্গলমহলের শালবনী সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল। আমি ডাক্তারি পাশ করেছিলাম তার অনেকটা আগেই কিন্তু সত্যি সত্যি চিকিৎসক হয়ে ওঠা কী জিনিস সেটা আমাকে শিখিয়েছিল এই শাল-মহুয়ার দেশ।
আউটডোরে বসে রোগী দেখছি। অস্থিচর্মসার একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে আদিবাসী বুড়ি আমার ঘরে এলো। মুখ ভর্তি ঘা। চামড়াগুলো শুকিয়ে এসেছে। চোখগুলো কোটরে।
– দ্যাখ না বাপু, ছিলাটার সদ্দিকাশি ভালো হয়নি কেন?
– সে নয় ওষুধ দিচ্ছি.. কিন্তু বাচ্চার চেহারার এই হাল কেন? কিছু খাওয়াও না নাকি? মুখের ঘাগুলো কবে থেকে?
বুড়ি চুপ।
– একটু ভালো করে ফল-টল খাওয়ালে তো মুখের ঘা গুলো হয় না.. কী অবস্থা করেছো? এরকম ভাবে বাচ্চা মানুষ করা যায় নাকি?
– তুই ত বাপু বলে দিয়্যাই খালাস। কী ফল খাবাব বাপু.. পাঁচটা প্যাট। মোদের রোজগার কথা যে ফল কিনব? পয়সা থাকলে কি বাচ্চাকে খাবাইতিনি?
সেই আদিবাসী বুড়ির কাছে আমার ডাক্তারি শেখার শুরু। বুঝতে শিখেছিলাম বইতে যা লেখা থাকে সেগুলো শুধুই নীরস তথ্য। চিকিৎসার আসল পাঠ মাটির কাছে। শুধু খসখসিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখে দেওয়াতেই ডাক্তারের কাজ শেষ হয় না। যদিও এভিডেন্স বেজড মেডিসিন আর কনজিউমার প্রোটেকশন অ্যাক্টের জাঁতাকলে আদিবাসী বুড়িরা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে!
৩.
বছর পাঁচেকের সুমিতার (নাম পরিবর্তিত) লিভারের জটিল রোগ। শরীরে তামা জমে যায়। বছর তিনেক আগে দিদি মারা গেছে একই রোগে। সুমিতারও অবস্থা ভালো না। পেটে জল জমে টইটম্বুর। হাত-পা গুলোও ফুলেছে। লিভার বদলাতে হ’তে পারে। আর সুমিতাদের মতো পরিবারের পক্ষে লিভার ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব। সকালের রাউন্ডে সুমিতাকে জিজ্ঞেস করলাম..
– কী রে? তোর কী কষ্ট হচ্ছে বল? পেটে লাগছে নাকি?
সুমিতা দু’হাত দেখিয়ে হঠাৎ লজ্জা লজ্জা মুখ করে হেসে ফেললো।
– হাতে কী হয়েছে? দেখি দেখি..
সমস্যার সমাধান করে দিলো সুমিতার মা। কাল সারারাত সুমিতা বলেছে ফোলা হাতে চুড়ি গলবে না। নতুন চুড়ি না পরলে দুর্গাপূজা দেখবে কীভাবে?
“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।”
দাড়িওয়ালা, দীর্ঘদেহী চিরকালীন শিক্ষক প্রতি মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক।
৪
দশ বছরের বুবাইয়ের বুকে টিবি ধরা পড়েছে। বুকের একটা দিক পুরো জল জমে ভর্তি। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। জ্বর আসছে থেকে থেকেই। সন্ধের মিটে বাড়ির লোকের মুখোমুখি হলাম। সবকিছু জানানোর পরে বাচ্চার বাবা হাঁফ ছেড়ে বললেন..
-যাক বাঁচালেন। টিবি ঠিক আছে। আমরা ভাবলাম করোনা-টরোনা..
তানিয়ার এক বছর দু’মাস। হঠাৎ মাত্রাছাড়া খিঁচুনির কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল ব্রেনের সামনের দিকের বেশ খানিকটা অংশ শুকিয়ে গেছে। অথচ করোনা নেগেটিভ শুনে বাড়ির লোক সোৎসাহে বলে উঠলেন..
– তাও ভালো। আমরা ভাবলাম খারাপ কিছু.. চারদিকে যা অবস্থা.. বোঝেনই তো..
কোভিড তার সত্যিকারের ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে মারাত্মক সামাজিক ভীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমনই, লোকে ভুলতে বসেছে করোনার বাইরেও লক্ষকোটি রোগ আছে। তাদের ভয়াবহতাও করোনার চেয়ে অনেকগুণ বেশি! অথচ, করোনা হলেই একঘরে আর সামাজিকভাবে অচ্ছুৎ হওয়ার ভয়। এমনকি যে স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগের মুখে ঢাল হয়ে দাঁড়াচ্ছেন তাঁদের প্রতিও হিংস্র হয়ে দাঁড়াচ্ছেন তাঁদেরই সহনাগরিক।
একদিন হাসপাতালের গেটের কাছে কিছু স্বাস্থ্যকর্মী বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ, সম্মিলিত জনতার চিৎকার শুরু হ’ল..
– আরে দ্যাখ রে বাচ্চু.. মন্টি আয় আয় দেখে যা। ওই দ্যাখ সব করোনা দাঁড়িয়ে আছে। সব এক একটা করোনা!!
এসব আমার নিজের চোখে দেখা।
নিজের চারদিকটা বুঝে নেওয়াও তো কম কথা নয়!
******
প্রতিদিনই শিখছি। প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি ঘটনা আমার শিক্ষক। নিউটনের তৃতীয় সূত্রে পড়েছিলাম, “প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।”
মারীর দেশের নিত্যনতুন অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারি, নিউটনের সূত্রে ‘ক্রিয়া’র বদলে ‘শিক্ষা’ বসালেও সম্ভবত সত্যের অপলাপ হয় না।
‘আঙুল’ আর ‘আয়না’ দুটোই কাছাকাছি উচ্চারণের শব্দ। এটুকু বুঝে নেওয়াই এই শিক্ষক দিবসের প্রাপ্তি।
ভালো লেখা।
আপনাদের লেখা পড়লে ভরসা পাই এখনও। মনে হয় যাই হোক না, আপনাদের মত কেউ তো আছেই। কিন্তু অনেকবার এই ভরসা ভেঙ্গেও গেছে। একান্নবর্তী পরিবারের অনেক সদস্যের চলে যাওয়া দেখেছি, নামকরা ডাক্তারের বিষাক্ত দিক ও চোখে পড়েছে, আবার তেমনই ভরসার হাত ও পেয়েছি।
আমাদের মত মধ্যবিত্তের একটাই সমস্যা, না পারি আমরা নামী দামী হাসপাতালে যেতে, না জোর পাই সরকারি হাসপাতালে মাটিতে ফেলে চিকিৎসা করাতে। মাঝামাঝি যেন কিছুই নেই।
সবাই মিলে কি কিছু একটা করা যায়না এই চিরকালের দৈন্যদশা দূর করতে? দেশের আগে রাজ্য থেকেই শুরু হোক?