এ গল্প ছোট্ট একটা স্টেশনের ছোট্ট একটা বেঞ্চির নিচের একফালি লালচে মাটির গল্প। নিউ জলপাইগুড়ি হলদিবাড়ি রুটে জলপাইগুড়ির ঠিক আগে একটা ছোট্ট স্টেশন নাম মোহিত নগর। সেই স্টেশনের বেঞ্চ। তার নিচের মাটি কেমন করে লাল হয়ে গেল জানতে ফিরে যেতে হবে ১৯৩২ সালে।
বাংলা জুড়ে উত্তাল সময়। আন্দামানের সেলুলার জেলে ওই পর্যায়ের রাজনৈতিক বন্দীদের প্রথম দফার দল এসে পৌঁছায় ১৮ ই আগস্ট। সংখ্যায় তেইশ জন। জেলের অবস্থা শোচনীয়। প্রতিদিন খাবারের সময় বন্দীদের মনে হত যে তারা বিষ পান করছে। নিত্য রক্ত আমাশয় ও জ্বর সেই খাবার খেয়ে। রোজ বিকেল পাঁচটায় আলোহীন অন্ধকার সেলে বন্ধ করে দেয়া হত, সেল খুলতো ভোর পাঁচটায়। বই পত্র পড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। বন্দীরা তিনটে দাবি আদায়ের জন্য অনশন ধর্মঘট করবেন ঠিক করেন: ভালো খাবার, আলো আর বই পত্র। মাত্র তেইশ জন বলে একটু অপেক্ষা করেন দল ভারী হওয়ার জন্য।
দ্বিতীয় দফার বন্দীরা এসে পৌঁছান। এঁদের মধ্যে ছিলেন মোহিত মৈত্র (অস্ত্র আইন মামলা), মোহন কৃষ্ণ নমোদাস (ময়মনসিংহ ডাকাতি মামলা) ও মহাবীর সিং (লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা)
এই মোহিত মৈত্রের জন্ম হয় পাবনার, নতুন ভরেঙ্গা অঞ্চলে। তাঁর বাবার নাম হেমচন্দ্র মৈত্র। উনি ছিলেন যুগান্তর দলের রংপুর শাখার সদস্য। মোহিতনগর স্টেশনের সেই বেঞ্চের নিচের লাল কাঁকর মেশানো মাটিটা একটু একটু করে আরো লালচে হতে শুরু করেছে।
বন্দীরা সংখ্যায় প্রায় একশ জন মতো হওয়ার পরে ১২ই মে ১৯৩৩ সালে শুরু হয় অনশন ধর্মঘট। শুরুতেই বন্দীদের জামা কাপড় কেড়ে নিয়ে জাঙিয়া কুর্তা পরিয়ে দেয়া হল। পাঁচ ছ দিনের মাথায় শরীরে চরম দুর্বলতা শুরু হল। তথাকথিত ডাক্তার ও কম্পাউন্ডারের কাজ হল জোর করে খাওয়ানো। জেলের দাগী আসামি মেট এদের সাহায্যে জোর করে নাক দিয়ে নল গুঁজে পেটে দুধ চালান করার ব্যবস্থা।
বন্দীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না অনশনরত সঙ্গী সাথীরা কে কেমন আছেন তার খবর রাখার। নানা রকম গুজব তাঁদের কানে আসছিল। তাঁদের স্নান করানোর জন্য করিডোরে আনা হলে সঠিক সংবাদের দাবিতে তাঁরা ফেটে পরেন। তাঁদের কাছে খবর ছিল যে জোর করে খাওয়াতে গিয়ে ওই হাতুড়ে ডাক্তারের কল্যাণে পেটের বদলে ফুসফুসে দুধ চলে গেছে কয়েকজনের অবস্থা খারাপ।
জেলার সাহেব বন্দীদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ডাক্তার নারায়ণ রায় ও নিরঞ্জন সেনকে একটু আলাদা করে ডেকে নিয়ে বললেন, দুঃখের বিষয় মোহন, মোহিত ও মহাবীর এই তিন জনেই মারা গেছে। বন্দীদের সন্দেহ সত্য বলে প্রমাণিত হল। বন্দীদের মুখে কোনো কথা নেই। নীরব প্রতিজ্ঞার মাঝে শুধু অশ্রু ঝরছে। এর পর থেকে অনশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর ‘সেল’ খোলে নি। ২৪ ঘন্টা সেল বন্ধ।
বন্দীদের থেকে ধ্বনি উঠলো “মহাবীর, মোহন, মোহিত জিন্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, স্বাধীন ভারত কি জয়।” আবদ্ধ অবস্থায় সেল থেকে সেলে চিৎকার করে জানিয়ে দেওয়া হল – “আরো বেশিদিন টিঁকে থাকতে হবে, চালিয়ে যেতে হবে অনশন। বন্দীরা সবাই মিলে গান ধরল: “নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার”। অন্ধকার জেল কুঠুরীগুলো কেঁপে উঠলো গানের শব্দে।
জয় শেষ পর্যন্ত এসেছিল। কারা কর্তৃপক্ষ একটি একটি করে দাবি মেনে নেন। সেলুলার জেলের কুঠুরিগুলোতে সন্ধ্যার অন্ধকার নামলে জ্বলে ওঠে একের পর এক আলো। অখ্যাত অনামা মোহিত নগর স্টেশনে সন্ধ্যার অন্ধকার নামে। একটা দুটো আলো জ্বলে ওঠে। নগন্য বেঞ্চিটার তলায় জমাট বাঁধা অন্ধকার মাটির ফালিটা আলো আঁধারিতে ভরে যায়। লালমাটিটা কেমন কালচে মনে হয়।
হওয়ারই তো কথা ছিল বন্ধু, সবার তো সৌভাগ্য হয় না মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসার। মোহিত মৈত্রদের থেকে যেতে হয় ফেটে যাওয়া ফুসফুস নিয়ে নইলে বন্ধ দ্বার খুলবে কি করে। আজই তো সেই আঠাশে মে। দূরে মোহিত নগরের ডিসট্যান্ট সিগনালের আলোটা লাল হয়ে আছে। আমি দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছি, আপনি পাচ্ছেন তো বন্ধু ?
২৮ শে মে, ২০২৩