স্যুইংডোর ঠেলে এবার ঢুকলেন বছর তিরিশের এক মহিলা। আর তাঁর গায়ের সঙ্গে লেপ্টে পায়ে–পায়ে এল সমাদৃতা। সমাদৃতা মিত্র। বয়স সাত।
–ডাক্তারবাবু, আমার মেয়ের কিন্তু স্কিনটা খুব খারাপ।
কোনো ভূমিকা–টুমিকা নয়, সটান একেবারে উপসংহারে পৌছে গেলেন ভদ্রমহিলা।
–কেন বলুন তো?
খুব নিরীহ মুখে, নিরুত্তাপ গলায় প্রশ্নটা করলেন ডাঃ গুপ্ত,
–কেন মানে? লিভার!
–লিভার?
মুখ তুললেন ডাঃ গুপ্ত। ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন তখনও।
–আপনি বসুন না।
বসলেন ভদ্রমহিলা। বসেই আবার বললেন–হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, লিভার। ওর লিভারটা খুব খারাপ।
–কিন্তু একটু আগে যে বললেন ওর স্কিনটা খারাপ!
ডাঃ গুপ্তের ছদ্ম–বিস্মিত ভাব।
–হ্যাঁ, মানে লিভারই তো আসল, তার থেকেই তো সব হয়েছে।
বেশ দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে বললেন ভদ্রমহিলা।
–তাই বুঝি?
হ্যাঁ, দেখুন না, কী ফর্সা মেয়ে হয়েছিল আমার, আর এখন…ইস, দিন–দিন আরও কালো হয়ে যাচ্ছে। সেই যে দু’বছর আগে ওর জনডিসটা হল, তার পর থেকেই…আসলে লিভারটা ওদের বাড়ির সকলের খারাপ… ওর বাবার…
বলেই চললেন ভদ্রমহিলা। সমাদৃতা চেয়ারে মাথা নীচু করে বসে পা দিয়ে মেঝেতে আঁকিবুকি কাটছে।
ডাঃ গুপ্ত বললেন—ও স্কুলে যাচ্ছে তো। রোদে তো যেতেই হয়। খেলাধুলাও করে নিশ্চয়ই। সেজন্য কিন্তু এ বয়সে…
ভদ্রমহিলা দমলেন না—কী বলছেন ডাক্তারবাবু? ওর মুখটা একবার দেখেছেন? সমু, মুখটা তোল তো। এই দেখুন, দেখেছেন ‘লিভার স্পট’ টা?
মেয়ের বাঁ গালে হাল্কা সাদা একটা ছোপ দেখিয়ে ভদ্রমহিলার প্রশ্ন,
–আগেও একবার হয়েছিল ডান গালে। শেষে প্রচুর লিভারটনিক খাইয়ে তারপর সেরেছিল। কিন্তু আবার দেখছি এ গালে হচ্ছে। কী করি বলুন তো ডাক্তারবাবু?
–কিছু করবেন না। ওটা এমনিই সেরে যাবে। আগেরটা যেমন সেরেছিল। লিভারটনিক না খাওয়ালেও সেরে যেত।
–এটা কী ডাক্তারবাবু?
অবিশ্বাসী প্রশ্ন ভদ্রমহিলার।
–পিটিরিয়াসিস অ্যালবা। এ–বয়সে হওয়া খুব সাধারণ একটা স্কিন ডিজিজ।
–লিভারের সঙ্গে…
এবার কথা কাড়লেন ডাঃ গুপ্ত—না, কোনো সম্পর্ক নেই। সামান্য কিছু এমেলিয়েন্ট লাগাতে দিচ্ছি আর খুব হাল্কা একটা স্টেরয়েড ক্রিম। সেরে যাবে।
–সেরে যাবে?
মধ্য–তিরিশের এক ভদ্রলোক ঢুকলেন।
–সরি, আমার একটু দেরি হয়ে গেল। আমি সমাদৃতার বাবা।
–হ্যাঁ দেখলাম ওকে, চিন্তা করবেন না। সেরকম কিছু হয়নি ওর।
–ডাক্তারবাবু, আমাদের বাড়ির সকলেরই কিন্তু লিভার খারপ। তার থেকে আমার তো চুলই উঠে গেল, দু’চোখের পাতায় দাগ, আমার এক দিদি, আর বোন, দুজনেরই দু’গালে মেচেতার দাগ। তারপর ধরুন, আমার ছোটকাকার আবার (গলার স্বর ঈষৎ নামিয়ে) লিকোডার্মা… বুঝতেই পারছেন…ভয় লাগে মেয়েটাকে নিয়ে…
–হ্যাঁ বুঝতে পারছি, আপনাদের পরিবারে কারও কারও স্কিনের কিছু সমস্যা আছে। কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, এঁদের সঙ্গে লিভার খারাপ হবার কী সম্পর্ক?
–সম্পর্ক নেই বলছেন?
হাঁ হয়ে গেলেন ভদ্রলোক–ভদ্রমহিলা।
–একেবারেই না। আপনার চুল উঠেছে, অ্যান্ড্রোজেনিক অ্যালোপেশিয়া থেকে। চোখের পাতায় কোলেস্টেরল জনিত জ্যানথেলসমা। আপনার দিদি আর বোনের গালে হয়েছে মেলাসমা। রোদ্দুর আর শরীরের কিছু বিশেষ হরমোনের জন্য যেটা হয়। আর আপনার কাকার শরীরের সাদা দাগ, এ সবকিছুর জন্য আপনারা শুধু শুধু লিভারকে দোষ দিচ্ছেন কেন বলুন তো?
–তাহলে কী থেকে হচ্ছে এগুলো?
–এগুলো প্রত্যেকটাই আলাদা আলাদা সমস্যা। একটার সঙ্গে অন্যটার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ, লিভার থেকে যে হচ্ছে না, সেটা নিশ্চিত।
–তবে যে লোকে বলে লিভার থেকেই স্কিনের যত রোগ। আমরা তো সেইজন্য বরাবর লিভারের ওষুধ খাই।
–লিভারের ওষুধ মানে?
–ওই টনিক। লিভারের টনিক। নিয়মিত খাই।
–কাল থেকেই বন্ধ করে দিন। ওতে কিছু হয় না।
–তা না হয় হল। কিন্তু ডাক্তারবাবু, লিভার থেকে স্কিনের কি কোনো অসুখই হয় না? মোবাইলটা বাজল। নম্বরটা অচেনা। কলটা কেটে দিলেন ডাঃ গুপ্ত। তারপর বললেন,
–দেখুন, একেবারেই যে হয় না, তা বলব না। হয়। যেমন ধরুন জনডিস। হলুদ হয়ে যায় স্কিন, চোখ, সবকিছু। এটা অবশ্যই লিভার থেকে হয়। আরও সঠিকভাবে বললে, হয় হাইপার বিলিরুবিনিয়াম থেকে।
–আর কালো দাগ?
সমাদৃতার মায়ের অসহিষ্ণু প্রশ্ন।
–তাও হয়। তবে আপনি যেমন ভাবছেন, ঠিক তেমন নয়। সিরোসিসের রোগীদের ত্বকে একটা ধূসর ছাই–ছাই ছোপ পড়তে পারে। গাঢ় কালচে বাদামি দাগ হতে পারে চোখ এবং ঠোঁটের চারপাশে। কিন্তু তার সঙ্গে জনডিসও থাকবে। আবার এই সিরোসিসেই হাল্কা সাদা দাগ পিঠে, পেছনে, ঊরুতে হতে দেখা যায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে।
–আর কিছু?
–গা চুলকাতে পারে। বিশেষত অবস্ট্রাকটিভ জনডিসের ক্ষেত্রে ত্বকে পিত্তলবণ বা বাইল–সল্ট জমে এই চুলকানির উৎপত্তি হয়। এছাড়াও লিভারের ক্রনিক অসুখে শরীরের ত্বকে এখানে–সেখানে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রক্তনালিকার বিস্তার দেখতে পাওয়া যায়। যাদের দেখতে হয় সরু সরু মাকড়সার মতো। একে বলে ‘স্পাইডার অ্যানজিওমা’। এছাড়াও হতে পারে ‘পামার এরিথেমা’। তাতে হাতের তালু লাল হয়ে যায়। তবে সৌভাগ্যের ব্যাপার, এসব খুব কমন নয়। অন্তত রোজ রোজ মোটেই দেখতে পাওয়া যায় না এসব অসুখ।
তাই বলছিলাম লিভার থেকে ত্বকের অসুখ যে একেবারেই হয় না, তা নয়। কিন্তু তাই বলে ছুলি, শ্বেতী, মেচেতা বা অন্য যে–কোনো স্কিন ডিজিজ হলেই শুধু–শুধু লিভার বেচারাকে অপরাধী ভাববেন না।
এ যেন যত দোষ সব ওই লিভার ঘোষ! আই মিন, নন্দ ঘষ। তাই না?
কী সমাদৃত? তুমি কী ভাবছ?
মুখ তুলল সমাদৃতা। ফিক করে হেসে ফেলল চোখে চোখ পড়তেই। ওর মুখের সেই অপরাধী, লাজুক লাজুক ভাবটা উধাও হয়ে, তার জায়গা নিয়েছে দুষ্টু–দুষ্টু অন্য আরেকটা মুখ।
হাসছিল সমাদৃতা।
হাসলে ওকে ভারি মিষ্টি লাগে!
বাহ, বেশ ভালো লাগলো।
যাক আপনি লিভার বেচারা কে গালি খেতে বাঁচিয়ে দিলেন
খুব ভালো লাগলো ধন্যবাদ
এমনই পোস্ট চাই যেগুলো আমাদের ভুল ধারণা গুলো ভেঙ্গে দেবে। ধন্যবাদ।
খুব সুন্দর লেখা এমন সহজ আর সরল ভঙ্গিতে যে কেউ বুঝতে পারবে।