~পনেরো~
দশটার মিটিং শুরু হতে হতে প্রায় দশটা চল্লিশ। সবাই এসে না বসা অবধি সিংজী ওপর থেকে নামেন না। আজ দশটা বারো মিনিট থেকে শুরু করে একে একে শেষ পর্যন্ত রবিবাবু পৌঁছনো অবধি সময় নিল প্রায় দশটা আঠাশ, আর তারপর আরও মিনিট দশেক পরে নামলেন সিংজী নিজে।
লক্ষ্মণ সিংজীর পেছনে। গত ঘণ্টা দুয়েকে ওর উত্তেজনা বেড়েছে। অনেক কষ্টে সামলে রাখছে নিজেকে। মালিকদের এই বাবুয়ানি চাল ওর কাছে অসহ্য। কিন্তু কিছু করার নেই।
সৌভাগ্যক্রমে মিটিং শেষ হতে বেশি সময় লাগল না। টিকটিকি সত্যজিৎ তার প্রমাণগুলো সামনে রাখামাত্র সকলেই বলল, আর এক মুহূর্তও দেরি করে কাজ নেই, এখনই রওয়ানা হতে হবে। ফলে বারোটা নয়, এগারোটার কিছু আগেই ওদের দুটো গাড়ি বেরিয়ে পড়ল আমোদপুরের দিকে।
মিনি ততক্ষণে এগিয়ে গেছে অনেকটাই। ড্রাইভার ববি জিজ্ঞেস করেছিল, “দিদি, আপনি সকালে খেয়েছেন, না খাবেন? সামনে দাঁড়াব? কচুরি, ল্যাংচা…”
মিনি খাবে না। বলেছিল, “সঙ্গে স্যান্ডউইচ আছে। তোমার খেতে হলে চট করে সেরে নাও।” তখনও ঘড়িতে দশটা বাজেনি। লক্ষ্মণ বলেছিল বেরোতে বেরোতে ওদের বারোটা হবে। মিনি জানে না, ঘণ্টাখানেক পরেই ওরাও বেরোবে। ওদের ব্রেকফাস্ট খাবার জন্য দাঁড়াতে হবে না।
ববি বলেছিল, “তাহলে এখানে না। সামনে বিরিঞ্চি থানার পাশে একটা ছোটো হোটেলে থামব। ওদের রুটি তরকারিটা ভালো।”
বিরিঞ্চি থানার পাশে কেবল একটা খাবার দোকান নয়, ছোটোখাটো বাজার। মিনি একটা জামাকাপড়ের দোকানে ঢুকল। যা আছে তার সবই গ্রাম্য। মিনি এসব কিছু পরে না।
তা-ও, এই উগ্র গোলাপি শাড়িটা বদলাতে হবে। মিনি একটু কম উগ্র রঙের একটা চুড়িদার কিনে দোকানের ভেতরেই এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, “দাদা, এখানে শাড়িটা বদলানোর কোনও জায়গা আছে?”
দোকানদার একটু অবাক হয়ে বলল, “এখানে তো…” তারপর উঠে এল দোকানের পেছন দিকে। তোরঙ্গ আর কাপড়ের গাঁঠরির পেছনে একটা ছেলে বসে ঢুলছিল, তাকে, “এই আবদুল, বেরো এখান থেকে, দিদি কাপড় বদলাবে…” বলে বের করে দিয়ে বলল, “এখানে যেতে পারেন, কেউ আসবে না।”
চট করে শাড়ি বদলে নীলচে-সাদা সালোয়ার কামিজ পরে বাইরে বেরোল মিনি। ববিও সবে জলখাবার শেষ করে বেরিয়ে এদিক ওদিক দেখছিল। মিনিকে দেখে একগাল হেসে এগিয়ে এসে বলল, “এ-ই মানিয়েছে ভালো, চলুন,…”
আবার গাড়িতে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিনির হঠাৎই টেনশন হল। বলল, “আর কতটা বাকি?”
ড্যাশবোর্ডে ফোন স্ট্যান্ডে রাখা ফোনের দিকে তাকিয়ে ববি বলল, “বিকেল চারটে দশে পৌঁছব বলছে। তবে মাঝে তো খাবার জন্য থামতে হবে?”
মিনি বলল, “আমার একটু তাড়া আছে ববি। আমার সঙ্গে খাবার রয়েছে। স্যান্ডুইচ… চলবে না? “
ববি একটু কিন্তু কিন্তু করছিল, মিনি বলল, “প্লিজ, ভাই… আমি কম্পেনসেট করে দেব…” তখন বলল, “না, ঠিক আছে, স্যান্ডুইচ তো ভালো…”
গাড়ি ছুটে চলল।
~ষোলো~
আকন্দপুরে পরাগব্রত পরবর্তী কার্যপদ্ধতি ঠিক করে ফেলেছে। মিছিমিছি ভয় পাওয়ার মানে হয় না। একজন অচেনা মানুষ এল কি এল না, তাতে আঁতকে উঠে সব কাজ ফেলে পালিয়ে গেলে কোথাও-ই নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে না। তার চেয়ে আগে যেমন ছিল — তেমনই তৈরি থাকা… এখন তো মোটরসাইকেলটাও আছে।
সারাদিন ধরে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার দিকেও নজর রাখছিল নাড়ুগোপাল। দোকান খোলা থাকলে সামনের দরজা সারাক্ষণই খোলা থাকে। সেই সঙ্গে আজ থেকে ভেতরের ঘরের পেছনের দরজাও হাট করে খোলা থাকবে। সে দরজার ঠিক বাইরে মোটরসাইকেল, পকেটে মোটরসাইকেলের চাবি — এখন থেকে এটাই দস্তুর হয়ে যাবে।
কাজ শেষ হল বেশ দেরি করে। একরাশ খুচরো টাকাকড়ি জমা হয়েছে। গুনে গেঁথে থলেবন্দী করে নিয়ে মদিনা ক্লথ স্টোর্সে ঢুকল। তারিকের সঙ্গে একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, খুচরো নোটে বদলে নেওয়া — যদি ওর বিক্রি বাটা হয়ে থাকে।
আজ তারিকের বিক্রি কিছু হয়নি বললেই চলে। দেবার মতো নোট জমেনি। বলল, “বসো, চা খাও। হাবিবরে কই…”
তারিকের গদিতেই না বসেই নাড়ুগোপাল হাবিবকে ডেকে বলল তিন কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসে আড্ডায় যোগ দিতে। তারপর তারিককে বলল, “চলো, বাইরে গিয়ে বসি। সারা দিন তো ঘরে বসে কাজ করলাম…”
তারিক আর হাবিব মুখ চাওয়া চাওয়ি করল, নাড়ুগোপাল পাত্তা দিল না। বন্ধ দোকানের ভেতর থেকে বাইরের রাস্তা দেখা যায় না।
চা খেতে খেতে তারিক আর হাবিব অনর্গল কথা বলে চলেছে। দুজনেই বড়ো বেশি কথা বলে। বিশেষত তারিক। ওদের সঙ্গে বসলে খানিক পরে ওদের বকবকানিতে নিজে থেকেই নাড়ুগোপালের মনটা যেন সুইচ টিপে কেউ বন্ধ করে দেয়। আজও তাই হয়েছিল, তাই হাবিবের প্রথম কথাগুলো শুনতে পায়নি। সম্বিত ফিরতে চমকে জিজ্ঞেস করল, “কী বললে? কে এসেছিল দোকানে?”
“আরে, ওই বাবুটা গো! সেদিন আকন্দপুরের খোঁজ নিলে যে? সে তো ফেরার পথে এসে থামলে — কইলে কাগজের জেরক করবে! তা আমি কইলাম নাড়ু তো খানিক আগে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল যে গো। বাইক নে গেছে মানে ফিরতে সময় লাগবে তো… কী হল তোমার?”
পথচলতি একজন গাড়িচড়া বাবু কি নাড়ুগোপালের দোকানে থেমে জেরক্স করাতে চাইতে পারে না? অবশ্যই পারে। তবু, আজ অবধি তো কেউ থামেনি? গাড়িচড়া একটা বাবু কি আকন্দপুর যেতে পারে না? তা-ও নিশ্চয়ই পারে, কিন্তু কই, সে-ও তো এই প্রথম? এবং সেটা একই লোক — যে আকন্দপুরে গেল আর তারপর ফেরার পথে নাড়ুগোপালের দোকানেই থামল — হবার সম্ভাবনা কতটা? তীব্র অস্বস্তিটা আবার ভেতরটা আচ্ছন্ন করে ফেলছে। এবং সেই জন্যই সাদা সুইফ্ট্ ডিজায়ার গাড়িটা ধীরে ধীরে এসে ওদের ঠিক সামনে দাঁড়ানো অবধি ওটা দেখতেই পায়নি। গাড়ির পেছনের সিটের জানলা খুলে মেয়েটা যখন, “ভাই, শুনছেন…” বলল, তাকে দেখে নাড়ুগোপালের মাথা থেকে পা অবধি ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এক লহমার জন্য মনে হল উঠে দৌড় লাগায়, পরমুহূর্তে বুঝল সেটা ভুল হবে। মিনি ওদের তিনজনের দিকেই তাকিয়েছে। ওকে চিনতে পারলে এতক্ষণ গাড়ির ভেতরে বসে থাকত কি? ওর চোখে চিনতে পারার কোনও আভাসই নেই। হাবিব উঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছে গাড়ির জানলার কাছে। কী বলবে মিনি? ও তো নাড়ুগোপালের ইতিবৃত্ত কিছুই জানে না। পরাগব্রত মুখার্জি বললে গাঁয়ের লোক কিছুই বুঝবে না। ফলে…
মিনি নাড়ুগোপাল চক্রবর্তীর জেরক্সের দোকানের কথাই বলছে। হাবিব ঘুরতে শুরু করেছে ওর দিকে। আর বসে থাকা ঠিক নয়। নাড়ুগোপাল উঠে দাঁড়াল। মিনির নজর ওর দিকে ঘুরেছে। চোখে চোখ… মিনির ঠোঁটের নড়া দেখে নাড়ুগোপাল ওর, “ও, মাই গড…” বলাটা বুঝল। তারপর দরজা খুলছে, মিনি নামছে, মিনি ছু্টে এসে পরাগের বুকে আছড়ে পড়ছে — কী বলছে মিনি?
“পরাগ, আমাদের খুব বিপদ, তোমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।”
পরাগ! ওর হতভম্ব অবস্থাটা কি তারিক দেখেছে? তারিকের চোখে সংশয়? পরাগব্রতর মনে পড়ল গ্রামে গল্প বলেছে নাড়ুগোপাল একমাত্র সন্তান। তবে এই বুকের ওপর আছড়ে পড়া ওর চেয়ে কম-বয়সী মেয়েটা ওর কে? পরাগ বলে ডাকে কেন ওকে? কী বলবে? এক লহমায় মাথায় যা এল বলে ফেলল নাড়ুগোপাল, “আমার মামাতো বোন…” মিনি-ও বোধহয় বুঝল কিছু একটা। অস্ফুটে বলল, “মৃণালিনী… মৃণালিনী।”
মিনি গাড়ি থেকে একটা সুটকেস আর একটা বটুয়া বের করল। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, “আমরা যদি এখনই ফিরি, আপনি নিয়ে যাবেন?” ড্রাইভার উত্তর দেবার আগেই নাড়ুগোপাল, ওরফে পরাগব্রত বলল, “ট্যাক্সি? ছেড়ে দাও। ধরে রেখো না।” তারপর চট করে তারিক আর হাবিবের দিকে ফিরে বলল, “পরে আসছি।” মিনি দ্বিরুক্তি না করে ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছে। ট্যাক্সিটাও ঘুরছে — ফিরে যাবে শহরের দিকে। পরাগ মিনির কনুই ধরে রাস্তা পেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। মিনি মৃদুস্বরে বলল, “পালাতে হবে। এক্ষুনি বেরোতে হবে। এক্ষুনি। কী করে যাবে?”
পরাগব্রতও নিচুস্বরে বলল, “বাইক আছে, পেছনের রাস্তা ধরে বেরোব। কিন্তু কেন বলবে তো?”
পরাগব্রতর ঘরে ঢুকে মিনি এক নিঃশ্বাসে বলল, “সিংজীর গুণ্ডারা আসছে। লক্ষ্মণ আর ওর দলবল। সঙ্গে ডিটেকটিভ। আমার পেছনেই। হয়ত এখনই এসে পড়বে। সময় নেই।”
পালানোর জন্য সবকিছু তৈরিই থাকে পরাগব্রতর। একটা ফোলিও ব্যাগ। তাতে যাবতীয় কাগজপত্র — নানা পরিচয়পত্র, ব্যাঙ্কের কাগজ। আর, ভেতরের একটা পকেটে একটা প্লাস্টিক জিপ্লক ব্যাগে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের মধ্যে, কাগজে মোড়া এক চিমটে সাদা ক্রিস্টাল, যার থেকে দু-চারটে গুঁড়ো একজন মানুষের পক্ষে যথেষ্ট। ওর পালকপিতা ভুবনব্রতবাবুর ইহলোকের লীলাখেলা এই চিমটের কয়েকটা গুঁড়োতেই শেষ হয়েছিল। এখন কি মিনির পালা? তবে এখানে না। এখানে কিছু করা বিপজ্জনক কেবল নয়, সময়-ও হয়ত নেই।
বলল, “চলো। একবার চট করে মোড়লের বাড়িটা ঘুরে যাব। ওদের কী বলব, শুনে নাও…”
মোড়ল নাসিবুল্লার বাড়িতে না ঢুকেই দুঃসংবাদটা দিল নাড়ুগোপাল। মৃণালিনী ওর মামাতো বোন। মামা গ্রামে থাকেন। খুবই অসুস্থ। মৃণালিনী শহর থেকে গ্রামে যাবার পথে নাড়ুগোপালকে নিয়ে যেতে এসেছে। ওরা চলল, হয়ত কয়েক দিন ফিরবে না।
নাড়ুগোপাল জানে, কয়েক দিন নয়, কোনও দিনই আর ফেরা হবে না। তবু, যারা খোঁজ করতে আসবে তারা যদি একটা ভুল খবর পায়…
নাড়ুগোপাল যখন আবার বাইকে স্টার্ট দিচ্ছে, তখন মোড়ল জানতে চাইলেন, “মামাবাড়ি কোথায়?”
এক লহমা না থেমেই নাড়ুগোপাল বলল, “চৌড়া। বাঁকুড়া হয়ে যেতে হবে।”
মোড়ল যতক্ষনে, “আরে বাঁকুড়া তো অনেক দূর। মাঝরাত পারোয়ে যাবে! রাতটা থেকে কাল সকালে বারোলে হত না?…” বলে ডেকেছেন, ততক্ষণে নাড়ুগোপাল আর মৃণালিনী অনেকটাই দূরে চলে গেছে।
লক্ষ্মণ আর তার দলবল অবশ্য মাঝরাতের পরেই এসে পৌঁছল। পাঁচটার কাছাকাছি আসার কথা ছিল, কিন্তু পথে একটা জায়গায় প্রথম গাড়িটা বেরিয়ে যাওয়ার পরেই পাণ্ডের গাড়ি আটকাতে পুলিশ হাত তুলেছিল। পাণ্ডে ভেবেছিল স্পিড বাড়িয়ে বেরিয়ে যাবে, কিন্তু তা তো হয়ইনি, বরং পুলিশটা এগিয়ে এসে রাস্তা আটকাতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছিল। তাতে প্রায় ঘণ্টা চার-পাঁচ দেরি হয়েছে ওদের। এবং পাণ্ডে এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিল যে গাড়ির গতি আর বাড়াতেই পারেনি।
রাতের অন্ধকারে আমোদপুর বাসস্টপের আসপাশের দোকানগুলো সব ছায়া-ছায়া। নিঃশব্দে দরজা খুলে নেমে কয়েকজন ছুটে গেল বাড়ির পেছনের দিকে, কয়েকজন দুটো সিঁড়ি বেয়ে উঠল সামনের দাওয়ায়। সকলের দায়িত্ব আগে থেকেই ঠিক করা আছে। কী কী করতে হবে ওদের মুখস্থ। এত রাতে বাড়ির সব দরজাই বন্ধ থাকবে ভেতর থেকে। পেছনের দরজা বাইরে থেকে খুলে ফেলা সাধারণত সহজ হয়। ভেতরের লোক যাতে বুঝতে পেরে সামনের দরজা খুলে না পালায়, সে জন্যই বাইরের দরজায় পাহারা থাকে।
আজ অবশ্য হিসেব গুলিয়ে গেল। বাইরের দরজায় তালা দেখে একজন গাড়িতে ফিরে এসে লক্ষ্মণকে যতক্ষণে রিপোর্ট করছে, “দরোয়াজা বাহার সে তালা লাগা হুয়া হ্যায়…” ততক্ষণে পেছনের দরজার ছিটকিনি উপড়ে চারজন ঢুকে গেছে বাড়ির ভেতর। তাদেরও মিনিট খানেকের বেশি সময় লাগল না বাড়ি খুঁজে দেখতে। বাইরের দরজা ভেতর থেকে খোলা গেল না। ওরা আবার পেছনের দরজা দিয়েই বেরিয়ে এল। গাড়ি থেকে নামেনি লক্ষ্মণ আর সত্যজিৎ। চট করে পালাতে হলে একজনের বিশাল চেহারা, আর অন্যজনের অনভিজ্ঞ চলাফেরা অন্তরায় হতে পারে। বাড়ির ভেতর কেউ নেই শুনে সত্যজিৎ বলল, “ওর মোটরসাইকেল?”
দুজন ছুটল আবার ভেতরে। ফিরতে সময় লাগল না। মোটরসাইকেলও নেই।
এর অর্থ কী? পরাগব্রত কি কোথাও গেছে, না একেবারেই পালিয়েছে?
লক্ষ্মণ বলল, “দরোয়াজা বন্ধ্ করো, জলদি নিক্লো। ইঁহা রুকনা নেহি।”
দু-জন ফিরে গেল পেছনের দরজার উপড়ে ফেলা ছিটকিনি লাগিয়ে দরজা ভেজিয়ে আসতে। বাইরে থেকে ভেতরের ছিটকিনি আটকানো যাবে না, কিন্তু কেউ যে ভেঙে ঢুকেছিল তা বোঝা না গেলেই হল। পরাগব্রত পরে ভাববে ও হয়ত ঠিক করে বন্ধ করেনি — ছিটকিনি আলগা ছিল।
গাড়ি দুটো যেমন এসেছিল, তেমনই বেরিয়ে গেল। গ্রামের বাইরে হাইওয়ের ধারে আবার ঝটতি আলোচনা হলো। ফোন গেল সিংজীর কাছে। অনিদ্র সিংজী খুশি হলেন না, কিন্তু মেনে নিলেন যে দুই গাড়ি ভর্তি লোকের পক্ষে আমোদপুরের আসেপাশে হাঁ করে বসে থাকা সম্ভব নয়। সত্যজিৎ দিনের আলোয় ফিরে যাবে। গ্রামের লোকের কাছে জেনে আসবে নাড়ুগোপালরূপী পরাগব্রতর খবর।
~সতেরো~
মিনি ঘুমিয়ে পড়েছে। পরাগব্রতর চোখে ঘুম নেই। মিনির কাছে সব শোনার পর থেকে একটা তীব্র অনিশ্চয়তাবোধ গ্রাস করেছে ওকে। এত সহজে সমস্ত প্রচেষ্টা একেবারে মাটিতে মিশে গেল? ওর অতীত-বর্তমান এত সহজে বের করে ফেলল হীরে স্মাগলাররা? মিনি অবশ্য বলতে পারেনি কী করে পরাগব্রত যে নাড়ুগোপাল ছিল এবং আবার সেই নামই নিয়েছে তা জানা গেছে। ডিটেকটিভ লাগিয়েছিল — এইটুকু জানে মাত্র। আর বলতে পেরেছে দুটো নাম। সিংজী — দলনেতা। আর তার প্রধান গুণ্ডা লক্ষ্মণ। প্রথম জনকে চেনে না, কিন্তু সে কে, জানে পরাগব্রত। লক্ষ্মণকে চেনে না। মিনির কথা সব জানা হয়ে গেছে। নিজের কথা কিছুই বলেনি। ক্লান্ত মিনি ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটাই কথা জানতে চেয়েছিল — তুমি ওদের হীরে চুরি করেছ? কত হীরে?
হীরে! অবাক হওয়ার ভান করেছিল পরাগব্রত। হীরের কথা তো ও কিছুই জানে না!
মিনি চোখ ছোটো করে তাকিয়ে ছিল। “হীরে নিয়ে পালাওনি, তো পালিয়েছিলে কেন?” পরাগব্রত বলেছিল, “তোমাকে বোঝাতে পারব না।” এখন বসে বসে ভেবে দেখছে, ও নিজের দিক থেকে দেখেছে বলে এতদিন বুঝতে পারেনি ওর উধাও হয়ে যাওয়াটা হীরে স্মাগলাররা কীভাবে নিয়েছে।
ও তো অনেক আগে থেকেই ঠিক করেছিল ভুবনব্রত আর দীপব্রত মুখার্জিকে মেরে, সমস্ত বিষয় সম্পত্তির দখল নিয়ে বাড়ি ছেড়ে আকন্দপুরে গিয়েই থাকবে। বৃদ্ধ ভুবনব্রতকে মেরে ফেলতে অসুবিধে হয় নি। বুড়ো অসুস্থ এবং মৃত্যুপথযাত্রী — দুই-ই ছিল। কিন্তু দীপব্রতকে মারা অত সহজ হত না। হঠাৎ পাওয়া সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল পরাগব্রত। প্রবল ঝড়ের রাতে দীপব্রত হীরে, আর হীরে ব্যবসায়ের টাকা সরাচ্ছিল ওর লুকোনো আস্তানা থেকে। একটা গাছ ভেঙে পড়েছিল বাড়িটার ঝুলবারান্দায়। বারান্দার ভাঙা ইঁটপাটকেলের আঘাতে অজ্ঞান দীপব্রতকে সেই ইঁট আর ভেঙে-পড়া গাছের ডাল দিয়েই পিটিয়ে মেরেছিল পরাগব্রত। টাকা আর হীরেও নিয়ে পালাতে হয়েছিল, কারণ সেগুলো পুলিশের হাতে পড়লে পরাগব্রতরও সমস্যা হত। এক ভাই বেআইনী হিরে ব্যবসা করে, আর অন্যজন সে বিষয়ে কিছু জানে না — এ কথা সহজে মেনে নিত না কেউ। কিন্তু সেই জন্যই আজ হীরে স্মাগলাররা ওর পেছনে লেগে আছে। এই মৃত্যুদূতের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া কঠিন হবে।
কী কী উপায় আছে? সন্দেহ নেই যে মিনি সঙ্গে থাকলে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। এই হোটেলটা পেতে যত সময় লাগল, তাতেই বুঝেছে। পর পর সব হোটেলেই বলে কাপ্ল্দের জন্য ঘর নেই। একজন তো বলল, ম্যারেজ সার্টিফিকেট আছে? পরাগব্রত মেকি রাগ দেখিয়ে বলেছিল, মামাতো বোনের সঙ্গে বিয়ের সার্টিফিকেট কার থাকে?
শেষ পর্যন্ত এই হোটেলটায় ঢুকেই ওরা বলেছিল দুটো ঘর চাই। তখন দেখা গেছিল মিনির সঙ্গে আধার কার্ড বা অন্য কোনও পরিচয়পত্র নেই। পরাগব্রত আর মিনির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অতি কষ্টে ঘর দুটো পেয়েছে। কাল সকালের মধ্যে আধার কার্ড জমা করে দেবে কথা দিতে হয়েছে। মিনি জানত না কী করে ফোন নম্বর দিয়ে আধার কার্ড ডাউনলোড করতে হয়। সেটা করতে গিয়ে চট করে একটা স্ক্রিন-শট নিজের ফোনে পাঠিয়ে দিয়েছে পরাগব্রত। মিনির বাবার নাম ঠিকানা নিয়ে কী করবে ও জানে না। তবু, থাক…
বাইরে রাত ঝিম ঝিম। পরাগব্রত ঘর ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। কী উপায় আছে? কী উপায় থাকতে পারে? মিনি সঙ্গে থাকলে একরকম, না থাকলে অন্য রকম। মিনি-কে এখানেই রেখে সরে পড়বে? ওর কিসের মাথাব্যথা? কৃতজ্ঞতা? মিনি বিপদ মাথায় করে এসেছে ওকে রক্ষা করতে, না নিজের তাগিদেই এসেছে? লক্ষ্মণ বলে কোন গুণ্ডার বন্দিনী শয্যাসঙ্গিনীর দশা থেকে মুক্তি পেয়ে পরাগব্রত ছাড়া আর কোনও রক্ষাকর্তার কথা মাথায় আসেনি। মিনির মতো একটা মেয়ে আর কোনও অনুভূতি বোধ করে বলেও মনে হয় না পরাগব্রতর। সুতরাং ওকে নিয়ে বেশি মাথা না ঘামালেও চলবে। আধার কার্ডে ওর বাবার নাম আর বাড়ির ঠিকানা দেখে পরাগব্রত গুগ্ল্ খুলে সার্চ করেছে। সদর শহরে যেখানে ওর বাড়ি, সেখানে মোটামুটি সচ্ছল লোকেরাই থাকে। সুতরাং মিনির ফিরে যাবার জায়গা একটা আছে…
রাত একটা। বারান্দার দরজা বন্ধ করে পরাগব্রত শুতে গেল।
~আঠেরো~
সিংজীর নির্দেশে সত্যজিৎ সকালে একা-ই ফিরল আমোদপুরে। পরাগব্রতকে জানতে না দিয়ে খবর নেবে ও ফিরে এসেছে কি না। না ফিরে থাকলে জানতে চেষ্টা করবে কোথায় গেছে। লক্ষ্মণরা সদলবলে রাস্তার ধারের একটা ধাবায় খাওয়া দাওয়া করতে বসল, আর ওদিকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাবিবের চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থেকে নামল সত্যজিৎ। চা-বিস্কুট খেয়ে জানতে চাইল, “জেরক্সের দোকানটা খোলেনি এখনও?”
হাবিবও তাকাল নাড়ুগোপালের দোকানের দিকে। বলল, “খুলেছেল তো, কিন্তু কাল বৈকেলে ওর বোন এল, মামা না কার শরীলটা খুব খারাপ। এখন তখন।” সেই শুনে নাড়ুগোপাল নাকি বোনের সঙ্গেই চলে গেছে মামাবাড়ি। আর কিছু বলতে পারল না হাবিব। সত্যজিৎ জানতে চাইল কোথাও সকালের খাবার পাওয়া যাবে কি না। হাবিব রাস্তার ওপারে একটা দোকান দেখিয়ে বলল, “দ্যাখেন, ওখানের লুচি তরকারি আপনার পোষায় কি না!”
দোকানটা আগের দিনই দেখেছিল সত্যজিৎ। মিষ্টির দোকান। এখন, সকালে, বেশ কিছু লোকের ভিড়। ওর গাড়ির ড্রাইভার মিশির এর মধ্যেই প্লেট নিয়ে বসে পড়েছে। এ দোকানটা বেশ সরগরম। দোকানীর নির্দেশে ভেতরের দিকে একটা টেবিলে বসে বুঝল এখানেই আগে আসা উচিত ছিল। খদ্দেররা উত্তেজিতভাবে নাড়ুগোপালের বিষয়েই আলোচনা করছিল। সত্যজিতের আগমনে আলোচনায় সামান্য ভাঁটা পড়লেও গ্রামেরই কেউ একজন ব্যাপারটা কিছুই তখনও জানতে পারেনি বলে সবাই মিলে পুরোটাই তাকে বর্ণনা করল।
আধঘণ্টা পরে, খাবারের দাম মিটিয়ে সত্যজিৎ দোকান থেকে বেরিয়ে একটু দূরে হেঁটে গিয়ে ফোন করল সিংজীকে। সিংজীও ওর সঙ্গে একমত। পরাগব্রতর আবার মামা কোথায়? ভুবনব্রতবাবুর শালা পরাগব্রতর কেউ নয়। ওর নিজের মামাবাড়ির সঙ্গে ওর কোনও যোগাযোগ নেই। আমোদপুরে এতদিন থাকা সত্ত্বেও ও আকন্দপুরেই কারও কাছে যদি ওর খবর না থাকে, তাহলে ওর মায়ের বাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গেও ওর কোনও যোগাযোগ হয়নি নিশ্চয়ই? তাহলে এই বছর তেইশ চব্বিশের মেয়েটা কে?
সিংজীর এ প্রশ্নের উত্তরে সত্যজিৎ বলল, ও পরাগব্রতর ব্যাপারে যতটা খোঁজ নিয়েছে তা থেকে বলতে পারে যে ওই বয়সী একটাই মেয়ে ওর জীবনে এখন থাকতে পারে — মিনি।
সিংজী সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “নেহি। ঔর কোই হোগা।” বাচনভঙ্গীর দৃঢ়তার ফলে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে পারল না সত্যজিৎ। সিংজী বললেন, “ওয়াপস্ আ যাও। ওহাঁ রুখকে ঔর ফায়দা নেহি হ্যায়। কিসিকো কুছ মত্ বাতানা। কাল সুবহ্ হি ইধার আ যানা। দশ বাজে।”
~উনিশ~
সকালে উঠে পরাগব্রত পাশের ঘরের দরজায় ধাক্কা দেওয়ামাত্র মিনি দরজা খুলে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ মিনিকে বোঝাতে চেষ্টা করল এত বেপরোয়া না হতে, নইলে কোনও দিন কোথাও দরজা খুলে দেখবে বাইরে লক্ষ্মণ দাঁড়িয়ে। মিনি বলল, “এইমাত্র ফোন করে বললে আসছ, এখন আর কে আসবে?” উফ্! পরাগব্রত ফোন করলেই বা কী? কিন্তু এখন আগের কাজ আগে।
পরাগব্রত বলল, “শোনো, আপাতত একটাই উপায় আছে। চলতে থাকা। এক জায়গায় বেশিদিন থাকলে চলবে না। আর লোকের সন্দেহ এড়াতে আমরা ভাই বোন পরিচয়েই থাকব। তুমি আমার মামাতো বোন হয়েই থেকো। বিধবা সেজে। থান কিনে আনব। বিধবা হবার সুবিধে এই, যে ঘোমটা দিয়ে থাকতে পারবে, মুখ দেখা যাবে না।”
বিধবা! কিন্তু ভাবার সময় নেই। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে পরাগব্রত।
“কোথায় যাবে?” ভয়ে ভয়ে, অনিশ্চিতভাবে জিজ্ঞেস করল মিনি।
“তীর্থে।”।
“আমি বিধবা বলে তীর্থে যাব? আর তুমি?”
“আমি তোমার মামাতো দাদা, তোমার বডিগার্ড। তোমার বাবা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন।”
“আমি তো তোমার মামাতো বোন?” অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করল মিনি।
“তুমিও কী করে আমার মামাতো দাদা হবে? তুমি তাহলে পিসতুতো দাদা।”
তাই? তবে তাই। পরাগব্রতর কোনও দাদা বা ভাই ছিল না দীপব্রত ছাড়া। ভুবনব্রত মুখার্জি পারতপক্ষে কোনও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না। নাড়ুগোপালের ছিল? মনে নেই ওর। সম্পর্ক কাকে বলে ও জানে না।
দু ভাই-বোন মিলে মামা-মামী, পিসি-পিসেমশাইয়ের নাম-ধাম, পরিচয় ঠিক করে হোটেল থেকে বেরোল। প্রথমে বাস-স্ট্যান্ড। বাইরে বাইক রাখার জায়গায় হাজারো মোটরসাইকেল, স্কুটার, মোপেডের মেলা। পরাগব্রত বাইকটা পার্ক করে বেরিয়ে এল। কার্যত ফেলেই দেওয়া হল, জেরক্স মেশিনের মতো। সামনের খাবার দোকানে দুজনে খাওয়া সেরে রিকশা নিয়ে গেল রেল স্টেশন। তিনটে ট্রেন বদলে খড়গপুর।
পরাগব্রত খোঁজ নিয়ে এল। বিকেলে পুরীর শতাব্দী আছে। রাতে সুপার ফাস্ট। বিকেলের ট্রেন রাত দশটায় পৌঁছবে। রাতেরটা সকাল সাতটায়। “সেটাই ধরব। স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা বলেছি। কিছু এক্সট্রা দিতে হবে, উনি এসি ফার্স্ট ক্লাসে ব্যবস্থা করে দেবেন। এসি ফার্স্টে দুজনের কুপে আছে। সেখানে তোমার পোশাক বদলাতে সুবিধা হবে।”
“পুরীতে থাকব কোথায়?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিল মিনি।
“ভাড়া বাড়ি,” জবাব তৈরি পরাগব্রতর। “তুমি রোজ যাবে জগন্নাথ মন্দিরে। তিন চার মাস পরে আবার অন্য কোথাও…”
সারা জীবন সাদা থান পরে তীর্থে তীর্থে ঘুরতে হবে?
কথাটা মনেই রইল, মুখে আনল না মিনি। হঠাৎ উপলব্ধি করল, পরাগব্রতর সঙ্গে বাকি জীবন কাটানোর সম্ভাবনাটা মনে করতে বেশ ভালোই লাগছে। ভাইবোন সেজে থাকতে হবে তো কেবল জনসমক্ষেই, আড়ালে কী না হতে পারে?
~কুড়ি~
মিনি আর পরাগব্রত যখন খড়গপুর স্টেশন থেকে রওয়ানা হয়েছে, মোটামুটি তখনই লক্ষ্মণ পৌঁছেছে ওর মায়ের বাড়িতে। সারাদিনে বার কয়েক, যতবারই দলবল, সঙ্গী সাথীদের থেকে একটুও আলাদা হতে পেরেছে, তুলসীর ফোনে ফোন করেছিল। প্রতিবারই একই রেকর্ডেড্ মেসেজ বেজেছে — সুইচ্ড্ অফ্। তুলসীর ফোন কখনওই বন্ধ থাকে না। তবে কি চার্জ শেষ হয়ে গেছে? চার্জার খারাপ? মিনির ফোন থাকলে ওকে ফোন করা যেত, কিন্তু মিনির কি ফোন আছে? ভাবার চেষ্টা করেছিল লক্ষ্মণ। মুখার্জিদের বাড়িতে তো ছিল। ওর বাড়িতে আসার পর থেকে তো একবারও মিনির হাতে ফোন দেখেছে বলে মনে হয় না। অবশ্য মিনির ফোন নম্বর জানেও না লক্ষ্মণ।
তুলসী অসুস্থ হয়ে পড়েনি তো? হয়ত সাহায্যও চাইতে পারছে না? মিনির ঘরের দরজা তো বাইরে থেকে বন্ধ। ওর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। আচ্ছা, মা যদি মরে গিয়ে থাকে? মিনি ওকে খবরও দিতে পারবে না। আর… নাঃ, জোর করে থামিয়ে রেখেছিল নিজেকে। শহরে পৌঁছে সিংজীকে বিস্তারিত রিপোর্ট দিতে হয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার, সিংজী টিকটিকি সত্যজিতের কাছে রিপোর্ট নিয়েছে আলাদা, আর ওর কাছে আলাদা। কেন?
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে লক্ষ্মণ বাড়ির দরজায় পৌঁছল। গলি থেকেই মিনির ঘরের জানলা দেখা যায়। অন্ধকার। যতদূর বোঝা যায় নিচের ঘরেও আলো জ্বলছে না। মিনি আর তুলসী দুজনেই ঘুমোচ্ছে। কড়া নাড়তে গিয়ে দরজাটা খুলে গেল গেল। ভেতর থেকে বন্ধ নয় কেন? কেন কেবল ভেজানো! একটা অজানা আশঙ্কায় লক্ষ্মণের বুকের ভেতরটা খালি হয়ে গেল। হাত দিয়ে ঠেলে দরজা খুলে ঢুকল বাড়িতে। উঠোনের ওদিকে তুলসীর ঘরের দরজা হাট করে খোলা। দোতলায় যাবার দরজাটা সবসময় শিকল তুলে বাইরে থেকে বন্ধ করা থাকে, কিন্তু এখন খোলা। লক্ষ্মণ তুলসীর ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালাল। ঘর খালি। লক্ষ্মণের বিশাল বপু নিয়ে দ্রুত চলাফেরা সহজ নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে গতিতে তুলসীর ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওপরতলায় নিজের ঘরের দরজা খুলে ঢুকে আলো জ্বালাল, কেউ দেখলে তার তাক লেগে যেত। অস্ফুটে, “মা জী,” বলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কোমরে গোঁজা চাকু দিয়ে তুলসীর হাত, পা, মুখের বাঁধন কেটে পরম মমতায় অচৈতন্য দেহটা কোলে করে নিচে নিয়ে এল। নিচের ঘরে বিছানায় শুইয়ে কাপড় ভিজিয়ে প্রথমে জল, তারপর তুলসীর চোখের পাতা অল্প কেঁপে ওঠার পরে ঘরে রাখা দুধ গরম করে ফোঁটা ফোঁটা করে মুখে ঢেলে দিল।
পুরীগামী সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেসে মিনি ওর ক্লান্ত দেহটা পরাগব্রতর ওপর থেকে সরিয়ে নিয়ে পাশে শুয়ে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “একটা কথা বলবে? সেদিন রাতে, বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে আমাকে আদর করে গেছিলে? সত্যি বলবে?”
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন সিংজী। তারপর আস্তে আস্তে ফোনটা টেনে নিলেন কাছে। স্ক্রিনে আঙুল বুলিয়ে নামটা বের করলেন। মিনি। বহুদিন এ নম্বরে ফোন করেননি। আরও কিছুক্ষণ কিছুই করলেন না। চুপ করে চেয়ে রইলেন নামটার দিকে। তারপর প্রায় ছোঁ মেরেই তুলে নিয়ে ডায়াল করলেন নম্বরটা।
সাধারণত কাউকে খুন করলে তার মোবাইল ফোন থেকে সিম কার্ড খুলে নিয়ে ভেঙে ফেলে দেওয়াই দস্তুর। লক্ষ্মণ এ-কাজে ভুল করবে বলে মনে হয় না। এবং মিনির ফোন যেহেতু প্রিপেইড, হয়ত মোবাইল কম্পানি এর মধ্যে নতুন কোনও গ্রাহককে নম্বরটা দিয়েও দিয়েছে। না দিলে ফোন বাজবে না, দিলেও কোনও অপরিচিত কণ্ঠস্বর উত্তর দেবে — এমন কেউ, যে মিনির নামও শোনেনি।
চলন্ত পুরী এক্সপ্রেসের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় রিনরিনে রিংটোন বেজে উঠে দুজনেরই ঘুমের চটকা ভেঙে দিল। মিনি হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে নিয়েই চমকে বলল, “শিট্!”
“কী হল?” ওপরের বার্থ থেকে পরাগব্রত উঁকি দিয়ে দেখতে পেল স্ক্রিনে ফুটে ওঠা নামটা। বুকের ভেতরটা শুকিয়ে গেল। এই ভুলটা ও কী করে করল? মিনির ফোন নম্বর বদলে নেওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। বলল, “উত্তর দিও না। বেজে যেতে দাও।”
উত্তর দেওয়ার প্রশ্নই নেই। ফোনের স্ক্রিনে ‘ভবানীচরণ সিং’ নামটা দেখামাত্র ওর অন্তরাত্মা কাঁপতে আরম্ভ করেছে। ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। পরাগব্রত বলল, “সুইচ অফ করো, সুইচ অফ করো!”
ওর গলার স্বরে তাগিদটা মিনিকে আরওই কেমন স্থবির করে দিল। পরাগব্রত লাফ দিয়ে উঠে তড়িঘড়ি কামরার আলো জ্বালাল। ফোনের পেছনের ঢাকনা খুলে সিম কার্ডটা বের করে সাবধানে নিজের মানিব্যাগে রাখতে রাখতে বলল, “তোমার আধার কার্ড এই নম্বরের সঙ্গে লিঙ্কড, তাই ফেলে দেওয়া যাবে না। আধার কার্ডের ফোন নম্বর কী করে বদলায় জানো?”
জানে না মিনি, মাথা নাড়ল। পরাগব্রত বলল, “ঠিক আছে, পরে খোঁজ নেওয়া যাবে। কিন্তু ভয় এখনও রয়েছে।”
মুখ শুকিয়েই ছিল মিনির। আরও শুকিয়ে গেল। বলল, “কী?”
পরাগব্রত চিন্তিত মুখে বলল, “ওরা এটার লোকেশন ট্রেস করেছে? বুঝতে পারবে কি, আমরা পুরী যাচ্ছি?”
দুজনেরই আর ঘুম এল না প্রায় সারা রাত।
সিংজী পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে আবার ফোন করলেন। এবারে শুনতে পেলেন, ‘সুইচ্ড্ অফ্’। ভুরু কুঁচকে ফোন নামিয়ে রাখলেন। বালিশে মাথা দিলেন বটে, কিন্তু কোঁচকানো ভুরু সোজা হল না। চোখ বুজলেনও না আর।
ক্রমশঃ