।। কাল নিরবধি?।।
সময় একটা ধারণা। যে ধারণা গড়ে উঠেছে আমাদের মনে, চেতনায়। চেতনা যেহেতু একটা স্থিতিস্থাপক ধারণা যাকে আকারে পরিবর্তিত করা যায় তাই সময়ের ধারণাও আমাদের কাছে বদলে যায়। কখনও তাকে মনে হয় প্রলম্বিত, কখনও তা নিঃশ্বাসের মতই দ্রুত উবে যায়।
একজন সুইডিশ মনোবিজ্ঞানী আল্পস পর্বতের অভিযাত্রীদের মধ্যে যাঁরা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তাঁদের ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন। তাঁরা সকলেই বলেছেন ঠিক যে মুহূর্তে তাঁরা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই সময় তাঁদের চিন্তার ও চেতনার গতি যেন হঠাৎ করেই প্রচুর বেড়ে গেছিল। কয়েক লহমা সময় তাঁদের কাছে মনে হচ্ছিল কয়েক বছর। মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এসে গিয়েছিল। মৃত্যুভয় বলে যেন কোনো বস্তুই ছিল না। কয়েক সেকেন্ড সময়ে তাঁদের গোটা এক জীবনের উপলব্ধি হয়েছিল।
একজন গাড়িচালক কোনোভাবে রেললাইনের ওপর গাড়ি নিয়ে চলে এসে দেখতে পান ট্রেন প্রায় চলে এসেছে। তাঁর বাঁচার আর প্রায় কোনো সম্ভাবনাই নেই। প্রচন্ড দ্রুতগতিতে ছুটে আসা ট্রেনটা যে তাকে পিষে দিয়ে চলে যাবে সেটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তিনি বেঁচে যান। পরে তিনি বলেছেন, যখন তিনি দেখলেন ট্রেনটি তার দিকে ছুটে আসছে হঠাৎ তার মনে হল ট্রেনটি যেন শামুকের গতিতে আসছে। তার চারপাশের সবকিছু যেন ভয়ঙ্কর শান্ত। কোনো শব্দ নেই, গতি নেই। সব যেন স্বপ্ন। এমনকি ট্রেনটি যখন তাকে অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে তখন এত দ্রুত গতিতে ছুটে আসা ট্রেনটির চালকের মুখটিও তিনি পরিষ্কার দেখতে পান। স্বাভাবিক গতিশীল অবস্থায় থাকা ট্রেনের চালকের মুখ দেখা কারোর পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
তাই মনে হয় জীবনে যখন জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয় তখন সময় যেন থমকে দাঁড়ায়। সবকিছু ধীরে ধীরে চলে। যেন স্লো-মোশনে চলে। প্রচন্ড দ্রুতগতির মহাকাশযানে থাকলে যে ‘টাইম ডায়লেশন’ হয় এক্ষেত্রেও তেমন হয়। জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে এক উদাসীনতা, এক পরম প্রশান্তি আমাদের আচ্ছন্ন করে। এটা কোনো অজানা চেতনার করুণাও হতে পারে। একটা সিংহ যখন কোনো হরিণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই মুহূর্তে সে বিমোহিত হয়ে যায়। একটা ট্রান্স। কেউ বলেন সিংহ তাকে সম্মোহিত করে। সিনেমায় মৃত্যুদৃশ্যগুলোতে দেখবেন স্লো-মোশনের আশ্রয় নেওয়া হয়। আপনি গ্ল্যাডিয়েটর বা ব্রেভ হার্ট সিনেমায় নায়কের মৃত্যুদৃশ্যের কথা চিন্তা করুন। সিংহের দাঁত যখন হরিণের টুঁটি চেপে ধরেছে সেই মুহূর্তে তার বেদনার অনুভূতি চলে যায়। এটা পরীক্ষিত। সৈনিক যখন যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হন তখন তার কোনো বেদনার অনুভূতি থাকে না।
আমি ডাক্তার হবার জন্য বহু মানুষের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছি। অনেকে আমার সামনেই মারা গেছেন। অনেকে শেষ জীবনে দীর্ঘ রোগভোগে অনেক শারীরিক কষ্ট সহ্য করে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু মৃত্যুর পরে আমি তাঁদের অনেকের মুখেই এক পরম প্রশান্তি লক্ষ্য করেছি। অনেকের মুখে যেন এক নিমীলিত হাসি লেগে থাকে। আমার কেন জানি মনে হয় তাঁরা অনেকদিন ধরে যতই কষ্ট পান না কেন জীবন-মরণের সেই সন্ধিকালে কেউ যেন তাঁদের সব বেদনা উপশম করে তাঁদের মধ্যে চিরপ্রশান্তির উপলব্ধি দিয়ে যান।
সময়ের এই পরিবর্তনের ধারণা আমাদের জীবনকালেও ঘটে। দেখা গেছে বয়স যত বাড়ে তত আমাদের মনে হয় সময় যেন দ্রুত চলছে। যুবকদের কাছে মনে হয় সময় ধীরে চলছে। শুধু মনে হয় না। ঘটনাটা সত্যিও। একজন যুবককে যদি মনে মনে তিন মিনিট গুনতে দেওয়া হয় তাহলে তারা ঘড়ির তিন মিনিটের হিসেবে তিন মিনিটই গুনবে। একজন বৃদ্ধ মানুষকে তিন মিনিট গুনতে দিলে তিনি সাড়ে তিন মিনিট গুনবেন। কোনোভাবে বয়স যত বাড়তে থাকে আমাদের ‘নিজস্ব’ সময়ের ঘড়ি যেন দ্রুতবেগে চলে।
যখন আমাদের মনে প্রচুর আনন্দ উল্লাস সময় যেন ফুৎকারে উবে যায়। যে সময় মনে অবসাদ, বাইরে বৃষ্টি, শোক, বেদনা সেই সময় যেন কাটতেই চায় না। ঘড়ি যেন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সময়ের এই ‘প্লাস্টিক’ ধারণা আমাদের সামনে স্পষ্টভাবে দেখা দেয় যখন কেউ নেশা করে। উইলিয়াম জেমস যাঁকে ‘ফাদার অফ সাইকোলজি’ বলা হয় তিনি বিভিন্ন নেশা করে নিজের ওপর তার প্রভাব লক্ষ্য করতেন। তিনি দেখেছিলেন হাশিস নেবার পর সময় খুব ধীরে চলছে। কতটা ধীরে চলছে?
জোসেফ মোরিয় ছিলেন পেশায় ডাক্তার। তিনি প্যারিসে প্রথম হাশিসের নেশা চালু করেন। দিকপাল ব্যক্তিরা তখন প্যারিসের ক্লাবে সেই নেশা শুরু করলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বোদলেয়র, বালজাক প্রমূখ সাহিত্যিকেরা। মোরিয় হাশিসের নেশা করে ক্লাব থেকে বেরিয়ে বাড়ি যাবার সময় লক্ষ্য করলেন যে ব্রিজটা পেরিয়ে তাঁর বাড়ি যেতে হয় স্বাভাবিক অবস্থায় তাকে পার হতে তাঁর হয়ত এক মিনিট লাগে। কিন্তু হাশিসের নেশা করে সেই ব্রিজ পার হবার সময় তাঁর মনে হল ব্রিজ যেন অনন্ত দীর্ঘ। তিনি যেন এই এক জীবনে সেই ব্রিজকে পার হতে পারবেন না।
আমি জীবনে বার তিনেক গাঁজা খেয়েছি। গাঁজা, হাশিস, ভাং, চরশ সব একই গাছ ক্যানাবিস ইন্ডিকার বিভিন্ন অংশ থেকে তৈরি হয়। গাঁজা হল ফুল আর হাশিস বা চরস হল রেসিন, ভাং হল গাছের পাতা। আমার গাঁজা খেয়ে মনে হয়েছিল আমি যেন স্থবির হয়ে গেছি। নড়াচড়া করতে পারছি না। আমার এক বন্ধু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খুব ভক্ত। সে বলত গাঁজা খেয়ে তার মনে হত সঙ্গীতের প্রতিটি নোটেশন এমনি সময় সে যা বুঝতেও পারে না তখন তা যেন স্পষ্ট তার শ্রবণ চেতনায় জেগে ওঠে। প্রতিটি সুর-তাল-লয় যেন আলাদা আলাদাভাবে বোঝা যায়। সময় যেন স্লো-মোশনে চলতে থাকে।
গতি সবসময় আমাদের সময়ের চেতনাকে বদলে দেয়। অলিভার স্যাকস তাঁর বইয়ে বলেছেন যখন সাইক্লিস্টরা কোনো রেসে অংশ নেয় তখন প্রায় চল্লিশ মাইল প্রতি ঘন্টায় চালায়। তারা এত দ্রুত এত গায়ে গায়ে চালায় যে আমাদের মনে হয় এই বুঝি ধাক্কা লেগে সবাই হুড়মুড় করে পড়বে। কিন্তু তা কখনই হয় না। সাইক্লিস্টরা বলেন তাঁরা যখন রেসে অংশ নেন তখন মনে হয় তাঁরা যেন স্লো-মোশনে চলছেন। সময় তাঁদের ক্ষেত্রে অনেক ধীরে চলছে। আর পাশের জনের থেকে তাঁদের এতটাই দূরত্ব যে কোনোভাবে ধাক্কা লাগার কোনো সম্ভাবনাই নেই। একজন বেসবল খেলোয়াড় প্রচন্ড বেগে ধেয়ে আসা বলটিকে যখন হাতে ধরেন দীর্ঘদিনের অভ্যাসের পর তাঁর মনে হয় বলটি যেন খুব ধীরে ধীরে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। মার্শাল আর্টসের শিল্পীরা এত তাড়াতাড়ি হাত-পা নাড়ান যে আমাদের মনে হতে পারে এটা কিভাবে সম্ভব। তাঁরাও দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এমন অবস্থায় পৌঁছান যে প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতিটি মুভ তাঁরা স্লো-মোশনে দেখতে পান।
স্যাকস তাঁর টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সির রুগিদের জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলেন যে মুহূর্তে তাদের চার কি পাঁচ সেকেন্ডের খিঁচুনি বা কনভালশন হয় সেসময় তাদের মনে হত সময় যেন কাটছেই না। এই সময়ের ধারণা খুব সুন্দর দিয়েছেন কালজয়ী রাশিয়ান সাহিত্যিক ফিয়োদর দস্তয়েফস্কি। তিনি অল্পবয়স থেকেই মেসিয়াল টেম্পোরাল লোব এপিলেপসির রুগি ছিলেন। তাঁর মৃগিরোগের একটা বিশেষ নাম ছিল ‘এক্সট্যাটিক সিজার’। এটি খুব কম দেখা যায় কিন্তু এই রোগে সিজারের সময় যে ‘অরা’ হয় তাতে রুগিদের অনির্বচনীয় অনুভূতি হয়। সারা দেহে এক উষ্ণতা ও মনে স্বর্গীয় অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। দস্তয়েফস্কির মত তাঁর গুরু ডিকেন্সও এইরকম সিজারে আক্রান্ত ছিলেন এবং দুজনেই তাঁদের এই অনুভূতির কথা লিখে রেখে গেছেন।
দস্তয়েফস্কি লিখেছেন, “সেটা সামান্য কিছু মুহূর্ত, হয়ত কয়েক সেকেন্ড কিন্তু সেই সময়েই তুমি এই জগতের চিরন্তন সুর নিজের ভেতরে উপলব্ধি করতে পারবে। সবকিছু এত স্পষ্ট ও এত পরিষ্কারভাবে তোমাকে ঘিরে নেবে যে তুমি তাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না… সেই পাঁচ সেকেন্ড সময়ে আমি যেন একটা সমগ্র মানবজীবন কাটিয়ে দিতে পারি। তবুও কখনো আমার মনে হয় না যে আমি খুব সচেতনভাবে সেটি করছি”। যাঁরা দস্তয়েফস্কি পড়েছেন তাঁরা জানেন তাঁর লেখায় যে ঈশ্বরের উপলব্ধি, ধর্মীয় ধারণা ও বাইবেলের ওপর তাঁর যে আস্থা সেই ভগবৎবোধের একটা প্রধাণ কারণ সম্ভবত ছিল তাঁর সেই টেম্পোরাল লোব ‘এক্সট্যাটিক’ এপিলেপসি।
পারকিনসনিজম এমন এক অসুখ যাতে প্রথমে রুগিদের নড়াচড়া, কাঁপুনি বেড়ে গেলেও পরে তা আস্তে আস্তে কমে আসে এবং এক সময় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তাঁদের সবরকম কাজকর্ম খুব খুব ধীরে ধীরে হয়। হাত দিয়ে মাথা চুলকোতেই হয়ত পনের মিনিট সময় লাগবে। স্যাকস তাঁর রুগিদের জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলেন এই ভীষণ স্লথ জীবনে তাঁদের কোনো অসুবিধে হয় না। কিন্তু যখন ঘড়ির দিকে তাকান তাঁদের মনে হয় ঘড়ির কাঁটা খুব দ্রুতবেগে ঘুরছে। বাইরে বেরিয়ে যখন অন্য লোকেদের দেখেন তখন মনে হয় তাঁরা যেন প্রচন্ড তাড়াতাড়ি চলাফেরা করছে। তাই তাঁদের কাছে সময় স্বাভাবিকভাবে চলছে। যদিও আমাদের মনে হচ্ছে তাঁরা অত্যন্ত অত্যন্ত ধীর, হয়ত বা স্থবির।
১৯৬০ সালে নিউরোফিজিওলজিস্ট বেঞ্জামিন লিবেট একটি বিখ্যাত পরীক্ষা করেন। তিনি সেই পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে আসেন যে আমাদের মস্তিষ্ক কোনো ক্রিয়া চেতনার সীমায় আসার কয়েকশ মিলি সেকেন্ড আগেই নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আমরা ভাবি আমরা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিন্তু সেটা একটা ইলিউশন। একশ মিটার দৌড়ের সময় প্রতিযোগী বন্দুকের শব্দ শোনার আগেই ছিটকে বেরিয়ে আসে। এটা সত্যি, কিন্তু সেটা মিলিসেকেন্ডের ব্যবধান তাই আমরা বুঝতে পারি না।
তাহলে পাঠক আমরা জানলাম আমরা যা দেখি তাই অস্তিত্ব, কিন্তু আমরা যা দেখি তা একটা ইলিউশন। তাই অস্তিত্বও একটা মায়া, চেতনা সেই মায়ারই আধার। আমরা জানলাম আমাদের ‘ফ্রি উইল’ বলে কিছু নেই। জানলাম স্থান-কাল এক কল্পিত ধারণা। এরা অনির্দিষ্ট হয়ত অস্তিত্বহীন। আমাদের ধারণাতেই এরা আছে। আমরা জানলাম আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আমাদের মনে হয় আমরা ভাবছি বা করছি। আসলে তা নয়। ‘সকলি তোমারি ইচ্ছা,/ ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।/ তোমার কর্ম তুমি কর মা,/ লোকে বলে করি আমি’। কী বলবেন? সাধক রামপ্রসাদ কত বছর আগে এই গান লিখে রেখে গেছেন। ভেবে দেখুন, সাধনা চেতনার স্তরকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে।
আমরা আমাদের আলোচনার প্রায় শেষভাগে চলে এসেছি। অহেতুক দীর্ঘায়িত করে কোনো লাভ নেই কারণ এই আলোচনার কোনো শেষ নেই। শেষ নেই যার শেষ কথাটি কে বলবে? তবে আমরা যেহেতু চেতনা নিয়ে কথা বলছি তাই চেতনার প্রধান আধার যে ‘প্রাণ’ সেই প্রাণ নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। তাই এবার আমরা একটু ছুঁয়ে যাব যে এই প্রাণ এল কোথা থেকে?
(চলবে)