আমার অতি প্রিয় দাদা তাড়া দিচ্ছিলেন কদিন ধরেই। মধ্যমগ্রামে থাকেন তিনি। মাত্র কদিন আগে তাঁর প্রায় প্রতিবেশীই ছিলাম। অতি সম্প্রতি মা চলে যাবার পর আমি উদ্বাস্তু হয়েছি আবারও। আমাকে নিউটাউনের নতুন আবাসে এসে উঠতে হয়েছে। সে অন্য গল্প। আপাতত এই গল্পটা শেষ করি।
দাদা প্রথম ফোনে জানালেন,– শোনো অরুণাচল, এক পাগল ছেলে দুই বোতল ভর্তি নলেন গুড় পাঠিয়েছে তোমার আর আমার জন্য। কুরিয়ারের কৃপায় তার এক বোতল প্রায় মাখামাখি। যেটুকু উদ্ধার করা গেছে সেই প্রায় খালি বোতলটার… আমার জন্য রেখেছি। বাকিটা আস্ত আছে। তুমি শিগগির এসে তোমার সেই গুড়টা নিয়ে যাও প্লিজ।
আমি ব্যাপার জেনে অবাক। সত্যি বলতে কী এই দেওয়াথোয়ার ব্যাপারে আমি চিরকালই একটু উদাসীন। হয়তো আমার অন্তর্গত কৃপণতার কারণেই।
কারওর বাড়িতে গেলে এক প্যাকেট মিষ্টি বা সেই বাড়ির ছোটো বাচ্চাটার জন্য একটা ক্যাডবেরি বা নিদেন দুটো লেবুলজেন্স এর কোনটাতে আমি অভ্যস্ত নই। অথচ কেউ যখন আমাকে ভালোবাসার স্মারক হিসেবে কিছু দেন, যে কোনও প্যাকেট, সেটি নেবার বেলায় দিব্যি ধাতস্থ আমি। আমার চরিত্রের এই নেহাতই নির্লজ্জতা মেনেও নিয়েছেন পরিচিত জনেরা।
কিন্তু এই ছেলে, গুড় যে পাঠিয়েছে সেই তার সঙ্গে আমার সেই অর্থে আলাপ নেই। যোগাযোগ যা কিছু ভার্চুয়ালে, মানে ফেসবুকে আর হোয়াটসঅ্যাপে। ভাব ভালোবাসা ঝগড়া পুরোটাই।
আমারও তখন নিজস্ব ঘটনার ঘনঘটায় মাখামাখি অবস্থা। মা চলে গেছেন। গিন্নি নতুন আবাসে যাবার ফরমান জারি করেছেন। এই সব নানান টানাপোড়েনে দাদার ডাকে তক্ষুনি সাড়া দিয়ে উঠতে পারছি না।
এমন সময়ে আবার দাদার ফোন।– ভাই অরুণাচল, তুমি এসে জিনিস বুঝে নিয়ে আমাকে দায়মুক্ত করো।
দাদার এই ব্যাকুলতার কারণ আমি বুঝি। সেই ছেলে বুঝি বা বার কয়েক খোঁজ নিয়েছে ফোনে, আমি তার উপহার হস্তগত করেছি কি না।
আমার দাদাটি চিরকালের নিষ্কলঙ্ক অপরিগ্রাহী মানুষ। কাজেই তিনি যারপরনাই বিব্রত আমার এই অসমীচীন দেরিতে। যে আমার নাম করে পাঠিয়েছে সে যদি কোনওমতে ভেবে বসে, আমার দাদাটিরই দেবার বাসনা নেই।
বিপদাপন্ন দাদা এমনকি এও প্রস্তাব দিলেন,– অরুণাচল, আমিই না হয় তোমার বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসি?
হায় রে আমার ভাগ্য! দাদা ভুলে গেছেন, আমি তো দাদার প্রতিবেশী নই আর। এখন তো আছি বেশ খানিক দূরে। সেই নিউটাউনে।
বিপদ কখনও একলা আসে না। আমার বেলা সে এল বইমেলার রূপ ধরে। এই বছর যাইনি তেমন। মা থাকলে রোজই যেতাম হয়তো। বই কিনতাম না। গতবারের মেলায় কেনা বইই পড়ে শেষ করতে পারিনি। তবু যেতাম ওই ফেরিওয়ালার কাছে শেখা আপ্তবাক্য খেয়ালে রেখে। কেনাকাটা যার যার… দেখাশোনা ফ্রি। দেখাশোনার জন্যেই যেতাম। দেখাশোনাও কি আর বইয়ের সঙ্গে? মেলায় যেতাম মিলতে। চেনা জানা আত্মীয় জনের দেখা পেতে। তা সেই যাওয়াও এবারে সেই ভাবে হলই না। অনেককেই সে ভাবে বলে আসা হলও না, আমি যে গান গেয়েছিলেম… এই কথাটি মনে রেখো।
তো সেই বইমেলা চলতে চলতেই সেই গুড় পাঠানো ছেলের কাছ থেকে একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ এল। মেসেজটা পড়েই মন ভারি খারাপ হল। অথবা খারাপ ঠিক না। একধরণের স্মৃতিমেদুরতা। মেসেজটা যেন আমার আকাশের ঈশান কোণের এক টুকরো কালো মেঘের মত। তারপরে বাতাস থমথমে হল। আর মেঘ ছড়িয়ে পড়ল ব্যক্তিগত আকাশটায়। চরাচরে পরিব্যাপ্ত সেই স্মৃতিমেঘ আমাকে ঘিরে রইল। আচ্ছন্ন করল। আচ্ছন্ন করে রাখল এই কদিন। লেখাটা লিখতে আর পোস্ট করতে দেরি হল তাই।
আমারও একটা বোকা বাবা ছিল। সংসারে কিছু প্রাণী জন্মই নেয় যেন ভার বইবে বলে। সংসারের, কাজের জায়গার।
প্রতিদানে কিচ্ছুটি চাইবে না। না বাড়ির লোকের কাছে, না প্রতিবেশী অফিস-কলিগ কারওর কাছেই। আমার বাবা ছিল সেই রকমের এক মানুষ। পরে আমার মনে হয়েছে, সময়ের সঙ্গে কিছুটা বেমানান এক অস্তিত্ব।
খুব ছোটো বেলায় দেখেছি বাবার সহকর্মীরা মানে রমেশ কাকু, দেবব্রত কাকু সবাই অফিস থেকে ফিরে গেছে। বাবার ফিরতে দেরি হয় রোজই। বাবা অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে মাকে বোঝাতো,— আরে, কাজ শিখতে হবে তো। তাই দেরি করে বেরোই। কাজ শিখে নিচ্ছি বেশি করে, বুঝলে তো।
ব্লক অফিসের কনিষ্ঠ কেরানি আমার বাবা তখন। মন দিয়ে কাজ শিখতে শিখতে খেয়ালই করল না কখন তাকে টপকে উঁচুতে প্রোমোশন পেয়ে গেল অনেক জুনিয়র দুলাল ঘোষ আর অন্যরা।
তখনকার দিনে ব্লক অফিসে কেরানিগিরিতে উন্নতির ধাপটা ছিল প্রথমে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক তার পরে ক্যাসিয়ারবাবু। তারও পরে বড়বাবু। কিন্তু কার কপালে প্রোমোশনের শিকে ছিঁড়বে তার কোনও নিয়মনীতি ছিল না সে কালে। অবশ্য কোন কালেই বা তা থাকে! বাবা খুব মন দিয়ে কোঅর্ডিনেশন কমিটি করত। মানে কর্মচারী ইউনিয়ন। আর বাবার চোখের সামনে একই সংগঠন করা অন্যরা টপাটপ পেরিয়ে যেত প্রোমোশনের ধাপগুলি। বাবা রাগ করত না।
তো দুলাল ঘোষেরা তদ্দিনে যখন পুরোনো বড়বাবু আমার বাবা তখনও তার ভাষায় কাজ শিখছে। তখনও ক্যাসিয়ারবাবু। দু পয়সা পাঁচ পয়সার হিসেব ক্যাশবুকে না মিললে চিন্তায় নিজের মাথার চুল আক্ষরিক অর্থেই টেনে টেনে ছিঁড়ছে।
তো কাজটাজ শিখে অনেকের পরে যদিও, বাবা নিজেই বড়বাবু হল একদিন। তখনও দেরি করে অফিস থেকে ফেরে। মা আপত্তি করে,– এখন তো তুমি কাজটাজ শিখে হেডক্লার্ক। এখনও কেন ফিরতে দেরি?
বাবা বলে,– আরে বোঝো না কেন? জুনিয়ররা কাজ শেখেনি তত। ওদের শেখাতে হয় তো হাতে ধরে। দায়িত্বের কাজ।
মাঝে সিদ্ধার্থ রায়ের আমলে মজার ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময়ের যুব কংগ্রেস কোঅর্ডিনেশন করা লোকেদের পেছনে লাগবে বলে ঠিক করল একবার। নাম দিয়েছিল চেয়ার দখল আন্দোলন বা এই রকমের কিছু। তারা ঠিক বেলা দশটার সময় অফিসে হাজির হয়ে খালি চেয়ার দখল করবে এই ছিল তাদের আন্দোলনের বিষয়। বাবা আগেই বলেছি, অফিস যেত অফিস খোলার অনেক আগে। আমার মায়ের ভাষায় অফিস ঝাঁট দিতে যায়। সাড়ে আটটা নটায় অফিসে পৌঁছনো মানুষের চেয়ার দখল করার হিম্মত ছিল না সেই সেদিনের যুব কংগ্রেসিদের!
আর একবার, বাবা তখন শক্তিপুর ব্লক অফিসে। আরএসপির সঙ্গে শরিকি লড়াই বেধেছে সিপিআইএমের। তো প্রচলিত বিশ্বাসে কো অর্ডিনেশন মানেই সিপিআইএম। বাবাদের অফিসে হামলা হল একদিন। যারা পারল পালিয়ে বাঁচল। অফিসের আশেপাশেই ধান ক্ষেতে গিয়ে লুকোলো তারা। বাবার মনে জেগে উঠল প্রত্যয়িত নীতিবোধ। এই অফিস আমার অধিকার। কোথায় পালাব আমি একে ছেড়ে? কার ভয়ে?
কাজেই বোকা বেচারা মানুষটা অফিসে থেকে বেধড়ক মার খেল খানিক। অথচ ভরা বাম আমল তখন।
নিজের যোগ্যতায় প্রোমোশন কি পায়নি? না না, পেয়েছিল। চাকরির একেবারে শেষদিকে ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিয়ে অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সার্ভিসে জুনিয়র অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড অডিট অফিসার হয়েছিল বাবা।
সেই পরীক্ষার গল্পও বলার মত। একটাই প্রশ্নপত্রে অঙ্ক ইংরেজি কন্সটিটিউশন আর সার্ভিস ল ইত্যাদি সব সাবজেক্ট।
বাবা পরীক্ষা দিয়ে বেরোবার পর আমি আর সুনন্দা (আর কিছুদিন বাদেই বাবার পুত্রবধূ হবে সে) জিজ্ঞেস করলাম গার্জিয়ানের মত,– কেমন পরীক্ষা দিলে বাবুনা? সব পেরেছো?
বাবা কেমন যেন মুখ চুন করে উত্তর দিল,– না রে, পরীক্ষাটা ভালো হল না। প্রথম কোশ্চেনটায় ভুল ছিল। সেটা যে ভুল প্রশ্ন তার কারণ লিখতে গিয়ে অনেক সময় গেল।
বিস্তারিত জানতে চাইলে কী ঘটেছে বোঝালো। প্রথম প্রশ্নটা ছিল অঙ্কের। যদ্দুর মনে পড়ে প্রশ্নটা ছিল সরকারি কর্মচারী কারও একজনের মাইনের ফিক্সেশন বা প্রাপ্য টাকাপয়সার ব্যাপারে। সেই লোক তার চাকরির জায়গায় বিস্তর ছুটিছাটা, আন অথরাইজড্ লিভ, লিভ উইথাউট পে এইসব গোলমেলে ব্যাপারে জড়িয়েছে। বাবা সেই দুর্বিনীত কর্মচারীর শেষ অবধি কত প্রাপ্য হতে পারে তা নির্ধারণের আগে, প্রশ্নটার ভেতরেই কী কী ভুল আছে, মানে প্রায় চাকরি চলে যাওয়া সেই কাল্পনিক লোকটির কখন কখন কী কী টাকা পেয়েছে সেই হিসেবেই যে বিস্তর ভুল রয়েছে মূল প্রশ্নে এই সব জটিলতা বিস্তারিত লিখে তারপরে লিখেছে, এ সত্ত্বেও যদি ধরে নিই একে সরকার সত্যিই প্রাপ্য মিটিয়ে দিতে চায়, তবে এইভাবে এগোতে হবে। এই বিস্তৃত উপক্রমণিকা লিখে বাবা মূল অঙ্কটা কষেছে।
শুনে মনে হল, আইন মানা আর জানা মানুষ আমার বাবা সত্যিই ফ্যাসাদ বাধিয়েছে এবারে। এ তো প্রশ্নকর্তাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ। যেন তার মুখের ওপর বলা,– অ্যাঃ, কোশ্চেন সেট করেছেন, কিন্তু আদতে নিজেই যে আইন কানুন কিছুই জানেন না মশাই। ছ্যা ছ্যা…
বাবা কিন্তু সেই পরীক্ষায় পাশ করেছিল ভালোভাবেই। শুনেছিলাম থার্ড না ফোর্থ। তখনও এইসব ফাঁকা ওএমআর শিটের গল্প আসেনি বলেই বোধহয়।
আমি যখন সরকারি চাকরিতে জয়েন করি সুধীরবাবু বলে এক করিতকর্মা ক্লার্ক আমায় বলেছিলেন,– স্যার আপনার স্টাফ আমি। আমার ছেলে যদি দোকানের কেনা কাগজে অঙ্ক করে সে কি আপনারই লজ্জা নয়?
এই নির্লজ্জ স্বীকারোক্তিটি শুনে সদ্য জয়েন করা আমার নিজের বাবার কথা মনে পড়েছিল। অফিসের কাগজ পেন্সিল দূরে থাক বাবার এক সহকর্মী আমাকে স্কুলে যাবার নির্জন রাস্তায় ডেকে একবার একটা পাইলট পেন পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। বাবা জানতে পেরে পরদিনই সেই পেন ফেরত দিয়েছিল সেই উৎকোচ দাতাকে। একটা মিথ্যে টিএ বিল আটকে ছিল তাঁর।
এমন কাণ্ড বাবার জীবনে বহুবার ঘটেছে। সন উনিশশো একাত্তর। বাবা তখন সাগরদীঘির বিডিও অফিসের হেড ক্লার্ক মানে বড়বাবু। পিলপিল করে রাশি রাশি শরনার্থী জমা হচ্ছে বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরে। কোনও হিসেব নেই। অজস্র মানুষ জমা হচ্ছে। বাবা খেয়াল করল একটা অদ্ভুত ঘটনা। হঠাৎই শিবিরের মৃত্যুহার বেড়ে গেছে। তখন নিয়ম ছিল প্রতিটি মৃত্যু বাবদ পঁচাত্তর টাকা সরকারি তহবিল থেকে খরচা হবে। তখনকার হিসেবে অনেক। বিল বানাতে হয় বাবাকে। সই করেন ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার আর ব্লক হাসপাতালের এমওআইসি। যত মানুষের মৃত্যুর বিল করতে হচ্ছে তত মানুষ কিন্তু সত্যিই মারা যাচ্ছে না। নেহাতই তছরুপ। খেয়াল হতেই বাবা নোট জুড়ে দিল সেই বিলে। জেলা সদরের ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হল এই অতিরিক্ত মৃত্যুহার। যা সত্যি হলে মহামারী ঘোষণা করতে হবে অবিলম্বে। এক ওষুধেই কমে গেল বানানো মৃত্যুহার।
ব্যক্তিজীবনে কেমন ছিল আমার এই বাবাটা? দায়িত্বের ব্যাপারে পারম্পর্যহীন কিছুটা। তখনও একান্নবর্তী সংসার আমাদের। যেন সবার জন্য দায় ছিল তার। শুধু আমার মায়ের ব্যাপারটা বাদ দিয়ে। মা যেন ছিল তার কাছে কিছুটা টেকন ফর গ্র্যান্টেড।
বাবা কিন্তু মাকে ভালবাসত খুব। মান্যও করত খুব। মা’টি ছিল কিছুটা বাস্তববাদী, স্পষ্টবাদিনী। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন বাবার জন্য এমনটিই এক কড়া সাধনসঙ্গিনীর দরকার ছিল। আমাদের গরিব সংসারে আসার পর আমার মা যে কটা ব্যবস্থা নিয়েছিল, তার প্রধানতমটি ছিল, পাড়ার দোকান থেকে ধারে জিনিস আনানেওয়া বন্ধ করা।
আসলে সেই দোকানে রাখা ধারের খাতাখানি ছিল আধুনিক ক্রেডিট কার্ডের এক অনতিঅতীত বেহিসেবী সংস্করণ। অনেক সময়েই খরচের তাল রাখা যেত না। হিসেবের গড়মিলের অতিরিক্ত হিসেবে পাওয়া যেত প্রাপ্য উপেক্ষা আর অনেক সময়েই অপমানটুকু। কাজেই ধারে জিনিস কেনা বন্ধ।
এই দোকানে ধার না রাখার ব্যাপারে আমার একটু অভিমান ছিল ছোটবেলায়। তদ্দিনে আমাদের একান্নবর্তী সংসার ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছে নানান জেলায়। মা বাবা আর আমি তখন মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তো তখন ওই অঞ্চলে নিয়ম ছিল, দোকানে হালখাতায় নেমন্তন্ন পাবে তারাই, যাদের নামে ধারের খাতা রয়েছে। প্রথাটির উদ্দেশ্য দ্বিবিধ। এক গতবছরের বকেয়া টাকা উদ্ধার করা আর তার সঙ্গে সাধ্যমত কিছু অগ্রিম যদি পাওয়া যায়।
হালখাতার নেমন্তন্ন পায় সবাই। পাড়া ঝেঁটিয়ে সব ছেলেমেয়েরা তাদের বাড়ির লোকের হাত ধরে হালখাতা করতে যায় খামারু, দত্ত আর সাহাদের দোকানে। তারা পায় গেলাসে শরবত নামের রঙিন জল। কাগজের প্লেটে কয়েকটুকরো হয়তো কুচো নিমকি কিম্বা খুব বড়ো দোকান হলে বোঁদের দানা। আর রঙিন ক্যালেন্ডার। দেবদেবীর ছবি দেওয়া। বাস্তবের কিম্বা পর্দার। আমাদের বাড়িতে… হায় সে সব কিছুই ঢোকে না।
আমি বাবাকে তাতাতাম খুব।– ও বাবা, অল্প করে ধার করি না আমরা। মা কে জানতে না দিলেই তো হল!
ভীতু বাবা মাথা নাড়ত।– নারে বাবু, তোর মা টের পেলে বধ করে দেবে। এক রাতের মধ্যে দেখবি আরও আটটা হাত গজিয়ে গেছে। দুর্গা হয়ে যাবে। সকালে উঠে দেখবি নিজের অজান্তেই বধ হয়ে গেছিস।
মা ধার নেওয়া বলত না। বলত ঋণাসুর। সেই থেকে বাবার ঋণাসুরকে ভয় পাওয়া শুরু।
সদ্য তার বড় নাতি ফ্ল্যাট কিনল … একটা না পরপর দুটো। গাড়িও তাই। সবই লোন নিয়ে। বাবা জেনে প্রবল চিন্তায় এই সেদিন শেষ পর্যন্তও বলত,– আঃ, জয়টা এতগুলো টাকার ঋণে জড়িয়ে গেল এত কম বয়সে! কী যে হবে ছেলেটার।
অন্যমনস্ক আমার বাবা খেয়ালই করেনি, মাঝের এই আধ শতাব্দী বছরগুলোতে সময় সত্যিই বদলে গেছে। বাবা জানত না এখনের এই প্রজন্ম বিশ্বাস করে, ঋণ না নিয়ে টাকা জমানো যাবে যদ্দিনে, তদ্দিনে পৃথিবীর রঙ রূপ রস গন্ধ সব ভেসে যাবে। কাজেই ঋণই নিতে হবে। ঋণগ্রস্ত হতে হবে ঝুঁকি নিয়েই।
– তাই তো কবি বলিয়াছেন, হেসে নাও দুদিন বই তো নয়!
নাতি এইসব বোঝাতো তার অন্যমনস্ক দাদুকে।
বাবা সাঁতার জানত খুব ভালো। এতটাই ভালো যে আরও শিশুবেলায় মাঝে মধ্যে ভয় পেয়ে যেতাম। ওই নয়নসুখেই বিশাল নদী এপার ওপার করত আমার বাবাটা। আমি নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে বাবার সেই জল দাপানো দেখতাম। সে না হয় হল, ভয় পেতাম যখন বাবা ডুব সাঁতার দিত। চারিদিক শুনশান। নদীতীরে একা আমি দাঁড়িয়ে আছি গামছা হাতে নিয়ে। বাবা জলের নীচে উধাও। বাপরে বাপ, দমও ছিল লোকটার। ওপরে নিস্তরঙ্গ জলে একটা বুদ্বুদ অবধিও নেই। জলের ভেতর গেল কোথায় সে? বেদম চিন্তায় পড়ে সেই শিশুটি খুব ত্রস্ত হত। কী ভাবত? বাবা হারিয়ে গেল… এই ভেবে আকুল হত কি? পরে অনেক ভেবে দেখেছি, বাবার জন্য চিন্তা নয়। সে আকুল হত এই ভেবে যে বাবা যদি সত্যিই না ওঠে কী করে বাড়ি ফিরবে সে! দেখতে শিশু হলে কী হবে আসলে সে নিজেরই নিরাপত্তা ভেবে ভারি স্বার্থপর সেই বাল্যকাল থেকেই।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। অন্যমনস্কতার কথা। এত ভালো সাঁতার জানা বাবাটি আমার, সাঁতার দেওয়া শেখায়নি আমাকে ছেলেবেলায়।
আর আক্ষরিক অর্থেই এই অকূল দরিয়ায় আমার হাত ছেড়ে উধাও হয়ে গেছে। আমি আজও সাঁতার জানি না।
বাবার এই এতগুলো কথা এক লহমায় মনে পড়ে গেল ভরা বইমেলায় আসা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজটা দেখে। পাঠিয়েছে পরম স্নেহভরে আমাকে গুড় পাঠানো সেই ছেলে। তার লেখাটা পড়াই সবাইকে।
*
জানেন স্যর, আমার একটা বাবা ছিল। পরিচয়টা ছিল ‘অযোগ্য’, বিশেষ করে মায়ের কাছে। একান্নবর্তী বৃহৎ সংসারের বড় ছেলে হ’লে যা হয়। ‘আদুরে দুলাল’ জীবনটাকে সিরিয়াসভাবে নিতেই শিখলো না কোনদিন। পিসেমশাইয়ের ব্যবসায় বেগার খাটা, চক্ষু লজ্জার খাতিরে অন্য কোন কাজে যেতে না পারা,আর পিসেমশাই যখন ব্যবসা বিক্রি করে নিজে লাখপতি হলো, বাবাকে ভাসালো অকুল পাথারে। মায়ের কাছে বাবা হয়ে গেলো আরো ‘অযোগ্য’।বাবা কোনদিন কারো বিরুদ্ধে প্রতিবাদই করতে শেখে নি। তাই না পিসেমশাই না মা- কাউকেই কিছু বলেনি। আমি ছোট সন্তান, প্রাণীরা যেমন মাটি-সংলগ্ন থাকে, আমিও বাবায়-মোড়া থাকতাম ছোটবেলায়। তেমন বড় হইনি, মায়ের বিরুদ্ধেও যেতে পারতাম না। বাবাকে শুধু অসহায় হয়ে মুখে বিড়ি লাগিয়ে বসে থাকতে দেখতাম। বোঝার বয়স হয়নি বাবাটা ভিতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। এক রাতে উইদাউট নোটিসে সেরিব্রাল অ্যাটাকে ঝরে গেলো বাবা। আমি তখন ১৬। প্রার্থনা করেছিলাম “বাবা, পরজন্মে যোগ্য হয়ে জন্মিও।”
তারপর ঠিকানাহীন পৃথিবীতে আমি একটা যোগ্য ‘বাবা’ খুঁজি। আপনিও তো কারো বাবা। আপনাকে নিয়ে ছেলে-মেয়েদের কত গর্ব বলুন তো।
তাই লোভ জাগে স্যর, আপনাদের সান্নিধ্যে আসতে। আমি এখন ৪৮। তবু মনটা পরিণত হলো না। খুঁজেই যাচ্ছি।
অপরাধ নেবেন না স্যর।
*
কী মায়ামাখা গর্ব যে হচ্ছে আমার এই ছেলের জন্য। হ্যাঁ, আমি রাজি। আমি যোগ্য নই জানি। তবু আমি রাজি!
অশ্রুভরা চোখে এই প্রদীপের আলো হতে রাজি আমি।