~একুশ~
প্রায় আধবাটি গরম দুধ খেয়ে তুলসী দুর্বল বাঁ-হাত তুলে ইশারায় থামতে বলল লক্ষ্মণকে। কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু গোঙানির শব্দ ছাড়া কিছু শোনা গেল না। মুখটাও কি একটু বাঁকা লাগছে?
তুলসী আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছিল। বাইরে ভোরের আলো ফুটছে। দুধের বাটিটা রান্নাঘরে নামিয়ে রেখে লক্ষ্মণ তুলসীর বিছানার পাশে বসল। মাথার ভেতরটা একই সঙ্গে রাগে এবং ভয়ে আক্রান্ত। মেয়েটাকে হাতে পেলে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলত। সেই সঙ্গে ভয়। সিংজীর নির্দেশ অমান্য করলে কী হয় ও জানে। তবে এতদিন সিংজীর সে কাজ সব ও একাই করে এসেছে। ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারার মতো লোক কি সিংজীর হাতে আর একজনও আছে?
সকাল সাতটা নাগাদ লক্ষ্মণের মাথাটা আস্তে আস্তে বুকের ওপর ঝুলে পড়ল। বসা অবস্থাতেই যখন ওর নাকটা অল্প অল্প ডাকছে, তখন পুরীতে ট্রেন থেকে নেমে নাড়ুগোপাল চক্রবর্তী ঘিরে ধরা পাণ্ডাদের বলছে, “ঘর ভাড়া চাই। ছ-মাসের জন্য। আমি আর বোন… সদ্য বিধবা…”
~বাইশ~
নাথুর প্রায় সারা রাতই ঘুম হয়নি। সিংজীর কাছ থেকে ফিরেই লক্ষ্মণ বেরিয়ে গেছিল বলে ও কর্মচারীদের কানাঘুষো শুনতে পায়নি — নাথুরা শুনেছে। রান্নাঘরের ছেলেটা ছিল কাছেই… যদি হঠাৎ চা-সরবত দিতে হয়! দিতে হয়নি। তাই প্রায় সব কথাই কানে গেছে ওর। একটা মেয়ে — পরাগব্রতর কোনও মামাতো বোন — এসে ওকে নিয়ে গেছে আগের দিন বিকেলে। সিংজী মানতে রাজি নন যে পরাগব্রতর কোনও মামাতো বোন আছে, তবে মেয়েটা কে হতে পারে সেটা উনি বলতে পারেনি। কেউ কিছুই বলতে পারে নি, কিন্তু নাথু জানে। সিংজী লক্ষ্মণকে কী বলেছিলেন জানে না, কিন্তু মিনিকে নিজের কাছে পুষে রাখতে বলেননি নিশ্চয়ই। লক্ষ্মণ রেখেছিল নিজের ভোগের জন্য। পরশু সকালে মিনি লক্ষ্মণের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় গেছিল? নিশ্চয়ই পালিয়ে গিয়ে পরাগব্রতকে খবর দিয়েছে। সিংজী জানেন না সে কথা, কিন্তু নাথুর কাছে প্রমাণ রয়েছে — পরশু সকাল অবধি মিনি লক্ষ্মণের বাড়িতেই ছিল। এবং পরশুই বেরিয়ে গিয়ে রাস্তা থেকে একটা ওলা ট্যাক্সি ধরে চলে গেছে — সঙ্গে একটা সুটকেস। লক্ষ্মণই হয়ত পাঠিয়েছিল, পরাগব্রতকে সাবধান করতে। যে কারণেই হোক, লক্ষ্মণ সিংজীর বিশ্বস্ত কর্মচারী আর নয়, হয়ত কখনওই ছিল না।
লক্ষ্মণ এখন নেই। এরই মধ্যে সিংজীকে খবর দিতে হবে। সিংজীর মুখোমুখি হয়ে লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে হবে ভাবতেই নাথুর হাত-পা পেটের ভিতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে। এ ক-বছরে লক্ষ্মণ এতটাই প্রভাবিত করেছে সিংজীকে, যে সিংজী ওর কোনও দোষই দেখতে পান না। কিন্তু এই ছবি দেখলেও কি সিংজীর ভুল ভাঙবে না? এক যদি না…
এক যদি না সিংজীই মিনিকে লক্ষ্মণের হাতে তুলে দিয়ে থাকেন?
আবার ভাবতে হল নাথুকে, কিন্তু ভেবে স্থির করল, না… তার সম্ভাবনা নেই।
সকাল আটটা। সিংজীর পুজো শেষ হয়েছে, কিন্তু এখনও নিচতলার কর্মচারীদের ওপরে যাবার অনুমতি নেই। তবু দুরুদুরু বুকে নাথু গিয়ে দাঁড়াল গেটে। দারোয়ানের চোখে মুখে বিস্ময়।
“আভি?”
“বহোত জরুরি হ্যায়। একবার ফোন লাগাইয়ে।”
দারোয়ান কী ভেবে ইন্টারকম তুলে কথা বলল। তারপর বলল, “উপর যাও, ন-তাল্লা মে রুকো।”
আর পেছোনোর উপায় নেই। ন-তলায় উঠে নাথু নিয়মমাফিক অফিস ঘরের বন্ধ দরজার পাশে দাঁড়াল। দেখতে দেখতে লিফটটা আবার ন-তলা থেকে বারো-তলায় উঠল, পরক্ষণেই আবার নামতে আরম্ভ করল। নাথু সোজা হয়ে দাঁড়াল। লিফট থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে অফিস-ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে নাক দিয়ে একটা ঘোঁত করে শব্দ করলেন। অর্থাৎ ঘরে ঢোকার অনুমতি দিলেন নাথুকে।
নাথু সিংজীর পেছন পেছন অফিসে ঢুকল। টেবিলের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন, চেয়ারে বসেননি সিংজী। নাথু টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। “কেয়া হ্যায়?” কালকের ঘটনার পরে সিংজীর মেজাজ এখমও শান্ত হয়নি। ভয়ে ভয়ে সিংজীর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিল নাথু। ফোনের স্ক্রিনে মিনির ছবি। পাশ থেকে নেওয়া। জুম-ইন করার ফলে স্ক্রিন জোড়া মিনির মুখ। চিনতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। নাথু হাত বাড়িয়ে ছবিটা ছোটো করে দিল। মিনি গোলাপি শাড়ি পরে একটা দরজা বন্ধ করছে। পর পর আরও তিনটে ছবি দেখাল নাথু। মিনি রাস্তা দিয়ে সুটকেস হাতে হেঁটে যাচ্ছে, শপিং মলের সামনে মিনি ক্যাফেতে ঢুকছে, এবং সব শেষে, মিনি একটা ওলা ক্যাবে উঠছে।
ফোনটা ফেরত দিলেন সিংজী।
“কভ লিয়া ইয়ে সব তসবির?” ওঁর গলা বিপজ্জনক রকম শান্ত।
ভেতরটা কেঁপে উঠল নাথুর। কোনও রকমে বলল, “পরসোঁ সুবহ্, সরকার।”
“ও গাড়ি-ওয়ালা তসবির ফিরসে দিখাও…”
নাথু বিনা বাক্যব্যয়ে বের করে দিল ছবিটা।
ওলা ক্যাবের ছবিটা দু-আঙুলে চিমটি দিয়ে বড়ো করে নম্বর-প্লেটটা দেখে বললেন, “জিগনেশ কো বোলো গাড়ি কা পাতা করে। ফির ড্রাইভার কো পুছো কাহাঁ গিয়া থা…”
“জি, সরকার।”
এবার নিজেই ডাইনে বাঁইয়ে আঙুল চালিয়ে প্রথম দেখা ছবিটা বের করলেন সিংজী। নাথুর হাতে ফোন ফেরত দিয়ে বললেন, “ইয়ে কহাঁ?”
নাথু বলল, “ইয়ে হ্যায় লচমন কা আপনা ঘর। উসকা মা ভি ইধর হি রহ্তি হ্যায়…”
আর একটা ছবি বের করে ফোনটা বাড়িয়ে দিল নাথু। এটা আগের দিন রাতের। এটা আগে দেখায়নি। অন্ধকারের মধ্যে একটা জানলা। ভেতরে আলো জ্বলছে। মুখ দেখা না গেলেও, দেহাবয়ব দেখে লক্ষ্মণকে চিনতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, আর সে ঘরেই মিনিকেও চেনা যায় মোটামুটি সহজেই।
“ইয়ে এক রোজ পহলে রাত কা হ্যায় সরকার…”
চড়াৎ করে প্রবল বিরাশি সিক্কার চড়টা এসে পড়ল যখন, তার আঘাতে নাথু দুটো চেয়ার নিয়ে ছিটকে গিয়ে পড়ল ঘরের উলটো দিকে।
“সালা হারামি, চুতিয়া, ভোঁসড়িকে…”
“সরকার, গলতি হো গিয়া সরকার। মাফি মাঙ্গে… সরকার…” নাথু বুঝতে পারছে না, অন্যায়টা কোথায় হয়েছে, কিন্তু আগে শান্ত করতে হবে মালিককে। “হুজুর মাফ কর দো…”
“পহেলে কিউঁ নেহি বাতায়া, মাদারচোদ্? আভি বাতাকে কেয়া ফায়দা?”
“মালুম নেহি থা সরকার, মাফি মাঙ্গে সরকার…” সত্যিই নাথু জানত না মিনির ব্যাপারে কী আদেশ দিয়েছিলেন সিংজী, এবং একটা মেয়ে গিয়ে যে পরাগব্রতকে সাবধান করে দিয়েছে, সে-ও তো কেবলমাত্র গতকাল রাতেই সবাই জানতে পেরেছে।
এতদূর ভেবেই নাথুর খেয়াল হল, গতকাল রাতে বন্ধ দরজার আড়ালে কী আলোচনা হয়েছে তা তো নাথু বা ওদের কারও জানার কথা নয়…
কিন্তু সিংজীর মাথায় সে চিন্তা নেই। ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “ঔর, ও কাহাঁ হ্যায়? ও মাদারচোদ্?”
মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও নাথু বেশ ভয়ে ভয়েই বলল, “সরকার, ও তো কাল রাত কো নিচে সোয়া নেহি। নিকলকে চলা গিয়া, শায়দ ওহি গিয়া হ্যায়…” একই সঙ্গে হাত বাড়িয়ে ফোনটা টেনে নিল নাথু — পাছে সিংজীর রাগ গিয়ে ওটার ওপরেই পড়ে…
“ফোন লাগাও হারামখোর কো, বুলাও ওয়াপস আভ্ভি। ইসি ওয়ক্ত।”
কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে নিয়ে নাথু ডায়াল করল।
~তেইশ~
অভিষেক পাণ্ডার তত্ত্বাবধানে পরাগব্রত আর মিনি এসে হাজির হল আঠেরোনালায়, যেখানে সমুদ্রতট থেকে এবং মন্দির থেকেও কয়েক মিনিটেরই দূরত্বে বিশ্বম্ভর পাণিগ্রাহীর বাড়ি। পাণিগ্রাহীর বেশ কয়েকটা বাড়ি আছে, তাতে অনেকগুলো করেই দু-কামরা, তিন কামরা এমনকি এক কামরারও ঘর রয়েছে। মিনিকে বাড়ির মেয়েরা যত্ন করে ভেতরে নিয়ে গেল, বাইরের ঘরে বসে পরাগব্রত মৃণালিনীর জীবনের দুঃখের কাহিনি শোনাল বিশ্বম্ভর আর অভিষেককে। বিয়ে হয়েছিল দু-বছরও হয়নি। স্বামী কাজ করত কাতারে। ওখানেই মারা গেছে। মৃণালিনীর বাবা প্রাচীনপন্থী মানুষ, নির্দেশ দিয়েছেন, মেয়েকে তীর্থ করতে যেতে হবে। নিজের ভাইবোন নেই বলে নাড়ুগোপালের ওপরেই ভার পড়েছে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। নাড়ুগোপালও বেকার, তাই ওর পক্ষেই কাজটা সবচেয়ে সহজ।
গল্পে কাজ হল, ছ-মাসের জন্য বাড়ি ভাড়া পেতে দেরি হল না।
নাড়ুগোপাল আর মৃণালিনীকে বাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বিশ্বম্ভর ফিরে গেলেন, মিনি দরজার পেছনে রাখা একটা পুরোনো ঝাড়ু নিয়ে ঘর পরিষ্কার শুরু করল, নাড়ুগোপাল গেল বাজারে।
বিশ্বম্ভর ফিরে গিয়ে দেখলেন স্ত্রী কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। জানতে চাইলেন ভাই-বোন সম্বন্ধে কী মনে করলেন। বিশ্বম্ভর অবাক হলেন। এর মানে কী? ভালো না লাগলে কি বাড়ি ভাড়া দিতেন নাকি?
স্ত্রীর দুর্জ্ঞেয় হাসির অর্থ বুঝতে দেরি হল না বিশ্বম্ভরের।
~চব্বিশ~
পকেটে ফোনটা বেশ খানিকক্ষণ বাজার পরে লক্ষ্মণের ঘুম ভাঙল। ধড়ফড় করে উঠে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে বোতাম টিপে উত্তর দিল। নাথু।
“কাহাঁ হো? সিংজী বুলা রহেঁ হ্যায়।”
কটা বাজে? সাড়ে আটটাও বাজেনি! এত সকালে সিংজী উঠে ওর খোঁজ করছেন? কী আশ্চর্য!
“জলদি আ যাও…” বলছে নাথু। “বহুত গুস্সে মে হ্যায়।”
“আভি আয়া…” বলে লাইন কেটে লক্ষ্মণ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তুলসী এখনও গভীর ঘুমে। বার দুয়েক “মা, মা… মা-ঈ…” বলে ডেকে সাড়া পেল না। ভাবল যত তাড়াতাড়ি পারে ফিরে এসে আবার কিছু খাওয়াবে। দ্রুতপায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটা দিল সিংজীর বাড়ির দিকে।
ওদিকে সকালে বাজার সেরে ভাই-বোন ঘর গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল জগন্নাথ মন্দিরের দিকে। দুটো ঘরেই মেঝেতে বিছানা করে শোয়ার ব্যবস্থা। ভেতরে বোনের ঘরে তোষকটা চওড়া — ডবল-বেডের সাইজ, বাইরের ঘরে ভাইয়ের বিছানা অনেক ছোটো। ঘরে আর কোনও আসবাবপত্র নেই। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনার বালাই থাকবে না, মৃণালিনী রোজই মন্দিরে পুজো দিতে যাবে — এ-ই ওদের পুরীতে আসার প্রধান কারণ, জেনে অতি নিশ্চিন্তে বিশ্বম্ভর ঘর দিয়েছেন। নিজের ঘরের বিছানার দিকে দেখিয়ে মিনি ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল, “আগে মন্দির, না আগে…?” পরাগব্রত বলল, “মন্দির। চালচলনে সামান্য ত্রুটি হলেও চলবে না। প্রথম দিকে ভুল হতে পারে, কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব শিখে নিতে হবে। অভিষেক পাণ্ডা অপেক্ষা করছে, দেরি করলে চলবে না।”
ওরা যখন মন্দিরে যাবার জন্য বেরোচ্ছে, তখনই লিফটে ঢুকে ন-তলার বোতাম টিপেছে লক্ষ্মণ।
সিংজী মিটিঙের বড়ো ঘরেই অপেক্ষা করছিলেন। লক্ষ্মণ ঘরে ঢুকে অভ্যাসমতো সেলাম করে দাঁড়াল।
“কাহাঁ থে?” সিংজীর গলা অদ্ভুতরকম মোলায়েম। নাথু নেই কোথাও, কিন্তু টেলিফোনে যে বলেছিল ভীষণ রেগে আছেন, তার কোনও চিহ্ন নেই চোখেমুখে, কণ্ঠস্বরে। লক্ষ্মণ প্রমাদ গণল। এত বছরের চাকরিতে ও সিংজীকে এত ভয়ংকর রাগতে ক-বার দেখেছে, মনে পড়ে না।
সিংজী তাকিয়ে আছেন। লক্ষ্মণ অল্প কথায় বলল মায়ের খুব অসুখ। অজ্ঞান। তাই…
সিংজীর গলায় উদ্বেগ। সে কী! কী হয়েছে? ডাক্তার দেখিয়েছে লক্ষ্মণ?
ডাক্তার? ডাক্তার দেখানোর কথা ওর মাথায়ও আসেনি। ও যেখানে থাকে সেখানে মেয়েদের জন্য ডাক্তার-টাক্তার ডাকা হয় না। ওর মা-ও মারা গেছে বিনা চিকিৎসায়, ওর ঠাকুমাও তাই। বিদেশ-বিভূঁইয়ে এক পাতানো মা-কে ডাক্তার দেখানোর কথা স্বপ্নেও মনে আসার কথা নয়, আসেওনি। সিংজী চুকচুক করে শব্দ করে বললেন, না, না। তা হয় না। আজই ডাক্তার বাবুকে পাঠানো হবে। গলা তুলে ডাকলেন, “নাথু?”
যেন দরজার আড়ালে তৈরিই ছিল — নাথু সঙ্গে আরও চারজন ঢুকে সিংজীর পেছনে দাঁড়াল। লক্ষ্মণের আত্মরক্ষার বোধ এখন তুঙ্গে।
সিংজী নাথুকে লক্ষ্মণের মায়ের অসুস্থতার কথা বলছেন! বলছেন, নাথু যেন আজই ডাক্তার বাবুকে সঙ্গে নিয়ে যায়… লক্ষ্মণের চিন্তাভাবনা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। নাথু যাবে ডাক্তার নিয়ে? নাথু তো জানেই না লক্ষ্মণের মা কোথায় থাকে! লক্ষ্মণ কিছু বলার আগেই সিংজী নাথুর সামনে হাত পাতলেন, নাথু আড়চোখে একবার লক্ষ্মণের দিকে তাকিয়ে সিংজীকে ওর মোবাইলটা দিল।
সিংজী লক্ষ্মণের দিকে ফিরলেন, “সামনে আও।”
লক্ষ্মণ সাবধানে এক-পা এগোল। সিংজী আঙুলের আলতো টোকায় ফোনটা এগিয়ে দিলেন। কী দেখাচ্ছেন সিংজী? ফোনটার দিকে হাত বাড়াতে ভয় পাচ্ছে; সিংজীর থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই আড়চোখে দেখার চেষ্টা করল, ঠিক বুঝতে পারল না। শুনতে পেল, সিংজী বলছেন, “আরে সামনে আও, শরমাও মৎ, ঠিক-সে দেখো…”
লক্ষ্মণ ঠিক করে তাকাল। ফোনটা এখনও একটু দূরে, তাই একটু ঝুঁকে পড়তে হল; পরক্ষণেই মাথাটা ঘুলিয়ে উঠল। নাথুর ফোনে মিনির ছবি! মিনি ঝুঁকে পড়ে লক্ষ্মণের বাড়ির গলিতে বাইরের দরজার কড়া ধরে — টানছে না ঠেলছে? চকিতে লক্ষ্মণের তালগোল পাকানো মাথায় অনেকগুলো ভাবনা খেলে গেল। তাহলে মিনি আসলে নাথুর সঙ্গে… নাথু মিনিকে… তাহলে মিনিই পরাগব্রতকে… নাথু আর পরাগব্রত…? প্রশ্নগুলো প্রশ্নই রয়ে গেল, মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল সিংজীর হাতে একটা পিস্তল। সিংজীর হাতে পিস্তল! লক্ষ্মণ জানে সিংজীর কাছে সবসময় একটা পিস্তল থাকে, কিন্তু কোনও দিন চোখে দেখেনি। কিন্তু লক্ষ্মণের দিকে কেন? ওটা কি নাথুর দিকে তাক করা উচিত না? নাথুই তো পরাগব্রতর সঙ্গে…
প্রথম গুলিটাতেই একেবারে হৃদপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবেন ভেবেছিলেন ভবানীচরণ সিং। ভাবেননি লক্ষ্মণের মোটা, শক্ত হাড়ের কথা। গুলিটা লক্ষ্মণের বাঁ দিকের তৃতীয় পাঁজরের ওপরে লেগে হৃদপিণ্ডের দিকে না গিয়ে একটু ওপরে উঠে হার্টের খুব কাছেই একটা ধমনী ছিঁড়ে শিরদাঁড়ায় গেঁথে গেল।
হার্টে রক্ত আসা প্রায় পুরোপুরি বন্ধ, এ অবস্থাতেও লক্ষ্মণ কোমরের ছুরিটা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সিংজীর ওপর। বাগিয়ে ধরা ফলাটা সিংজীর বক্ষস্থলেই গেঁথে যাবার কথা ছিল, কিন্তু চারজন রক্ষীও একই সঙ্গে লক্ষ্মণকে আটকাতে এগিয়ে এসেছিল, তাই ওরও লক্ষভ্রষ্ট হল; ছুরিটা গেঁথে গেল সিংজীর গলায়। গলার বাঁ-দিকের জাগুলার ভেইন এবং ক্যারটিড আর্টারি দুই-ই কেটে বেরিয়ে গেল; চেয়ার পেছনে উলটে পড়ল, তার ওপর সিংজী, এবং তার ওপর লক্ষ্মণ। সিংজীর পিস্তল থেকে আরও তিনবার গুলি চলল; তার কোনটাতে লক্ষ্মণের প্রাণ গেল পোস্ট মর্টেমেও তা জানা যায়নি।
লক্ষ্মণের বিশাল শরীরটা টেনে সরাতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লেগেছিল, ততক্ষণে চেঁচামেচি হইচই শুনে কাজের লোক আর বাড়ির লোক অনেকেই ছুটে এসেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সিংজীর শরীর আর ঘরের মেঝে। সিংজীর নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে। গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। বাড়ির লোক ডাক্তারকে ফোন করে ডাকা, এবং পনেরো কুড়ি মিনিট পরে ডাক্তারবাবুর এসে পৌছনোর মধ্যে সিংজীর শরীরও নিথর হয়ে গেল।
ক্রমশঃ