।। রিলকের গোলাপ ।।
চেতনার বহুমাত্রিক উৎস হতে পারে। তবে প্রাথমিকভাবে দৃশ্যচেতনার কথাই আমাদের সবার আগে মনে আসে। বিজ্ঞানও যত অনুসন্ধান করেছে তার বেশিরভাগই দৃশ্যচেতনাকে কেন্দ্র করে। তাই একজন বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আমরা প্রথমে দেখি দৃশ্যচেতনা কিভাবে আমাদের মস্তিষ্কে তৈরি হয়।
আলো কোনো বস্তুর ওপর পড়লে তা প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পড়লে তবেই আমরা দেখি। তবে সেই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০০-৭০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে হলেই আমরা তাকে দেখতে পাই। এর নীচের অতিবেগুনি ও ওপরের অবলোহিত রশ্মি আমরা দেখতে পাই না। তাই অধিকাংশ মহাজাগতিক বিকিরণই আমাদের কাছে অদৃশ্য। আলো আমরা জানি ফোটন কণার সমষ্টি, যেটি নিজে অদৃশ্য। তাই যখন আপনার বাগানে শীতের সকালে প্রথম ফোটা কোনো গোলাপের দিকে আপনি তাকাচ্ছেন তখন সেই গোলাপ থেকে লক্ষ লক্ষ প্রতিফলিত ফোটন কণা আপনার চোখের মধ্যে প্রবেশ করে অক্ষিগোলকের পেছনে রেটিনার ওপর একটি খুব ছোট্ট জায়গা যাকে আমরা ‘ফোভিয়া’ বলি তার ওপরে থাকা ৬০ লক্ষ কোণাকৃতি কোষের ওপর এসে পড়ছে।
যেই না ফোটনেরা কোণাকৃতি কোষগুলোর ওপর এসে পড়ছে সেই কোষের গায়ে লেগে থাকা একটি বিশেষ প্রোটিনের আকার সামান্য পালটে দিচ্ছে। খুব সামান্য। ঠিক যেমন আপনি কোনো লেখা আয়নার সামনে ধরলে বদলে যাওয়া দেখেন তেমন। ব্যাস, শুধুমাত্র এইটুকু ওই আলোর কাজ। ওই লক্ষ লক্ষ ফোটনকণার কাজ। তাদের শুধু ওইটুকু কাজের জন্যই আমরা ‘দেখতে’ পাই।
এই ‘সামান্য’ ঘটনাটা এবার সেই কোণাকৃতি কোষগুলোর মধ্যে নানান পরিবর্তন নিয়ে আসে। তারপর সেই কোষগুলোতে তড়িৎপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। সেই প্রবাহ ২৫০ মাইল প্রতি ঘন্টা বেগে অপটিক নার্ভ দিয়ে ছুটে যায় আমাদের মাথার পেছনের দিকে থাকা সামান্য একটি অংশে। সেখানে দ্রুত ও জটিল বিশ্লেষনের পরে আমাদের মস্তিষ্ক বুঝতে পারে সেটি ফুল এবং গোলাপ। এটিই আমাদের চেতনা। আমাদের ‘গোলাপচেতনা’।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, অনেকেই ভাবেন বা বলেন আমাদের চিন্তা বা চেতনা আলোর থেকেও দ্রুতগামী। আমরা এখানে দেখছি ‘চিন্তার’ একটা গতি আছে সেটি ২৫০ মাইল প্রতি ঘন্টা। এটির গতি আলো ছেড়ে দিন, আমরা যে সুপারসনিক জেট প্লেন তৈরি করেছি তার থেকেও তিন থেকে চারগুণ কম।
আমরা যে শুধু গোলাপ চিনলাম তাই নয়, তার রং, রঙের বিভিন্ন শেডের তারতম্য, গভীরতা, তার প্রতিটি পাপড়ির নিখুঁত জ্যামিতি আমরা বুঝতে পারলাম। আমরা এখন কিছু কিছু জেনেছি আমাদের মস্তিষ্কের ঠিক কোন কোন অংশ এই কাজগুলোর জন্য দায়ি। তবে ওইটুকুই। ওটুকুই আমরা জেনেছি। সেটা কম নয়। সেই জানাটাও বিরাট। বহু বছরের বহু পরিশ্রমের ফসল। কিন্তু এটাই কি ‘গোলাপচেতনা’?
শীতের কুয়াশামাখা এক ভোরে ঘুম থেকে উঠে আপনি বাগানে গিয়ে যখন দেখলেন আপনার প্রথম মরশুমি গোলাপটি ফুটেছে, তাকে দেখে আপনার মনে যে অভূতপূর্ব আনন্দ ও সৌন্দর্য মেশানো এক অনুভূতির সৃষ্টি হল- সেটার ব্যাখ্যা কে দেবে? সেই সার্বিক চেতনার ব্যাখ্যা দেওয়া আদৌ কি সম্ভব কোনোদিন? আপনার যা মনে হল, আমার নিশ্চই তাই মনে হবে না। রিলকের কি তাই মনে হয়েছিল?
If your blooming sometimes so astonishes us,
happy rose,
it’s that, petal against petal, you rest
within yourself, inside.
গোলাপের প্রতিটি পাপড়ি যেন একেকটি শব্দ, ফুল যেন আধখোলা একটা বই সঙ্কোচে গুটিয়ে আছে। মাত্র কয়েকদিনের জন্য এত সুন্দর হয়ে ফুটে ওঠা। তার এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মধ্যেই যেন এক করুণ মৃত্যুচেতনা লুকিয়ে আছে। তার এই মর্মান্তিক সৌন্দর্য যেন এই পৃথিবীর বুকে এক লহমায় চিরন্তনকে স্পর্শ করে গেছে।
Does your indescribable state make you understand
in a mingling in which all is silenced
that ineffable harmony of nothingness and being
that we ignore?
কী নিদারুণ কাব্যিক প্রকাশ ভেবে দেখুন! আমরা যা দেখি প্রতিটি সৌন্দর্য, প্রেম তা যেন একদিন গোলাপের মত ঝরে যাবে বলেই তারা এত সুন্দর। আমাদের অস্তিত্ব আর শূন্যতার মাঝে যেন এক নীরব সুর আছে- আমরা কি তাকে দেখতে পাই?
রিলকের যখন লিউকিমিয়া ধরা পড়ে তখন তিনি অবসাদের জন্য হাসপাতালে ভর্তি। তার প্রিয় গোলাপকে বাগানে ছুঁতে গিয়ে হাতে কাঁটা ফুটে গেল। তা থেকে হাতে সংক্রমণ হয়ে সারা হাত ফুলে গেল। তখন তো আর কোনো অ্যান্টিবায়োটিক নেই! সেই সংক্রমণেই মৃত্যু হল রিলকের। মৃত্যুর আগে নিজেই লিখে গেলেন নিজের এপিটাফঃ- “Rose, oh pure contradiction, delight of being no one’s sleep under so many lids.”
কবি যেন সেই গোলাপের পাপড়ির মধ্যে নিজের শেষ আশ্রয় খুঁজে নিতে চাইলেন।
এই হল রিলকের সামগ্রিক ‘গোলাপচেতনা’র খুব নগন্য একটা উপস্থাপনা। আপনি কি বলবেন, এই চেতনা বিজ্ঞান একদিন খুঁজে পাবে? এটা সম্ভব? দেখুন একজন কবির একটি ফুল দেখে গড়ে ওঠা মৃত্যুচেতনা কিভাবে কবির নিজের মৃত্যুর সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। আপনি বলতে পারেন ‘কোইনসিডেন্স’ ‘সমাপতন’। আমি পারি না। আমি এর রহস্যময়তায় বিশ্বাস করি। আমি রিলকের ওই চরণটিতে বিশ্বাস করি- ‘all is silenced that ineffable harmony of nothingness and being that we ignore’?
আমাকে এবার অন্য প্রসঙ্গে যেতে হবে। আমি তো আগেই বলেছি, কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলছে আমি গোলাপটি দেখছি তাই সেটি আছে। যদি না দেখি তবে সেটি নেই। যদি এই কথাটাকে উলটো করে ভাবি। যদি বাগানের গোলাপটিকে কেউ অন্যখানে সরিয়ে নেয় তবেও কি সেটি আগের জায়গাতে থাকবে?
থাকতে পারে। আবার নাও থাকতে পারে। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না যে সেটি নেই। স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে গেলে আমরা নিশ্চিত নই যে ট্রেনটি সেখানে নেই। একটি ইলেকট্রন একই সাথে বিভিন্ন অবস্থানে থাকতে পারে। এই গোলাপটি ইলেকট্রনের থেকে অনেক অনেক অনেক বড়। তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক অনেক অনেক কম। তাই হয়ত আমরা তাকে দেখতে পারছি না। আমাদের রিয়্যালিটি বা বাস্তবতায় না থাকলেও সেটি হয়ত অন্য বাস্তবতায় আছে।
আমাদের প্রিয়জন যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তারা হয়ত অন্য বাস্তবতায় আছেন তাই তারা আমাদের চেতনা থেকে কিছুতেই হারিয়ে যান না। রিলকে এখনও হয়ত সুইজারল্যান্ডের র্যারন শহরে তার কবরের কাছে ফুটে থাকা গোলাপগাছের কাছে রোজ ফিরে ফিরে আসেন। আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যান, আমরা দেখতে পাই না। আমরা এই আলোচনা নিয়ে পরে ফিরে আসব তার আগে আরেকটি গভীর বিষয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেব।
রিলকে তার কবিতায় গোলাপের ওপর যেমন চেতন বস্তুর ধর্ম আরোপ করেছেন তা কি হতে পারে? ফুলেদেরও কি আছে মন? চেতনা? যখন নিচু ক্লাসে পড়ি আমাদের ভাবসম্প্রসারণ লিখতে হত। ‘পুষ্প নিজের জন্য ফোটে না। অপরের জন্য আপনার হৃদয়কে কুসুমিত করিও’। আমরা এখন জেনেছি কথাটি সত্যি নয়। ফুল নিজের জন্যই ফোটে। নিজের বংশবিস্তারের জন্য।
আগে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন ফুল উভলিঙ্গ। একই সাথে পুংকেশর ও গর্ভকেশর থাকার জন্য সেটি সেলফ পোলিনেশন বা স্বপরাগমিলন করে। ডারউইন মনে করলেন তাই যদি হয় তবে উদ্ভিদের মধ্যে কি অভিযোজন হয় না? সেল্ফব্রিড করে কারোর পক্ষে এতকাল ধরে পৃথিবীতে টিকে থাকা অসম্ভব। তারপর তিনি অর্কিডের ওপর পরীক্ষা করে দেখলেন ফুল প্রচন্ড সচেষ্ট থাকে অন্য ফুলের সাথে মিলিত হতে। এতে তাদের সাহায্য করে বিভিন্ন পতঙ্গ।
মৌমাছি কখনও লাল ফুলের ওপর বসে না। তারা হলুদ বা নীল ও বেগুনি ফুলের দিকে উড়ে যায়। কারণ তারা রেড ব্লাইন্ড। লাল রং চিনতে পারে না। কিছু ফুল তাদের কথা বিচার করেই তাদের পরাগথলির রং করেছে অতিবেগুনি। তাই সেই রং আমরা দেখতে না পেলেও মৌমাছি কিন্তু পায়। প্রজাপতি আবার লাল ফুলের দিকে আকৃষ্ট হয় বেশি। যেসব ফুল রাতে ফোটে যেমন বেলি, জুঁই, মুন ফ্লাওয়ার তারা সাদা। তাদের তো রঙের দরকার নেই। তারা গন্ধ দিয়ে পতঙ্গদের আকৃষ্ট করে।
বালক অলিভার স্যাকসদের বাড়িতে বাগানে নানান সুন্দর রঙ্গিন ফুলেদের মাঝে দুটি ম্যাগনোলিয়া ফুলের গাছ ছিল। স্যাকস তার মাকে জিজ্ঞাসা করেন যে বাগানের অন্য ফুলগুলো রঙ্গিন, সুগন্ধী হলেও ম্যাগনোলিয়া এত ফ্যাকাশে গন্ধহীন কেন? আপনার বাচ্চা ছেলে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে আপনি কি বলতেন? অলিভারের মা বললেন, আসলে ম্যাগনোলিয়া বহু প্রাচীন পৃথিবীর গাছ। তারা ১০০ কোটি বছর আগে থেকে পৃথিবীতে আছে। তখন পৃথিবীতে মৌমাছি, মথ, প্রজাপতি কেউই আসে নি। তাই তারা পরাগমিলন ঘটাতে একরকমের লার্ভার মত পোকাদের সাহায্য নেয়। তাদের ফুল পরিণত হলে লার্ভারা ফুলের ভেতরে ঢুকে পরাগ ও মধু চুরি করে খায়। তাদের আকৃষ্ট করতে তাই রং ও গন্ধের কোনো দরকার নেই।
তাহলে ফুল এতকিছু রহস্য জানল কিভাবে? সে জানল কিভাবে যে মৌমাছি লাল বর্ণান্ধ? সে জানল কিভাবে আলো না থাকলে গন্ধ না ছড়িয়ে উপায় নেই? এটা কী ‘চেতনা’ নয়? আপনি বলতে পারেন এটা ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’। অবশ্যই তাই। কিন্তু শুধুই কি তাই? এই মহাবিশ্বে শুধু কি আমরাই চেতন? আর সবকিছুই অচেতন? তাদের ‘চেতনা’ কি কোনোভাবেই আমাদের চেতনার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারে না। নাকি এই পৃথিবীর এই মহাবিশ্বের কোনো সামগ্রিক চেতনা আছে। আমরা সবাই সেই একক সংহত কোনো চেতনারই অঙ্গ।
(চলবে)