বেশ কিছুদিন আগের কথা। এক ঝাঁক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বলে রাখি এই ফাঁকে।
বাজারে গিয়ে দেখি মাছওয়ালা পাশের লোককে কী একটা হিসেব দিচ্ছে। কজন লোক, কে কী খাবে, ক প্লেট ভাত, কত কেজি মাংস… এই সব কথা। আমি সামনে দাঁড়িয়ে আছি, খেয়ালই নেই। পাশ থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট, যে আঁশ ছাড়িয়ে দেয়, সে বলছে, “দাদা, দাদা, সামনে দেখুন”, কোনও রি-অ্যাকশন নেই। প্রায় জনা দুশ’ লোকের খাওয়া দাওয়ার হিসেব পাশের মাছওয়ালাকে দিল। তার পরে আমার দিকে ফিরল। বলল, “ডাক্তারবাবু, মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিলাম। সেই বলছিলাম আর কী!”
আমি বললাম, “বাঃ, ভালোই করেছ।”
বলল, “জানেন তো, মেয়েটা পড়াশোনা শেষ করে বসে ছিল। বাইশ বছর বয়েস থেকে লোকে বলছে বিয়ে দাও। আমি বলেছি, না, আগে পড়াশোনা শেষ হোক। মেয়ে চাইছে।”
ভালো লাগল। উলটো গল্পটা অনেক শুনেছি। বাবার শরীর খারাপ, মায়ের হার্ট অ্যাটাক হল – এমনকি, ছেলের মা শয্যাশায়ী হল বলে আর কেউ তাঁর অষ্টাদশীর লেখা পড়া বন্ধ করিয়ে বাইশ বছরের স্বামীর একান্নবর্তী পরিবারের হেঁসেল ঠেলতে লক্ষ্মী পাঠিয়েছেন, তাও জানি। বললাম, “কী পড়েছে।”
সুজন হেসে বলল, “গ্র্যাজুয়েশন করেছে। আমি অত জানি না, কী-পড়েছে না-পড়েছে। তবে জামাই ব্যাঙ্কের অফিসার। খুব ভালো পেয়েছি শেষে। চার বছর অপেক্ষা করা সার্থক হয়েছে। মেয়ের বয়েস এখন ছাব্বিশ, ছেলে আঠাশ।”
বাঃ।
সুজন বলে চলল, “লোকে বলছে, তুমি মাছ বিক্কিরি কর, কিন্তু এতো বুদ্ধি এল কোত্থেকে?”
মাছওয়ালাদের সম্বন্ধে লোকের হীন ধারণা জেনে আমি আরও চমৎকৃত।
“জানেন তো, একমাত্র মেয়ে। আমি বলেছি, পণ দিতে পারব না। তবে মেয়েকে সাজিয়ে দেব। পনেরো লাখ খরচ হল বিয়েতে সব মিলিয়ে। আজকাল এর কমে হয় না।”
আমার টাক ঘেমে গেল। এত?
সুজন বলছে, “বড্ডো নিশ্চিন্ত। জানেন তো, আমার নিজেরও মাঝে বছর তিনেক খুব শরীর খারাপ ছিল। প্রায় আড়াই মাস তো হাসপাতালেই ছিলাম।” জানি। তখন ওর ভাই একাই দোকান চালাতো। জিজ্ঞেস করলেই মাথা নেড়ে বলত, “এখনও হাসপাতালে।”
“তখন তো পাঁচ-ছ লাখ খরচ হয়ে গেছে,” বলল সুজন। তাহলে তো ভালোই। অসুখের চিকিৎসা এখনও কম খরচেই হচ্ছে।
মাছ ওজন করতে করতে বলল, “খরচা-পাতির মা-বাপ নেই আর, ডাক্তারবাবু, জানেন, মা-বাপ নেই। এই দেখুন না, আপনার বাবা-ই যখন আসতেন, মনে আছে, তখন আমার এই মাছের দোকান থেকে দিনে পাঁচশো টাকা মতন প্রফিট হত (তখনই আমার বাবা নেই প্রায় সাত বছর। সুতরাং সুজন বছর দশেক-বারো আগের কথা বলছে)। খরচ ছিল দিনে শ’দুয়েক টাকার বেশি না। বাকি ব্যাঙ্কে যেত। জানেন, আজও আমি পাঁচশো টাকাই রোজগার করি। কিন্তু আমার দৈনিক খরচ হাজার টাকার কম না।”
অ্যাঁঃ?
“দেখুন না, এই যে মাছের ব্যবসা থেকে আমার হাজার পনেরো টাকা লাভ, এই টাকাই আমার মাসের ইলেকট্রিক বিল।”
আমার চোখ ছানাবড়া।
“তিনটে বাড়ি, ডাক্তারবাবু,” এবার সুজনের মুখ একটু লজ্জা পাওয়া ধরণের। “আমাদের খাওয়া দাওয়া একই সঙ্গে। ছোটো ভাই আমার সঙ্গেই — কিন্তু মেজো ভাই চাকরি করে — সংসারে কিছু দেয়। তাতে হয় না। ভাগ্যে ঠাকুর্দা কিছু বাড়ি করে গিয়েছিলেন, তাতে ভাড়া পাই, তাই চলে যায়।”
ও। নইলে ইলেক্ট্রিক বিল দিতেই যে মাছওয়ালা ফতুর, সে খায়ই বা কী, চিকিৎসার পাঁচ লাখ আর মেয়ের বিয়ের পনেরো লাখই বা পায় কোথা থেকে!
মাছ কাটা, ব্যাগে ভরা আর টাকা দেওয়ার মধ্যে সাত রকমের খাবার আইটেম, সানাইওয়ালার বায়না, প্যান্ডেল বাঁধা-ছাদার গল্প শেষ হল। টাকা দিয়ে যাচ্ছি, সুজন আবার একটু লজ্জা-লজ্জা হেসে বলল, “আমার মেয়ে খুব সুন্দর দেখতে। আপনার মতো গায়ের রং।”
এটা কি কমপ্লিমেন্ট? না কি নিছক তথ্য-দেওয়া? বুঝলাম না। কিন্তু কিছু একটা বলতে হয়, বললাম, “তা, মেয়ের বাবার রং তো আরও খোলতাই — তার বেলা?”
এবার সুজন আরও লজ্জা পেল। বলল, “জামাই আরও ফর্সা। আমার মতো।”
_____________________________
সেদিন সন্ধেবেলা বাজারের পাশ দিয়ে ফিরতে ফিরতে দেখলাম বাজার বন্ধ। কেউ নেই। মনে হলো কোরোনা-ভাইরাসের কারণে নাকি? ফোন করলাম আমার তরকারিওয়ালাকে। শুনলাম সুজন আর নেই। ওরই স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতে সেদিন বাজার বন্ধ রাখা ছিল।