১। পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী, মনোবিদ, মনোচিকিৎসকদের ভয়াবহ অপ্রতুলতার এই দেশে মূলত জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই আলোচনা। এতে ওষুধের নাম বা ডোজ নেই।
২। আত্মহত্যার কিছু সামাজিক-জনতাত্ত্বিক উপাদান:
- বয়েস- আত্মহত্যার হারের দুটি শিখর দেখতে পাওয়া যায়; অল্পবয়সী (১৫-৩৫ বছর বয়স্ক) আর বেশিবয়সী (৭৫ বছর বা তার বেশি বয়েস)।
- লিঙ্গ- যদিও মেয়েরা ছেলেদের থেকে আত্মহত্যার চেষ্টা বেশি করে, ছেলেরা সফল হয় বেশি।
- বিবাহ- বিবাহিত মানুষের তুলনায় বিবাহ বিচ্ছিন্ন, বিধবা, এবং অবিবাহিতদের মধ্যে হার বেশি।
- পেশা- চিকিৎসক, চিকিৎসকর্মী যেমন ফার্মাসিস্ট, কেমিস্ট, এবং কৃষকদের মধ্যে হার বেশি। সম্ভবত নাগালের মধ্যে বিষ জাতীয় বস্তুর সহজলভ্যতা।
- বেকারি- কোনোদিন চাকরি পায়নি এমন লোকের চেয়ে চাকরি চলে গেছে এমন লোকের মধ্যে হার বেশি।
- অভিবাসন- চাকরি বা অন্য কারণে গ্রাম ছেড়ে শহর অভিমুখী বা অন্য শহর, রাজ্য বা দেশ এ অভিবাসনরতরা বেশি ভঙ্গুর।
৩। পরিবেশগত উপাদান: জীবনে বেঁচে থাকার ওপর চাপ- বিভিন্ন ধরনের ঘটনা যা চাপ তৈরি করে যেমন
- ব্যক্তিগত সম্পর্ক: স্বামী/স্ত্রী, পরিবারের অন্য সদস্য বা বন্ধুবান্ধব বা প্রেমিক/প্রেমিকার সাথে ঝগড়া, কলহ;
- প্রত্যাখ্যান: বন্ধু বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া;
- ক্ষতি: আর্থিক ক্ষতি বা প্রিয়জনের বিয়োগ।
- সামাজিক পরিবর্তন: দ্রুত রাজনৈতিক/ অর্থনৈতিক পরিবর্তন
- অন্যান্য যেমন লজ্জা, অপমান, গ্লানিবোধ, দোষী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ভয় ইত্যাদি
৪। আত্মহননকামী মানুষজনের মানসিক অবস্থা: তিনটি মূল বৈশিষ্ট্য আছে এই ধরণের মানসিক অবস্থার-
(ক) দোদুল্যমানতা: বেশিরভাগ মানুষের মনে আত্মহত্যা করার বিষয়ে মিশ্র মনোভাব থাকে। একদিকে বেঁচে থাকার ইচ্ছে আর অন্যদিকে মরে যাওয়ার ইচ্ছে ঢেঁকির মতো ওঠানামা করে। বেঁচে থাকার যন্ত্রণা থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছের পাশাপাশি বেঁচে থাকার ইচ্ছে অন্তর্নীল বইতে থাকে। অনেক আত্মহননকামী মানুষ কিন্তু সত্যি সত্যিই মরতে চায় না – তারা কেবল জীবন নিয়ে অসুখী। যদি সাহায্য করা যায় আর বেঁচে থাকার ইচ্ছের পরিমাণটা বেড়ে যায় তাহলে আত্মহত্যার রিস্ক অনেকটা কমে যায়।
(খ) আবেগপ্রবণতা: আত্মহত্যা কিন্তু একটা আবেগতাড়িত কাজও বটে। অন্যান্য আবেগের মতো আত্মহত্যা করার আবেগটাও ক্ষণস্থায়ী, কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা থাকে। প্রাত্যহিক কোনো না কোনো নেগেটিভ ঘটনায় এটা শুরু হয়। ওই গুলোকে কমিয়ে দিয়ে, কিছু সময় হাতে পেলে আত্মহত্যা করার ইচ্ছেটাকে কমানো সম্ভব।
(গ) অনমনীয়তা: যখন মানুষ আত্মহননকামী তখন তাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি বা কাজকর্ম -সবই কেমন সংকুচিত হয়ে পরে। সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্য উপায়গুলি আর ভাবনার মধ্যে আসে না। তারা কেবলই মারাত্মক চিন্তাভাবনা করে।
আত্মহননকামী মানুষজনের একটা বড় অংশ তাদের আত্মহত্যা করার ভাবনাচিন্তা বা ইচ্ছেগুলো কোনো না কোনো ভাবে প্রকাশ করে অন্যদের কাছে। তারা সঙ্কেত পাঠায়, নানান ধরণের বিবৃতি দেয় যেমন, “মরে যেতে চাই”; “নিজেকে মূল্যহীন মনে হচ্ছে”; ইত্যাদি ইত্যাদি।
৫। সমস্যাগুলো যে ধরণেরই হোক না কেন, সারা পৃথিবী জুড়ে আত্মহননকামীদের অনুভূতি ও চিন্তাভাবনা প্রায়শই একই খাতে বয়ে চলে। অনুভূতি-চিন্তাভাবনার নমুনাগুলি এমন :
(১) দুঃখিত, বিষণ্ন – “মনে হয় মরে গেলেই ভালো”;
(২) একাকি – “কিছুই করতে পারি না আমি”;
(৩) অসহায় – “আর নিতে পারছি না”;
(৪) হতাশ – “আমি একটা হেরে যাওয়া মানুষ, বোঝা”;
(৫) অপদার্থ – “আমাকে ছাড়াই অন্যরা বেশি সুখী থাকবে”।
৬। আত্মহত্যা সংক্রান্ত কিছু অতিকথন ও বাস্তব সত্য:
(ক): অতিকথন- যারা আত্মহত্যা নিয়ে কথাবার্তায় বলে তারা আত্মহত্যা করে না।
বাস্তব– যারা আত্মহত্যা করে, তারা তাদের অভিপ্রায় সম্পর্কে বেশিরভাগ সময়ই কিছু না কিছু সতর্কবার্তা দেয় তার আগে।
(খ) অতিকথন- আত্মহননকামী মানুষজন মরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বাস্তব– বেশিরভাগই দোলাচলে ভোগে।
(গ) অতিকথন- কোনো রকম সতর্কবার্তা ছাড়াই আত্মহত্যা ঘটে যায়।
বাস্তব– বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রচুর ইঙ্গিত দেয়
(ঘ) অতিকথন- সব আত্মহত্যা কে আটকানো যায় না।
বাস্তব– বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আটকানো যায়।
(ঙ) অতিকথন- একটা সঙ্কট জনক অবস্থা থেকে উন্নতির অর্থ হ’ল আত্মহত্যার ঝুঁকি উবে গেছে।
বাস্তব– বহুক্ষেত্রেই ওই উন্নতির সময়েই মানুষটি সফল ভাবে আত্মহত্যা করে কারণ সেই সময়ে ধ্বংসাত্মক কাজটা সফলভাবে করার শক্তি খুঁজে পায়।
প্রথম পর্ব এখানে সমাপ্ত। বাকি আলোচনা যেমন – কি ভাবে ওই ধরণের মানুষজনকে চিহ্নিত করা যায়, চিহ্নিত করার পরে কি কর্তব্য, ঝুঁকি কতটা কি ভাবে মাপা যায়, একজন সাধারণ মানুষ, প্রশিক্ষণ না পাওয়া স্বাস্থ্যকর্মী কি কি ভাবে সাহায্য করতে পারেন এসব তুলে ধরা যাবে।
এটুকু মনে রাখা প্রয়োজন যে আত্মহত্যা কোনো অনিবার্য ঘটনা নয়, সবাই মিলে চেষ্টা করলে এটা নিবারণযোগ্য।
আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগলে কথা বলুন প্লিজ। চারপাশে খুঁজে পেতে দেখুন, কেউ না কেউ আছে আপনার কথা শোনার জন্য,সত্যিকারের শোনা। পৃথিবীটা যত খারাপ ভাবছেন ততটা খারাপ নয়। সেটাকে আরো ভালো করার লড়াই এ হাল ছেড়ে দিলে হবে না।
১০ই সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব আত্মহত্যা নিবারণ দিবস।