তখন ক্লাস থ্রি। লেখাপড়ায় ভয়ানক অন্যমনস্ক। আজ যেগুলো পড়ানো হতো কালই ভুলে যেতাম। পাড়াপড়শী সবাই বলাবলি করতো সুধীর মাস্টারের ছেলেটা আস্ত গবেট। কেউ কেউ আবার আমাকে গবেটানন্দ বলে ডাকা শুরু করেছিল। স্পষ্ট মনে আছে রোজ সন্ধ্যায় ঠাকুরঘরে মা কেঁদে উঠে বলতো ‘ ঠাকুর এমন একটা জড়বুদ্ধির ছেলেকে কেন পাঠালে? পাঠালে যখন ছেলেটাকে মানুষের মতো মানুষ করো’।
ওসব কান্নাফান্না তে আমার মন বিচলিত হতো না। মহানন্দে ঊর্ধ্বপদ দোল খেতাম শিমুলের ডালে… কিংবা ডুব সাঁতারে পুরো পুকুর ক্রশ করে জেগে উঠতাম ওপারে। মাঝরাতে চুপিচুপি উঠে ভিডিও দেখতে চলে যেতাম পাশের গ্রামে। গ্রামগঞ্জে তখন ভিডিও দেখার হিড়িক ছিল। সামনে ভিসিপি চলতো আমরা খড় পেতে বসে, হাঁ করে সব গিলতাম।
রোদঝলমলে এক গ্রীষ্মের দুপুরে মর্নিংস্কুল থেকে ফিরে বইয়ের ব্যাগ রেখে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটছি, বাবা এসে হাজির। কান ধরে জল থেকে বাবা আমাকে তুললেন, তখন আমার বস্ত্রহীন তৈলঙ্গস্বামীর মতো অবস্থা। শুরু হল মার… মারের প্রাবল্য সময়ের সাথে সাথে বাড়তে লাগলো। লোক জমতে লাগল, রব উঠল ‘ আর মেরো না, মরে যাবে ছেলেটা’। সব শেষে, উঠোনে রাখা আস্ত একটা পাথরে বাবা আমাকে আছড়ে ফেললেন। ধাক্কার চোটে চোখের সামনে মহাশূন্য ও নক্ষত্রমণ্ডল দেখতে লাগলাম।
তারপর কী যে হল! যাই পড়ি সব মুখস্ত হয়ে যায়। সাতদিনের ভেতর সব বইয়ের প্রতিটা পাতা আমার আত্মস্থ। ক্লাস ফাইভ থেকে প্রথম হয়ে সিক্সে উঠলাম। সিলেবাসের সব পড়া আমার স্মৃতিতে… ক্লাসের সব বই শেষ হয়ে যেতে আড্ডা গাড়লাম শ্রীনিবাস স্মৃতি পাঠাগারে। কয়েকবছর ভেতর পুরো লাইব্রেরি ফিনিশ, শরদিন্দু অমনিবাস থেকে জেমস হেডলি চেজ।
বাবার একদিনের পিটুনিতে আমার স্মৃতি খুলে গিয়েছিল। যার পুরোটা ফায়দা তুলেছি ডাক্তারি পড়তে এসে। ডাক্তারিতে প্রচুর ইনফরমেশান মনে রাখতে হতো। ছোটোবেলায় বাবার সেই ভয়ানক মারের চিহ্ন এখনও আছে কয়েকটা। পিঠের একটা কাটা দাগ এখনো মেলায় নি। মাঝে মাঝে ওখানে হাত রাখি, মনে মনে বলি আরও কতগুলো দাগ কেন দিলে না বাবা? তাহলে আরো ভালো মানুষ হতে পারতাম। শিক্ষক দিবসে আমার প্রথম শিক্ষক; বাবাকে প্রণাম জানালাম। হাত তুলে বাবা আজ আমাকে আশীর্বাদ করলেন।
স্ট্রোকের থাবা এসে কেড়ে নিয়েছে
বাবার অর্ধেক জীবন।
আশীর্বাদের মুদ্রা তাই বদলেছে বিস্তর
পুরো হাত আর ওঠে না এখন
বয়স বেড়েছে আমারও
সঞ্চয়ে জমেছে অজ্ঞানতা কিছু
আধখানা আশীর্বাদ নিয়ে
আমাকে খুশি থাকতে হয়―
কতকিছু না পাওয়া অভিমানী বালকের মতো।
৫.৯.২০২২