~পঁচিশ~
প্রথম দিনের পুজো শেষ করে মিনি আর পরাগব্রত অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়াল জগন্নাথ মন্দিরে। ওখানে বসেই ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক আলোচনা করল। তারপর মহাপ্রসাদ নিয়ে পর্দার দোকান হয়ে বাড়ি ফিরল। বেলা তখনও দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে ঢলেছে। দুটো ঘরের দুটো জানলায় পরাগব্রত যতক্ষণ পর্দা লাগাল মিনি ততক্ষণ অতি কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছিল। জানলায় পর্দার আব্রু লাগামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়ল পরাগব্রতর ওপর। ঘণ্টাখানেক পরে দুজনে হাঁপিয়ে, ঘেমে বিছানা ছেড়ে উঠে চান করল। তারপর আবার শুল বিছানায়।
“তুমি আবার আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?”
মিনির মুখে চোখে চুমু খেতে খেতে পরাগব্রত ভাবছিল একই কথা। মিনির সঙ্গে থাকার মধ্যে শরীর ছাড়া আর কোনও আকর্ষণ আছে কি? বোধহয় না। এভাবে ক-দিন চলতে পারবে? যদিও বেশিদিন এখানে থাকার ইচ্ছে নেই, তবু সে ক-দিনও সর্বসমক্ষে ভাইবোন, আর লোকচক্ষুর আড়ালে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক কতদিন লোকের সন্দেহ উদ্রেক করবে না? তার চেয়ে অন্য কোথাও গিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ভেক ধরাই কি বেশি নিরাপদ নয়? না কি মিনিকে কোথাও রেখে চুপচাপ একা একা চলে যাওয়াটাই ভালো হবে?
“কী গো, চুপ করে কী ভাবছ?” নিজের বিবস্ত্র শরীরটা পরাগব্রতর শরীরের নিচ থেকে টেনে বের করে মিনি পরাগব্রতর দিকে ফিরল।
পরাগব্রত মুখটা নামিয়ে আনল মিনির বুকে। ঠোঁট, জিভ আর দাঁতের স্পর্শে বিহ্বল মিনি আলতো শিৎকার করে উঠল। তারই মধ্যে শুনল পরাগব্রত বলছে, “না। যাব না।”
পরদিন ভোর থাকতেই মিনির মন্দিরে যাবার কথা। আজ আবার কিসের ব্রতও আছে — বিধবাদের পালন করা জরুরি। অভিষেক পাণ্ডা অপেক্ষা করবে। রাতে দুজনের শুতে দেরি হয়েছে। ক্লান্ত মিনি বিছানা ছাড়তে চাইছিল না। পরাগব্রতর তাগাদাতেই উঠেছে। পরাগব্রত বুঝিয়েছে, এই ভেক বজায় রাখতে গেলে ভোরে উঠে রোজ মন্দিরে যাওয়া জরুরি। না হয় রাতে আরও আগে শুতে যাবে ওরা।
মিনি যখন মন্দিরে পাণ্ডার সঙ্গে পুজো দিচ্ছে, পরাগব্রত তখন মন্দিরের বাইরের দোকানপাট ঘুরে দেখছে। একটা চায়ের দোকানে দু-জন বাঙালি বেশ জোরে জোরেই কী যেন আলোচনা করছে… খুন, রক্তারক্তি, কাল নাকি টিভিতে দেখিয়েছে… পরাগব্রত ভেতরে গিয়ে এক কাপ চা নিয়ে পাশের টেবিলে বসল। একজনের তাগিদে দোকানি টিভির চ্যানেল বদলে বাংলা একটা নিউজ চ্যানেল দিলেন। পরাগব্রত চায়ে চুমুক দিতে দিতে অলস চোখে তাকাল টিভি স্ক্রিনের দিকে। উত্তেজিত সংবাদ-পাঠিকা এখনও জোড়া-খুনের খবর বলছেন। নিচে স্ক্রোল করছে খবরের হেডলাইন এবং অন্যান্য জরুরি তথ্য। কর্মচারীর হাতে ব্যবসায়ীর মৃত্যু! আত্মরক্ষা করতে গিয়ে ব্যবসায়ীর গুলিতে মৃত্যু কর্মচারীর! জোড়া খুনের তদন্তে সি-আই-ডি! এখনও রহস্যের কুয়াশায় আবৃত পরিস্থিতি!
স্ক্রিনে ডানদিক থেকে বাঁদিকে দ্রুত সরতে থাকা ব্যবসায়ীর আর কর্মচারীর নাম দুটো চোখে পড়তেই চমকে উঠল পরাগব্রত। ভবানীচরণ সিং! তাঁর কর্মচারী লক্ষ্মণ! এর কী অর্থ হতে পারে? ফোনটা তুলে একটা বাংলা কাগজের ই-পেপার খুলল পরাগব্রত। দু-আঙুলে চিমটি দিয়ে স্ক্রিন বড়ো করে সবটা পড়ে ফেলল যত তাড়াতাড়ি পারে। তারপর এক চুমুকে চা শেষ করে মন্দিরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল আবার। মিনির পুজো দেওয়া শেষ হলে এই দরজা দিয়ে বেরিয়েই ওর নতুন ফোন থেকে পরাগব্রতকে ডাকবে — এই ছিল কথা। কিন্তু পরাগব্রতর তর সইছে না।
আজ পরবের জন্য মিনির পুজো দিয়ে বেরোতে সময় লাগল। ঘণ্টা দুয়েক বাদে যখন সরু কালোপাড় সাদা শাড়ি পরিহিত, লম্বা ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকোনো চেহারাটা দেখা গেল, সে ফোন করার আগেই পরাগব্রত লম্বা পা ফেলে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এক লহমা ওর মুখের দিকে তাকিয়েই মিনি চমকে বলল, “কী হয়েছে?”
পরাগব্রত ডান-হাতে মিনির বাঁ কবজিটা শক্ত করে ধরে বলল, “তেমন কিছু না। চলো, বলছি।”
দুজনে হেঁটে স্বর্গদ্বার পার করে গিয়ে বসল সমুদ্রের ধারে। সূর্য উঠে গেছে, তাই সূর্যোদয় দেখার ভীড় কমেছে; সমুদ্রের জল এখনও ঠাণ্ডা খুব, তাই স্নানার্থীদের ভীড় এখনও নেই। মিনি বলল, “এবার তো বলবে? কী হয়েছে?”
মুখে কিছু না বলে ফোনটা মিনির হাতে দিল পরাগব্রত। ওই ই-পেপারের পাতাটাই খোলা। হেডলাইনের নিচেই ছবি। কী ভাবে যেন পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে তোলা অকুস্থলে জোড়া মৃতদেহ এবং রক্তগঙ্গার ছবি রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী খুনের বর্ণনার সঙ্গে শিল্পীর স্কেচ, এবং তা ছাড়াও, ভবানীচরণ সিং এবং লক্ষ্মণের জীবিত অবস্থার ফটোগ্রাফ।
মিনি পুরো খবরটা পড়ে বিস্তারিত চোখে পরাগব্রতর দিকে তাকাল।
“এর মানে?”
পরাগব্রত কাঁধ ঝাঁকাল। “পুরোটা বুঝতে পারছি না, কিন্তু বেশ কিছু দিন নিশ্চিন্ত থাকা যাবে বোধহয়। এই সিংজীই তো লিডার, না কি?”
মিনি তা জানে না। পরাগব্রত আবার জিজ্ঞেস করল, “আর এ-ই লক্ষ্মণই তো তোমাকে…?”
বাক্যটা শেষ করতে পারল না পরাগব্রত। মিনিও মুখে উত্তর দিল না। দূরের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল।
পরাগব্রত বলল, “ছ-মাস না হলেও, মাস দু-তিন এখানে গা-ঢাকা দিয়ে থাকা যায়। তার পর ভেবে দেখা যাবে।”
দু-মাস! আঁতকে উঠল মিনি। এইভাবে ভাইবোন সেজে… রোজ পুজো দিয়ে কাটাতে হবে?
পরাগব্রত হেসে ফেলল। একটু আগেও, যখন সিংজী আর লক্ষ্মণের মৃত্যুসংবাদ ওরা পায়নি, তখন তো ছ-মাসের কথায় এত আপত্তি হয়নি?
মিনি মাথা নাড়ল। “মোটেই তা নয়! আপত্তি সবসময়ই ছিল। তখন মনে হয়েছিল উপায় নেই, এখন তো জেনে গেছি যে ওরা আর নেই…”
“আপনারা এখানে! ওদিকে পুরুতমশাই এসে অপেক্ষা করছেন!”
বিশ্বম্ভর পানিগ্রাহীর গলায় সম্বিত ফিরল দুজনের। তাড়াতাড়ি কাগজ ভাঁজ করতে করতে উঠল মিনি। বলল, “এ বাবা, একেবারে খেয়াল ছিল না… আসলে…”
আসল-নকলের হিসেব নেবার সময় বা মানসিকতা নেই বিশ্বম্ভরের। বললেন, “চলুন, চলুন, তিথি থাকতে থাকতে পুজো আরম্ভ করতে হবে…”
বিশ্বম্ভরের পেছনে যেতে যেতে নিচুগলায় পরাগব্রত জিজ্ঞেস করল, “কী পুজো আবার?”
ততোধিক নিচুস্বরে মিনি বলল, “কী একটা পুজো করতে হবে আমাকে। মন্দিরে বলল অভিষেক।”
“বাড়িতে? মন্দিরে পুজো দিয়ে রক্ষা নেই…?”
“তোমার আর কী? তোমাকে তো নিরম্বু উপবাসে থাকতে হবে না?”
“নিরম্বু কী?” এত বাংলা জানে না পরাগব্রত।
“জল খাওয়াও বারণ!” কথাটা মিনি তামাশার সুরেই বলেছিল, কিন্তু বাড়িতে পুজো-আচ্চার ব্যাপারটাই পরাগব্রতর পছন্দ হয়নি। ঝাঁঝিয়ে কী বলতে যাচ্ছিল, সামনে থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে বিশ্বম্ভর বললেন, “তাড়াতাড়ি আসুন। তবু ভালো সত্যবতী ছিল, ও সব জোগাড় করে দিচ্ছে…”
যদিও বাড়ি খুব দূরে নয়, তবুও পা চালাল দুজনেই। এখন বিশ্বম্ভরের খুব কাছাকাছিই ওরা, চুপিচুপি জিজ্ঞেস করার উপায় নেই, তবু ফিসফিস করে জানতে চাইল, “সত্যবতী কে? ওর বউ?”
মিনির মনে হল বিশ্বম্ভর শুনতে পেয়েছেন। মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে ‘না’ বলল।
দোতলার ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। ভেতরে অভিষেক পুরুতমশাই পুজোর তোড়জোড় করছেন এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। দরজা ওরা তো বন্ধ করে গেছিল! তবে? বিশ্বম্ভরকে জিজ্ঞেসই করে বসল পরাগব্রত, “দরজা কি আপনি খুলে দিলেন?”
বিশ্বম্ভর ওদের দরজার গডরেজ লক-এর একটাই চাবি দিয়েছেন। বলেছিলেন অন্যটা এমার্জেন্সি ছাড়া ব্যবহার হবে না। এখন বিশ্বম্ভরের কথা শুনে বোঝা গেল এটাও এমার্জেন্সি।
“কী করি বলুন? ঠাকুরমশাই পুজোর সব সরঞ্জাম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাই তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়ে আমি আপনাদের খুঁজতে গেলাম।”
ওরা বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল একটা মেয়ে — বয়সে পরাগব্রত আর মিনির মাঝামাঝি। কিছু না বলে পরাগব্রতকে হাতজোড় করে নমস্কার করল। বিশ্বম্ভর পরিচয় দিলেন, “সত্যবতী। আমার বোন।”
পরাগব্রতর ঘরে আসবাব নেই। দু-ঘরে ভাইবোনের শোবার বন্দোবস্ত রয়েছে কেবল। শীতলপাটির ওপর ওর
বিছানাটা দেওয়ালের পাশে গোটানো। বন্ধ দরজার ওপরে এমনই আর একটা বিছানা রয়েছে। সেটা গোছানো নেই। বাইরের লোকে দেখলে সন্দেহ করতে পারে। পরাগব্রত তাড়াতাড়ি নিজের বিছানাটা টেনে দরজা খুলে মিনির ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিচের মাদুরটা কেবল বের করে আনল। পুজো আরম্ভ হয়ে গেছে, বিছানো মাদুরের ওপর বসতে বসতে বিশ্বম্ভর নিচু গলায় বললেন, “কিছু ফার্নিচার তো কিনতেই হবে, নাড়ুগোপালবাবু… দু-চারটে চেয়ার, একটা টেবিল… নইলে কেউ এলে-টেলে… বসাবেন, খাওয়াবেনই বা কোথায়?”
পুরীতে এসে তীর্থ করার ভেক ওদের। লোকজন ডেকে এনে সামাজিকতার অভ্যেস বজায় রাখার নয়। এমনিতেও পরাগব্রত কোনও দিনই খুব সামাজিক ছিল না। ওর পালকপিতা ভুবনব্রত মুখার্জির পরিবারের কেউই ছিল না। পালপার্বণে, পুজোয়, এমনকি শহর দেখতে এসেও তাদের কোনও আত্মীয়-বন্ধু কখনও এসে থেকেছে বলে ওর মনে পড়ে না। কালেভদ্রে কোনও বিয়ে, অন্নপ্রাশন, পৈতে বা শ্রাদ্ধের কার্ড হাতে কেউ আসলেও তারা থাকেনি বেশিক্ষণ। শুকনো চা-বিস্কুটে আপ্যায়িত হয়ে ফিরে গেছে। সে সব সময়ে ওর মা কখনও দোতলা থেকে একতলায় নামেনি। ছোটোবেলায় পরাগব্রত যেত, কিন্তু বুঝতে পারত ওকে নিয়ে ওর পালক-মা বিব্রত হচ্ছেন। কেউ না থাকলে বড়ো-মা যতটাই আদরে ভালোবাসায় ওকে জড়িয়ে রাখতেন, বাইরের লোক, বিশেষত আত্মীয়-স্বজন থাকলে ততোধিক অস্বস্তিতে পড়তেন। কখনও কোনও নেমন্তন্ন বাড়িতে মুখরক্ষা করতে গেলেও ওকে, বা ওর মা-কে নিয়ে যেতেন না। সেটা বোঝার পর থেকে কেউ আসলে পরাগব্রতও দোতলা থেকে নামত না। ভুবনব্রতবাবু আর দীপব্রত তো অসামাজিকের পরাকাষ্ঠা! বয়স একটু বাড়তে না বাড়তেই বাবার মতো দীপব্রতও যাব-না, বলে ঘরে ঢুকে পড়ত। বড়ো-মা কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে হয় একাই যেতেন, নয়ত বিয়েবাড়িতে উপহার বা শ্রাদ্ধে ফুল পাঠিয়ে ক্ষান্ত দিতেন।
মাদুরে বসতে না বসতেই সত্যবতী এসে বিশ্বম্ভর আর ওর হাতে দু-কাপ চা দিল। দুটোই কাপ কিনেছিল কাল পরাগব্রত। কিন্তু চা এল কোত্থেকে? ও তো কফি এনেছিল, মিনির ইচ্ছায়! তার ওপর এ চা খুব তরিবৎ করে আদা, লবঙ্গ, এলাচ দিয়ে বানানো।
পাশ থেকে বিশ্বম্ভর বলছেন, “রান্নাঘরে তো কিছুই নেই! তাই ছেলেকে পাঠিয়ে চট করে কিছু আনিয়ে রাখলাম।”
পকেট থেকে একটা দাম-লেখা ফর্দ বের করে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, “তাড়া নেই। সুবিধেমতো দেবেন।”
পরাগব্রতও কাগজটা নিজের পকেটে চালান করে দিল কী লেখা আছে না দেখেই। বিরক্তি বাড়ছে। গায়ে-পড়া, না অধিকারবোধ, না কি অত্যাচার? কাপে শেষ চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখতে না রাখতেই সত্যবতী এসে তুলে নিয়ে গেল। সামনে অভিষেক হুম্-হুম্ শব্দে মন্ত্র পড়ছে। মিনি কি দেখতে পাচ্ছে কী হচ্ছে এ পাশে? অ্যাত্তোবড়ো ঘোমটা টেনে বসে আছে। পরাগব্রত হুটহাট প্ল্যান করা পছন্দ করে না। একটু না ভাবলে চারদিক সামলানো যায় না। হঠাৎ মিনি আমোদপুরে এসে পড়ায় থতমত খেয়ে ওকে মামাতো বোন বলে পরিচয় দিয়েছিল বটে, কিন্তু তারপর ওটাকেই টেনে টেনে বিধবার গল্প না বানালেই চলত না? মামার জন্য পুজো দিতেও তো আসতে পারত ভাইবোনে? সব হিজিবিজি হয়ে গেছে।
আবার রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে সত্যবতী। দাদার কানে কানে কিছু একটা বলতেই বিশ্বম্ভর উঠে ভেতরে চলে গেলেন। শালারা বাড়িটা নিজেদের বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে! বিশ্বম্ভর আবার বেরিয়ে এসেছেন; হাত নেড়ে ডাকছেন পরাগব্রতকে। বিরক্তি লুকোতে লুকোতে পরাগব্রত রান্নাঘরে ঢোকামাত্র ওর হাতে একটা পাতার প্লেট ধরিয়ে দিল সত্যবতী। তাতে দুটো লুচি আর কালোজিরে দেওয়া সাদা আলুর তরকারি। বিশ্বম্ভর বলছেন, “একটু খেয়ে নিন। কখন পুজো শেষ হবে, তার তো ঠিক নেই।” সকালে কিছু খাওয়ার সময় পায়নি। বেরোবার সময় পরাগব্রত বলেওছিল ফেরার পথে কিছু খেয়ে আসবে। বাড়িতে এই পুজোর ফলে সেটা হয়নি। পরাগব্রত বুঝতে পারল কী ভয়ানক খিদে পেয়েছে। দ্বিরুক্তি না করে একটু গরম লুচি ছিঁড়ে নিয়ে আলুর তরকারির সঙ্গে মুখে দিয়েই চমকে উঠল।
কতদিন এত ভালো রান্না খায়নি পরাগব্রত? সেই এক সময় ছিল যখন দীপব্রত আর পরাগব্রতর খাবার টেবিলে এমন মেনু থাকত, যা অনায়াসে যে কোনও রাজা মহারাজাকে খাওয়ানো যেত। তারপর কোভিড লকডাউনে সেই যে রান্নার লোক সুব্রতকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল ওরা, সেই থেকে ভালো রান্না কাকে বলে ভুলেই গেছে পরাগব্রত। প্রথমে মিনি রান্না করত। সে এমনই অখাদ্য, যে মিনি নিজেও অনেক সময় খেতে পারত না। তারপর, ধীরে ধীরে লকডাউন আলগা হওয়ায় ওরা খাবার আনাত সুইগি বা জোম্যাটোকে দিয়ে। দীপব্রতর মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যে পরাগব্রত বাড়ি ছেড়ে যেখানে থাকতে গেছিল, সেখানে বাইরের খাবারের সঙ্গে নিজেও রান্না করা শুরু করেছিল। আমোদপুরে খাবার আনিয়ে খাওয়া যাবে না জানত পরাগব্রত। লকডাউনের শেষে, যখন জেরক্সের দোকান খুলে আমোদপুরে গিয়ে থাকতে শুরু করেছিল, ততদিনে ও খুব ভালো না হলেও খাবার মতো রান্না করে। তবে এ রকম অসাধারণ রান্না তা নয়।
হঠাৎ খেয়াল হল সত্যবতী আর বিশ্বম্ভর দুজনেই যেন খুব অধীর আগ্রহে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বিশ্বম্ভর বললেন, “ঠিক আছে?”
পরাগব্রত কিছু চিন্তা না করেই বলতে শুরু করেছিল, “খুব ভালো রান্না… এ রকম…” ওর কথা শেষ হবার আগেই সত্যবতী একরকম লজ্জায় লাল হয়ে প্রায় ঠেলেঠুলেই বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। বিশ্বম্ভর বললেন, “ওর বানানো। বোনটা আমার খুবই ভালো। ঘরকন্নার কাজে জুড়ি নেই। এবার ভালো একটা ছেলে পেয়ে পাত্রস্থ করতে পারলেই আমার স্বর্গবাসী মা-বাবা শান্তি পাবেন।”
পরাগব্রত খাওয়া শেষ করে থালা নামিয়ে বাইরের ঘরে ফিরে গেল। সত্যবতী তখন মাদুরের ওপর বসে দুই হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে একমনে পুজো দেখছে।
পুজো শেষ করে চা-লুচি খেয়ে অভিষেক বেরিয়ে গেলেন, তখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা। মিনিও লুচি তরকারি খেল, বিশ্বম্ভর-ও। বাড়তি দুটো লুচি পরাগব্রতকে, “আরে খেয়ে নিন, না হয় দুপুরে একটু কম খাবেন…” বলে বিশ্বম্ভর খাইয়ে দিলেন; বিশ্বম্ভরের, “কিন্তু দুপুরে আপনারা খাবেন কী? বাড়িতে তো কোনও ব্যবস্থাই নেই”-এর উত্তরে পরাগব্রত ওদের, “আমাদের কিছু কাজ আছে… বাড়ি থেকে বাবা কিছু মালপত্র পাঠাচ্ছেন, সেগুলোর জন্য একবার ট্রান্সপোর্ট কম্পানির ওখানে…” বলে ওদের বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করে মিনির দিকে তাকিয়ে চাপা তর্জনে ফেটে পড়ল।
“এর মানে কী? আমরা বাড়ি নেই, সেই সময়ে ঘরে তালা খুলে ঢুকে…”
মিনিও চটেছিল। কিন্তু সেইসঙ্গে ওর চোখে খেলছিল কৌতুক। বলল, “আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারোনি তো? আমিও প্রথমে বুঝিনি। তারপর খেয়াল হল। তুমি হলে সত্যবতীর সম্ভাব্য পাত্র। প্রসপেক্টিভ গ্রুম। বুঝলে?”
“আরে ধ্যাত্!” আপত্তি জানাল পরাগব্রত। “চেনা নেই, জানা নেই — এভাবে কেউ বিয়ের কথা ভাবে? মেয়েটা তো কানা-খোঁড়া-অসুন্দর নয়…”
“অসুন্দর নয়? অসুন্দর নয়? তাকাওনি নাকি ওর দিকে, না কি ন্যাকামি করছ?”
“ন্যাকামি করব কেন? বেশ ভালো দেখতে…”
“আজ্ঞে তা-ও নয়। রীতিমতো সুন্দরী।”
“হ্যাঁ। তা-ই বলছি। সুন্দরী; দাদা বলে গেল ঘরকন্নার কাজে ওস্তাদ… পড়াশোনাও নিশ্চয়ই জানে?”
এবারে মাথা নাড়ল মিনি। “না। পড়াশোনা হয়নি। স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি।”
সে কী! অবাক হল পরাগব্রত। “আজকালকার দিনে? অত ব্যাকওয়ার্ড তো মনে হল না?”
“না,” বলল মিনি। “সমস্যাটা সেখানেই। কথা বলতে শোনোনি নিশ্চয়ই?”
মাথা নাড়ল পরাগব্রত। কেবল ফিসফিস-ই করেছিল দাদার কানে কানে।
“ওটাই সমস্যা। সাংঘাতিক তোতলা। কথাই বলতে পারে না। একটা সেন্টেন্স্ বলতেই কয়েক মিনিট লাগে। অনেক চিকিৎসা হয়েছে, শেষে কেবলমাত্র একটাই পদ্ধতি কাজে লেগেছে। ফিসফিস করে কথা বললে নাকি তেমন তোতলায় না। সে যা-ই হোক, ছোটোবেলা থেকে তোতলা বলে এতই কথা শুনতে হয়েছে, আর বাচ্চা-বুড়ো সবাই এমন পেছনে লেগেছে, যে স্কুলে যাওয়াই বন্ধ হয়ে গেছিল। অতি কষ্টে হোম-স্কুলিং করিয়েছে মা-বাবা। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারেনি।”
“তাই বলে গতকাল সকালেই যার সঙ্গে পরিচয় হল…”
“ওদের এখন দেওয়ালে পিঠ। বয়েস তো বসে নেই। এখন অবিবাহিত পুরুষ দেখলেই বিয়ের কথা ভাবে। কাল তুমি যতক্ষণ বাইরের ঘরে কথা বলছ, ততক্ষণ আমার জেরা চলছিল ভেতরে। আমি প্রথমে ভেবেছি, বাড়িওয়ালা ভাড়াটের পরীক্ষা নিচ্ছে। তারপর দেখি, না। তোমার কথাই বেশি। কী করো, পড়াশোনা কতদূর… কেন বিয়ে করনি… তারপর এল সত্যবতী, তারপর ওর কথা বলা এবং পাত্র পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা।”
পরাগব্রত নিজের ভেতর কোথাও যেন অনুভব করতে পারল মেয়েটার অসহায় অবস্থাটা। বলল, “বেচারা।”
“সত্যি বেচারা। ভেবে দেখো। পাত্রী হিসেবে খারাপ না। তুমি তো এখন আর পরাগব্রত নও। লুঙ্গি মার্কা ধুতি ফতুয়া পরা নাড়ুগোপাল। একেবারে রাজযোটক!”
দিন দুয়েক হল পরাগব্রতর মনে সংসারী হওয়ার একটা চিন্তা কোথা থেকে যেন ঘুরপাক খেতে আরম্ভ করেছে। মন্দ কী? বাকি জীবনটা — তা যতদিনই বাকি থাকুক — মিনির সঙ্গে কাটানো? ভোরবেলা চোখ খুলে মিনির ঘুমন্ত মুখটা পাশে দেখে ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে খারাপ লাগেনি। তারপর কোনও একদিন রিটায়ার্ড শ্বশুরের ড্রয়িং রুমে বসে আরাম করে শ্বশুরের বিলিতি হুইস্কি? একটা বা দুটো ছেলে-মেয়ে? না, অতদূর যাওয়া সম্ভব নয়। হীরে স্মাগলাররা কবে হাজির হবে… তাড়াতাড়ি তাই চোখ পাকিয়ে বলল, “চুপ।”
মিনি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “মন্দ হত না — ভেবে দেখো — একদম শান্ত, মুখচোরা বউ হবে, চেঁচামেচি করে ঝগড়া করতে পারবে না।”
পরাগব্রত মিনির দিকে তাকিয়ে বলল, “চেঁচামেচি ঝগড়াঝাঁটি করলে তোমারও মুখ বেঁধে রেখে দেব, ব্যাস!”
মিনি ভেতরের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল। পরাগব্রতর কথাটা বুঝতে একটু সময় নিল। তারপর থমকে ঘুরে দাঁড়াল। পরাগব্রত তখনও মিনির দিকে তাকিয়ে। মিনি বলল, “সত্যি?” দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে পরাগব্রতর জামার বুকের কাছটা খামচে ধরে বলল প্রায় চেঁচিয়ে বলল, “সত্যি?”
পরাগব্রত আস্তে আস্তে মিনিকে টেনে নিল কাছে। দু-দিন আগে থেকে ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলো এক এক করে খালি করেছে। ওর যে ব্যাগটা নিয়ে আমোদপুর ছেড়ে এসেছিল, তাতে পরাগব্রত আর নাড়ুগোপাল চক্রবর্তী ছাড়াও আর একজনের আধার আর প্যান কার্ড আছে। তার নাম তীর্থঙ্করপ্রসাদ দাশ। তার সঙ্গে পরাগব্রত বা নাড়ুগোপালের কোনও সম্পর্ক নেই। নাড়ুগোপালের আধার কার্ড বানানোর সময় নামটা পরাগব্রত একেবারে আকাশ থেকেই প্রায় পেড়ে এনেছিল। বাড়ির ঠিকানাটা পেয়েছিল ইন্টারনেট থেকে। জলপাইগুড়ি শহরের একটা ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্রের দোকান। আজ নাড়ুগোপালের কোনও অ্যাকাউন্টে কোনও টাকা নেই। বস্তুত, নাড়ুগোপাল চক্রবর্তীর কোনও অ্যাকাউন্টই আর নেই কোথাও। সবই জিরো ব্যালেনস করে অনলাইনেই অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করে দিয়েছে পরাগব্রত।
নতুন নামটা মিনিকে না জানালেও চলবে। নাড়ুগোপাল আর পরাগব্রত — এই দুটো নাম দিয়েই মিনি চালাক যতদিন সম্ভব। কিন্তু পরাগব্রতকে আরও কিছু আধার কার্ড তৈরি করতে হবে। যে রকম উল্কার গতিতে স্মাগলাররা ওর নাড়ুগোপালের সব খবর বের করে ফেলেছে, তাতে আরও কয়েকটা আধার কার্ড হাতে থাকা ভালো। তার জন্য যেতে হবে…
মিনি বলছে, “আমরা তো বিবাহিত দম্পতি হয়ে এখানে থাকতে পারব না — পুরী ছেড়ে যেতে হবে।”
পরাগব্রত বলল, “ইন্দোর।”
অবাক হয়ে মিনি বলল, “ইন্দোর? ইন্দোর কেন?”
“নয় কেন?” জানতে চাইল পরাগব্রত। “কাল ভোরবেলা বেরোলে সাতটার মধ্যে ভুবনেশ্বর, ন-টা চল্লিশের ফ্লাইটে দিল্লি। ঘণ্টা দুয়েক লাগবে নতুন করে বাজার করার জন্য? তারপর বিকেলে চারটে কুড়ির ফ্লাইট ধরে ইন্দোর। সেখানে মিঃ অ্যান্ড মিসেস পরিচয়েই না হয় শুরু করা যাবে?”
রাতে শুতে যাবার পরে মিনির টাকাভর্তি সুটকেস, আর নিজের ফোলিও ব্যাগটা মাথার কাছেই রাখল পরাগব্রত। কাল আর কিছু নিয়ে বেরোবে না। সকালে যদি অত্যুৎসাহী বাড়িওয়ালা বা তার বোন তালা খুলে ঢোকে-ও, ভাববে ভাই-বোন মন্দিরেই গেছে। শোবার আগে ফোলিও ব্যাগের ভেতরে হাত বুলিয়ে একটা জিপ লাগানো পকেটে প্লাস্টিক জিপ্লক ব্যাগে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের মধ্যে, কাগজের মোড়কটা হাত দিয়ে অনুভব করল পরাগব্রত। ক্রিস্টালগুলো আপাতত কাজে লাগছে না। পরে দেখা যাবে। হয়ত ইন্দোরে… হয়ত বা তারও পরে, অন্য কোথাও… কে জানে…
~উপসংহার~
নিজের বাড়িতে বড়ো টেবিলের চারদিকে বসা সকলের দিকে তাকিয়ে রবিবাবু ডানহাতে টেবিল চাপড়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলেন।
“হামারা সব কাজ-কাম জো বাকি হ্যায় উসমে সবচে’ জরুরি হ্যায় ওই শুয়োরের বাচ্চা ভুবনব্রত কা হারামি কা ঔলাদ পরাগব্রত কো ঢুন্ডকে নিকালনা। আগের বার জলদিবাজি কিয়া বোলকে শালা ভাগ জানেকা সুযোগ পায়া, কিন্তু এবার সাবধানি সে করনা পড়েগা। সত্যজিৎ উসকা নাড়ুগোপাল নামকা আধার কার্ড কা নম্বর পা গিয়া। প্রভাতজী, আপনার ওই ব্যাঙ্কের আদমিটা ইসসে উসকা নয়া ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টকা খোঁজ পায়েগা না? ভেরি গুড, তব চালু হো যাও।”
শেষ
সম্পূর্ণ কাহিনি একসঙ্গে পড়ার জন্য —
THOUGHTSANIDEB.BLOGSPOT.COM
প্রাপ্তি