দেশজুড়ে কোভিড টিকাকরণ চলছে। সামান্য কিছু হোঁচট ছাড়া কোভিশিল্ড ভ্যাক্সিনের যাত্রা এখনও অব্দি নিরুপদ্রব। আমি নিজেও আজ টিকা নিলাম। আপাতত বেঁচে আছি এবং সুস্থ আছি। টিকা নেওয়ার সময়ের ছবিটা রেখেছি। অতিমারী কেটে গেলে এই ছবিটা সাহস দেবে। আমাদের যুদ্ধের স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে। যদিও চলতি মিডিয়ায় ছোটোখাটো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রঙ চড়িয়ে পরিবেশন করা হয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এমনিতেই টিকা নিয়ে ঢাক গুড়গুড় আর সন্দেহ ছিল। এসব প্রতিবেদন তাতে আরও উস্কানি জুগিয়েছে। অবশ্য বাজারি মিডিয়ার কাছে খবর বিক্রিটাই বড় কথা। সমাজ-সচেতনতার কথা ভাবতে তাঁদের ভারী বয়ে গেছে!
দিন দুই-তিনেক আগেই তাঁরা আশা এবং এ.এন.এম দিদিদের পরিচয় দিতে গিয়ে ‘মাঠে-ঘাটের কর্মী’ বলে উল্লেখ করেছেন। এমনিতে দেখতে গেলে কথাটায় আক্ষরিক অর্থে ভুল কিছু নেই কিন্তু এই শব্দবন্ধে বুনিয়াদি স্তরে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি কদর্য উন্নাসিকতা আছে। অথচ, দেশের সত্তর শতাংশ মানুষের স্বাস্থ্যের একটা বড় দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা। এই অতিমারী হাতে ধরে শিখিয়ে যাচ্ছে জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব আর তার পরেও আশা-এ.এন.এম দিদিরা শুধুই ‘মাঠে-ঘাটের কর্মী’!
গর্ভবতী মায়ের যত্ন, রক্তাল্পতা রোধ, জন্ম-নিয়ন্ত্রণ, শিশুর প্রাথমিক যত্ন, জাতীয় টিকাকরণ, সাধারণ কিছু রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা সহ সাধারণ স্বাস্থ্য-সচেতনতা গড়ে তুলতে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। ডায়েরিয়া, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, টিবি, হাম, অপুষ্টি ইত্যাদি তথাকথিত সাধারণ রোগেই এখনও অধিকাংশ শিশুমৃত্যু হয়। গর্ভাবস্থায় যথেষ্ট দেখভালের অভাব, বাড়িতে প্রসব, রক্তাল্পতা, অপুষ্টি আর অগুনতি কুসংস্কার এখনও অধিকাংশ গর্ভবতী মায়ের অকালমৃত্যুর কারণ। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের সেসব মূল ভিত্তিকে যাঁরা শক্ত হাতে বেঁধে রেখেছেন তাঁরা স্রেফ ‘মাঠে-ঘাটের কর্মী’!
আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাস্থ্যের ধারক ও বাহক বলতে কেবলমাত্র সুসজ্জিত কোট-টাই, চকচকে জুতো আর চোস্ত ইংরেজি ভেসে ওঠে। আমাদের দুর্ভাগ্য, দেশের হর্তাকর্তারা ভাবেন আকাশঝাড়ু সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালে জাতীয় স্বাস্থ্যের উন্নতি। তাই এদেশে রোদ-ঝড়-জল উজিয়ে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মীরা শুধুই ‘মাঠে-ঘাটের কর্মী’!
২০০৫ সালে প্রতি এক লক্ষে গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু ৪৫০ থেকে ২০১৬ তে ১৩০। শিশুমৃত্যু প্রতি ১০০০ নবজাতকে ৫৭ থেকে ২০১৫-১৬ তে ৪১। এর পেছনে আশা-এ.এন.এম দিদিদের অবদান কম নয়। অথচ, এখনও রোগী সুস্থ হ’লে ধরে নেওয়া হয় উমুক ডাক্তার বা ডাক্তারদের হাতে সুস্থ হয়েছেন। পর্দার পেছনে কাজ করা নার্সিং স্টাফ-ল্যাব টেকনিসিয়ান-সুইপার-সিকিউরিটি বা অন্যান্য কর্মীরা আড়ালেই থেকে যান। তাই ‘মাঠে-ঘাটের কর্মী’রা আমাদের ভাবনার চৌহদ্দির মধ্যে আসবেন না বলাই বাহুল্য।
যখন চায়ের কাপ হাতে স্ক্রিনে ট্যাপটেপিয়ে এই লেখা লিখছি তখন কোনও আসন্নপ্রসবা মাকে নিয়ে তাঁরা পৌঁছে যাচ্ছেন নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, কোনও বাড়িতে খোঁজ নিচ্ছেন বাচ্চা দুধ খাচ্ছে কিনা, কোথাও জন্ম-নিয়ন্ত্রণের উপদেশ দিচ্ছেন। হ্যাঁ, আমাদের ‘মাঠে-ঘাটের কর্মী’রা!
নিউজ চ্যানেল পুজো মন্ডপের ভিড় দেখাতো, এখন টিকা নেওয়ার লাইন দেখাচ্ছে। দু’দিন বাদে ভোটের লাইন দেখাবে। তারকা পুত্র-কন্যার বায়না, আই.পি.এলের অকশন, বিরাট কোহলির চুলের ছাঁট… এসব গুরুত্বপূর্ণ খবরও মিস করা চলে না। খবরের দুনিয়া থেকে বহুদূরে ‘মাঠে-ঘাটের কর্মী’রা কাজ করে যান। একটাই কাজ। প্রতিদিন।
শহরের কয়েক কিলোমিটার ব্যাস ছাড়িয়ে গেলে যে মাঠে-ঘাটের দেশ তাকে ছাড়া জনস্বাস্থ্যের উন্নতি অসম্ভব। মাঠে-ঘাটের মারীর দেশ বেগুনি শাড়ি দিদিদের কাছে ঋণী।
(টিকা নিয়ে সংশয় কাটাতে ছবিটা জুড়ে দিলাম)
একদম সত্যি কথাটা তুলে ধরেছেন.আসলে এই সমস্ত সাংবাদিক বা বুদ্ধিজীবীদের অর্ধশিখ্যিতো বলেই ধরতে হবে.
আর আমরাও এইসব বাস্তব দেখতে বা শুনতে হয়তো পছন্দ করি না।
সঠিক বক্তব্য।