।। পিকাসো ও আলতামিরা ।।
আমরা যখন স্থির কোনো বস্তু দেখি যেমন গোলাপের কথা এইমাত্র বললাম, তার তুলনায় গতিশীল কোনো বস্তু আমাদের চেতনায় অন্যরকম পরিবর্তন নিয়ে আসে। ভেবে দেখলে আমাদের যা কিছু ‘চেতনা’ তা কিন্তু সবসময়ই গতিশীল। আপনি যখন আনন্দময় বা বেদনার্ত কোনো স্মৃতির কথা চিন্তা করছেন তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চলমান। আমাদের স্বপ্ন চলমান। আমাদের কল্পনা চলমান। আমাদের প্রেম-ভালোবাসা-যৌনতা-হিংসা-লালসা-রিরংসা সবকিছুর চেতনাই চলমান। তারা সবাই যেন চলমান অশরীরী! আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে চুম্বন করতে চাই। আমাদের যৌনতার চেতনা অনুপ্রবেশ। আমাদের রিরংসার চেতনা আঘাত, হত্যা। এর একটা কারণ আমার মনে হয় যে আমরা প্রাণী। কোনোকিছু সচল না হলে তাকে আমরা প্রাণী বলতে পারি না। আমাদের দেহে যত স্নায়ু আছে তাদের অধিকাংশই আমাদের চলমানতা নিয়ন্ত্রণ করে। তাই হয়ত আমাদের চেতনা অধিকাংশ সময়ই জঙ্গম।
কিভাবে এই চলমান চেতনা আমাদের মস্তিষ্কে তৈরি হয় তা বিজ্ঞানের একটা অনুসন্ধানের বিষয়। উইলিয়াম জেমস যাকে ‘ফাদার অফ সাইকোলজি’ বলা হয় তিনি অনেক আগেই বলে গেছেন আমাদের চেতনা অনেকগুলো ছবি বা ঘটনাকে পরপর জুড়ে তৈরি হয়। যেন পরপর সুতোয় গাঁথা এক ফুলের মালা। অনেকে বলেন হাশিশের নেশার মাধ্যমে তিনি এমন ধারণায় পৌঁছান। ফ্রান্সিস ক্রিক যিনি ডি এন এর গঠন আবিষ্কার করে নোবেল পেয়েছিলেন তিনি পরে স্নায়ুবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনিও আমাদের দৃশ্যচেতনা নিয়ে অনেক গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে চেতনা আসলে অনেকগুলো স্থির ছবি বা স্ন্যাপ্শটস। তাদের পরপর আঠার মত জুড়ে দিয়েছে ‘সময়’। ঠিক যেন কোনো মুভি ক্যামেরায় তোলা ছবি। ক্যালাইডোস্কোপ। ধারাবাহিক, অনুক্রমিক স্থিরচিত্রের এই প্রবাহই হল চেতনা। এখানে যে ‘সময়ের’ কথা বললাম এটা একটা সাঙ্ঘাতিক ধারণা। আমরা পরে এই নিয়ে আবার ফিরে আসব।
আমাদের বাস্তব জগতে এই ধারণার কি কোনো প্রমাণ আছে? অলিভার স্যাকস তার মাইগ্রেনে আক্রান্ত রুগিদের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন যখন তাদের প্রবল মাথাব্যাথায় ‘অরা (aura) হয় সেসময় তারা কিছুক্ষণ পরপর কিছু স্থির ছবি দেখতে পান। এই প্রদর্শনী চলতে থাকে যতক্ষণ না মাথাব্যথার কিছুটা উপশম হয়েছে। একজন জার্মান মহিলার মাথার পেছনে রক্ত জমে স্ট্রোক হয়েছিল। তিনি তার চোখের সামনের সব ঘটনাকে থেমে থেমে দেখতেন। যেমন ধরুন উনি ওনার বন্ধুর সাথে কথা বলছেন যার হাতে একটা চায়ের কাপ ধরা আছে। তিনি তার কথা একটানা শুনতে পেলেও অনেক্ষণ পর পর তার বন্ধুকে নড়তে দেখতেন। তার বন্ধুটি হয়ত ততক্ষণে কথা বলতে বলতে তার পেছনে চলে গেছে কিন্তু তখনও তিনি তাকে তার সামনে ‘দেখতে’ পাচ্ছেন।
আমরা যা দেখি তা প্রায় পুরোটাই আমাদের অভিজ্ঞতা দ্বারা নির্দিষ্ট। সেই অভিজ্ঞতা আমরা যেমন সারা জীবন ধরে অর্জন করে থাকি তেমনি আমার মনে হয় এই ‘অভিজ্ঞতা’ অনেক ক্ষেত্রে একটা ‘জেনেটিক প্রবাহ’ যা বহু যুগ থেকেই আমাদের সঙ্গে বয়ে আসছে। আমার তাই খুব তীব্রভাবে মনে হয় চেতনাও ‘জিনগত বৈশিষ্টের’ মত আমাদের প্রজাতির মধ্যে প্রবাহিত হয়।
আমাদের দৃশ্যমান জগত অনেক ক্ষেত্রেই একটা ‘ইলিউশন’। আমাদের চেতনা কেবলমাত্র তার কোয়ান্টাম বাস্তবতায় সত্যি। কথাটা খুব ভারি। আমার মত লেখকের কলমের পক্ষে অত্যন্ত উদ্ধত এবং হয়ত অনৈতিক। তবে চেতনার কথা যখন বলতে বসেছি আমাদের তা নিয়ে না বলে উপায় নেই। বলব। তার আগে বরং ইলিউশনের একটা ধারণা করে নিই।
রবার্ট ল্যাঞ্জা তার ‘বায়োসেন্ট্রিজম’ বইটিতে এই ইলিউশনের একটি মজাদার উদাহরণ দিয়েছেন। উনি বলেছেন আমরা রামধনু দেখছি তাই সেটি আছে, আমরা না দেখলে রামধনু নেই। কথাটা কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে সত্যি। অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেক করতে গেছি। সারাদিন হেঁটে ক্লান্ত হয়ে যখন প্রায় গ্রামের কাছে পৌঁছে গেছি তখন হালকা বৃষ্টির পরে দেখি আকাশ জুড়ে রামধনু। ভুল করে খানিক এগিয়ে ক্যামেরা বের করতে গিয়েই দেখি সেটি বেমালুম গায়েব। যেন ভোজবাজির মত উড়ে গেছে।
রামধনু হতে হলে তিনটি জিনিসের দরকার। বাতাসের জলকণা, সূর্যের আলো আর আপনার চোখ বা ক্যামেরা। আমরা জানি বাতাসে ভাসমান জলকণা প্রিজমের মত কাজ করে। তাই তার মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো যেতে গিয়ে সাতটি রঙের বর্ণালিতে ভেঙে যায়। সূর্যের এবং জলকণার অবস্থান যদি এমন হয় যে সেই বিচ্ছুরিত আলো আপনার চোখে এসে ঠিক ৪২ ডিগ্রি কোণ করে তবেই আপনার অ্যান্টিসোলার পয়েন্টে আপনি রামধনু দেখতে পাবেন। আপনার পাশের জন তা নাও দেখতে পারে। দেখলেও তার রামধনু আর আপনার রামধনুর অবস্থান আলাদা হবে। তাই ভেবে দেখুন আপনি বা আপনার ক্যামেরা ‘দেখছে’ তাই রামধনু আছে। আপনি না দেখলে বা সেখানে না থাকলে রামধনু কিন্তু নেই। আমাদের দৃশ্যমান জগত সেরকমই আমাদের চেতনার ওপর নির্ভর করে। আমি যা দেখছি তা সত্যি নাও হতে পারে। আমার রিয়ালিটিতে তার অস্তিত্ব আছে- আমরা শুধু সেটুকুই বলতে পারি।
পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী তা সে যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন তাদেরও নিজস্ব চেতনা আছে, নিজস্ব ইউনিভার্স আছে। সমুদ্রে লক্ষ লক্ষ সার্ডিন মাছের ঝাঁক জলের মধ্যে এঁকেবেঁকে তরঙ্গের মত সাঁতার কাটে। বড় মাছ বা হাঙর শত চেষ্টা করেও তাদের একটিকেও ধরতে পারে না। সন্ধ্যের দিকে হাজার হাজার স্টার্লিং পাখির ঝাঁক গোধূলির আলোয় আকাশে বিরাট তরঙ্গের মত উড়ে বেরিয়ে পোকা ধরে খায়। শিকারি পাখিরা বহু চেষ্টা করলেও তাদের একটিকেও শিকার করতে পারে না।
সংখ্যায় এত অমিত হলেও একটি মাছ বা পাখি অন্যটির গায়ে পড়ে না। তারা তাদের প্রতিরক্ষায় একটি সাধারণ ‘কোড’ ব্যবহার করে। প্রতিটি মাছ বা পাখি তার আগের জনের থেকে সবসময় সমান দূরত্ব বজায় রাখে এবং আগের জনের গতির দিকে বাঁক নেয়। শুধু এইটির প্রয়োগ করে তারা যুগ যুগ ধরে শিকারির হাত থেকে বেঁচে আসছে। কিন্তু একজনের হাত থেকে সার্ডিনেরা পুরোপুরি রেহাই পায় না। সেটি ডলফিন। এরা সার্ডিনদের কায়দা জানে। তাই ওরা ওদের ঝাঁককে জলের ওপরের তলের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে ওরা গভীর জলের মত ইচ্ছেমত বাঁক নিতে পারে না। তাই ঝাঁক ভেঙে যায়।
পাপুয়া নিউগিনির বার্ড অফ প্যারাডাইসের অপূর্ব সুন্দর পুরুষ পাখিরা নানান রকম পালকের রং, নানান ডাক, নানা বিভঙ্গের নাচ করে কুচ্ছিত মেয়ে পাখিগুলোকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। পুরুষ ময়ূর পেখম মেলে ময়ূরীকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান, লেসার ফ্লোরিক্যান ঘাসের জঙ্গল থেকে ওপরে লাফ দিয়ে উঠে জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে মেয়েটিকে আকৃষ্ট করে। আমাদের যুবকেরা একমাস ধরে জিমে গিয়ে বাইসেপস ফুলিয়ে, টেরি কেটে সাইকেল নিয়ে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রেমিকার আশায় বসে থাকে।
আপনি বলবেন এগুলো ‘বিহেইবিয়ার’, ‘চেতনা’ নয়। আমার সবসময় মনে হয় সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়া কোনোকিছুই প্রাণীদের স্বভাবের মধ্যে স্থান করে নিতে পারে না। আরেকটি মজার উদাহরণ শুনুন। প্রাণীবিজ্ঞানি এরিক কার্শেনবাম নেকড়েদের স্বভাব নিয়ে গবেষণা করেন। নেকড়েদের মধ্যে সামাজিকতা বিরাট ব্যাপার। তারা একসাথে শিকার ধরে। দলপতি বা ‘আলফা মেল’ একত্রিত হবার বিশেষ ডাক দিলে সবাই এক জায়গায় চলে আসে। ডলফিনও তাই। তারাও খুব সামাজিক প্রাণী। তারাও একসাথে শিকার করে। এরিক নেকড়ের ডাক আর ডলফিনের হুইসেল রেকর্ড করে হতবাক। ডলফিনের হুইসেলকে যদি একটু ধীরে বাজানো হয় তা অবিকল নেকড়ের ডাকের মত শোনায়। আপনি কী বলবেন? দুটো ভিন্ন পরিবেশে অভিযোজিত হওয়া ভিন্ন প্রাণী তাদের ‘ভাষাগত’ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অবিকল একই ডাক ব্যবহার করছে।
অন্য প্রাণীদের কথা নাহয় বাদ দিন। আমি এখন এমন একটি উদাহরণ দেব যাতে আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না। ফ্রান্সের লাঁসৌ (Lauscaux) তে একটি গুহা আবিষ্কার করা হয়েছিল যার দেওয়ালে আদিম মানুষেরা ছবি এঁকে রেখেছে। আজ থেকে প্রায় ১৮,০০০ বছর আগে আদিম প্রস্তরযুগের গুহাবাসী মানুষ সেখানে তাদের কল্পনায় ছবি আঁকত। একটি ছবি আমি নীচে দিয়েছি সেটি ভালো করে দেখুন।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ শুয়ে ‘স্বপ্ন’ দেখছে। তার লিঙ্গটি উত্থিত। তার স্বপ্নে দেখা যাচ্ছে একটি বাইসনের ছবি। যার পেটটি হাঁ করে কাটা। একটি পাখি তার স্বপ্নে উড়ে যাচ্ছে। স্ট্যানিসলাস ডেহেনে তার বইতে বলেছেন স্বপ্ন বিশেষজ্ঞ মিকেল জোভেট মনে করেন এটাই সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথম আঁকা কোনো স্বপ্নচিত্র। আপনারা অনেকেই লক্ষ্য করে থাকবেন সকালে স্বপ্ন দেখে যখন আমাদের ঘুম ভাঙ্গে তখন আমাদের লিঙ্গ উত্থিত থাকে। এই ঘুমের অংশকে আমরা বলি ‘রেম স্লিপ’। এই ঘুমেই আমরা স্বপ্ন দেখি এবং এই ঘুম থেকেই ভোরে জেগে উঠি।
এই ঘুমের বিজ্ঞান আমরা জেনেছি খুব বেশি হলে একশ বছর। তাও অধিকাংশই আমাদের অজানা। আজ থেকে ১৮,০০০ বছর আগের এক আদিম গুহামানব সেই স্বপ্নের সঠিক পর্যবেক্ষণ অন্ধকার গুহার গায়ে এঁকে গেছে। এটা কী করে সম্ভব? আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করুন যে পাখিটির ছবি আছে সেটি একটা অদ্ভুত দার্শনিক ‘ডুয়ালিটি’র কথা বলছে। বহু প্রাচীন কাল থেকেই আমরা মনে করি আমাদের আত্মা বা সোওল যেন পাখির মত আমাদের দেহ থেকে বেরিয়ে আসে। আমাদের উপনিষদে যে ঘুঘুর কথা আছে, বাইবেলে মুখে করে অলিভ পাতা নিয়ে আসা যে পবিত্র ঘুঘুর কথা বলা হয়েছে সেই ‘পাখিচেতনা’ কত হাজার হাজার বছর পরেও দেখুন আদিমতা থেকে আমাদের চেতনায় প্রবাহিত হয়ে এসেছে। দেকার্তে তার দেহ ও আত্মার ‘ডুয়ালিটি’র কথা বলেছেন এই তো সেদিন। ফ্রান্সের লাঁসৌর আদিম সেই গুহামানবের চেতনা কি ফরাসি দার্শনিকের চেতনাতেও প্রবাহিত হয় নি?
স্পেনের আলতামিরা গুহাতে যে গুহাচিত্র আঁকা তাদের আনুমানিক বয়স প্রায় ৩৬,০০০ বছর। সেই গুহাচিত্র দেখে পিকাসো বাইরে বেরিয়ে হতাশ হয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন, “বিগত এত হাজার হাজার বছরে আমরা নতুন কিছুই আবিষ্কার করি নি”।
মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকায় আদিম গুহাচিত্র দেখতে গেছি। ঢোকার পথেই আপনি দেখবেন পাথরের গায়ে একটি শিশুর হাতের ছাপ। ১০,০০০ বছর ধরে সময় তাতে কোনো আঁচড় কাটতে পারে নি। সেই শিশুর হাতটি দেখে আমার মনে হল নিজেকে প্রকাশ করার এই ‘চেতনা’ এই আত্মপ্রকাশের তীব্র আবেগই যেন এত এত বছর ধরে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
আপনি এই সামগ্রিক চেতনাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? আপনি হয়ত একে সময়ের স্কেল দিয়ে মাপবেন। আমি আপনাকে বলব আপনার চেতনার সঠিক অভিমুখের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হল এই সময়। এই সময়ের মায়াজাল যতক্ষণ না আপনি ছিন্ন করতে পারছেন আপনার বিশ্বচেতনা সম্পূর্ণ হবে না। এটি বড় গভীর কথা। এই কথার নিথর জলে ডুব দিতে হলে আগে আমাদের কোয়ান্টাম ফিজিক্সের অসম্ভবতার জগতে ঘুরে আসতে হবে।
চলুন আমরা ‘সম্ভাবনা’ ও ‘অবাস্তবতার’ জগত থেকে একবার ঘুরে আসি।
(চলবে)