।। কোয়ান্টাম চেতনা ।।
“Anyone who claims to understand quantum theory is either a liar or crazy” . – Richard Feynman
সুতরাং আমার কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়। ফাইনম্যান যখন বলে দিয়েছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স কেউ বোঝেন না তখন আমি যদি ভুল কিছু বলে ফেলি (যার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি) বিরাট কিছু অন্যায় হবে না।
আজ পর্যন্ত ফিজিক্সের যত শাখা পল্লবিত হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স তাদের সবার চেয়ে এলিট। তার অন্যতম কারণ এটি আমাদের হতবাক করে দেয়। বিমূঢ় করে দেয়। বাস্তবতা ও অবাস্তবতার মধ্যে নিয়ত যে টানাপড়েন এই শাখা আমাদের সেই জগতে নিয়ে যায়। আজ ইনফরমেশন টেকনোলজি বলুন কি কোয়ান্টাম কম্পিউটার সর্বত্রই এর প্রভাব অথচ এই তত্ত্ব সামনে আসার আজ নব্বই বছর হয়ে গেলেও এ নিয়ে আমাদের মধ্যে ধাঁধাঁ বা রহস্য ক্রমশ আরো ঘনীভূত হয়ে উঠছে। তাই চেতনার কথা বলতে বসে সেই জগত যদি ছুঁয়ে না আসি তবে বিরাট অবমাননা হয়ে যাবে।
ক্ল্যাসিকাল ফিজিক্স যেমন আমাদের দৃশ্য পৃথিবীর মধ্যে কাজ করে কোয়ান্টাম মেকানিক্স আপাত অদৃশ্য পরমাণুর ভেতরের ক্ষুদ্র কণিকা ইলেক্ট্রন, নিউট্রন, প্রোটনের জগতে কাজ করে। এই তত্ত্ব বলে যে কোনো কণার একই সাথে কণা ও তরঙ্গ দুই ধর্মই থাকে। যে কোনো কণা যেমন ইলেক্ট্রন একই সাথে বিভিন্ন অবস্থানে থাকতে পারে। একে বলে ‘সুপারপজিশন’। আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না পরিমাপ করছি আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না সেটি কোথায় আছে বা আদৌ আছে কিনা। বিজ্ঞানীরা বলেন এটা পর্যবেক্ষণের আগে একটা ‘প্রবেবলিটি ওয়েভ’ বা ‘সম্ভাব্য তরঙ্গের’ অবস্থানে থাকতে পারে।
এই তত্ত্বের সাক্ষ্য হিসেবে যে বিখ্যাত পরীক্ষাটা করা হয় তা হল- ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট। একটি ধাতব পাতের মধ্যে দুটি লম্বালম্বি ছ্যাঁদা করা হয়। পাতের একদিকে ফোটন বা ইলেকট্রনকে ক্রমাগত ছ্যাঁদার দিকে নিক্ষেপ করা হয়। পাতের অন্যদিকে একটি সেন্সর রাখা হয় যাতে ফোটন বা ইলেক্ট্রন তার ওপর আছড়ে পড়লে তাদের অবস্থান আমরা কম্পিউটারের পর্দায় দেখতে পাই। যদি একই সাথে এক বা একাধিক কণাকে নিক্ষেপ করা হয় তবে দেখা যায় তারা স্ক্রিনে একটা ‘ইন্টারফেরেন্স প্যাটার্ন’ তৈরি করে। মানে আপনি পুকুরের জলে একটি ঢিল মারলে যেমন তরঙ্গের সৃষ্টি হবে ঠিক তেমন। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি ফোটন বা ইলেক্ট্রন এক্ষেত্রে তরঙ্গধর্ম দেখাচ্ছে। (ছবি দেখুন)
এবার আসল হেঁয়ালিটা ঘটে। যদি আমরা কোনোভাবে ছ্যাঁদায় পড়ার আগে বা পড়ে সেই ইলেক্ট্রনের অবস্থান জানার জন্য কোনো যন্ত্র রাখি তাহলে দেখব ফোটন বা ইলেকট্রন তখন আর তরঙ্গধর্ম দেখাবে না কণাধর্ম দেখাতে শুরু করবে। বিজ্ঞানীরা বলেন, তার ‘ওয়েভ ফাংশান কোলাপ্স’ করে যাবে।
কি আশ্চর্য একবার ভেবে দেখুন! আইনস্টাইন নিজে এই পরীক্ষার ফলাফল মানতে পারেন নি। তিনি মনে করতেন এতে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু পরে যতবার যত উন্নততর যন্ত্র নিয়ে এই পরীক্ষা করা হোক না কেন প্রতিবার একই ফলাফল এসেছে। যে মুহুর্তে আমরা কণার অবস্থান জানতে চেষ্টা করেছি সেটি তার তরঙ্গধর্ম বর্জন করেছে।
এটা কিভাবে হয়? এটা তো এটাই প্রমাণ করে যে পদার্থকণিকাদেরও ‘মন’ আছে, ‘চেতনা’ আছে। না হলে তারা বুঝতে পারছে কিভাবে যে তাদের অবস্থানকে আমরা লক্ষ্য করছি? এটা বিজ্ঞানীদের মধ্যে চিরকালীন এক এনিগমা। কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশনের প্রবক্তা বোর ও হাইজেনবার্গ মনে করতেন, এটায় কোনো ধাঁধাঁ নেই। কোয়ান্টাম জগতে পদার্থরা এমন অদ্ভুত আচরণই করে। তা বোঝার চেষ্টা করা বিজ্ঞানীদের কাজ নয়। যদি সম্ভাবনার গণিত তাকে প্রমাণ করে তবে তাই সত্যি।
কিন্তু আরেক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ইউজিন ওয়াইগনার বললেন, না তা হবে না। এখানে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি যে মুহূর্তে কোনো ‘চেতন পর্যবেক্ষক’ পদার্থদের পর্যবেক্ষণ করছে তখনই এই ঘটনা ঘটছে। সুতরাং কোয়ান্টাম পরীক্ষার ফলাফল আমাদের চেতনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই আমি দেখছি তাই আছে, না দেখলে নেই। আমাদের চেতনা কোনোভাবে এই মহাবিশ্বের নিয়মকে প্রভাবিত করে, ডিস্টার্ব করে। তাই তাদের অবস্থান পালটে যায়। আইনস্টাইন বললেন, বুল শিট। ঈশ্বর কখনও জুয়া খেলেন না।
ওয়াইগনারের বক্তব্যের সূত্র ধরে হিউ এভারেট তার ‘একাধিক মহাবিশ্বের’ ধারণা নিয়ে আসেন। তিনি বললেন, কেন এমন নয় যে কণাগুলো তাদের অবস্থান পাল্টাচ্ছেই না। আমরা তাদের পালটে যাওয়া দেখছি কারণ সেই মুহুর্তে আমি অন্য রিয়ালিটিতে আছি। আগের রিয়্যালিটিতে ইলেকট্রন বা ফোটন তরঙ্গধর্মই দেখাবে। আমাদের চেতনা একই সাথে এমন বিভিন্ন রিয়ালিটিতে থাকতে পারে। এর থেকে বলা যায় আমরা আমাদের চারপাশে যা দেখছি অর্থাৎ আমাদের চেতন জগতের অস্তিত্ব আছে কেবলমাত্র আমরা তাকে ‘দেখছি’ বলে। আবার যেহেতু একই সাথে বিভিন্ন রিয়্যালিটি থাকতে পারে তাই যা দেখছি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না সেটাই ‘সত্য’।
এই ধারনার ওপর ভিত্তি করে আরেক দিকপাল বিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিনগার এক বিখ্যাত ‘থট এক্সপেরিমেন্ট’ করেন। তিনি বলেন, ধরা যাক একটা বাক্সের মধ্যে একটি জীবন্ত বিড়ালকে এবং এক বোতল বিষ রাখা হল। তারপর তার ভেতরে একটি তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামকে রাখলাম ও তার তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপ করার জন্য একটি ‘গাইগার কাউন্টার’ রেখে বাক্সটিকে বন্ধ করে দিলাম। ইউরেনিয়ামের বিকিরণ আমরা জানি কোয়ান্টাম সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করে। তাই যদি সেটি তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে তাহলে বাক্সের ভেতরে রাখা বিষের বোতলটি একটি হাতুড়ির আঘাতে ভেঙে যাবে ও বিড়ালটি মারা যাবে।
কিছুক্ষণ পরে যখন আপনি বাক্সটি খুলবেন তখন কী দেখতে পাবেন বিষের প্রভাবে বিড়ালটি মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে? কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা মেনে নিলে যতক্ষণ বাক্স খুলছি না ততক্ষণ বিড়ালটি একই সাথে বেঁচে থাকবে এবং মারা যাবে অর্থাৎ সেটি ‘সুপারপজিশনে’ থাকবে। কিন্তু বাক্স খুললে তো আমরা রিয়্যালিটিতে যে কোনো একটা দেখব হয় বিড়ালটা মৃত বা জীবিত। তাহলে কোয়ান্টাম রিয়্যালিটি কী? ওয়াইজনারের ব্যাখ্যা মেনে নিলে আমরা যখন বাক্স খুলব যেহেতু আমরা পর্যবেক্ষণ করছি তাই কোয়ান্টাম পরিবেশে ওয়েভ ফাংশান নষ্ট হয়ে যাবে এবং আমরা বিড়ালটিকে হয় বেঁচে থাকতে দেখব না হয় মারা যেতে দেখব। পর্যবেক্ষক বিড়ালের সাথে ‘এন্ট্যাংগলড’ হয়ে যাবেন।
তারপরে প্রশ্ন এল কিন্তু আমি কিভাবে বুঝব যে ‘আমি’ অর্থাৎ পর্যবেক্ষক বেঁচে আছি? আমি তো অন্য রিয়ালিটিতে বেঁচে থাকলেও এই রিয়ালিটিতে মৃত হতে পারি। তাই আমি জীবিত কি না তা বলার জন্য অন্য একজন পর্যবেক্ষক লাগবে। তাকে দেখার জন্য আরেকজন। তাকে দেখার জন্য আরেকজন। এভাবে অগণিত পর্যবেক্ষক লাগবে যতক্ষণ না শেষ একজন অন্তিম পর্যবেক্ষক আসবেন। এই ‘অন্তিম পর্যবেক্ষক’ কে? তিনি কি ‘নেচার’ বা ‘প্রকৃতি’ নাকি ‘ঈশ্বর’? তা আমরা জানি না।
মায়াবী কোয়ান্টাম জগতের আরেকটি ঘটনার কথা না বললেই নয় সেটি হল ‘কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট’। মনে করুন কোনো কাল্পনিক দুটো লুডোর ছক্কাকে এমনভাবে ‘এন্ট্যাঙ্গলড’ করা হয়েছে যাতে তাদের একসাথে ফেললে সবসময় ৭ হবে। একটায় ২ পড়লে আরেকটায় ৫, ৩ পড়লে ৪ এমন। আপনি যদি রানাঘাটে থাকেন আমি ব্যারাকপুরে, আমরা যদি একই সময় দুটি ছক্কা ফেলি তাহলেও একই ঘটনা ঘটবে।
ইলেক্ট্রনের দুরকম ঘূর্ণন থাকতে পারে। একটি ওপরের দিকে অন্যটি নীচের দিকে। যদি দুটো ইলেক্ট্রনকে আমরা যন্ত্র দিয়ে ‘এন্ট্যাংগলড’ করি তবে দেখব যখনই আমরা পরিমাপ করব একটির স্পিন ওপরের দিকে থাকলে অন্যটির সবসময় নীচে হবে। আমি যত দূরেই তাদের আলাদা করে পরীক্ষা করি না কেন তারা সবসময় একই ফলাফল দেখাবে। ঠিক যেন তারা পরস্পরের মধ্যে তথ্যের আদানপ্রদান করছে। এটা কিভাবে সম্ভব? আইনস্টাইনের মতে এ অসম্ভব ব্যাপার! এটা হতে পারে না। তাহলে নিশ্চই যখন তাদের ‘এন্ট্যাঙ্গলড’ করা হচ্ছে তখনই তাদের মধ্যে তথ্যের চালাচালি হয়ে যাচ্ছে। তিনি একে বললেন, Spooky action at distance । কিন্তু বিজ্ঞানীরা বহুবার বহু উন্নত যন্ত্র দিয়ে এই পরীক্ষা করে দেখেছেন ফলাফল একই আসছে।
এই ঘটনা যদি সত্যি হয় তবে একটা মারাত্মক ব্যাপার হবে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলছে এই দুই ইলেকট্রনকে আমরা যদি দুটো আলাদা গ্যালাক্সিতে রাখি তবেও একই ফল পাব। তাই যদি হয় তাহলে এই দুটো ইলেক্ট্রন নিজেদের মধ্যে যে তথ্যের আদানপ্রদান করছে তার গতি আলোর থেকে হয়ত ১০,০০০ গুণ বেশি। তাহলে আইনস্টাইন ভুল। তিনি বলে গেছেন এই মহাবিশ্বে কোনো কিছুর গতিবেগ আলোর থেকে বেশি হতে পারে না। আর যদি আমরাও মেনে নিই আইনস্টাইন ভুল তাহলে আমাদের রিয়্যালিটি ভেঙে যাবে। আমাদের এতকালের বিজ্ঞান, মডেল, ধ্রুবক সব চুরমার হয়ে যাবে। তাহলে?
আইরিশ বিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট বেল এর ব্যাখ্যা করে বললেন, এটা ঘটছে ‘সুপারডিটারমিনেশন’ থেকে। এই পৃথিবীতে সবকিছুই পূর্ব নির্ধারিত। প্রিডিটারমাইন্ড। ‘ফ্রি উইল’ বলে কিছু হয় না। তাই এটা বহু আগেই নির্ধারিত হয়ে আছে যে একটি ইলেক্ট্রনের আপস্পিন হলে অন্যটির ডাউনস্পিন হবে। তেমনি আপনি আমি অনেক চেষ্টা করলেও আমাদের নিয়তি বদলাতে পারব না। সব বহু আগের থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে। হামলোগ তো কাঠপুতলিয়া হ্যাঁয়, বাবুমশায়! আমাদের সব পরীক্ষা, সব ফলাফল, আমাদের জীবন-মরণ-কর্ম সবই পূর্ব নির্ধারিত। আমরা হতভাগ্যের মতই সময়কালের নিরন্তর চক্রে একই ভূমিকায় বারবার অভিনয় করে যাই। যদিও নিজেরা ভাবি আমরা নিজেদের পরিবর্তন করছি বা করতে পারি- কিন্তু তা অসম্ভব।
আমাদের যে রিয়্যালিটি তার সাপেক্ষে অন্য রিয়ালিটিতে আমার ভূমিকা সামান্য আলাদা হতে পারে কিন্তু সেটাও আগের থেকেই ঠিক হয়ে আছে। সমগ্র মহাবিশ্বের এই ভয়ঙ্কর চেতনা যেন আমাদের থেকে গোপন করে রাখা আছে। তাই আমরা নিজেদের ব্যক্তিত্বকে, চেতনাকে অন্যরকমভাবে দেখি।
কি বলবেন আপনি? এটা বিজ্ঞান না দর্শন? আপনার কি হিন্দুদের দর্শনের কথা মনে আসছে না? মনে আসছে না কর্মযোগের ‘নিষ্কাম কর্মের’ কথা? তাহলে চেতনা কি? চেতনাও কি একটা ইলিউশন নয়? চেতন জগত কি একটা মায়া নয়? এই জগতে আমি যদি অভিনেতাই হই তবে আমি কিভাবে সংলাপ বলব সেটাই গুরুত্বপূর্ণ, কী বলব তা অনেক আগেই লেখা হয়ে আছে।
(চলবে)