~নয়~
এখনও কি গ্রামের জমিজমার খবর নেওয়ার সময় হয়েছে? ভেবে ঠিক করতে পারছে না পরাগব্রত, ওরফে নাড়ুগোপাল। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে খোঁজ শুরু করামাত্র সদরের জমি-দালালরা ওয়াকিবহাল হয়ে যাবে, আর তা হলে আমোদপুরের দালালরাও জেনে যাবে, যে ওদের নবাগত প্রতিবেশী নাড়ুগোপাল চক্রবর্তী আকন্দপুরে জমির খোঁজ নিচ্ছে — আর যাদের জমির খোঁজ নিচ্ছে, তারাও সবাই চক্কোত্তি। না-হয় নাড়ুগোপালের ভালো করে মনে নেই ছেলেবেলার গ্রাম্যজীবনের কথা, কিন্তু আকন্দপুরে নিশ্চয়ই এই তিরিশ বছর পরেও কারও ওর মা-বাবার নাম মনে আছে? মনে আছে ওর নামও? গ্রামে আসার আগে কথাগুলো ভাবেনি নাড়ু। এসে দেখছে গ্রামবাসীদের মধ্যে ঐতিহাসিক কম নেই। কে কার বাবা, কার মা, তাদের কোন আত্মীয় স্বজন কোথায় থাকে, কী করে — এসব কথা আড্ডায় গল্পে বেশ জোরে জোরেই আলোচনা হয়। গলা নামিয়ে আলোচনা হয় অবৈধ সম্পর্কের কথা। সে হিসেবও গাঁয়ের লোকে খুব ভালোই রাখে। কোন বোঁচা-নাক ব্যক্তির স্ত্রীর কাছে কোন তীক্ষ্ণনাসা পরপুরুষ আনাগোনা করে, এবং বিবাহিত দম্পতির দুটি বোঁচা-নাক সন্তানের পরে এক লম্বা নাকওয়ালা ছেলে জন্মায়, আলতাফের মতো লোক অনায়াসে বলে দিতে পারে। আর আলতাফ কেবল গ্রামবাসী নয়, জমির দালালও বটে। কোন জমি কত টাকার বিনিময়ে কবে কার থেকে কে কিনেছিল, আলতাফ তিন চার পুরুষের ইতিহাস গড়গড়িয়ে বলতে পারে। গ্রামের এত কাছে ঘাঁটি গেড়ে জমির দখল নেবার চেষ্টা করা ঠিক হবে না। অনেক বার ভেবেছে, আলতাফকে জিজ্ঞেস করবে, আকন্দপুরের চক্কোত্তি পরিবারের কোনও মা-বাবা-ছেলে বছর পঁচিশেক আগে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল কি না। কিন্তু সেটা করা মানেই নিজের পরিচয় দেওয়া। তাই চুপ করে থেকেছে।
লকডাউনের মধ্যেই স্কুল-কলেজে অনলাইন ক্লাস চালু হওয়ার পরে নাড়ুগোপালের ব্যবসার কাজ অল্প বেড়েছিল। গ্রাম হলেও বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বেসরকারি স্কুল-কলেজে পড়ে। তাদের অনেক ক্লাস এখনও অনলাইন হয়। টিচাররা নোট, হোমওয়ার্ক, সবই মোবাইল ফোনে পাঠিয়ে দেন। এদিকে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য নেই। নাড়ুগোপাল তাদের জন্য একটা সার্ভিস চালু করেছে। একটা নতুন ফোনের কানেকশন নিয়ে গ্রামের লোকের কাছে নম্বর দিয়েছে। যাদের স্মার্টফোন নেই, তারা স্কুলে কলেজে নাড়ুগোপালের নম্বর দিয়ে রেখেছে। তাদের টিচাররা দিনের পড়াশোনা, বাড়ির কাজ — সব সেই নম্বরে পাঠায়। নাড়ুগোপাল সে-সব ওর কম্পিউটারে ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে দেয় ছাত্র ছাত্রীদের। ওরা বাড়ির কাজ করে আবার নিয়ে আসে, নাড়ুগোপাল-ই ফোনের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে টিচারের নম্বরে পাঠায়। মন্দ রোজগার হচ্ছে না। অবশ্য যখন রোজের স্কুল আবার শুরু হবে, তখন এত হবে না জানে নাড়ু। তবে সে নিয়ে ওর মাথাব্যথা নেই, বলা-ই বাহুল্য। ওর নরকবাসী পালক পিতা ভুবনব্রতর কল্যাণে ওর অভাব নেই। এই গ্রামের মতো কোথাও থাকতে হলে সারা জীবনে যা খরচ হবে তাতে ওর ব্যাঙ্ক ব্যালেনসে আঁচড়টাও পড়বে না। রোজ ওর দোকানে কালো-কালো, রোগা-ভোগা, গরিব-গরিব ছেলেমেয়ে আর তাদের ধুতি-ফতুয়া পরা, বা খালি-গা বাবাদের দেখে নাড়ুগোপাল ভাবে, সেই কবে ছোটোবেলায়, ওর মা বাবা যদি ওকে নিয়ে শহরযাত্রা না করত, আর পথে ট্রেন থেকে বাবা হারিয়ে না যেত, তাহলে একদিন, অন্য এক জীবনে হয়ত ও-ও এরকম খালি গায়ে হাফ-প্যান্ট পরে গাঁয়ের স্কুলে পড়তে যেত। শহরের স্টেশনে সদ্য বাবা-হারা, স্বামী-হারা নাড়ুগোপাল আর ওর মায়ের সঙ্গে যদি ভুবনব্রতবাবুর সপরিবারে দেখা না-হত, তাহলেও ওরা কোথায় এতদিনে ভেসে গেছে, কে জানে। আজকের বাচ্চাদের দেখে নাড়ুর পঁচিশ বছর আগের নিজেকে নিয়ে কোনও আবেগ উত্থিত হয় না, কিন্তু তাদের বাবারা, যারা আজ ওর কাছাকাছি বয়সী, তারা নাড়ুর মনে একটা আশ্চর্য সতৃষ্ণতার উদ্রেক করে। আকন্দপুরেই যদি থাকত, আকন্দপুরেই বড়ো হত, তাহলে আজ ও-ও এদেরই মতো চাষ-আবাদ করত, দিন-শেষে বাড়ি আসত, হুঁকো হাতে দাওয়ায় বসে বিশ্রাম করত… অবশ্য এখন গ্রামে আর কাউকে বিশেষ হুঁকো খেতে দেখা যায় না। লোকে প্রধানত সিগারেট খায়, কেউ কেউ বিড়ি। তবে, নাড়ুগোপাল নিশ্চয়ই খেত। হুঁকোর তামাক কি পাওয়া যায় আজকাল? কোথায়? জগদ্ধাত্রীপুরের বড়ো বাজারে? একবার গিয়ে খোঁজ নিলে হয়!
কিন্তু হুঁকো কেনার সুযোগ হল না পরাগব্রতর।
সেদিন শনিবার ছিল, স্কুলের ছাত্র ছাত্রী কম। কয়েকজন কলেজ-ছাত্রী সকালেই এসে ঘুরে গেছে। অভ্যাসমতো নাড়ুগোপাল দরজায় পিঁড়ি পেতে বসে ছিল। নজর ছিল রোজকার মতোই রাস্তার দিকে। দরজায় এসে একটা লজ্ঝড়ে মোটরবাইক দাঁড়াল। বাইকে একটা বছর আট-নয়ের বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে তার… বাবা, না কাকা? এতদিন গ্রামে কাটিয়েও গ্রামের লোকের বয়স বোঝে না নাড়ুগোপাল। মেয়েকে দেখে আন্দাজ করল, এ-ই যদি মেয়ের বাবা হয়, তবে ওরই সমবয়সী হবে, বা বড়োজোর একটু বড়ো।
মেয়েটার কাগজগুলো নিতে নিতে অভ্যাসমতো নাড়ুগোপাল কথা বলতে শুরু করল। গ্রামের লোককে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলে তারা বিরক্ত হয় না, বরং খুশি হয়েই গল্প করে। সেই সঙ্গে অবশ্য নানা কথা জানতেও চায়… এতদিনে নাড়ুগোপালেরও সে গল্প বলতে আর অসুবিধে হয় না। বহুদিন ধরে বলতে বলতে টুকরো টুকরো করে একটা সম্পূর্ণ অতীত তৈরি করে ফেলেছে নাড়ু।
“কী নাম তোমার?”
মেয়েটা প্রশ্নের উত্তরে এক ঝলক সঙ্গের লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, “কুমারী লক্ষ্মীরানি চক্রবর্তী।”
নাড়ুগোপাল প্রথম কাগজটা জেরক্স মেশিনে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “কোন ইশকুলে পড়ো তুমি? আগে তো দেখিনি …”
মেয়েটা বলল, “আমি তো এখানে থাকি না। আমি আকন্দপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ি।”
“ও বাবা! তুমি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ো! তুমি তো এইটুকুনি!”
এই ঠাট্টাটা নাড়ুগোপাল প্রায়ই করে এখানে বাচ্চাদের সঙ্গে। বাচ্চারাও খুব উপভোগ করে জেরক্সকাকুর এরকম বোকামো।
লক্ষ্মীমণিও হি-হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু তারপর কী বলল, সেটা খেয়াল করল না নাড়ুগোপাল। ওর হঠাৎ মনে হচ্ছে, এই মেয়েটার পদবি চক্রবর্তী। বাড়ি সম্ভবত আকন্দপুরেই। নাড়ুগোপালের আত্মীয়? ওর বাবা দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। গ্রাম্য লোকটা কি বাইরে সাইনবোর্ডটা খেয়াল করে দেখেছে? দেখেছে, যে দোকানের নামের সঙ্গে নাড়ুগোপালের নামও লেখা আছে? নাম জিজ্ঞেস করবে? যদি মিল থাকে? হরিগোপাল, বা চূনিগোপাল যদি হয়? যদি ওর আত্মীয় বা যদি জ্ঞাতি হয়? নামটা জিজ্ঞেস করবে? না, থাক। যদি লোকটা খেয়াল না করে থাকে, কিন্তু যদি বললে পরে খেয়াল হয়? — আপনি… তুমি… নাড়ুগোপাল … মানে আমাদের ন্যাড়া? আমি তোমার …তুতো দাদা…
নাম জিজ্ঞেস করা বিপজ্জনক।
“আপনারা আকন্দপুরে থাকেন?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“আমি আগে ভেবেছিলাম আকন্দপুরেই দোকান করব কি না, তবে এটা তো বড়ো গঞ্জ। দোকান এখানে চলবে ভালো…”
লোকটা বলল, “আমোদপুরই আগে ছোটো গাঁ ছিল। আকন্দপুর ছিল বর্ধিষ্ণু। ওখানেই থাকত সব বড়ো ব্যবসায়ী, জমিদার… বামুনপাড়া, কায়েতপাড়া ওখানেই। আমোদপুর ছোটো জাতের বাসা ছিল। আর মুসলমান। পরে এখানেই ব্যবসাপাতি বাড়ে। মুসলমানদের ব্যবসাবুদ্ধি বেশি। আমরা কেবল চাষবাসই জানতাম… এসব জমি…” চারপাশে হাত দিয়ে বলল লোকটা, “সব আমাদেরই ছিল। কিন্তু সরকার বর্গা করল, সব চলে গেল আমাদের। এখন না আছে জমিজমা, না আছে ব্যবসাপাতি…”
এ সব নাড়ুগোপাল জানে। এ-ও জানে, যে আকন্দপুরে নাড়ুগোপাল চক্রবর্তীর-ও জমি আছে। ছিল। জমি জিরেতের যেখানে অভাব, সেখানে কি ও জমি পড়ে আছে? যে সেখানে চাষ করছে, সে কি এক কথায় নাড়ুগোপালের দাবি মেনে নেবে?
~দশ~
লক্ষ্মণ আগে বাড়ি যেত না বেশি। সিংজীর বাড়িতেই পড়ে থাকত দিনরাত। হয়ত দু-তিন সপ্তাহে একবার বা, মাস পেরোলে মায়ের কাছে যেত। ওর পাতানো মায়ের বাড়ি কোথায় কাউকে ও বলেনি, কেউ জানতেও চায়নি। সিংজীর বাড়িতেই ওর থাকা-খাওয়া, আর কখনও সখনও, কালেভদ্রে সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে নিয়ে মোচ্ছব। বিশেষত সিংজী লক্ষ্মণকে খুশি হয়ে বকশিস দিলে। সিংজীর জন্য লক্ষ্মণ যতরকম কাজ করে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকশিস যে ধরনের কাজে পাওয়া যায়, ওর দলের সবাই জানে তেমন একটা কাজ কিছুদিন আগেই লক্ষ্মণ নিশ্চয়ই করেছে। নইলে মুখার্জিবাড়িতে পাহারার কাজটা ওদের আর করতে হয় না কেন? অন্যরা এ কথা নিয়ে ভাবে? নাথু জানে না। কিন্তু নাথু ভাবে।
আজ অবধি এরকম কাজ করে যখনই লক্ষ্মণ টাকাকড়ি পেয়েছে, প্রতিবারই ওদের খাইয়েছে। এবারে কী হল? নাথুর উদ্যোগে দু-চারবার নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করেছে ওরা। লক্ষ্মণকে জিজ্ঞেস করার সাহস কারওরই নেই।
ওদিকে বস্তির গলির বাড়ির দোতলায় বন্দী মিনি ক্রমশ নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ঘর, সিঁড়ি, আর নিচের ঘরের সামনের ছোট্ট উঠোনের শেষে ঘুপচি স্নানঘর। এ-ই ওর চলাফেরার পরিধি। লক্ষ্মণ ওকে বলে রেখেছে, এইটুকুর মধ্যে সীমিত থাকলে ওর বিপদ নেই, কিন্তু এর বাইরে বেরোনো সমীচীন নয়। লক্ষ্মণের বন্ধুবান্ধব বিশেষ নেই, কিন্তু যারা আছে তারা হঠাৎ এসে পড়ে মিনিকে দেখে ফেললে সমূহ বিপদ। সিংজীর কাছে খবর পৌঁছলে লক্ষ্মণ বা মিনি, দু-জনের কারওরই আর রক্ষা থাকবে না।
ফলে মিনিকে ভোরের আগে বা গভীর রাতের অন্ধকারেই ঘরের বাইরের সব কাজ শেষ করতে হয়। এবং তার জন্যেও অপেক্ষা করতে হয় কতক্ষণে নিচ থেকে লক্ষ্মণের মা বুড়ি তুলসী এসে দরজার হুড়কো খুলে দেবে। লক্ষ্মণ থাকলে সমস্যা নেই, দরজা বন্ধ থাকে ভেতর থেকেই, কিন্তু লক্ষ্মণ বেরোলে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে যায়।
সারাদিন করার কিছু থাকে না মিনির। লক্ষ্মণের ঘরে টিভি নেই, বই বা খবরের কাগজের বালাই নেই, এক টুকরো লেখার কাগজ বা কলম নেই। মিনির অবশ্য বই বা কাগজ পড়ার অভ্যেস নেই। লেখারও নেই কিছু। ও মানুষের সান্নিধ্য ভালোবাসে। যে ক-দিন মুখার্জিবাড়িতে একা কাটাতে হয়েছে, সে ক-দিন ওর সঙ্গী ছিল মোবাইল।
কপর্দকহীন অবস্থায় গৃহত্যাগ করেছিল মিনি। বেশ কিছু টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ছিল। ওর নিজের রোজগার। ছোটোবেলা থেকে যত মডেলিং, ছোটোখাটো রোলে যত শিশু-অভিনেতার অ্যাপিয়ারেন্স মানি — সব বাবা-মা জমা করে রাখত। সমস্যা ছিল, অ্যাকাউন্টটা ছিল মা-র নামে, ও মাইনর ছিল বলে। যতদিনে ওর আঠেরো বছর বয়েস হয়েছে ততদিনে মা-বাবার সঙ্গে বিবাদ এমনই চরমে উঠেছে, যে ওই অ্যাকাউন্টে মিনির নাম যোগ করা যায়নি। তবে মিনি আঠেরো হতেই ব্যাঙ্কে গিয়ে নিজের অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। সিংজীর আশ্রয়ে আসার আগের কয়েক মাসের সমস্ত রোজগারটা জমা ছিল সেখানে। ব্যাস। সিংজীর পাঁচতারা হোটেলের ব্যক্তিগত স্যুইট, আর তারপর দীপব্রত মুখার্জির বাড়িতে ওর কোনও রোজগারই হয়নি। ওই ক-বছর মিনির খরচার সব ভার সিংজীর আর দীপব্রত মুখার্জির হওয়া সত্ত্বেও মাঝে মাঝে মিনি নিজস্ব খরচা কিছু নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে করত। ব্যক্তিগত কিছু মেয়েলি খরচার জন্য সিংজী ওর হাতে টাকা দিতেন, দীপব্রত ওর জি.পে-তে টাকা ভরে দিত। লক্ষ্মণের কাছে ও চায়ওনি, আর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে লক্ষ্মণ কিছু দেয়-ও না। প্রথম মাসে বিগ বাস্কেট থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন অর্ডার করেছিল। তারপর দোতলার জানলা থেকে দেখেছিল তুলসীবুড়ি একটা হতভম্ব ডেলিভারি বয়কে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। গনগন করতে করতে উঠে এসেছিল মিনির ঘরে। রণং দেহি মূর্তি। বারণ করা সত্ত্বেও কেন মিনি বাইরের লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে? জানে না, লক্ষ্মণ জানতে পারলে কী কাণ্ড করবে? মিনি কাঁচুমাচু মুখে স্যানিটারি ন্যাপকিনের কথাটা বলাতে তুলসী আর কিছু বলেনি, চুপচাপ নিচে চলে গেছিল। কিছুক্ষণ পরে আবার ওপরে উঠে এসেছিল হাতে একমুঠো ন্যাকড়া নিয়ে। বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিল, “ও রহা। ইসিসে কাম চালানা।” ঘর থেকে বেরোবার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “ধো-কে, সুখাকে ফির উসিকো ইস্তেমাল করনা।”
হতভম্ব মিনির মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোয়নি। ন্যাকড়া! বাড়িতে ওর মা কাজের লোককেও কোনও দিন ন্যাকড়া ব্যবহার করতে দেননি। বকাবকি করেছেন, “ভয়ানক অসুখ হবে। খবরদার কক্ষনও এসব করবে না… আমার কাছে চাইবে…” এই সব।
তবে এসব কথা মিনি প্রাণ গেলেও লক্ষ্মণকে তো বলতে পারবে না। পারবে না বোঝাতে তুলসীকেও। ফলে সেদিন থেকে মনে একটা আবছা ভাবনা ক্রমশ দানা বাঁধতে আরম্ভ করল। এখান থেকে বেরোতে হবে।
কেন এতদিনে কথাটা মনে হল মিনির? নিজেই অবাক হয়ে ভাবে। ক্রমে বুঝতে পারে, যে স্বাধীনতা নিয়ে বাড়িতে যতই বড়ো বড়ো কথা বলে থাকুক, আসলে ও কোনওদিন কারও ছত্রছায়া ছাড়া থাকেনি। প্রথমে বাবা, তারপরে সিংজী, তারপরে দীপব্রত, এবং সবশেষে দীপব্রতর বাড়িতে সিংজীর তত্ত্বাবধানে — সবসময়ই কোনও না কোনও পুরুষ ওর দায়িত্ব নিয়েছে। আজ নিচ্ছে লক্ষ্মণ। সুখ-শান্তি আর ভবিষ্যতের আশায় প্রথম দিকে অন্যের হাতে নিজেকে সঁপেছিল মিনি। লক্ষ্মণের কাছে এসে এতদিন একটা হতাশা ছিল মনে। ভাবছিল এই ফাঁদ থেকে ওর মুক্তি নেই। কিন্তু তুলসীর কাছ থেকে সেদিন হঠাৎ একগাদা ন্যাকড়া পেয়ে হঠাৎ করে অনুভব করল যে এতদিন ও কী ভুল করেছে। এখানে জীবন কাটানো যাবে না। এটা তো ভাবার বিষয় নয়, এটা স্বাভাবিক চিন্তা হওয়া উচিত ছিল! এতদিন লাগল কেন ভাবতে! মিনি কি গাধা?
আগে কী হত, জানে না মিনি, কিন্তু এসে থেকে দেখেছে সদর দরজাটা সবসময় ভেতর থেকে তালা দেওয়া। বলা বাহুল্য, চাবি থাকে তুলসীর কাছে। তুলসী বেরিয়ে গেলে বাইরে থেকে তালা দিয়ে যায়। অবশ্য তা না হলেও ফারাক পড়ত না। মিনির ঘরের দরজা সারাক্ষণই বাইরে থেকে হুড়কো আঁটা। একমাত্র যদি না লক্ষ্মণ ঘরে থাকে। তখনও ভোরবেলা সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাথরুমেই যেতে পারে মিনি, বাইরের দরজা খোলার ক্ষমতা ওর নেই। তার চাবি তুলসির কোমরে গোঁজা। যা-ই হোক, পালানোর প্ল্যান পরে। আগে দরকার গোছানো। সবার আগে টাকাকড়ি। ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের টাকা দিয়ে লক্ষ্মণের এই সরলস্য সরল জীবনও কয়েক মাসের বেশি চলবে না। আর বাড়ি যদি ভাড়া করতে হয়… যদি কেন, করতে তো হবেই, তাহলে তো কথা-ই নেই।
টাকা জোগাড়ের রাস্তা ভেবে পায় না। রাগ হয় নিজের ওপর। বুদ্ধিহীনের মতো স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করতে গিয়ে নিজেকে দেহপসারিণী করে ফেলেছে। রাগ হয় তাদের ওপর — সিংজী, সিংজীর বন্ধুবান্ধব, ব্যবসার সাথী, দীপব্রত — যারা ওর শরীরটা নিয়ে ছিঁড়ে খেয়েছে, কিন্তু বেশ্যাবাড়িতে গেলে যে খরচটা করতে হয়, তার তিলার্ধও করেনি। সবচেয়ে বেশি রাগ হয় লক্ষ্মণের ওপর। পারত মিনির স্ট্যান্ডার্ডের একজন রূপোপজীবিনীকে ওর দারোয়ানের রোজগারে কিনতে?
রাগটা ফিরে আসে নিজের ওপরেই। না, মিনি রূপোপজীবিনীও নয়। নিজের রূপ, যৌবন, দেহ ও বিলিয়েছে, বিক্রি করেনি। দোষ ওরই।
ব্যাঙ্কের সামান্য সঞ্চয়টুকু বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এই ক-দিনে অল্পই খরচ হয়েছে — মোবাইল ফোন রিচার্জ করতে। মুখার্জিদের বাড়িতে ওর শাড়ি-জামা নিয়ে যে কাণ্ডটা লক্ষ্মণ করেছিল, তারপর মোবাইলটা ওর সামনে আর বের-ই করেনি মিনি। লক্ষ্মণ আসলে সুইচ অফ করে লুকিয়ে রাখে। আর যখন থাকে না, তখন ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি থেকে যত রাজ্যের এক্সার্সাইজ ভিডিও ডাউনলোড করে। এর পরে আর বেশি রিচার্জও করবে না মিনি। যতক্ষণ না যথেষ্ট টাকা পায়। শুধু নম্বরটাকে জিইয়ে রাখতে যতটা দরকার ততটাই খরচ করবে।
আগে মিনি অতিমাত্রায় স্বাস্থ্য সচেতন ছিল। খাদ্যাখাদ্য-বিচার, নিয়মিত ব্যায়াম — দুই-ই ছিল অপরিহার্য। তাতে অবশ্য মায়ের অবদানও কম ছিল না। সিংজীর হোটেলের সবচেয়ে ওপরের ফ্লোরের স্যুইটে থাকার সময় প্রথম টসকালো ডায়েট। তবে হোটেলের জিমে নিয়মিত যেত মিনি। রোজ। সম্পূর্ণ নিয়মভঙ্গ শুরু হল দীপব্রত মুখার্জির বাড়ি গিয়ে। খাওয়া দাওয়ার ওপর কনট্রোল তো রইলই না, ব্যায়াম করাও মাথায় উঠল। দীপব্রত, পরাগব্রত দুই ভাই ব্যায়াম বা সুষম আহার কাকে বলে বুঝতই না। মিনির দাবিতে দীপব্রত জিমে ভর্তি করে দিয়েছিল বটে, কিন্তু নিয়ে যেত না নিয়মিত। প্রথম দিকে যখন মিনির প্রেমে হাবুডুবু খেত, তখন তবু সপ্তাহে তিন চার দিন যেতে পারত অনেক সাধ্যসাধনার পর, কিন্তু পরের দিকে বলত, “রাস্তা তো চেনো, চলে যাও…”
যেতে হয়ত পারত মিনি, কিন্তু সিংজীর বারণ ছিল, একা যেন রাস্তায় না বেরোয়। সে আদেশ অমান্য করতে সাহস হয়নি, তাই জিম-ও যাওয়া হয়নি।
তারপর তো লকডাউন আর পরপর দুই ভাইয়ের উধাও হয়ে যাওয়ার পরে রেগেমেগে সিংজী ওর চলাফেরার ওপর রাশ টেনে দিয়েছিলেন। ঘরে বসে বসে মুটিয়ে গেছিল মিনি।
একমাসেরও কম সময়ে তুলসীবুড়ির রান্না ভাত, ডাল আর একটা তরকারি খেয়ে মিনি উপলব্ধি করল শরীরটা যেন আগের চেয়ে বেশি ঝরঝরে। তাই, সারা দিন একা ঘরে মিনি আবার ব্যায়াম শুরু করল। প্রথমে সহজ ব্যায়াম, অনভ্যস্ত শরীরটা আবার সচল করতে। তারপর আর একটু কঠিন। এমন করে ক্রমে ক্রমে দিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা ঘরে ব্যায়াম করে, নয় বিশ্রাম করে কাটায়। ওজন নেওয়ার উপায় নেই, ঘরে আয়নাও একটাই, এবং সেটা দিয়ে লক্ষ্মণের দাড়ি কামানো, চুল আঁচড়ানোর বেশি কিছু করা যায় না, তবু মিনি বোঝে, শরীরটা আস্তে আস্তে আবার মজবুত হচ্ছে। সেই সঙ্গে চেষ্টা আরম্ভ করল লক্ষ্মণের বিশ্বাস অর্জন করতে — যাতে দরজাটা বন্ধ করে না চলে যায়। এখনও পর্যন্ত কাজ হয়নি। তবে লক্ষ্মণ কি আজকাল ওর সঙ্গে কথা বলছে বেশি? অন্তত যখনই আসে পরাগব্রত সম্বন্ধে কিছু বলে যায়। কী হয়েছে, তদন্তে কতদূর কী জানা গেল… এসব কি লক্ষ্মণ ওকে গল্প করে বলে, না কি ও-ও চেষ্টা করছে মিনি কতদূর কী জানে তার হদিস পাবার? বোঝে না মিনি।
~এগারো~
সিংজীর দুশ্চিন্তা বেড়ে এখন রাগে পরিণত হয়েছে। কিছু ঘটলেই ভিসুভিয়াসের মতো ফেটে পড়েন যেন সব দোষ সামনে বসা বা দাঁড়ানো লোকটার। যেন তারাই সিংজীর সঙ্গে দীপব্রতর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। যেন তারাই দীপব্রতকে হীরে পাচারের ব্যবসায়ে ঢুকিয়েছিল! বস্তুত ব্যাপারটা ছিল ঠিক তার উলটো। সিংজীর পরিচয় হয়েছিল দীপব্রতর সঙ্গে। কোন ক্লাবে, না কোথায়। সিংজীই নিয়ে এসেছিলেন ওকে। বলেছিলেন ওকেও হিস্সেদার করবেন। সকলেই আপত্তি করেছিল। চেনা নেই, শোনা নেই… না জান, না পহেচান! সবচেয়ে বেশি আপত্তি করেছিলেন রবিবাবু। বলেছিলেন, “উসকা বাপ-কা সাথ মেরা অদ্রক ঔর ওই-কী-বলে কাঁচকলাকা সম্পর্ক থা।” কে যেন বলেছিল, “যথেষ্ট চেনেন? পুলিশের চর নয়ত?” তখন সিংজী বলেছিলেন, “পুলিশ নেহি, খানদান ভি ঠিক হ্যায়। সুনা নেহি, রবিবাবু কেয়া বোলা? ইসকে বাপকে সাথ দুষমনি থা। মতলব কেয়া? মতলব এক হি বেরাদরি কা হ্যায় হম…”
সকলে কেবল মুখচাওয়াচাওয়ি করেছিল। কারও দুঃসাহস নেই সিংজীর মুখের ওপর আপত্তি করে, কিন্তু রবিবাবু ঘাবড়ানোর পাত্র নন। ভুবনব্রতর ছেলের সঙ্গে উনি কাজ করতে পারবেন না সাফ বলে দিয়েছিলেন।
সিংজী বরাভয়ের ভঙ্গিতে বলেছিলেন, “ফিকর মত্ করো।” বলেছিলেন দুজনের মুখোমুখি দেখা না হয় যাতে সেটা উনি দেখবেন।
আজ সেই রবিবাবুকেই সারাক্ষণ ঝাঁঝিয়ে ওঠেন। এখন তাঁর দোষ, সেই কবেকার কাজের মেয়ে মানদাকে খুঁজে না-পাওয়া। রোজই জিজ্ঞেস করেন, রোজই রবিবাবু মাথা নাড়েন, আর রোজই সবাইকে শুনতে হয়, “কোই কাম কে নেহি হো তুমলোগ, বংগালি হোতে হি অ্যায়সে… নিকম্মে…” ইত্যাদি। অন্যরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি আরম্ভ করেছে — এভাবে কাজ করা যায় না। তার চেয়ে ছেড়ে চলে যাওয়া ভালো। ছেড়ে চলে যাবার সাহস বা উপায় যদিও কারও নেই, কিন্তু আগুন একটা লাগতে চলেছে, তা বুঝতে পারছেন উকিলবাবু। ওঁর নিজের দিক থেকেও কোনও সুরাহা পাচ্ছেন না। ভুবনব্রতর বাড়িতে সব কাগজ গোছানো শেষ। আবার নতুন করে দেখা গেছে বিষয়-সম্পত্তি, বা টাকাকড়ি সংক্রান্ত কোনও কাগজই নেই পড়ে নেই ওখানে। সত্যজিৎ গিয়েছিল দীপব্রতকে জন্ম দেওয়া গাইনিকলজিস্ট ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে। লাভ হয়নি। তিনি এখন অতিবৃদ্ধ। স্মৃতিশক্তি প্রায় লোপ পেয়েছে।
অনেক ভেবে তারাশঙ্কর একটা পথ খুঁজে পেলেন। বা, বলা ভালো, পথটা তাঁর জানা-ই ছিল, এতদিনে, আর কোনও রাস্তা নেই বুঝে সে পথে হাঁটলেন। একদিন কাজ সেরে সন্ধেবেলা কোর্ট থেকে বাড়ি না ফিরে গেলেন বহুবাজার থেকে অনতিদূরে একটা শুঁড়িখানায়। দরজার ওপরে টিমটিমে আলোর নিচে প্রাচীন সাইনবোর্ডটায় বহুকাল আগে কেউ যত্ন করে ‘গোল্ডেন বার্ড বার কাম ফ্যামিলি রেস্টুরেন্ট’ লিখেছিল। বাঁকা হাসলেন তারাশঙ্কর। এখানকার খদ্দেরদের ফ্যামিলি থাকলেও তাদের তারা এখানে নিয়ে আসবে না। আর যে মা-বাবা তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে রেস্তোরাঁয় যায়, তারা জীবন থাকতে গোল্ডেন বার্ডে কেন, এই গলিতেই ঢুকবে না। সন্ধেবেলা এখানে রোজই রবিবাবু মদ খেতে আসেন। বয়সকালে তারাশঙ্করও এসেছেন, তবে সে বহু বছর আগের কথা। তখনকার কর্মচারীরা কেউ থাকলেও তাদের নিশ্চয়ই আর তারাশঙ্কর চিনতে পারবেন না।
গেটের বাইরের ময়লা পাগড়ীওয়ালা দারোয়ান থেকে শুরু করে টেবিলে সার্ভ করা বয় পর্যন্ত সকলেই যখন একগাল হেসে, “আসুন স্যার, অনেক দিন পরে…” বলে আপ্যায়ন জানাল, তারাশঙ্কর খুশি হবেন, না দুঃখ পাবেন বুঝতে পারলেন না।
ধোঁয়ায় ছাওয়া ঘরটার দূরের কোনের টেবিলে পানে মত্ত রবিবাবু। তারাশঙ্করকে আসতে দেখে হাসি মুছে গেল মুখ থেকে। ভুরু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। সঙ্গীরাও তারাশঙ্করের অপরিচিত নন। তাদের তাকানোর ভঙ্গীও ভালো নয়। তারপর, তারাশঙ্কর তখনও কয়েক পা দূরে, রবিবাবু টেবিল ছেড়ে উঠে এসে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে ভুরু তুললেন। ‘কী চাই?’ ধরনের ভুরু তোলা।
“কথা আছে,” মৃদুস্বরে বললেন তারাশঙ্কর।
“সিংজী পাঠিয়েছে?”
সিংজী পাঠাননি এবং বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়েই এসেছেন এ কথা প্রমাণ করতে তারাশঙ্করকে অনেকটা সময় ব্যয় এবং দু-পাত্তর পান করতে হল। সেই সঙ্গে বেহেড করে দিতে হল রবিবাবুকে। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় তারাশঙ্কর শুঁড়িখানা থেকে বেরোলেন। বউয়ের মুখ-ঝামটা সইতে হবে, কিন্তু যা জানা গেল, তার তুলনা হয় না।
পরদিন সকালেই ফোন করলেন সত্যজিৎকে। জরুরি তলব। বাইরের ঘরে, মামার চেম্বারে বন্ধ দরজার আড়ালে শলাপরামর্শ হল মামা-ভাগনেয়।
“তার মানে রবিবাবু মানদার খোঁজই করেনি? গ্রাম-বাসা জানা সত্ত্বেও?”
“করবে কী করে?” জানতে চাইলেন তারাশঙ্কর। “রবিবাবুর বাড়িতে মদনমোহনের বিগ্রহ ছিল। একদিন কী কারণে রবিবাবুর গিন্নি মানদাকে ধমকধামক দিয়েছেন, বলেছেন, কাল সকালেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, আর মুখ দেখতে চাই না। পরদিন সকালে ঠাকুরঘরে ঢুকে দেখেন মদনমোহন নেই। মানদাও নিরুদ্দেশ।”
পুলিশ গিয়ে দেখেছিল মানদা গ্রামে ওর বাড়িতেই রয়েছে! মজার কথা হল মদনমোহন চুরির কথা শুনে ভয় পাওয়া দূরে থাক, খেপে বোম। পুলিশকে বয়ান দিয়েছিল, রবিবাবু মদের নেশায় চুর হয়ে রাতে মানদার কাছে এসেছিল। মানদার চেঁচামেচিতে সবার ঘুম ভেঙে যায়, গিন্নিমা এসে মানদাকেই বকাবকি করেন। বলেন মানদা নষ্ট মেয়েছেলে। ও-ই নিশ্চয়ই বাবুকে ফুসলেছে… বলে-টলে ওকেই তাড়িয়ে দেন। সে পর্যন্ত ঠিক ছিল। ওরা ছোটোলোক, গরিব, বাবুরা কথায় কথায় ওদেরই দোষ ধরে এ আর নতুন কী? কিন্তু একে তো বাবু তার সতীত্ব নিতে এসেছিল, তার ওপর চুরির দায়? এবার মানদা মুখ খুলবে। কারও কথা শুনবে না। রবিবাবু ওকে রেপ করতে এসেছিল। না-পেরে বউ আর বাড়ির ঠাকুর-চাকরের কাছে মান রাখতে কেবল চাকরি ছাঁটাই করেনি, চুরির দায়ে জেল পাঠানোর ধান্দা করছে!
পুলিশ মানদার বাড়িতে মদনমোহনের বিগ্রহ পেল না, তার ওপর থানায় তখন নতুন ওসি — সবে নারী-নির্যাতনের ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন — তিনি এবার রবিবাবুর দিকে নজর ফেরালেন। বিগ্রহ উদ্ধারের আশা জলাঞ্জলি দিয়ে কোনওমতে বহু খেসারতের বিনিময়ে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলেন।
“খেয়াল রাখিস, বুড়ি রবিবাবুর আঁচ পেলেই আর মুখ খুলবে না। কিছু একটা বলতে হবে যাতে সন্দেহ না করে…”
মানদার গ্রাম সুন্দরবনের কোথাও। একেবারে ভোরবেলা না বেরোলে দিনের-দিন ফেরা কঠিন। রবিবাবুর কথায় একবার লঞ্চে, তারপর ভটভটিতে, এবং তারপর পাথরপ্রতিমায় রাত কাটিয়ে আবার লঞ্চ যাত্রা।
গুগ্ল্ ম্যাপ খুলে দেখা গেল আজকাল হয়ত পুরো রাস্তাটাই গাড়ি করে যাওয়া যাবে। তবু একটা দিন দেরি করে পরদিন সকালেই বেরোল সত্যজিৎ। সারাদিন দুশ্চিন্তায় কাটল তারাশঙ্করের। তবে সন্ধের মধ্যেই ফিরে এল সত্যজিৎ। বেঁচে আছে মানদা, বয়সও খুব নয়, তবে রোগব্যাধিতে জর্জরিত। জবর গপ্পো ফেঁদেছিল বটে তারাশঙ্করের ভাগনে। একবারের জন্যও রবিবাবুর নাম করতে হয়নি। বলেছিল মুখার্জিদের কথা। মানদার মুখ খুলতে দেরি হয়নি। ভুবনবাবু কতটাই ভালো মানুষ ছিল, মানদাকে কত ভালোই না বাসত, মানদার জন্য কত কী করে দিয়েছিল… এই ঘর, বাড়ি, সবই তো তারই দেওয়া…
সত্যজিৎ জানতে চেয়েছিল, “তাহলে ছাড়লে কেন তাদের কাজ?”
যেমনই মুখ থেকে কথাটা বেরোনো, তেমনই মানদার ফুঁসে ওঠা — “ওই হারামজাদি খানকি মাগী…” কিছুক্ষণ তোড়ে গালাগালি করে মানদার রাগ খানিকটা কমার পর সত্যজিৎ জিজ্ঞেস করেছিল, “কে সেই… ইয়ে… মেয়েলোকটা?” শুনল কবে নাকি ছেলে-বউ নিয়ে ভুবনব্রতবাবু শ্বশুরবাড়ি গেছিলেন কার বিয়েতে। সেই জীবনে প্রথম, আর সেই যাত্রা-ই হয়ে দাঁড়াল অভিশাপ। ফিরেছিলেন আরও একজন মহিলা আর তার বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে। তাদের বাবা নাকি ট্রেন থেকে পড়ে হারিয়ে গেছিল। সব মিথ্যা। ওই মাগীর ঠাঁই হওয়া উচিত ছিল নিচতলায়, বাড়ির পেছনে, অন্য ঝি-চাকরদের সঙ্গে, কিন্তু সে তো হলই না, বরং সে হয়ে দাঁড়াল বাড়ির দ্বিতীয় কর্ত্রী। দেখতে না দেখতে বাবুর বিছানাও ঠাকরুনের শয্যা হয়ে দাঁড়াল।
বুঝল সত্যজিৎ। তখন থেকেই মানদার ভালোবাসায় — এবং রোজগারেও টান পড়তে আরম্ভ করে। কিন্তু মানদার কথা শেষ হয়নি…
“আর ওই অপোগণ্ড ছেলেটাকে দত্তক পর্যন্ত নিল। নিজের ছেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখল, পরাগব্রত। মরে যাই, নামের কী ছিরি!”
অবাক হবার ভান করল সত্যজিৎ। “তার মানে ওরা আপন ভাই না? সবাই তো জানে…”
জানুক সবাই। আসল কথা জানে মানদা। মহা ধান্দাবাজ ওই মাগী আর ব্যাটা। সব সুলুক-সন্ধান নিয়ে তবেই এসেছিল। ভালোমানুষ মুখুজ্জেদের সর্বনাশ করতে।
এতটা বলার পরে স্বভাবত সেয়ানা মানদার টনক নড়ল। সত্যজিতের দিকে চেয়ে বলল, “কিন্তু তুমি কে বাবা? তোমায় তো চিনলাম না?”
সত্যজিৎ বলল, “আমি একজন উকিল। তোমার জন্য ভালো খবর এনেছি। কিন্তু আগে বলো, তুমি কি ওদের এখনকার কথা কিছু জানো? ওই মুখার্জিদের?”
জানে না মানদা। বহু বছর শহরমুখো হয়নি সে। সত্যজিৎ ওকে মুখার্জিবাড়ির দুই গিন্নি, আর ভুবনব্রতবাবুর মৃত্যু সংবাদ দিল। তারপর বলল, “দীপব্রতও আর নেই।”
“নেই মানে?” চমকে জিজ্ঞেস করল মানদা। “মরে গেছে? ছোটোবাবু মরে গেছে? কী হয়েছিল?”
সত্যজিৎ সংক্ষেপে আম্ফানের রাতের দুর্ঘটনাটা বর্ণনা করল। মানদার চোখ ছলছল করে এল। কেবল ভুবনব্রত মুখার্জি নয়, ছোটোবাবুকেও পছন্দ করত মানদা। কিন্তু সে কেবল এক লহমাই। পরক্ষণেই রেগে উঠে বলল, “তাহলে? দেখলে? কী বলেছিলাম? আসল মালিককে সরিয়ে দিয়ে এখন উড়ে এসে জুড়ে বসা বজ্জাতটা সব ভোগ করছে।”
“সেও আর নেই।”
“নেই? সে-ও মরেছে নাকি?”
“না। ওকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
খ্যাকখ্যাক করে হাসল মানদা। “পাওয়া যাবে না। নিগ্ঘাত পালিয়েছে। দেখো গে, তার গাঁয়ে গিয়ে রাজার হালে বসে আছে।”
“গ্রাম? কোথায় গ্রাম তার?”
মানদা এতক্ষণে খেয়াল করেছে যে সত্যজিতের আসার কারণটা এখনও জানা হয়নি। বলল, “সে আমি কী জানি? তুমি বললে ভালো খবর আছে?”
সত্যজিৎ বলল, “আছে। দীপব্রত অনেক টাকাকড়ি রেখে গেছে তোমার নামে।”
আবার চোখে জল এল মানদার। বলল, “ছোটোবাবুর মনটা ভালো।” তারপর বলল, “এনেছ?”
সত্যজিৎ মাথা নেড়ে বলল, “অত টাকা আনা যাবে না।”
“কত টাকা?” চোখ ছোটো হয়ে এল মানদার।
“সে অনেক হাজার। যেতে হবে শহরে, কাগজে সই করে টাকা পেতে হবে।”
মানদা পড়তে, বা সই করতে জানে না জেনে আপাতত পাঁচ হাজার দিয়ে সত্যজিৎ সাদা কাগজে মানদার টিপসই আর দুটো নাম নিয়ে ফিরেছে।
পরাগব্রতর আসল… না… অতীতজীবনের নাম নাড়ু, বা নাড়ুগোপাল। গ্রামের নাম আকন্দপুর।
ভাগনের কান এঁটো করা হাসির অর্থ মাথায় ঢুকল না তারাশঙ্করের। আকন্দপুর কোথায়? এরকম নামের কটা গ্রাম থাকতে পারে পশ্চিমবঙ্গে?
সত্যজিৎ স্মিত হেসে বলল, “না, মামা, ভুবনব্রত মুখার্জি শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরছিল। শ্বশুরবাড়ি কোথায় তো জানি। সেই ট্রেনেই উঠেছিল নাড়ুগোপাল আর ওর মা। বাবা ছিল কি না জানি না, তবে সেটা সমস্যা নয়। ব্যাপার হল এই, যে এই লাইনের কাছাকাছি কোথাও আকন্দপুর বলে কোনও গ্রাম আছে কি না। আছে। গুগ্ল্ বলছে… এই যে…”
ভাগ্নের ফোনে আকন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কথা লেখা দেখে তারাশঙ্কর বিহ্বল হয়ে গেলেন। কিছু বলতে পারলেন না। ভাবলেন, কেমন চট করে সত্যজিৎ গ্রামের সমস্যাটা সমাধান করে দিল! কার ভাগনে দেখতে হবে তো! অবশ্য সেটা হলে এ-ও সত্যি যে মানদা পড়তে জানে না বলে সত্যজিৎ নির্ঘাৎ ওকে পাঁচ হাজার টাকা দেয়নি।
হাজারখানেক, হাজার দুয়েক দিয়ে কাগজে টিপসই মেরে নিয়েছে। তবে তাতেই বা তারাশঙ্করের কী? টাকা তো গৌরী সেন সিংজী দেবেন।
ক্রমশঃ