১.
“আর সামনে নয়,
এবার পেছন ফেরার পালা”
শীত ছেড়ে যাওয়ার দিনে কেন এত বিষন্নতা কে জানে! চরাচর জুড়ে কুয়াশার রহস্যময়তা ক্রমশ উধাও। বেলা বাড়লেই রোদতপ্ত দিনের মুখড়া। দখিনা বাতাসে মন কেমনের এসরাজ। ফ্যান চালানো উচিত হবে কিনা- এ প্রশ্নের উত্তর কে সি নাগের অঙ্কের চেয়েও কঠিন মনে হয়। এতদিন যেসব শীতের পোষাকের ওমে কুঁকড়ে-মুকড়ে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকতাম- তাদের এবার বচ্ছরকার মতো বিদায় জানানোর পালা। আরও এক বসন্তের স্মৃতি বুকে নিয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়বে ট্রাঙ্ক, আলমারি, বক্স-খাটের তলার অন্ধকারে। কোনও একদিন হঠাৎ মনে পড়বে- ওই যে ঘিয়ে রঙের শালটা একধারে পড়ে আছে, যে গায়ে দিত সেই মানুষটাই নেই। আজ কত বছর হ’ল… প্রথম প্রথম বিয়োগের আগুন বড় গনগনে হয়ে জ্বলে। তারপর, সময়ের ধারাপাত মেনে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে অনেকটা ওপরে ওঠার পর পিছন ফিরে তাকালে দেখি, শুধু পোড়া স্মৃতির কিছু কাঠকয়লা। শীত শেষের দখিনায় সেসব ‘নেই’ মানুষেরা ফিরে ফিরে আসে। ফেলে আসা দিনের সম্পর্কের দলিল দস্তাবেজের পুরোনো গন্ধ ফিরে ফিরে আসে। আবার হঠাৎই দমকা হাওয়ার মতো মিলিয়ে যায়। অথচ অদ্ভুতভাবে সে বিয়োগ আর ততখানি পোড়ায় না। বুঝি, বয়স বাড়ছে…
২.
“সীমান্তে আজ আমি প্রহরী”
খান দশেক ভেন্টিলেটর, গোটা কুড়ি ইনফিউশন পাম্প, ওয়ার্মার আর শ’য়ে শ’য়ে নল, ছুঁচ, ইঞ্জেকশন শিশি, আইভি লাইনের সাম্রাজ্যে আমি নিতান্ত এক পদাতিক সৈন্য। সকাল থেকে ডিউটি শুরু হয়। কখন যে ঘড়ির কাঁটা তিনটের ঘরে গিয়ে ঠেকে বুঝতে পারি না। দুপুরের খাওয়ার পর চোখ বুজে আসে। কোনোমতে টেনে নিয়ে চলি। চলতেই হয়। এর গলার টিউবে কফ জমেছে, ওর চ্যানেলের জায়গা ফুলছে… ওদিকের পেশেন্টের রক্তের অ্যাসিড-ক্ষারের মাপ নিতে নিতে এদিকের বাচ্চার জ্বর এসেছে একশো দুই! ইমার্জেন্সিতে নতুন পেশেন্ট অ্যাটেন্ড করতে করতে খবর আসছে তিনশো উনত্রিশের বাচ্চার হিমোগ্লোবিন ফাইভ পয়েন্ট সিক্স!
ডাক্তার-নার্স-অন্যান্য স্টাফ মিলিয়ে আট-দশজন স্বাস্থ্যকর্মী নাগাড়ে ছুটছেন। চতুর্দিকে ফটোথেরাপির নীল আলো। কিছুক্ষণ তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বাইরের পৃথিবীতে গোধূলি ছাড়িয়ে সন্ধে নামে। আড্ডা-হাট-খেলার মাঠের ভিড় ঘরে ফেরে। ফুচকাওলার চারদিকে ইতিউতি জমায়েত…
আইসিইউর ভেতরে এ এক অন্য পৃথিবী। এখানে দিনের আলোর ছাড়পত্র নেই। বিনিদ্র রাতের শেষে জীবন থেকে খোয়া যায় আরও একটা গোটা দিন।
নতুন টিমকে দায়িত্ব বুঝিয়ে প্রায় টলতে টলতে ফিরি। ফেরার পথটুকুর দু’ধারে ত্রিপল খাটিয়ে রোগীর বাড়ির লোক রাত কাটায়। চোখেমুখে হাজারো আশা-উৎকন্ঠা-ভয়। তবু তারা কীভাবে যেন আত্মীয় হয়ে যায়। হাসপাতাল তীর্থে জাত-ধর্ম-বর্ণ মিশে একাকার…
৩.
“গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোষাক”
তিনটে বাচ্চা পেটেই নষ্ট হয়েছে। বিয়ের প্রায় সাত বছর পর এই বাচ্চাটা। পেটের নাড়িভুঁড়ি জড়িয়ে গেছে। রক্তে জীবাণু সংক্রমণ। চোখ-মুখ ফুলেছে। রোজ সন্ধেয় দরজার পাশে চুপটি করে মা দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে এলে খুব নিচুস্বরে জানতে চায়, ‘ডাক্তারবাবু, বাচ্চা ভালো আছে?’ একটা সত্যিকারের মুখোশ আর একটা তৈরি করা প্রফেশনাল মুখোশের আড়াল থেকে নিক্তি মেপে উত্তর দিই।
বাচ্চার অপারেশন হ’ল। সার্জেন জানিয়েছেন, খাদ্যনালীর বিভিন্ন জায়গায় ঘা। অপারেশন টেবিল থেকে হাওয়া ভরা ব্যাগ পাম্প করতে করতে আইসিইউ ফিরিয়ে আনার সময় আবার সেই এক প্রশ্ন, ‘ডাক্তারবাবু, বাচ্চা ভালো আছে?’
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কঠিন কাজ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। কাঁধের ওপর স্টেথোস্কোপ বড্ড ভারী হয়ে ওঠে সময় সময়।
৪.
“যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য”
গত শনিবার খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে আরশির বাম দিকের ভ্রুর ওপর গভীরভাবে অনেকখানি কেটে গেছে। পিয়ালী কাঁদতে কাঁদতে ভিডিও কলে দেখিয়েছে মেয়ের কপালে কত রক্ত! ওষুধ বলে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি। ছটফট করেছি। ছবি দেখে কাটার গভীরতা খুব ভালো ভাবে বোঝা সম্ভব নয়। একে-ওকে দেখতে বলেছি স্টিচ লাগবে কিনা। পিয়ালী আর বাড়ির সবাই মিলে সামলেছে। মেয়ে ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে আর আমি তখন অনেক দূরে স্টেথোস্কোপের ঋণ শোধ করছি!
যাইহোক, আরশির কাটা জায়গাটা অনেকটা সেরে উঠেছে। আমি দিন গুনেছি, কবে জড়িয়ে ধরে কোলে নেবো। অনেকগুলো নির্ঘুম রাত পার করে আজ সেইদিন।
“ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে”
ভারি সুন্দর লেখা। দিনপঞ্জির আকারে লেখা এই আলেখ্য চোখের দৃষ্টি ঝাপসা করে দিল।