নিপোর তিন বছরের জন্মদিনে মার বন্ধু তানা মাসী একটা বড়োসড়, মোটাসোটা টেডি বেয়ার দিয়েছিল। হালকা ছাই-ছাই তার গায়ের রং, চোখগুলো কালো, কিন্তু হাত আর পায়ের তালু ধবধবে সাদা।
তানা মাসি মার সঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকে যাবার পরে বাবার বন্ধু টুকাই কাকু এসে বলেছিল, “নিপো, এই টেডিটা কিন্তু স্পেশাল। ও অনেক ম্যাজিক জানে। রোজ রাত্তিরে ওর কাছে একটা পক্ষীরাজ ঘোড়া আসবে। সেই ঘোড়ায় চড়ে ও চলে যাবে অনেক দূরে। আবার ভোর হবার আগে ফিরে আসবে। তুমি যদি রাত্তিরে মন দিয়ে ঘুমোও, তাহলে কখনও কখনও ও তোমাকে স্বপ্নে নিয়ে যাবে সেই সব অজানা জায়গায়।”
শুনে যেমন নিপো, তেমনই টেডি — দুজনেই অবাক হয়ে গেছিল। টেডি-ও জানত না যে ওর কাছে রাতে পক্ষীরাজ আসে। কই, আগে তো কখনও হয়নি! পরে যখন তানা মাসি জিজ্ঞেস করেছিল, “নিপো, তোর নতুন টেডির কী নাম রাখলি?” তখন নিপো বলেছিল, “ওর নাম বিম্বু। টুকাইকাকু বলেছে।” তানা মাসি হেসে বলেছিল, “টুকাই কাকু তোর টেডির নাম রাখল?” নিপো বলেছিল, “টুকাই কাকু ওকে চেনে। ও রোজ রাতে পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। আমাকেও নিয়ে যাবে স্বপ্নে।” সে কথা শুনে তানা মাসি কেমন অদ্ভুতভাবে টুকাই কাকুর দিকে তাকিয়ে ছিল, আর টুকাই কাকুও কেমন হেসে মাথা ঝুঁকিয়েছিল, তার মানে নিপো বোঝেনি।
নিপো বিম্বুকে নিয়ে রেখেছিল ওর নিজের বিছানায়। প্রথম দিন রাত্তিরে যখন ওকে জড়িয়ে নিপো ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন বিম্বু ভয় পেয়েছিল। ভেবেছিল, এত জোরে ধরে থাকলে ও কী করে পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে করে কোথাও যাবে? কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ঘুমিয়ে পড়েছিল নিজেই। সকালে উঠে দেখেছিল, নিপোর হাত ওকে জড়িয়ে নেই আর। কখন রাতে খুলে পড়েছে। অবাক হয়ে ভেবেছিল, তাহলে পক্ষীরাজ এসে ওকে নিয়ে গেল না কেন? না কি বিম্বু ঘুমিয়ে পড়লে সে আর আসে না?
সেদিন বিকেলে আবার যখন টুকাই কাকু এসেছিল, নিপোকে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী রে? কাল গেছিলি বিম্বুর সঙ্গে?”
নিপো ঠোঁট উলটে, মাথা নেড়ে বলেছিল, “না তো। কখন গিয়েছিল বিম্বু, কখন ফিরেছে, আমি কিচ্ছু জানি না। স্বপ্নেও কিছু দেখিনি।”
টুকাই কাকু বলেছিল, “আমি জানি। পক্ষীরাজ বাড়ি যাবার আগে আমাকে বলে গেছে, ওরা কাল গেছিল রামধনুর দেশে। সেখানে সব কিছু রঙীন! আকাশের রং লাল-নীল-হলুদ-সবুজ, গাছপালা গোলাপি-হলুদ-বাদামী, ঘাসের রং বেগুনি, খয়েরি, নীল… আর সেখানে অনেক ছোটো ছোটো বাচ্চা পার্কে খেলছিল, ওরা দুজনে সেখানে খেলা করল, আর তুমি স্বপ্নে ওদের সঙ্গে খেললে।”
হাততালি দিয়ে নিপো বলেছিল, “কী মজা। আমার স্বপ্ন মনে নেই কেন?”
টুকাই কাকু বলেছিল, “সবসময় স্বপ্ন মনে থাকে না। যেদিন থাকবে, সেদিন তুমি আমাকে বলবে, আর যেদিন তোমার মনে থাকবে না, সেদিন মা-কে বলবে আমাকে ফোন করতে, আমি বলে দেব… কেমন?”
বিম্বু অবাক হয়ে ভেবেছিল, এত কিছু হয়েছে? তাহলে ওর কিচ্ছু মনে নেই কেন?
প্রথমে কয়েক দিন নিপো রোজ মা-বাবার মাথা খেত, “টুকাই কাকুকে ফোন করো, কাল বিম্বু কোথায় গেছিল জানতে হবে…” পরে ও-ও কাকুকে ফোন করে ওর দেখা স্বপ্নের কথা বলত। বিম্বু কোনও দিন যেত পাখিদের দেশে — তার নাম নাকি ক্রৌঞ্চদ্বীপ, কোনও দিন যেত খুব বেঁটে বেঁটে মানুষের দেশে। আবার কোনও দিন যেত রাতচরাদের দেশে। সেখানে লোকে দিনে ঘুমোয়, রাতে জাগে। তাদের চোখ খুব উজ্জ্বল। দিনের আলো তারা সহ্য করতে পারে না। তাই রাতে বেরোয়। প্যাঁচার মতো। নিপো একবার গেছিল ওদের সঙ্গে নিনাভাদের রাজ্যে। নিনাভা-রা অদ্ভুত প্রাণী। ওদের নাকের ফুটো নেই। তাই ওরা হাঁচতে শেখেনি। এই পর্যন্ত বলে নিপো বলেছিল, “টুকাই কাকু আমাকে যে গল্পটা বলেছিলে — সেই টাফা গ্রহের প্রাণীদের মতো।”
শুনে তানা মাসি হেসে কুটিপাটি। বলেছিল, “টুকাই, আপনি যেমন, আপনার চ্যালাও তেমনি। নাকের ফুটো নেই… হিহিহি…” টুকাই কাকু বলেছিল, “তুমি যদি চাও, আমি তোমাকেও ওরকম অনেক নিনাভার গল্প বলতে পারি। তবে তার জন্য আমার পরের প্রশ্নের উত্তর হতে হবে — হ্যাঁ।”
অবাক হয়ে তানামাসি বলেছিল, “কী প্রশ্ন?”
টুকাই কাকু বলেছিল, “আমাকে বিয়ে করবে, তানা?”
এর পরে নিপো অবাক হয়ে দেখেছিল, তানা মাসির গাল, গলা, কান সব কেমন লাল হয়ে গেল, আর তারপরে কেমন অদ্ভুত গলায়, ‘যাঃ’, বলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। আর মা বাবা টুকাই কাকুকে কনগ্র্যাচুলেশন বলতে লাগল। নিপো অবাক হয়ে বলেছিল, “কনগ্র্যাচুলেশন কেন বলছ?”
মা বলেছিল, “তানা মাসি টুকাই কাকুকে বিয়ে করবে বলল যে!”
নিপো আরও অবাক হয়ে বলেছিল, “কিন্তু কই বলল? যাঃ বলল তো।”
বাবা বলেছিল, “নিপো, লোকে যখন তানা মাসি আর টুকাই কাকুর মতো বড়ো হয়, তখন যাঃ মানেই হ্যাঁ।”
নিপো কিছুই বোঝেনি। বিম্বুকে কোলে নিয়ে চলে গেছিল খেলতে। ট্রাই সাইকেলে বসিয়ে বিম্বুকে নিয়ে গেছিল একটা অন্য দূর দেশে।
রোজ সকালে উঠে বিম্বুর মন খারাপ হত। হয় টুকাই কাকু, নয় নিপো গল্প বলত কেমন পক্ষীরাজের পিঠে চড়ে বিম্বু কতদূর দেশে কত মজা করে এসেছে, কিন্তু বিম্বুর কিছু মনেই থাকত না। রোজ প্রতিজ্ঞা করত, আজ আমি রাতে কিছুতেই ঘুমোব না। কিন্তু নিপোর সঙ্গে সারাদিন হুটোপাটি করে চোখ খুলে রাখতে পারত না। নিপো ঘুমোনোর একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ত। পরদিন সকালে উঠে নিপো আর টুকাই কাকুর কথা শুনত, আর ভাবত, আজ আমি কিছুতেই ঘুমোব না। একেবারেই না। মোটেই না।
রাত হলেই ঘুমিয়ে পড়ত অঘোরে।
ওদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে আর একটা বাড়িতে একটা ছেলে থাকত, তাকে নিপোরা চিনত না। ওর নাম ছিল কাটুম। কাটুমের বাবা-মা ছিল আর্টিস্ট। মা ছবি আঁকত, আর বাবা মূর্তি বানাত মাটি দিয়ে। কাটুমের বাবা মা খুব বিখ্যাত। ওরা সারা দেশে ওদের ছবি আর মূর্তির এক্সিবিশন করে বেড়াত, আর কাটুম থাকত আয়ার সঙ্গে। একা একা কাটুমের মন খারাপ হলে ও ওর মা-বাবার দেওয়া অনেক খেলনা নিয়ে খেলত, আর খেলনাদের সঙ্গে বেড়াতে যেত দূর দূর দেশে।
কাটুমের বাবা ওকে একটা ঘোড়া বানিয়ে দিয়েছিল। কাটুম ওর নাম দিয়েছিল পক্ষীরাজ। ওর ডানা ছিল না, কিন্তু কাটুম মনে মনে ওকে দুটো ডানা দিয়েছিল। কাটুমের পিঠে ও একা একা দেশ বিদেশে যেত। ওর ঘরে বসেই উড়ে যেত সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে। তারপরে ফিরে আসত মা-বাবা বাড়ি আসার আগেই। ওদের বেড়ানোর কথা কেউ জানত না। মা জানত না, বাবা জানত না, আয়া মাসি জানত না — জানত কেবল কাটুম আর পক্ষীরাজ। আর কেউ না।
একদিন এবাড়িতে নিপো, আর ওবাড়িতে কাটুম বড়ো হয়ে গেল।
তখন বিম্বু আর পক্ষীরাজ দুজনের কাজ শেষ হয়ে গেল। বাচ্চাদের বিছানা থেকে বিম্বুকে সরিয়ে নিয়ে গেল নিপোর মা। ওর ঠাঁই হলো একটা প্যাকিং বাক্সে। আর কাটুমের ঘরের এক কোণে রঙ-ওঠা নীল ঘোড়াটার গা থেকে ধুলো মুছে দিত ওদের কাজের মেয়ে।
একদিন নিপোর মা ঘর সাফা করতে করতে বললেন, “নিপো, তোর এই ছোটোবেলার খেলনাগুলো যেগুলো তানা মাসি আর টুকাই কাকুর মেয়েকে দিসনি, সেগুলো কী করব রে?”
নিপো তখন ক্লাস নাইনের কঠিন অঙ্ক করছিল। বলল, “ওগুলো নিয়ে তো আমি খেলতাম। এখন আর খেলি না, কিন্তু পিদিম কি আর এগুলো নেবে? ও তো এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। ক্লাস সেভেনের মেয়েরা আজকাল খেলনা নিয়ে খেলে না।”
নিপোর মা বলল, “আমাদের কাজের মেয়েকে দেব? ওর নাতি খেলতে পারবে। গরিব মানুষ, খেলনা কোথায় পাবে বল?”
নিপো ঘাড় নেড়ে বলল, “দিয়ে দাও।”
মা কাজের মেয়েকে সব খেলনাগুলো দিয়ে বলল, “দেখো, এই টেডিটা খুব নোংরা হয়েছে। নিপোর খুব প্রিয় ছিল তো, তাই এই অবস্থা। এটা পছন্দ না হলে নিও না…”
কাজের মেয়ে বাক্সটা হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল, তারপরে রাস্তার মোড়ে একটা নির্জন জায়গায় এক চিলতে ঘাসের ওপর বিম্বুকে নামিয়ে রেখে, বাকি খেলনাগুলো নিয়ে চলে গেল।
কাটুমরা সবাই কাল প্লেনে করে দিল্লি চলে গেছে, ওর বাবা ন্যাশনাল গ্যালারিতে কিউরেটর হয়েছে। ওদের বাড়ি থেকে সব পুরোনো জিনিস-পত্র ফেলে দেওয়া হয়েছে। সন্ধেবেলা ওদের সুইপার বিরাট থলে ভর্তি করে ওদের রেখে যাওয়া সব কিছু নিয়ে এল রাস্তার মোড়ের কাছে ময়লার ভ্যাটে ফেলবে বলে। বগলে এনেছিল একটা গাঢ় নীল রঙের ঘোড়া। বাখারির ফ্রেমের ওপরে নীল কাপড় সেঁটে বানানো। কী মনে হলো, ওটাকে ভ্যাটে না ফেলে রাস্তার মোড়ের পাশে একটুখানি ঘাসের ওপর কে যেন নোংরা একটা টেডি ফেলে গেছে, সেখানে রেখে দিয়ে চলে গেল।
সন্ধে হয়ে এল, আকাশের আলো নিভে গেল, রাস্তার আলো জ্বলে উঠল। মোড়ের রিকশওয়ালারা একে একে বাড়ি চলে গেল। নির্জন রাস্তার মোড়ে, লালচে আলোর নিচে টেডি বলল, “কে তুমি?”
পক্ষীরাজ বলল, “আমি পক্ষীরাজ।”
টেডি বলল, “তুমি পক্ষীরাজ? আমার ছোটোবেলায় তুমি আমার কাছে আসতে রাত্তিরে? যখন আমি ঘুমিয়ে পড়তাম? তোমার পিঠে আমি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতাম? আমাকে মনে পড়ে? আমি বিম্বু।”
বুড়ো পক্ষীরাজ ছানিপড়া চোখে টেডিকে দেখল। মনে পড়ল, একদিন ও কেমন কাটুমকে পিঠে নিয়ে দূর দূরান্তে যেত। বলল, “দেশে বিদেশে আমি যেতাম বটে। তোমাকে নিয়ে যেতাম কি না মনে নেই তো?”
টেডি বলল, “মনে করে দেখো, মনে করে দেখো — আমি নিপোর ঘরে থাকতাম, নিপোর খাটে শুতাম। আমি আর তুমি যেতাম ক্রৌঞ্চদ্বীপে — সেখানে পাখির মেলা। যেতাম নিনাভাদের কাছে — তারা হাঁচতে জানে না। আরও কত জায়গায় গেছি আমরা…”
পক্ষীরাজের মনে পড়ল, ও একদিন কাটুমকে নিয়ে কত জায়গা ঘুরেছে — দূর দ্বীপে, যেখানে গভীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় বিরাট বাঘ, আরও দূরে পাহাড়ের গায়ে সেই ঝরনা — রোদ উঠলে মনে হয় যেন হাজার হাজার হীরে ঝরঝর করে পড়ছে তো পড়ছেই… বলল, “সে আমি নই। কিন্তু এখন তো তোমার পক্ষীরাজ এখানে নেই। চলো, যাবে আমার সঙ্গে? আবার আমরা যাব — পাখিদের দ্বীপে, নিনাভাদের দেশে, দূরের পাহাড়ে?”
টেডি বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাব। যাব।”
পক্ষীরাজ বলল, “চলো তাহলে, উঠে বসো আমার পিঠে।”
পরদিন সকালে রিকশওয়ালারা এসে বলল, “আরে দেখ দেখ, রাত্তিরে কে এসে ভালুকটাকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিয়ে গেছে।”
আর একজন বলল, “থাক ওমনিই।”
ওরা তাই ওমনিই আছে — কিন্তু ওরা ওখানে নেই। রাস্তার মোড়ে একটা বুড়ো টেডি আর একটা বুড়ো ঘোড়া আছে, কিন্তু বিম্বু আর পক্ষীরাজ ওখানে আর নেই। ওরা উড়ে গেছে অনেক দূরে। ওরা এখন কখনও থাকে পাখীদের দেশে, কখনও বাঘেদের জঙ্গলে, কখনও বা যায় পরীদের রাজ্যে, বা রামধনুর দেশে।
আর ফিরে আসে না। এখানে আর ফিরে আসার দরকার নেই।