সন্ধ্যাবেলায় কাজকর্ম, রোগী দেখা শেষ করে আমার স্ত্রী বাজারে গেছেন তরিতরকারি আর মাছ কিনতে। তিনিও ডাক্তার। শিশু চিকিৎসক। সব্জীর দোকানে সব্জী কিনছেন।
– ম্যাডাম, আপনিও বাজার করেন?!!!
– হ্যাঁ। আমি খাইও, জানেন!
প্রশ্ন কর্ত্রী খুব হতাশ হলেন। তিনি বোধহয় ভেবেছিলেন চিকিৎসকরা শুধুমাত্র রোগীর চিকিৎসা করেন। মাঝেমধ্যে প্রয়োজনে একটু-আধটু পড়াশোনা করতে পারেন। তবে বাকি কোনো শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া তাদের হয় না। তাদের রোগব্যাধি হয় না। খিদে বা ঘুম ও পায় না। এই রকমই মনে করেন অধিকাংশ সাধারণ মানুষ।
– আপনারও জ্বর হয়! তাহলে আমাদের কি হবে, ডাক্তারবাবু !
আর আমরা, চিকিৎসকরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লোকের এই মনোভাবে উস্কানি দিই।
– ডাক্তার বাবু, আপনি ভগবান।
– ভগবানের পরেই আপনি।
– ডাক্তার বাবু, আপনি সবই পারেন।
– হাসপাতাল, নার্সিংহোম আমি জানি না। আমি আপনাকে চিনি।
– ভেলোর-চেন্নাই সব ঘুরে এসেছি। কিছু করতে পারবে না বলে দিয়েছে। এখন আপনি শেষ ভরসা।
ডাক্তাররা, বিশেষতঃ প্র্যাকটিসিং ডাক্তাররা, নিয়মিত এই কথাগুলো শুনে থাকেন। এই কথাগুলো যে সবসময় অভিসন্ধি মূলক তা একেবারেই নয়। বরং এগুলো ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ানোর প্রচেষ্টা।
ভারতবর্ষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চিরকালই অসংগঠিত এবং অবহেলিত। স্বাস্থ্যব্যবস্থা মানে তো শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থা নয়। স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলতে পরিশ্রুত পানীয় জল, সুষম ও রোগজীবাণুমুক্ত খাদ্য, স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশ, রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাও বোঝায়। কোটি কোটি মানুষ এই চুড়ান্ত অব্যবস্থায় বসবাস করে। আপদে- বিপদে তাদের পাশে থাকার জন্য না আছে শাসক, না আছে আমলা। তাই সাধারণ মানুষ এমন কাউকে খোঁজে যাকে সে বিপদে-আপদে, অসুখে-শোকে আঁকড়াতে পারে। সেই এমন কেউ হল চিকিৎসক। কারণ সে হল চিকিৎসা ব্যবস্থার মুখ। তার চার দিকে অক্টোপাসের হাজার হাতের মতো পরজীবীর দল যে সমাজের রক্ত চুষে চলেছে সেটা বেশীরভাগ মানুষই উপলব্ধি করে না। আর তাই চিকিৎসা ব্যবস্থার দোষের দায়িত্ব বা গুণের কৃতিত্ব সব ডাক্তারের।
এই গুণের কৃতিত্ব নিতে গিয়ে কিছু কিছু চিকিৎসক নিজেদের ঈশ্বরের সমকক্ষ ভেবে নিজেদের উচ্চ বেদীতে বসিয়ে ফেলেছেন।
– আমার এত বছরের অভিজ্ঞতায় এটা বলছি।
– আমি বলছি, হচ্ছে না? বই বা জার্নালে আর বেশী কি লিখবে!
এক অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান একসময় তাঁর স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করতে যেতে দিতেন না, পাছে ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাঁর নিজের গুরুত্ব কমে যায়! এক বিখ্যাত চিকিৎসক অন্য রাজ্যে সন্মেলনে বক্তৃতা দিতে উঠেছেন। নবীন শ্রোতারদের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘ বই তে এমন কি আর লেখা আছে? আমার এত দিনের অভিজ্ঞতা। আমি যা বলছি সেটাই ঠিক।’
‘এভিডেন্স বেসড্ মেডিসিন’ নয়। শুধু আমি, আমি, আমি! প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে সার্জারির ন্যূনতম পরিকাঠামো নেই সেখানে ‘তিন কিলো ওজনের টিউমার বাদ দেওয়া’ বা গল-ব্লাডার সার্জারির মত ‘তাৎক্ষণিক জরুরী নয়’ এমন পরিষেবা দিয়ে সফল হয়ে গেলে হাততালি কুড়োনো যায় ও সংবাদ মাধ্যমে প্রচার পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু এতে নিজেকে এবং গোটা ডাক্তার সমাজকে অস্বাভাবিক উচ্চ বেদীতে প্রতিষ্ঠা করা হয়ে যায়। এতে ডাক্তার এক সমাজ বিচ্ছিন্ন, ভগবান সুলভ প্রাণীতে পরিণত হয়। এর অনেক বিপদ। সাধারণ মানুষ সব ডাক্তারের কাছেই সবসময় ওই ধরণের অলৌকিক কাজ ও ফলাফল আশা করে।
স্বাভাবিক ভাবেই সবসময় সেটা পাওয়া যায় না। আর পাওয়া না গেলেই ভুল বোঝাবুঝি, অশান্তি, মারামারি।
ডাক্তাররা চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি অংশমাত্র। যে ব্যবস্থাটা প্রায় কখনই তারা নিয়ন্ত্রণ করে না। সরকারের স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের মাত্র এক শতাংশ কেন? সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো, ওষুধ, যন্ত্রপাতি নেই কেন? কেন বেসরকারি হাসপাতালে এত বেশী খরচ?- তার জবাব তো ডাক্তারের দেওয়ার কথা নয়!
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সব ঘাটতি, খামতি ঢেকে দিয়ে দু-একটা বীরত্বপূর্ণ কাজকর্ম করে প্রচারের আলো নিজের দিকে টেনে নিতে যাওয়া খুব বিপজ্জনক প্রবণতা। সরকার, সিদ্ধান্তগ্রহণকারী রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ভুল, দূর্নীতি ও অনৈতিক কাজের ফলে রোগীদের কষ্ট ও ভোগান্তি-র জন্য রোগীর আত্মীয় ও সাধারণ মানুষ প্রশাসন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে দায়ী না করে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা পেশাকে দায়ী করে। এক্ষেত্রে হয়ত আত্ম-প্রচারকারী একজন চিকিৎসকের কাজের জন্য ভুক্তভোগী হয় আরেকজন সৎ, আন্তরিক ও মানবিক চিকিৎসক।
চিকিৎসা পেশায় জড়িত মানুষেরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে কাজ করে। এদের এক বিরাট অংশ সরাসরি রোগের চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত। সাধারণ মানুষ এদেরই একমাত্র ‘দেখতে’ পায়। এছাড়াও অনেক চিকিৎসক রোগ নির্ণয়, রোগ প্রতিরোধ, রোগের সংখ্যাতত্ব ও রোগ সংক্রান্ত গবেষণার কাজ করে। এদেরকে মানুষ ‘দেখতে’ পায় না। কারণ এদের সঙ্গে মানুষের সরাসরি যোগাযোগ থাকে না অথবা সাধারণতঃ এরা প্রচারেও আসেন না। এদের চটজলদি বীরত্ব প্রকাশ করে কৃতিত্ব নেওয়ার সুযোগ নেই। অথচ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এরা নীরবে অনেক প্রশংসনীয় কাজ করেন। যেহেতু প্রচার নেই তাই ডেঙ্গু বা এনকেফেলাইটিস এর মহামারী-র জন্য ওই সংক্রান্ত গবেষকদের কেউ মারতেও যায় না।
সাধারণ মানুষ যাদের ‘দেখতে’ পায়, সেই সমস্ত চিকিৎসককে-ই মানুষ বিপদে তলিয়ে যাওয়ার মূহুর্তে খড়কুটো হিসেবে আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করে। সফল হলে তারা চিকিৎসককে বীরের উচ্চ আসনে বসিয়ে পূজো করে। আর সফল না হলেই চায় ডাক্তার কে হত্যা করতে, নয়তো খাদে ঠেলে ফেলে দিতে। আমাদের দেশ ব্যক্তিপুজো, বীরপুজো করা দেশ। সেই সুযোগে সরকার ও প্রশাসন নিজেদের অক্ষমতাকে আড়াল করতে, জনসাধারণের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চিকিৎসা পেশাকে বলির পাঁঠা বানায়। চিকিৎসকরাও বুঝে বা না বুঝে মাথা এগিয়ে দিয়ে বসে থাকে।
বাহ বেশ লিখেছিস। সুজয়দা। Dr. Sujoy Maitra
Can’t agree more
Fatafati
Agreed.
Excellent
Darun sir..
বাস্তব
Khub sotti kotha. Bhalo laglo
নিজের কাজ নীরবে করে অন্য সতীর্থকে প্রাধান্য দেওয়াই বীরত্ব। রোগীরা ভগবান বললেও অহঙ্কার বোধ না জাগাই ভালো।
একদম ঠিক কথা
একদম সত্যি
Darun likhechhen..
Ajker din to botei, sob samay e prasongik!!!
সত্যিকথা, আমদের ভাবার সময় এসেছে
।
These are actually great ideas in concerning blogging.
Sotti osadharon akta lekha