।। ১/১৩৭ ।।
আপনি যত বিজ্ঞানের বসতবাটিতে প্রবেশ করবেন তত কানে আসতে থাকবে নানা কন্সট্যান্ট বা ধ্রুবকের নাম ও তাদের মান। এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্ভবত মহাকর্ষীয় ধ্রুবক। তার পরেই সম্ভবত আলোর গতিবেগ। এদের মান নিত্য, অপরিবর্তনীয়। আপনি এই মহাবিশ্বের যেখানেই এদের পরিমাপ করুন না কেন এরা সর্বত্র একই মান দেখাবে। কিন্তু আমাদের মনে প্রশ্ন, এরা কেন একই মান দেখাবে? কেন এরা ধ্রুবক?
এই মহাবিশ্বে মোট চাররকম বল আছে। মহাকর্ষীয়, তড়িচ্চুম্বকীয় এবং স্ট্রং ও উইক ফোর্স। আমাদের প্রশ্ন কেন এই চার রকমেরই বল আছে? এর থেকে বেশি বা কম নেই কেন? নীলস বোর বলে গেছেন ইলেক্ট্রন যখন এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষপথে ঝাঁপ দেয় তখন সে কিছু শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করে। এই শক্তি তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি হিসেবে নির্গত হয়। এই শক্তির পরিমাপ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখলেন, পদার্থের কেন্দ্রে এক আশ্চর্য ধ্রুবক লুকিয়ে আছে- একটা ম্যাজিক নাম্বার তা কোথা থেকে আসছে জানা যাচ্ছে না কিন্তু সেটি যদি না থাকত এই মহাবিশ্বের শৃংখলা বলেই কিছু থাকত না। আমাদের এই পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বই থাকত না।
বিজ্ঞানী সমারফিল্ড প্রথম এই ধ্রুবককে আবিষ্কার করেন। তাই এটিকে তার নাম অনুসারে ‘সমারফিল্ডের ধ্রুবক’ বলা হয়। যদিও এটিকে আমরা সবাই ‘ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট’ বা গ্রিক বর্ণমালার প্রথম অক্ষর ‘আলফা’ নামেই বেশি চিনি। তিনি এটিকে প্রকাশ করেন ইলেক্ট্রনের আধানের বর্গকে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক ও আলোর গতিবেগ দিয়ে ভাগ করে। দেখা যায় এটির কোনো একক নেই। এটি কেবলমাত্র একটি সংখ্যা। ১/১৩৭। এই সংখ্যাটা প্রত্যেক পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে এক চরম ধাঁধাঁ। এটি এল কোথা থেকে? কেনই বা এর মানের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না? কেনই বা এর কোনো একক নেই?
রিচার্ড ফাইনম্যান যেমন বলেছেন, “এটি সম্ভবত পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে বড় রহস্য যে এই ম্যাজিক সংখ্যাটা আমাদের কাছে এসেছে অথচ আমরা কেউ জানি না এটা কিভাবে এল। কেউ হয়ত বলবেন এটা ‘ঈশ্বরের হাত থেকে এসেছে’। তবে আমরা জানি না ঈশ্বর কিভাবে তার পেনসিল দিয়ে খাতায় সেই সংখ্যাকে লিখেছেন। আমরা জানি কিভাবে এক বিশেষ নৃত্যের আয়োজন করে তার পরিমাপ করলে আমরা সেই নির্ভুল সংখ্যাটা পাব কিন্তু আমরা জানি না কম্পিউটারে কেমন নৃত্যের আয়োজন করলে সেই সংখ্যাটা ভেসে উঠবে যদি না আমরা তাকে গোপনে বসিয়ে দিই”।
নোবেল বিজেতা উলফগ্যাং পাওলি বলেছিলেন, “আমার মৃত্যুর পরে যদি শয়তানের সাথে দেখা হয় তাহলে তাকে একটা প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করবঃ ওহে, ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট ব্যাপারটা ঠিক কি”? পাওলি যখন মারা যান তখন হাসপাতালের যে ঘরে মারা যান তার নম্বরও ছিল ১৩৭। হাইজেনবার্গ বলেছিলেন, “আমরা যেদিন জানতে পারব ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট কী সেদিনই আমরা কোয়ান্টাম তত্ত্বের রহস্য ভেদ করতে পারব”। বিজ্ঞানী লরেন্স ইভস বলেছেন, “আমরা যদি অন্য গ্রহের মানুষদের সাথে যোগাযোগ করতে চাই তবে আমাদের ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট-এর মাধ্যমে যোগাযোগ করা উচিত। তাহলে তারাও বুঝতে পারবে আমরাও কোয়ান্টাম মেকানিক্স জানি। পদার্থে মধ্যেকার রহস্য আমরাও কিছুকিছু উদ্ঘাটন করেছি”। কিন্তু আমার আপনার মত সাধারণ মানুষ যদি জানতে চেষ্টা করি ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট আদপে কী তাহলে আমরা কীভাবে বুঝব?
আসলে এটি এমন এক সংখ্যা যা কিনা সারা মহাবিশ্বের সকল প্রকার সৃষ্টি তা নতুন পরমাণু হোক বা প্রাণ সবকিছুর মূল উৎস বলে ধরা হয়। সকল রাসায়নিক ও জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া যা নিরন্তর ঘটে চলেছে তা এই সংখ্যা আছে বলেই হয়েছে। আমাদের পৃথিবীতে প্রাণ কিভাবে এসেছে তা আমরা জানি না। কেউ বলেন সব পরমাণুগুলো এলোপাথাড়িভাবে মিশ্রিত হতে হতে একদিন কোনো সম্ভাবনায় প্রাণের আদি অণু নিউক্লিক অ্যাসিড সৃষ্টি করে ফেলেছিল। কেউ বলেন প্রাণ উল্কাপিন্ডের মাধ্যম বাইরের কোনো গ্রহ থেকে এসেছে। তা যেখান থেকেই আসুক না কেন প্রাণের জন্য প্রধান যে মৌলটি জরুরি তা হল কার্বন। এই কার্বন কোথা থেকে এসেছে জানেন তো? এই কার্বন এসেছে নক্ষত্রদের অভ্যন্তরের আগ্নেয় চুল্লি থেকে। তাই সঠিকভাবে বলতে গেলে আমি আপনি সকলেই জন্ম গ্রহণ করেছি নক্ষত্রদের চুল্লির গর্ভে। কিন্তু কিভাবে?
বিগ ব্যাঙের পর কেবল দু-রকমের মৌল ছিল। হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। চারিদিকে শুধু হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের গ্যাস। এই গ্যাস ঠান্ডা হলে মহাকর্ষের প্রভাবে ঘনীভূত হয়ে নক্ষত্রের কেন্দ্রে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করল। চাপ বাড়লে তাপ বাড়ল। সেই প্রচন্ড উচ্চ তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম ছোটাছুটি করতে শুরু করল। এরা একে অপরের সাথে সংযুক্ত হল যাকে বলে ‘নিউক্লিয়ার ফিউশন’। তার ফলেই লিথিয়াম, বেরিলিয়াম, বোরন ও তারপর সৃষ্টি হল কার্বন। কার্বনের সৃষ্টি হতে হলে তিনটি হিলিয়াম পরমাণুকে একই সাথে প্রচন্ড বেগে মিলিত হতে হবে। সময়ের একচুল এদিক ওদিক হলে হবে না।
নক্ষত্রের ভেতরেও এই একইসাথে মিলিত হবার সম্ভাবনা খুবই খুবই কম। তাহলে এত যে কার্বন এসেছে মহাজাগতিক ধুলো থেকে যা থেকে এত এত জীবপ্রজাতির সৃষ্টি তারা কিভাবে এল? কার্বনের তৈরি হওয়া যদি এত কঠিন তাহলে এত কার্বন পৃথিবীতে এল কিভাবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন সম্ভবত, ‘কার্বন রেসোনেন্স’ এর জন্য দায়ি। যার ফলে এত বেশি কার্বন তৈরি হতে পেরেছে। কিন্তু মোদ্দা কথা হল নক্ষত্রের কেন্দ্রে এই ‘ফিউশন রিয়াকশন’ হবেই না যদি এই ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট ১.১ গুণ মাত্র পরিবর্তিত হয় অথবা ৪% বেড়ে যায়। এটি অভ্রান্ত আছে বলেই হাইড্রোজেন থেকে সব পরমাণু মায় আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন ও দেহ গঠনের কার্বন গলায় পড়ার সোনা থেকে শুরু করে লৌহযুগের লোহা সবকিছু তৈরি হয়েছে। এই ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট আছে তাই আমরা আছি। না থাকলে নেই।
এখন তাহলে আগের প্রশ্নটিই আবার করা যাক? কেন আমাদের মহাবিশ্বে চারটিই মাত্র বল? কেন এখানে সব ধ্রুবকের মান নির্দিষ্ট? কেন ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট-এর মান ১/১৩৭ এবং অপরিবর্তনীয়? এর পক্ষে দুটি ধারণা আছে। একদল বলেন, আছে তাই আছে বা আছে তাই আছি। আমাদের এই পৃথিবীতে এই সবকিছুই এইভাবে আছে তাই আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ ঘটেছে। যদি না থাকত তাহলে প্রাণ থাকত না। এই তত্ত্ব প্রথম সামনে নিয়ে আসেন গোল্ডিলক। একে বলে ‘অ্যান্থ্রোপিক প্রিন্সিপাল’। সবকিছু ঠিকঠাক আছে তাই আমরা আছি। এই মহাবিশ্বের অন্য কোথাও যদি এমনই থাকে তাহলে সেখানেও প্রাণ থাকতে পারে।
আরেকদল বলেন, এই মহাবিশ্বের সবকিছু এত নির্দিষ্ট, ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট অপরিবর্তনীয় অথচ সেটি কিভাবে এসেছে আমরা জানি না এর থেকেই মনে হয় কোনো পরম শক্তি যিনি ঈশ্বরও হতে পারেন তিনি এই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। সত্যিই আমরা কিছু জানি না। আমাদের জানা থেকে অজানার ব্যপ্তি যে কত বেশি সেটা আমরা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারি।
কিন্তু এই যে ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট এর মান কি পরিবর্তিত হতে পারে? আমাদের মহাবিশ্বের বহু দূরে একধরণের নক্ষত্রপুঞ্জ আছে তাদের বলে কোয়াসার। মনে করা হয় বিগ ব্যাং হবার পরপরই এদের সৃষ্টি। তাই টেলিস্কোপ নিয়ে এদের দিকে তাকানোর অর্থ হল আমাদের আদিম উৎসের দিকে তাকানো। বিজ্ঞানীরা এই কোয়াসার থেকে আসা আলোর স্পেক্ট্রোস্কোপিক বিশ্লেষণ করে দেখেছেন তাতে ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট-এর মানের সামান্য পরিবর্তন হচ্ছে। এটা খুব প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ। যদিও তারা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না তবে তারা পার্থক্য লক্ষ্য করেছেন। আরো উন্নত স্পেক্ট্রোস্কোপ দিয়ে দেখার কাজ শুরু হয়েছে। যদি তাই হয় তবে স্বীকার করে নিতে হবে ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট বা আলফার মানও বদলাতে পারে। কিন্তু তার মান বদলালে আমাদের এই মহাবিশ্বের রিয়ালিটিই তো ভেঙ্গে যাবে। আমাদের এই মহাবিশ্বে যা কিছু আছে পদার্থ থেকে প্রাণ সবার গঠনই বদলে যাবে। তাহলে? তাহলে এমন হতে পারে যে ‘মাল্টিভার্স’ বা অন্য অনেক মহাবিশ্ব আছে এই ধারণা সত্যি। একেকটি মহাবিশ্বের জন্য একেকরকম ফাইন স্ট্রাকচার কন্সট্যান্ট, একেকরকম রিয়্যালিটি, একেক রকম ধ্রুবক, একেক রকম নিয়ম ও সূত্রাবলী।
তাই যদি হয় তবে আমাদের চেতনা যা এই মহাবিশ্বের রিয়্যালিটি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত সেটিও ভেঙ্গে যাবে এবং আমরা এক সাগর থেকে আরেক অথৈ সাগরে গিয়ে পড়ব। মাঝে মাঝে মনে হয় ভয়েজার থেকে তোলা আমাদের পৃথিবীর যে ছবিটা একসময় সারা পৃথিবীতে সারা ফেলে দিয়েছিল সেই ‘পেল ব্লু ডট’ বা ‘হালকা নীল বিন্দু’টিই সঠিকভাবে আমাদের রিয়্যালিটি। আমরা কত ক্ষুদ্র ছবিটি সেটাই বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়। তবে যে চেতনা নিয়ে কেউ ওই হালকা নীল বিন্দুর মধ্যে বসে দূরবীন দিয়ে রাতের আকাশ দেখে চলেছে বা কেউ সুদূর হিমালয়ে বসে নিজের মধ্যে বিশ্বজগতের চেতনাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে বা কোনো কবির মুখ দিয়ে নির্গত হচ্ছে চেতনার প্রথম কবিতাঃ মা নিষাদ! সেই চেতনা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন সেও কম রহস্যময় নয়।
তবে সে নিজের ভেতরে ডুব দিয়ে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করছে। এটিই তার সবচেয়ে বড় শক্তি এবং সবচেয়ে বড় দূর্বলতা।
(চলবে)
পরের পর্ব ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২১-এ।