১.
– কী গো মা, বাচ্চা ভালো খাচ্ছে তো?
মায়ের বয়স মেরেকেটে বাইশ-তেইশ। লিকলিকে রোগা। চোখে-মুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। দু’বার জিজ্ঞেস করার পর খুব মিনমিনে গলায় উত্তর দিল, ‘হ্যা’। বলে আলতো করে ঘাড় নাড়লো। আর কোনও কথা নেই। ওই একটিমাত্র ‘হ্যা’ বলে অপরাধীর মতো নখ খুঁটতে লাগলো মেয়েটা। ততক্ষণে বাচ্চা কাঁদতে শুরু করেছে। স্পষ্টতই সেটা খিদের কান্না। তবু মায়ের যেন হুঁশ নেই। খানিকটা অবাক হলাম। এই কান্না শোনার পরে কোনও মায়ের পক্ষেই চুপ করে বসে থাকা সম্ভব নয়। হঠাৎ পাশ থেকে তাঁতের শাড়ির খসখসে আওয়াজ। একটা অদ্ভুত খোনা অথচ চেরা গলা পাওয়া গেল-
– কী রে বল… বল না গব্বের কথা! এর আগে দু’টা ঝি। ইবার তিনটা লিয়্যা কীত্তন করবি বলে দে…
– তুমি কে?
– কে আর? ভাগ্যগুণে এরকম বৌ পেছলি…
– বেরিয়ে যাও। এক্ষুনি বেরোও এখান থেকে। বাইরে দাঁড়াও, তোমার সাথে কথা আছে।
– তিনটা ঝি লিয়্যা…
– আমি বেরোতে বলে দিয়েছি। আর এক মুহূর্ত যেন এখানে না দেখি… আর শোনো, মেয়ে হওয়া নিয়ে আর কোনোদিন খোঁটা দিলে তোমার বাড়িশুদ্ধ লোককে পুলিশে দেবো।
ততক্ষণে বাচ্চা আর বাচ্চার মা দুজনেই কাঁদছে। একজন খিদের চোটে, অন্যজন অপমানের খোঁচায়। বাচ্চা মেয়েটা কী ফুটফুটে! এই বাচ্চাকে দেখে পাথরেরও মন গলতে বাধ্য!
– তুমি একদম কেঁদো না মা। বাচ্চাটাকে বুকে ধরো। ওদের কথায় একদম মন খারাপ কোরো না। এই মেয়েই তোমার লক্ষ্মী হবে দেখো… ওকে ভালো পড়াশোনা করাও। ও অনেক বড় হবে…
– ঝি হলে মোর কী দোষ বল ত ডাক্তারবাবু… অরা দিনরাত মোকে যা নয় তাই বলে।
– ওদের সাথে আমি কথা বলবো। তুমি বাচ্চাটাকে কোলে নাও তো দেখি…
বাইরে এসে শাশুড়িকে তেড়ে গালাগালি করেছিলাম…
– মেয়ে হওয়া কি দোষ নাকি? তোমাদের মতো মাথামোটাদের জন্যই আজ দেশের এই অবস্থা। আর শোনো, যদি তর্কের খাতিরে মেয়ে হওয়াকে ‘দোষ’ বলে ধরেও নিই, তাহলে সেই ‘দোষ’টা বাচ্চার মায়ের নয়। তোমার গুণধর ছেলের। সে ‘ছেলে হওয়ার জিন’ দিতে পারে নি।
শেষ কয়েকটা কথা শুনে হয়তো বিশুদ্ধবাদীরা হাঁ হাঁ করে উঠবেন। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রাম্য এলাকায় নিক্তিমেপে কথা বললে চলে না। সে সব থাক… বিশেষত পুলিশে ধরানোর ভয় দেখাতে দজ্জাল বুড়ি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেছিল। ওদিকে বাচ্চার বাবার মুখও কাঁচুমাচু।
চিৎকার-চেঁচামেচি সেরে ঘামতে ঘামতে যখন ওয়ার্ডে ফিরে এলাম ততক্ষণে ফুলের মতো বাচ্চাটা মায়ের বুকের দুধ খেয়ে শান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে!
২.
– শ্বাসকষ্ট সাংঘাতিক। নাড়ির অবস্থাও খুব ভালো বুঝছি না মা। খুব ভয়ের ব্যাপার।
– আপনি যা হোক কিছু চেষ্টা করুন ডাক্তারবাবু…
– আমাদের হাতে যদ্দুর ক্ষমতা… দেখা যাক! তবে বাঁচানো যাবে কিনা বলা মুশকিল।
– আজ তিনদিন জ্বর বাবু। আগে থেকে নিয়ে এলে হয়তো বাচ্চাটা…
কান্নায় ভেঙে পড়লেন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। আমাদের এসব ইমোশনে গলে গেলে চলে না। মারী আর মৃত্যুর সাথে সংসার। নির্বিকার গলায় বলি-
– বাচ্চার বাবা কই? ক’টা সই করতে হবে।
– তার কথা আর বলবেন নি ডাক্তারবাবু। সে এখন ইয়ার-বক্সি নিয়ে মদ আর তাসের নেশায় মত্ত।
– বাচ্চার এই অবস্থা, আর সে…
– বাচ্চাটা যে মেয়ে! ওদের কাছে তার মূল্য নেই।
৩.
– এর আগে বাচ্চা আছে?
– হ্যা, হ্যা। দুটা মেয়াঝির পরে ইটা ব্যাটাছ্যানা।
‘দুটা মেয়াঝি’ আর ‘ইটা ব্যাটাছ্যানা’ উচ্চারণের মধ্যে স্বরক্ষেপণের তফাত স্পষ্ট।
– আমি শুধু বাচ্চা আছে কিনা জিজ্ঞেস করেছি। যতটুকু জানতে চাইবো ঠিক ততটুকু উত্তর দেবে। আর শোনো, ‘ব্যাটাছ্যানা’ হওয়ার জন্য ধেই ধেই করে নাচার কিচ্ছু নেই। বাচ্চার মা কোথায়?
– নেই।
– নেই মানে?
– বাচ্চা হতে গিয়ে রক্ত বের হয়্যা মরেইছ্যা।
– মারা গেছে? কোন হাসপাতালে? দেখি, কাগজগুলো বের করো তো… পোলিও কার্ডটা দাও।
– না… মানে… বাচ্চা ত ঘরে হছ্যা।
– ঘরে হয়েছে মানে? ইয়ার্কি পেয়েছো নাকি? হাসপাতালে যাও নি কেন?
– পথম দু’বার ত হাসপাতালে গেছলি। দু’বারেই মেয়াঝি। ইবার মোদের মৌলবির কাছে ফুঁক করিয়া ব্যাটাছ্যানা হছ্যা।
– ওইসব গাধাপনা করেই তো এই কান্ড। তা বাচ্চার মা যে মারা গেল তোমার মৌলবি তার দায়িত্ব নেবে? বাচ্চা পেটে থাকতে হাসপাতালে দেখাতে?
– মোদেরকে ত বলছল বাইরের হাওয়া না লাগাইতে। অতে নজর লেগে যাবে।
এর পরে আর কিছু বলার থাকে না। কন্যাভ্রূণ হত্যা আজও এদেশে রমরমিয়ে চলে। পুত্রসন্তান হ’লে সাতদিন ব্যাপী হরিনাম সংকীর্তন, পাড়া ডেকে মোচ্ছব, মিষ্টি বিতরণ। কন্যাসন্তানের বেলা সবার মুখ গোমড়া। আর একটা ঘটনা দিয়ে এই লেখা শেষ করবো-
যমজ সন্তানের একটি ছেলে, একটি মেয়ে। মা দু’জনকে খাইয়ে উঠতে পারে না। অতয়েব বাড়ির মুরুব্বিদের পরামর্শে ছেলেকে প্যাকেটের দুধ খাওয়ানো শুরু হয়। আহা, কারণ বুঝলেন না? ছেলেটা হীরেমাণিক। তাই তার জন্য পয়সা দিয়ে কেনা দামী দুধ। মেয়েটা যেহেতু এলেবেলে তাই তার ওই ‘বিনি পয়সার বুকের দুধ’ খেলেই চলবে। ফলাফল ক’দিন বাদেই বোঝা গেল। প্যাকেটের দুধ খাওয়া হীরেমাণিকের রক্তে ইনফেকশন। পেট ফুলে জয়ঢাক। বাঁচানো যায় নি। অথচ এলেবেলে মেয়ে অবজ্ঞার আশীর্বাদ পেয়ে দিব্যি বেড়ে উঠেছে!
এ অতিমারীর কাল জীবনযাত্রার অনেককিছু বদলে দিয়েছে কিন্তু কন্যাসন্তানের প্রতি সামাজিক অবহেলা বদলায় নি। জন্মের পর থেকেই তাদের জন্য বেঁচে থাকার লড়াইটা অনেক কঠিন। লাব-ডুবের ছন্দে আর মুষ্টিবদ্ধ হাতের প্রত্যয়ে তাদের নিজেদেরই উচ্চারণ করে যেতে হয়, “ফাইট কোনি, ফাইট!”
দারুন দারুন