১.
– ডাক্তারবাবু, বাচ্চাকে গ্রাইপ ওয়াটার রোজ কতটা করে খাওয়ানো উচিত?
– এটা খাওয়ানোর কথা কে বললো?
– না.. মানে.. সেরকম কেউ নয়। সব বাচ্চাই তো খায়..
– কেন খায়? কার পরামর্শে খায়?
– হজমের জন্য তো গ্রাইপ ওয়াটার দিতেই হবে। কেমন পেট ফাঁপ হয়ে থাকে, পেটে আওয়াজ হয়। তারপর টক টক পটি..
– আর সেটা গ্রাইপ ওয়াটার খেলে ভালো হয়ে যায়। তাই তো?
– হ্যাঁ.. মানে..
– শুনুন, এই বস্তুটির উপকারিতার কোনও বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নেই। বরং, প্রথম ছ’মাসে বুকের দুধের বাইরে এসব হাবিজাবি খাওয়ালে বুকের দুধ কমে যেতে পারে।
– তাহলে হজমের সমস্যা হয় যে..
– এই বয়সে বাচ্চাদের পায়খানা এরকমই হয়। সারাদিনে যতবার দুধ খাবে তারপর বারবার অল্প অল্প করে জলের মতো পায়খানা হতে পারে। সন্ধের দিকে পেট মুচড়ে ব্যথা হতে পারে। আবার কখনও পাঁচ-সাতদিন পায়খানা নাও হতে পারে।
– তাহলে গ্রাইপ ওয়াটার..
– ফেলে দিন। সিম্পলি ফেলে দিন। প্রমাণ নেই এমন কোনোকিছু বাচ্চাকে দেবেন না। ডাক্তারি শাস্ত্রের কোনো টেক্সট বুকে বাচ্চাকে গ্রাইপ ওয়াটার খাওয়ানোর নিদান নেই।
– তাহলে টিভিতে দেখায় যে? কতজন ব্যবহার করেন..
– হনুমান চালিশার অ্যাড দেখেছেন? সুলতানী পাথর?
২.
– সে তো দেখতেই পাচ্ছি। গলার চারদিকে ঘা হয়েছে। কবে থেকে হয়েছে?
– তা পেরায় মাসখানেক হয়েইব্যা। একটা শিকড় বেট্যা লাগাইছিলি হপ্তাখানেক। কিচ্ছু কাজ হয়নি বাপু। মোরা বলি ডাক্তার দেখি লেই..
– সবার আগে বাবা তোমার এই মাদুলিটি খুলতে হবে।
– উ বাপা গ.. এউটুকু বাচ্চা। নজর লেগেইব্যা।
– তা মাদুলি দিয়ে কোন নজরটা আটকাচ্ছে? সেই তো গলায় ঘা করে এনেছো..
– তুমি একটু দেখ্যাশুন্যা ওসুদ দিয়্যা দও..
– না, হবে না। মাদুলি না খুললে ঘা ভালো হবে না। ওই মাদুলির দড়িতে বারবার ঘষা লেগে লেগে চামড়াটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া, ওই দড়ি থেকে জীবাণু ছড়াচ্ছে। তুমি বলো তো.. এই যে বাচ্চার জামাকাপড় রোজ কেচে পরিষ্কার করো.. মাদুলি কাচো রোজ? যত আবর্জনা ওই দড়িতে থাকে।
– তাহলে কী করি বল ত..
– একদম খুলে ফেলো। তোমার খুব বিশ্বাস থাকলে বাচ্চার বিছানার তলায় রেখে দিও কিন্তু গায়ে পরাবে না।
– কিছু হবে নি ত বাবু?
– শোনো.. এইসব মাদুলি দিয়ে রোগ আটকে গেলে আমরা ডাক্তাররা রাস্তায় বসে তুলসীকাঠের মালা গুনতাম আর সরকার হাসপাতাল না বানিয়ে মাদুলি শিল্প খুলতো..
– আচ্ছা লও, খুলে দিব।
৩.
– হ্যালো
– ডাক্তার কাকু, আমি *
– হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। বল.. কেমন আছিস বাবা?
– আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
– আমার ওই একরকম.. তুই ওষুধটা খাচ্ছিস তো? বন্ধ করিস নি তো?
– না, খাচ্ছি। কাকু, তুমি আর এদিকে আসবে না?
– আসবো রে.. কী করবো বল? গাড়িঘোড়া সব বন্ধ তো..
– কাকু, বাবা বলেছে লক-ডাউন উঠলে তোমার জন্য আলু দিয়ে যাবে।
– তাই?
– আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন রাখি। খেলতে যাবো।
– আচ্ছা যা।
******
প্রতিদিন ভাবি একদম নিক্তিমাপা প্রফেশনাল হয়ে যাবো। ‘হ্যাঁ/না/এই ওষুধটা খাওয়াবেন’। ব্যাস!! এর বাইরে অনর্থক বকবক করবো না। তবু ঠিক বলা হয়ে যায়। কেন যে শুধু শুধু সময় নষ্ট করি..
নচিকেতা অনেকদিন আগেই ডাক্তারদের ‘কসাই’ বলে দাগিয়ে গেছেন। আজ ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কের ক্রমাবনতির জন্য এসব মানুষ-খেপানো গান-ব্যবসায়ীদের অবদান কম নয়। ঠান্ডা ঘরে বসে ডাক্তারদের গালাগালি করলেই খুব সহজে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়।
মাঠে নেমে কাজ করাটা অনেক কঠিন নচিবাবু!! স্বাধীনতার পরে দেশের গড় আয়ু দ্বিগুণ হয়ে যাওয়াটা ফাঁকা বুলিতে আসেনি। কিছু খারাপ মানুষ সব জীবিকাতেই আছেন। সব, সব জীবিকায়। কিন্তু নচিবাবু যেভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে জনমানসে ডাক্তারদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন তার জন্য কোনও সমালোচনাই যথেষ্ট নয়। আপনাদের মতো কিছু কুচক্রী মানুষের জন্য বহু তরুণ ডাক্তার কাজ করার ইচ্ছে হারিয়েছেন বা হারাচ্ছেন।
আজ থেকে বছর পাঁচেক আগেও স্যোশাল মিডিয়া বা অন্যান্য জায়গায় ডাক্তাররা সেভাবে নিজেদের বক্তব্য রাখতেন না। শুনে নিন, ডাক্তাররা কাজের ফাঁকে ফাঁকে কলম, গিটার, তুলি, ক্যামেরা হাতে নিলে অনেক তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর ভাত মারা যাবে। কাজের সুবাদে ডাক্তারদের যে বিপুল সংখ্যক মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয় তার প্রতিটিই একটি করে গল্প, গান, কবিতা হওয়ার দাবী রাখে। ঠান্ডা ঘরের কষ্টকল্পনা নয়। জীবনসমুদ্র সেঁচে তুলে আনা অভিজ্ঞতার মুক্তো।
এতদিনে মানুষ বেশ ভালো করে বুঝে গেছেন সমাজে এসব বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী। সমাজের কোন অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা এই মানুষগুলি পূরণ করেন? সমাজ-বদল রাত পোহাতেই শ্যামল তৃণদল। তারপর সুযোগ মতো কারো হাতের ছোঁয়ায় শতদল হয়ে ফুটে ওঠে। শাসকের ছায়ায় নির্বিঘ্নে গান-কবিতার বিকিকিনি..
আর হ্যাঁ, সেজেগুজে ক্যামেরার সামনে দু-প্যাকেট চাল বিলি করে সমাজসেবী হওয়া যায় না। ডাক্তাররা তাঁদের কাজ ঠিকই করবেন। গরীব বিধবা বৃদ্ধা ছানির জন্য দেখতে না পেলে, প্রত্যন্ত গ্রামের আদিবাসী বাচ্চাটার জ্বরে গা-পুড়ে গেলে তারা হাসপাতালে এসেই ডাক দেয়, ‘ও ডাক্তার’। সে ডাক রোগমুক্তির সন্ধানে। ডাক্তারের মধ্যেই তারা ভরসা খোঁজে। ডাক্তার তার অধিত বিজ্ঞানের ভরসায় স্টেথো বসায়। আর কেউ না জানুক, বিধবা বৃদ্ধা আর বাচ্চার বাবা-মা বেশ জানে ওই স্টেথোস্কোপ গলায় ঝোলানো মানুষটাই তার অসময়ের সাথী। স্টেথোস্কোপ ঝোলানো মানুষটার সাথে কেমন একটা অব্যক্ত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই মানুষটা হাজারবার নিক্তিমাপা প্রফেশনাল হতে চেয়েও পারে না। কেন, কে জানে?
ছুরি, কাঁচির সাথে কলম ও ধরুন ডাক্তারবাবু, তাহলে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারবো।
“ডাক্তাররা কাজের ফাঁকে ফাঁকে কলম, গিটার, তুলি, ক্যামেরা হাতে নিলে অনেক তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর ভাত মারা যাবে। কাজের সুবাদে ডাক্তারদের যে বিপুল সংখ্যক মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয় তার প্রতিটিই একটি করে গল্প, গান, কবিতা হওয়ার দাবী রাখে। ঠান্ডা ঘরের কষ্টকল্পনা নয়। জীবনসমুদ্র সেঁচে তুলে আনা অভিজ্ঞতার মুক্তো।”
আমি আপনার এই বক্তব্যের সঙ্গে ১০০% সহমত। আসলে এই জগতে সমালোচনা করাটাই সহজ, কারন সেটা বাইরে থেকে করা যায়- কোনো দায় না নিয়েই।
আমরা পড়েছিলাম “সব ক্ষার ই ক্ষারক কিন্তু সব ক্ষারক ক্ষার নয়।” কেতা বাবু ও তাই। এরা নিজেদের ভাবে সলিল চৌধুরী। আমার বাবা বলতেন এরা বন্ধ্যা গাছ, তর তর করে বেড়ে ওঠে, ফল দেয় না। যে গাছ ফল দেয় সে নুয়ে পরে। একজন ডাক্তার কে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা এদের নেই। আপনি যা লিখেছেন, সেটা হয়তো উনি বুঝবেন না, সস্তার হাততালি কুড়ানোর লোক, এত গভীরতা আছে কি?
খুব ভালো লাগলো