আমি অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মানুষের চেহারা নিয়ে কিছু বলা অনুচিত। না হলে ভদ্রলোককে ছোটোখাটো জলহস্তীর সাথে তুলনা করাই যেত। তবে জলহস্তী না বলে সিন্ধুঘোটক বললে মিলটা আরও জুতসই হতো। তিনি চেয়ারে যেভাবে থেবড়ে বসেছেন, তাতে সহজে উঠে দাঁড়াতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।
তাঁর পোশাক পরিচ্ছদও ঠিক সাধারণ মানুষের মতো না। পরনে বুকের বোতাম খোলা বেশ রঙচঙে জামা। গলায় মোটা মোটা দুটো চেন। সোনার চেন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। দু-হাতের দশটা আঙুলে কুড়িটা পাথর লাগানো আঙটি। রবীন্দ্রনাথের কল্যাণে সবুজ পান্না আর লাল চুনি চিনতে পারলাম। বাদবাকি পাথর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কিছু বলে যাননি।
তবে অবাক হওয়ার কারণটা অন্য। ভদ্রলোক খুপরিতে ঢোকার থেকে নিজের সমস্যা না বলে আমাকে নিয়ে পড়েছেন। কিছুক্ষণ আমার কপালের দিকে অপলক তাকিয়ে বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনার কপালের রেখাই বলে দিচ্ছে, আপনার কন্যাযোগ। সম্ভবত আপনার দুটি কন্যা আছে। ঠিক বললাম?
আমি অবাক ভাবে মাথা কাত করে বললাম, একেবারে ঠিক।
ভদ্রলোক চোখ বুজে ভুরুটুরু কুঁচকে বললেন, আপনার স্ত্রীর নামের প্রথম অক্ষর R। মিলেছে?
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, একশ ভাগ মিলেছে।
ভদ্রলোক মন ভুলানো হাসি হেসে বললেন, আসলে আমি কে জানলে আপনি এতটা আশ্চর্য হতেন না।
আমি গদগদ কণ্ঠে বললাম, আপনি কে আমি জানি। আর জানি বলেই তো এতোটা আশ্চর্য হচ্ছি। আপনি হলেন গোল্ডমেডেলিস্ট জ্যোতিষার্ণব শ্রী ভৃগু দ্বিতীয়, ব্র্যাকেটে আসল। মোড়ের মাথায় আপনার ছবি দিয়ে বিশাল পোস্টার আছে। যেতে আসতে দুবেলা দেখি।
শ্রী ভৃগু দ্বিতীয় (আসল) প্রশ্রয়ের হাসি দিলেন। বললেন, আপনাকে যা বললাম, তা অত্যন্ত সামান্য। এটুকুতেই আশ্চর্য হবেন না।
বললাম, না না,সে কারণে আশ্চর্য হইনি। আমি ফেসবুকের লেখক। আপনি যা বললেন, সে সব কিছু ফেসবুকেই দেওয়া আছে। আর বাবা মা মিলে আমার যা ইউনিক নাম রেখেছেন, তাতে আমার ফেসবুক প্রোফাইল খুঁজে পাওয়া দেড় সেকেন্ডের ব্যপার। আমি অবাক হচ্ছি এই ভেবে আপনার মতো একজন স্বনামধন্য গোল্ডমেডেলিস্ট জ্যোতিষার্ণব আমার মতো নগণ্য নন গোল্ডমেডেলিস্ট ডাক্তারকে দেখাতে এলেন কেন?
জ্যোতিষীদের মনে হয় কোনো পরিস্থিতিতেই ঘাবড়াতে নেই। তিনি মুখে হাসি এনে বললেন, জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে।
আমি বললাম, সেতো বুঝলাম, কিন্তু ডাক্তার দেখানোর উপর তো আপনার হাত আছে।
না, নেই। জন্ম, মৃত্যুর দুটোই যেই ব্যক্তির হাতে, তাঁকে চয়েস করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনার কাছে আসাটা আমার পূর্ব নির্ধারিত।
অনেক রোগী জমে আছে, আর এঁড়ে তর্ক করার সময় নেই। এঁড়ে তর্ক শব্দটা মাথায় আসতেই মনে হলো বাংলা ভাষাটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইংরাজির থেকে জোরদার। লজিকাল ফ্যালাসি আর এঁড়ে তর্ক দুটো শব্দের মধ্যে তুলনাই হয়না। বললাম, এবার বলুন কেন দেখাতে এসেছেন?
শ্রী ভৃগু দ্বিতীয় (আসল) বললেন, ডাক্তারবাবু, আমায় বাঁচান। অর্শের ব্যথায় মরে যাচ্ছি। পরপর দুদিন মাঝ রাতে হাসপাতালে গিয়ে ডামাডোল ইনজেকশন নিয়ে ব্যথা কমিয়েছি।
ওটা ডামাডোল ইনজেকশন নয়, ট্রামাডল ইনজেকশন।
সে যাই হোক, ডামাডোল ভালোই বেঁধেছে। আমি মরে যাব ডাক্তারবাবু, কিছু একটা করুন। আমি নিজের কুষ্ঠি বিচার করে বুঝতে পেরেছিলাম, সামনে বড়সড় ফাঁড়া আসবে। কিন্তু এভাবে যে আসবে বুঝতে পারিনি। আগে বুঝতে পারলে তবু একটা শান্তি স্বস্ত্যয়ন যজ্ঞ টজ্ঞ করা যেত। আজ শিলিগুড়িতে চেম্বার ছিল। ফ্লাইটের টিকিট কাটা। ক্যান্সেল করে দিলাম।
আমি বললাম, ঈশ, কতো মানুষ আপনার আশায় বসে ছিল সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে বলে। তাঁদের কথা ভেবেই খারাপ লাগছে।
ডাক্তারবাবু, আপনি আগে আমার কথা ভাবুন। তাঁদের কথা ভাবার জন্য আমি আছি।
তাহলে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ুন।
সিন্ধু ঘোটককে উল্টো করে শোয়ানোর পদ্ধতি বেশ জটিল। বিশেষ করে সেই সিন্ধু ঘোটকের যদি পেছনে সমস্যা থাকে। তবে প্রাণের দায়ে গরুও গাছে ওঠে, সিন্ধু ঘোটকও উল্টো হয়।
আমি পরীক্ষা করার পর বললাম, উঠে পড়ুন।
শ্রী ভৃগু দ্বিতীয় (আসল) বললেন, সোজা হতে পারছিনা যে।
আমি হাত ধরে টেনে তুলে বললাম, আমার দ্বারা হবে না। পরিস্থিতি বেশ জটিল। কাঁটা ছেড়া করতে হবে।
উনি বললেন, ডাক্তারবাবু, দেখুন না ওষুধে যদি হয়। শুনেছি, ওখানে কাঁটা ছেড়া করলে ক্যানসার হয়।
বললাম, ভুল শুনেছেন। কাঁটা ছেড়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। তবে আপনি গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব পরিবর্তন করে আরেকবার চেষ্টা করতে পারেন। ঐ চিকিৎসাটা আমার ঠিক জানা নেই।
উনি কাতরে বললেন, করেছি, সব গ্রহকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেছি। সূর্য, চন্দ্র থেকে রাহু কেতু সবার কুপ্রভাব দূর করার জন্য পাথর ধারণ করেছি। এই যে পান্নাটা দেখছেন, এটা বুধ গ্রহের অশুভ প্রভাব কাটানোর জন্য। অর্শ ভগন্দরে দারুণ উপকার পাওয়ার কথা।
আমি ততক্ষণে অবাক হতেও ভুলে গেছি। কোনো রকমে বললাম, সূর্য, চন্দ্র এরা গ্রহ?
উনি হাসলেন, বললেন হ্যাঁ, জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে নবগ্রহ হলো সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, কেতু, রাহু। আসলে জ্যোতিষ হলো একটা বিজ্ঞান। তার মূল সূত্রগুলো না জেনে এভাবে আধখেঁচড়া জানলে আপনি কিছুই বুঝতে পারবেন না।
বললাম, এটুকু শুনেই আমার বিজ্ঞান, ভূগোল, গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র সব গুলিয়ে গেছে। আমি আর জানতে চাই না।
ওষুধপত্র লিখে ওনাকে বিদায় করা দরকার। বারবার বললাম, সার্জেন দেখাতেই হবে। ওষুধপত্র খেলে আর সেঁক নিলে সাময়িক কষ্ট কমতে পারে, তবে সারবে না। কদিন বাদে আবার সমস্যা শুরু হবে।
উনি যখন ধন্যবাদ টন্যবাদ জানিয়ে একদিকে কাত হয়ে বিদায় নিচ্ছেন, বললাম, যাওয়ার আগে একবার বলে যান না, সামনে আমার কোনো ফাঁড়া আছে কিনা?
উনি বললেন, এভাবে তো বলা যায় না। আপনি আপনার কুষ্ঠি নিয়ে একদিন আমার চেম্বারে চলে আসুন। আমার পাঁচশো টাকা ভিজিট। আপনার জন্য অর্ধেক করে দেব।
বললাম, ‘পুরো পাঁচশো দিতে আমার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা অন্য জায়গায়। আমার তো কোনো কুষ্ঠি নেই। বাবা মা লেখা পড়া শিখিয়েছেন, খেলা ধুলোয় উৎসাহ দিয়েছেন, ঠিক ভুল চিনিয়েছেন। কিন্তু কুষ্ঠি নামক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটাই করেন নি। তাহলে কি আমি ভবিষ্যৎ জানতে পারব না? আগে থেকে জেনে রয়ে সয়ে মরতে পারব না? দুম করে মরে যাব?
শ্রী ভৃগু দ্বিতীয় (আসল) কথা বাড়ালেন না। তিনি ততক্ষণে বুঝে গেছেন আমি পাপ গ্রহ শনি, রাহু ও কেতুর প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছি। এতটাই, যার প্রভাব স্বয়ং শ্রী ভৃগু দ্বিতীয় (আসল)ও কাটাতে পারবেন না।
দুটি সংযোজনঃ
১. গোল্ডমেডেলিস্ট জ্যোতিষার্ণব ভদ্রলোকের নাম পরিবর্তিত।
২. ছবি নেট থেকে ঝাড়া।