মেডিসিনের ছাত্র এবং শিক্ষকমহলে অতি মান্য বৃহদাকৃতি পুস্তক হ্যারিসন’স প্রিন্সিপলস অফ ইন্টার্নাল মেডিসিন-এ হাসপাতালে রোগীদের বাস্তব অবস্থা এবং আত্মপরিচিতি নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে – “The hospital is an intimidating environment for most individuals. Hospitalized patients find themselves surrounded by air jets, button, and glaring lights; invaded by tubes and wires; and beset by the numerous members of the health care team – hospitalists, specialists, nurses, nurses’ aides, physician’s assistants, social workers, technologists, physical therapists, medical students, house officers, attending and consulting physicians, and many others. They may be transported to special laboratories and imaging facilities replete with blinking lights, strange sounds, and unfamiliar personnel; they may be left unattended at times; and they may be obligated to share a room with other patients who have their own health problems. It is little wonder that patients may lose their sense of reality.” (Harrison’s Principles of Internal Medicine, 19th edition, vol. 1, ২০১৬, পৃঃ ৫) অর্থাৎ এমন এক আভ্যন্তরীণ মেকানিজমে হাসপাতাল বা ক্লিনিক কিংবা নার্সিং হোম চলে যেখানে রোগীরা নিজেদের বাস্তবতা হারিয়ে ফেলে। ডাক্তারেরা এক্ষেত্রে রোগী এবং রোগীর বহির্জগতের বাস্তবতার মাঝে অতিক্ষীণ সংযোসূত্র (tenuous link) হয়ে দাঁড়ায়।
কি এই বাস্তবতা? একজন রোগী প্রকৃত অর্থে একজন মানুষ যিনি ঘটনাচক্রে রোগাক্রান্ত। এ অবস্থানে আমিও একজন চিকিৎসক হিসেবে আমিও থাকতে পারতাম – অবস্থানের অদলবদল হয়েছে মাত্র। এবং চিকিৎসক হিসেবে আমাদের কাছে দীর্ঘদিনের অধীত বিদ্যা, এক্সপার্টাইজ এবং রোগীর সবচেয়ে সংকটজনক মুহূর্তে সবচেয়ে কার্যকরী ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারার জ্ঞান এবং বিচক্ষণতা (acumen)। এজন্য রোগী-ডাক্তার সম্পর্কে সবসময়েই ডাক্তারের অবস্থান উচ্চতর এবং নির্ধারক স্থানে থাকবে। ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে এটা বাস্তব ও সত্যি।
অথচ রোগী হিসেবে ডাক্তারের কাছে আসার আগে মানুষটি একজন সামাজিক-পারিবারিক মানুষ, স্বামী বা প্রেমিক কিংবা কাজ হারানো মজুর। হয়তো বা সৃষ্টিশীল একটি সত্তাও, যার ভালোবাসা বিরহ রাগ-ক্রোধ অসহায়তা বঞ্চনা সবকিছু মিলেমিশে রয়েছে। হাসপাতালে একজন রোগী হিসেবে ভর্তি হবার সাথে মুছে যায় তার বিভিন্ন ভিন্নমুখী সত্তার পরিচয়। হাসপাতালের বেডে কেবলমাত্র একটি কেস নম্বর হয়ে ওঠাই তখন তার একমাত্র পরিচয়।
তাহলে এক বা একাধিক সত্তার অবলুপ্তি হল (বা বিনির্মাণ হল) আধুনিক মেডিসিনের দুনিয়ায়, পরিবর্তে গড়ে উঠলো এক সত্তাহীন আত্মপরিচয়। অন্যভাবে বললে পরিচয়হীন এক নতুন আত্ম বা self – এটা রোগীর আত্মপরিচয় হয়ে গেল।
এখানে প্রাসঙ্গিক একটি ইতিহাস আলোচনা করা যেতে পারে। স্যার রবার্ট হাচিসন ইংল্যান্ডের একজন প্রবাদপ্রতিম মানুষমুখী চিকিৎসক ছিলেন। ১৮৯৭ সালে তাঁর লেখা ক্লিনিক্যাল মেথডস আজও মেডিসিনের ছাত্রদের পাঠ্য। ১৯৫৩ সালে তাঁর মৃত্যুর ৭ বছর আগে তিনি নবীন প্রজন্মের চিকিৎসকদের সতর্ক করার জন্য এবং ভাবলে ভুল হবেনা, হয়তোবা নিজের epitaph হিসেবে লিখেছিলেন –
“From inability to let well alone
From too much zeal for the new and contempt for what is old
From putting knowledge before wisdom, science before art, and
Cleverness before common sense;
From treating patients as cases;
And from making the cure of the disease more grievous than the
Endurance of the same, Good Lord, deliver us.”
এ যেন গ্রিসের ডেলফির ওর্যাকল-এর মতো শোনাচ্ছে। “রোগীকে কেস হিসেবে চিকিৎসা করা থেকে”, “রোগের নিরাময়কে অসুখের থেকে বেশি যন্ত্রণাদায়ক করার হাত থেকে” “নতুনের জন্য তীব্র উৎসাহ এবং যা পুরনো তাকে ঘৃণা/অবজ্ঞা করা থেকে” “হে সর্বময় ঈশ্বর আমাদের মুক্তি দিন”। আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে স্যার হাচিসনের এই অসামান্য উপলব্ধিটি।
এখানে একটি মনোযোগ দেবার মতো বিষয় উল্লেখ করা যায়। আয়ুর্বেদ লিপিবদ্ধ হবার সময়কালীন (চরক- এবং সুশ্রুত-সংহিতায়, বাগভটের টেক্সট আরও পরবর্তী কালের ৭ম শতাব্দীর বলে ধরা হয়) গ্রেকো-রোমান বিখ্যাত চিকিৎসক গ্যালেন (১২৯-২০৩-এর আশেপাশে খ্রিষ্টাব্দ)। গ্যালেনের হিউমারের ধারণা ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত (প্যারিসের হাসপাতালগুলোতে “হসপিটাল মেডিসিন”-এর উদ্ভব অব্দি) ১৫০০ বছরেরও বেশি সময়য় জুড়ে মেডিসিনের জগতকে শাসন করেছে। লক্ষণীয়, আয়ুর্বেদে রোগ এবং রোগের চিকিৎসার উল্লেখ আছে, কিন্তু ব্যক্তি রোগীর কোন উল্লেখ নেই। অর্থাৎ রোগী ব্যক্তি হিসেবে তখনও আবির্ভূত হয়নি ভারতীয় চিকিৎসার জগতে। রোগের ধারক হিসেবে রোগীর অস্তিত্ব। ফলে রোগীর কোন আত্মপরিচয়ও তৈরি হয়নি। আবার আত্মপরিচয় জন্ম না নিলে পরিচিতি বা সত্তার কোন সংকটও থাকবেনা। আমরা এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব মাথায় রাখবো।
যে সময় দিয়ে এখানে আয়ুর্বেদের নির্ধারক টেক্সটগুলো ম্যানাস্ক্রিপ্ট হিসেবে পাঠের যোগ্য হচ্ছে, চিকিৎসার বিভিন্ন বিধি codified হচ্ছে, প্রায় সেসময়েই গ্যালেনের বিভিন্ন টেক্সটও রচিত হচ্ছে। এবং তিনি মূলত বাদর ডিসেকশন করে অ্যানাটমির জ্ঞান লিপিবদ্ধ করছেন। এই জ্ঞানকে প্রায় ১৫০০ বছর পরে ভেসালিয়াস তাঁর ১৫৪৩ সালে প্রকাশিত পুস্তক De Humani Corporis Fabrica Libri Septem বা ইংরেজিতে On the fabric of the human body in seven books প্রকাশের মধ্য দিয়ে সংশয়াতীতভাবে গ্যালেনের অ্যানাটমির আদ্যপ্রান্ত ভ্রান্তি চিরকালের জন্য মুছে দিলেন অ্যানাটমির ইতিহাসে। থাক এ কথা। এটা স্বতন্ত্র প্রসঙ্গ। কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ তাহল গ্যালেন রোগীদের কেস রেকর্ড রাখতেন। বিভিন্ন বর্গে রোগীদের ভাগ করলেও ব্যক্তি রোগী হিসেবে তাঁরা নোটবুকে স্থান পাচ্ছে, লিপিবদ্ধ হচ্ছে।
(H.F.J. Hormanshoff, “Galen and His Patients”, in Ancient Medicine in its Socio-Cultural Context, ed. Ph.J. van der Eijk, H.F.J. Horstmanshoff and P.H. Schrijvers, vol. 1, 1995, pp. 83-100)
গ্যালেনের ব্যাপারে আরেকটি কথা বলা দরকার। “Many off hand comments suggest that he treated women, children, and slaves as part of his normal practice, but he does not write about them as often as his aristocratic male patients.” (Susan Mattern, “Galen and his patients”, Lancet, August 6 2011, pp. 478-479) আমরা নজরে রাখব, ব্যক্তির রোগী হিসেবে আলাদা পরিচিতি এবং একক সত্তা হিসেবে উদ্ভব গ্যালেনের সময় থেকেই ইউরোপীয় মেডিসিনে আসতে শুরু করেছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর সবচেয়ে নামী চিকিৎসক ছিলেন গিলবার্টাস অ্যাংলিকাস (Gilbertus Anglicus)। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ কম্পেন্ডিয়াম অফ মেডিসিন ১২৩০ থেকে ১২৫০ সালের মধ্যে লেখা। তিনি এতটাই বিখ্যাত ছিলেন যে সেসময়ে তাঁকে নিয়ে ছড়া বাঁধা হয়েছিল –
“Wel knew he the olde Esculapius
And Deyscorides and eek Rufus,
Olde Ypocras, Haly and Galyen,
Serapion, Razis and Avycen,
Averrois, Damascien and Constantyn,
Bernard and Gatesden and Gilbertyn.” (Henry E. Handerson, GILBERTUS ANGLICUS: Medicine of the Thirteenth Century, 1918)
মজার বিষয় হল, গিলবার্টকে নিয়ে এই ছড়ায় সেসময় পর্যন্ত যারা মেডিসিনের অভিমুখ নির্ধারণ করেছেন তাঁদের সবার নাম আছে – এসকিউলোপিয়াস এবং গ্যালেন থেকে আভিসেনা এবং আল রাজি পর্যন্ত। যাহোক, এই বইতে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল যে এখানে রোগীর বলা বৃত্তান্ত প্রাধান্য পাচ্ছে। ডাক্তার রোগীর দেওয়া বিবরণের ওপরে নির্ভর করছেন। ফলে রোগী তার উপসর্গ নিয়ে নির্ণায়ক অবস্থানে থাকছে। চিকিৎসক অনেকাংশে এর অনুসারী। কারণ সেসময় অব্দি চিকিৎসক রোগের prognosis-এর ওপরে বেশি নির্ভর করেন, ডায়াগনোসিস নয়। তখনও পর্যন্ত organ localization of disease বা অসুখের অঙ্গ স্থানিকতা প্রাধান্যকারী অবস্থানে আসেনি। এজন্য, রোগীর “আত্ম” বা পরিচিতি বা সত্তা চিকিৎসার মাঝে দ্রবীভূত হয়ে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছেনা।
এখানে জার্মান দার্শনিক হান্স গ্যাডামারের একটি মন্তব্য ভাবা যেতে পারে – “Although health is naturally the goal of the doctor’s activity, it is not actually ‘made’ by the doctor.” (Hans Gadamer, The Enigma of Health: The Art of Healing in a Scientific Age, 1996, পৃঃ ২০) অস্যার্থ, স্বাস্থ্য ডাক্তারের কর্মকাণ্ডের লক্ষ্যবস্তু হলেও, এটা ডাক্তারের ‘তৈরি করা’ নয়। যবে থেকে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্ত বিষয়কে ডাক্তারসমাজ গড়েপিটে তৈরি করে নিতে শুরু করল সেদিন অসুস্থ মানুষ মেডিক্যাল কসমোলজি থেকে অপসৃত হতে শুরু করল – “The disappearance of the sick-man from medical cosmology, 1770–1870” (N D Jewson, International Journal of Epidemiology 2009; 38:622–633)। সঠিক কবে থেকে? ইতিহাসের পর্বভাগ এভাবে হয়না। ফরাসী বিপ্লবের মাঝে রাজতন্ত্রের পুনরুত্থানের বীজও থেকে যায়। একটি পর্বের মাঝে আরেকটি পর্বের অস্তিত্ব থাকে। এজন্য মুক্ত ঐতিহাসিক বীক্ষণে ঘড়ির কাঁটা ধরে পর্বান্তর ঘটেনা। নির্দিষ্ট কিছু সময় বা বছরকে আমরা চিহ্নিত করি ঐতিহাসিক স্বার্থে, আমাদের বোঝার সুবিধের জন্য।
লুডভিগ এডেলস্টাইন তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ Ancient Medicine (ed. Owsei Temkin and C. Lilian Temkin, 1987)-এ গ্রীক মেডিসিনের আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন – “The contribution of medicine to philosophy, I venture to suggest, lies in the fact that philosophy found in medical treatment and in the physician’s task a simile of their own endeavour.” (পৃঃ ৩৫০) যবে থেকে দর্শন ও মেডিসিনের এই সহাবস্থান, প্রীতিময়তা এবং যুগলবন্দী ছিঁড়ে গেল সেসময় থেকে মেডিসিনের দর্শন হ্রস্ব হতে শুরু করল (reductionism)। আমরা সে সময়গুলো ধরে আলোচনা করব, সংক্ষেপে।
Guenter B. Risse তাঁর ম্যাগনাম ওপাস Mending Bodies, Saving Souls – A History of Hospitals গ্রন্থে দেখাচ্ছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে – “as a general rule, individuals suffering from acute, self-limited, and benign diseases were admitted. All others, especially the chronically ill and dying, were “improper” candidates for hospitalization and were to remain in their homes or seek attention in hospices.” (পৃঃ ২৩৫) হাসপাতাল এবং রোগীর “মেডিক্যালাইজেশন” হতে শুরু করল। একইসাথে রোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি exclusionary বা বাতিল করার দৃষ্টিভঙ্গী ক্রিয়াশীল হচ্ছে সেসময় থেকে।
এর পূর্ববর্তী সময়ের অর্থাৎ ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের নির্দিষ্টতা নিয়ে এক গবেষকের মন্তব্য – “One of the most important manifestations of the patient’s power over the practitioner was his ability to dictate the very definition of illness itself … Medical knowledge revolved around the problems of the prognosis and therapy of symptoms, rather than the diagnosis and analysis of diseases.” (N D Jewsosn, “Medical Knowledge and the Patronage System in 18th Century England”, Sociology 1974, 8 issue (3): 369-385) মোদ্দা কথা হল, ডাক্তারের রোগীর উপসর্গ শুনে দেহ পরীক্ষা করে sign বের করার চাইতে রোগীর বলা symptom-এর গুরুত্ব মেডিসিনের জগতে তখন প্রাধান্যাকারী অবস্থানে রয়েছে। রোগী তখনও তার আত্মপরিচিতি হারিয়ে ফেলেনি, অসুখের ওপরে ডাক্তার ও টেকনোলোজির প্রাধান্য গ্রাস করতে পারেনি সম্পূর্ণভাবে রোগীর সত্তাকে।
একই গবেষক অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে নতুন যে মেডিক্যাল সিস্টেমের সূচনা হল তাঁর পর্যবেক্ষণে দেখছেন – “The sick-man may be said to have disappeared from medical cosmology in two related senses during the period 1770–1870. Firstly, as control over the means of production of medical knowledge shifted away from the sick towards medical investigators the universe of discourse of medical theory changed from that of an integrated conception of the whole person to that of a network of bonds between microscopical particles. Secondly, as control over the occupational group of medical investigators was centralized in the hands of its senior members the plethora of theories and therapies, which had previously afforded the sick-man the opportunity to negotiate his own treatment, were replaced by a monolithic consensus of opinion imposed from within the community of medical investigators.”
মেডিক্যাল কসমোলোজি এবং মেডিক্যাল জ্ঞান (কলকারখানায় উৎপাদনের মতো নয়, বরঞ্চ স্কুলে কলেজে শিক্ষার নতুন ধরনের মাঝে উপ্ত থাকে এ জ্ঞানের বীজ) উৎপাদনের প্রক্রিয়ার ফরাসী বিপ্লব পরবর্তী সময়ে প্যারিসের হাসপাতালগুলোতে আমূল রূপান্তর ঘটার ফলে মেডিসিনের জগতে দুটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটলো – (১) ফিজিসিয়ান (যারা অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মেডিক্যাল হায়ারার্কিতে সর্বোচ্চ বর্গের চিকিৎসক হিসেবে গণ্য হত) এবং সার্জনের (যাদের অনেক নিম্নবর্গের ক্রাফটসম্যান বলে ধরা হত) মধ্যেকার ব্যবধান মুছে গিয়ে এক নতুন প্রজাতির চিকিৎসক জন্ম নিল, যারা একাধারে সার্জন এবং ফিজিসিয়ান; এবং (২) রোগীর বলা symptoms-এর চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো রোগীর দেহ থেকে ডাক্তারের নিষ্কাশন করা sign। ফলে ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে চিরকালের জন্য রূপান্তরিত হয়ে গেল। ডাক্তার চিকিৎসার একমাত্র নির্ণায়ক শক্তি যেমন হয়ে উঠলো তেমনই সম্পর্কের হায়ারার্কিতে ডাক্তার সর্বোচ্চ অবস্থানে স্থিত হল। রোগকে বোঝা নৈর্বক্তিক হয়ে গেল। বিখ্যাত ইংরেজ অ্যানাটমিস্ট এবং সার্জনের উক্তি (ছাত্রদের উদ্দেশ্যে) “necessary inhumanity” বীজমন্ত্র হয়ে গেল।
এরকম এক নতুন প্রজাতির ডাক্তারের প্রথম প্রতিনিধি ছিলেন ফ্রান্সের জেভিয়ার বিখাট (Francois Xavier Bichat)। তিনি ক্লিনিক্যাল ওয়ার্ডে দিনরাত পরিশ্রম করতেন। তার চেয়েও বেশি পরিশ্রম করতেন মৃত রোগীর পোস্টমর্টেম পরীক্ষায় রোগের কারণ অনুসন্ধানের জন্য। মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৮০২ সালে তিনি মারা যান। ছাত্রদের জন্য তাঁর বিখ্যাত উপদেশ ছিল – “Dissect in anatomy, experiment in physiology, and make necropsy in medicine; this is the threefold path without which there can be no anatomist, no pathologist, no physician.” মৃতদেহ শিক্ষিত করতে শুরু করল জীবিত দেহে রোগের এবং স্বাভাবিক অবস্থার অনুধাবনকে (কাঙ্গুইলেমের ভাষায় দ্য নর্ম্যাল অ্যান্ড দ্য প্যাথলজিক্যাল)।
জিউসন তাঁর “The disappearance of the sick man from medical cosmology, 1770-1870” প্রবন্ধে বলছেন – “The patient’s interest in prognosis and therapy was eclipsed by the clinician’s concern with diagnosis and pathology. The special qualities of the individual case were swallowed up in vast statistical surveys. In short the sick-man was no longer regarded as a singular synthesis of meaningful sensations. Instead the sick in general were perceived as a unitary medium within which diseases were manifested.” (ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ এপিডেমিওলজি, ২০০৯, পৃঃ ৬২৮)
আধুনিক মেডিক্যাল শিক্ষার দু-চার কথা
ক্লিনিকে বা হাসপাতালে (সরকারি/বেসরকারি) একক ব্যক্তি বা রোগীর চিকিৎসা, যাকে বলা যায় ক্লিনিক্যাল হেলথ। ২০০৬ সালে দেখা যাচ্ছে – Clinical teachers have been under intensifying pressure to increase their clinical productivity – that is, to generate revenues by providing care for paying patients. (“American Medical Education 100 Years after the Flexner Report”, NEJM 355 (2006): 1339-44) অর্থাৎ, মেডিক্যাল শিক্ষাক্রমে কাঞ্চনমূল্যের প্রসঙ্গটি অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে – যদি “revenue” তৈরি করতে পারে তাহলে শিক্ষকের গুরুত্ব বাড়বে, নাহলে গুরুত্বহীন। ২০১১ সালে এসে আমেরিকায় মেডিক্যাল শিক্ষার বর্তমান চেহারা নিয়ে মন্তব্য করা হল, এটা নিয়তির পরিহাসের মতো যখন মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীলতা শেখার কথা সে সময়ে ছাত্রেরা “begin to lose empathy.” (“Into the Waters – Clinical Clerkships”, NEJM 364: 1190-92)
কখন ঘটে এই সহৃদয়তার স্খলন? “[T]he first three years of medical education significantly decreased students’ vicarious empathy. (“Is There Hardening of the Heart during Medical School?” Academic Medicine 83 (2008): 244-289) অন্যত্র, মেডিসিনের ট্রেইনিং-এ বর্তমান মূল লক্ষ্য হল রোগ ডায়াগনোসিস করা, রোগীর সামাজিক অবস্থান, চাহিদা বা সক্ষমতাকে বোঝা নয়। (“Patient- and Family-Centered Medical Education: The Next Revolution in Medical Education?”, Annals of Internal Medicine 2014, 161 (1): 73-75)
প্রশ্ন ওঠে – “Are We Living in a Medical Education Bubble Market?,” (NEJM 2013, 364: 300-301) এ প্রবন্ধে লেখকেরা জানিয়েছেন যে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা যে দামে শিক্ষা কেনে তার চাইতে বেশি দামে বিক্রী করে। বাজার অর্থনীতির চরম প্রভাবে “we will march down the debt-to-income-ratio ladder, through psychiatrists to cardiologists to orthopedists . . . until no one is left but the MBAs.”
মেডিক্যাল শিক্ষার এ চেহারা তো আমরা এ দেশেও প্রত্যক্ষ করছি। কেন ঘটছে এরকম ঘটনা? কেন গভীরভাবে বদলে যাচ্ছে মেডিক্যাল শিক্ষার ধরন-ধারণ? কেন পরিহার্য কিন্তু অবধারিত “অ-মানবিকীকরণ” ঘটছে বারংবার? সুজান ব্লক এবং অ্যান্ড্রু বিলিং কয়েক বছর আগে একই জার্নালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন “মৃত্যু থেকে শিক্ষা” শিরোনামে। (Susan Block nd Andrew Billing, “Learning from Dying,” New England Journal of Medicine 2005, 353(13): 1313-1315) এ প্রবন্ধে তাঁরা হাসপাতালের ওয়ার্ডের একের পর এক উদাহরণ তুলে ধরে দেখিয়েছিলেন যে বাস্তবে শেখানো শিক্ষাক্রমের বাইরে থাকে লুকিয়ে-থাকা তথা “informal or hidden curriculum”। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান সময়ের মেডিক্যাল শিক্ষার এই “hidden curriculum” এবং “especially the disease-centered, impersonal, high-throughput clinical years … still tends to undermine the best intentions of students and faculty members and the best interests of patients and families.”
আরও সাম্প্রতিক সময়ে নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে “How Medical Education is Mising the Bull’s Eye” (জুন ২৫, ২০২০)। এ প্রবন্ধে বলা হয়েছে – “Medical education is missing the bull’s-eye. The current standardized, homogeneous representation of white males in medical education is exclusionary and puts patients of color and women at risk for adverse health outcomes.”
এই জার্নাল-এ এরকম আর্ত অবস্থার – “primary care, the backbone of the nation’s health system, is at grave risk of collapse” – প্রতিফলন ঘটছে “Primary Care – Will It Survive?” শিরোনামের প্রবন্ধে। মেধাবী, আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন চোখে নিয়ে যে ছাত্র সমাজ মেডিক্যাল শিক্ষার জগতে প্রবেশ করে তারা ক্রমাগত এই অ-মানবিক শিক্ষাক্রম আর বাজারী হিংস্র অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার বুদ্বুদের বাজারের মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘ যাত্রা করে একজন পরিশীলিত ব্যবসায়িক চিকিৎসা-পরিষেবা বিক্রেতা হয়ে ওঠে। এ ট্র্যাজেডি কার? ছাত্রদের? সমাজের? চিকিৎসকের? রাষ্ট্রের? নাকি সম্মিলিতভাবে সবার?
১৯৯৯-২০০০ সালের মধ্যে AIIMS-এর মতো প্রতিষ্ঠানের ৫৪% ছাত্র পাড়ি দিয়েছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে (“High-end physician migration from India, Bulletin of the World Health Organization 86 (2008): 40-45)। ২০০৬-এর অথ্যানুযায়ী, ভারতের মোট মেডিক্যাল স্নাতকের (৫৯২,২১৫) ১০.১% বা ৫৯,০৯৫ জন বিদেশে চলে গিয়েছে (Fitzhugh Mullan, “Doctors For the World: Indian Physician Emigration,” Health Affairs 25.3 (2006): 380-393)। প্রায় ৬০,০০০ ডাক্তার যারা বিদেশে পসার করেছে তাদের ৪০, ৮৩৮ জন আছে আমেরিকায় (আমেরিকার মোট চিকিৎসকের ৪.৯%), ১৫,০৯৩ জন ইংল্যান্ড-এ (মোট চিকিৎসকের ১০.৯%), ২,১৪৩ জন অস্ট্রেলিয়াতে (মোট চিকিৎসকের ৪.০%) এবং ১,৪৪৯ জন কনাডাতে (মোট চিকিৎসকের ২.১%)। [Fitzhugh Mullan, “The Metrics of the Physician Brain Drain,” NEJM October 27, 2005: 1810-1817] এ সমস্ত চিকিৎসকেরা কি ভূমিকা পালন করেন। সব দেশের তথ্য না পাওয়া গেলেও আমেরিকার পরিসংখ্যান বলে আমেরিকার গ্রামাঞ্চলের দিকে যেসব CAH (Critical Access Hospital) আছে সেখানকার প্রতি ৪ জন চিকিৎসকের ১ জন (২৫%) হচ্ছে আমেরিকান নয় এমন, এদের মধ্যে ৬১% হচ্ছে ভারতীয় (“The role of international medical graduates in America’s small critical access hospitals,” Journal of Rural Health 20.1 (2004): 52-58)।
এরপরেও বলার থাকে। আমেরিকায় গ্রামীণ চিকিৎসকের ঘাটতি নিয়ে হাহাকার উঠেছে। ২০১৯-এর জুলাই মাসে NEJM-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে “Implications of an Aging Rural Physician Workforce” বলা হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে (আমেরিকার) “Limited access to physicians can reduce access to preventive care and exacerbate unmet health needs, leading to costly hospitalizations and poor health status.” বলা হচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ৬৬% ঘাটতি রয়েছে চিকিৎসকের। বলা হচ্ছে – “In 2030, residents of rural areas will have access to one third as many physicians per capita as their suburban and urban counterparts will.” জিডিপির প্রায় ১৮% স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়িত হবার পরেও আমেরিকার মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সুরক্ষা সুরক্ষিত নয়।
এরপর?
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল (NEJM)-এ ১৪ নভেমব্র, ২০১৩-এ একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল “Dead Man Walking” শিরোনামে। এ প্রবন্ধে জানানো হয়েছিল একজন মেডিক্যাল ইন্সিউরেন্স-বিহীন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ সারাজীবনের জমানো সঞ্চয় ১০,০০০ ডলার খরচ করেছেন কেবলমাত্র ডাক্তার দেখানো এবং বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায়। লেখকরা বলছেন – “তার পাশে বসে তার স্ত্রী ফুঁপিয়ে কাঁদছেন যখন তাকে পরীক্ষা করা হচ্ছিল এবং কিভাবে তার ওজন ভয়ঙ্করভাবে কমে গেছে একথা বলছিলেন। তাদের সন্দেহ কোলনের ক্যান্সার হয়েছে।” এই রোগীটি বাঁচেনি। কিন্তু এই প্রবন্ধের চিকিৎসক-লেখকদের উপলব্ধি – “We find it terribly and tragically inhumane that Mr. Davis and tens of thousands of other citizens of this wealthy country will die this year for lack of insurance.” সঠিক উপলব্ধি ও উচ্চারণ।
কিন্তু যে প্রশ্নটি রয়ে গেল বড় দগদগে হয়ে তাহল – আধুনিক মেডিসিন কি এক্ষেত্রে ফুঁপিয়ে কাঁদা স্ত্রীর কিংবা হতভাগ্য কৃষ্ণাঙ্গ মানুষটির suffering (বেদনা/ক্লিষ্টতা) বোঝে কিংবা মেডিসিনের কাঠামোর মধ্যে ধারণ করতে পারে?
নভেম্বর ১১, ২০০৪-এ একই জার্নালে হার্ভার্ড মেডিল্যাল স্কুলের শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক-শিক্ষক জেরোম গ্রুপম্যান লিখেছিলেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে “A Great Case”। এ প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছিলেন তিনি যখন শিক্ষার্থী তখন কি বিপুল উৎসাহে একজন রোগীকে “কেস” হিসেবে দেখে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সমস্ত জ্ঞান ঢেলে সঠিক ডায়াগনোসিসের তীব্র প্রতিদ্বন্দিতা চলত – “cases were great because of the muscular drama they brought.” এরপরে তাঁর প্রথম সন্তানকে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মিলে অত্যন্ত গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আবার “great case”-এর সন্ধানে চিকিৎসকদের দল ঝাঁপিয়ে পড়ে। মরিয়া হয়ে বলেন – “I fixed on the intern’s expectant eyes and lost control. “Who the hell are you? My son is not a ‘good case!’” যাহোক, তাঁর ছেলে সে যাত্রা বেঁচে যায়। এরপরে তাঁর তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু নন-হজকিন্স লিউকেমিয়ায় মারা যায়। তাঁর চূড়ান্ত উপলব্ধি – “পেছনে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমি এখনও অসমর্থ আমার যৌবনের ডাক্তারি ভাষাকে পুনরুদ্ধার করতে এবং “a great case” নিয়ে বলতে। আমার জীবনের বর্তমান দশায় মেডিসিন যেন দুটি স্রোতে বিভাজিত হয়ে গেছে – একদিকে বিস্ময়কর বায়োলজি এবং অন্যদিকে অন্তঃসলিলা ধারা যেখানে আত্মাকে টেনে আনে। তীরে যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে এটা কল্পনা করা কঠিন যে এই দুটি ধারা আর কখনও একটি প্রবাহ হিসেবে মিলে যাবে।” গ্রুপম্যান এবং তাঁর স্ত্রীর suffering চাপা পড়ে যায় টেকনোলোজি-নির্ভর আধুনিক মেডিসিনের “a great case”-এর নীচে।
আর্থার ক্লিনম্যান তাঁর Illness Narrative (১৯৮৭) গ্রন্থে বলছেন – আধুনিক মেডিসিন তো suffering-কে ধারণ করতে পারেইনা বরঞ্চ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং স্কেল দিয়ে এটাকে বায়োলজির একটি fault হিসেবে প্রতিপন্ন করে। “modern medical bureaucracy and the helping profession that work within it … are oriented to treat suffering as a problem of mechanical breakdown requiring a technical fix.” (পৃঃ ২৮)
আধুনিক মেডিসিন যতদিন suffering-কে ধারণ করতে পারবেনা ততদিন একজন রোগীর সত্তা বা আত্ম মেডিসিনের অন্তর্বস্তুতে স্থান পাবেনা। রোগী রয়ে যাবে “a great case” হিসেবে। কেভিন ও’নীল তাঁর “Disciplining the Dead” প্রবন্ধে (Perspectives on Emobodiment: The Intersections of Nature and Culture, ed. Gail Weiss & Honi Fern Haber, ১৯৯৯, পৃঃ ২১৩-২৩১) বলছেন – “By the end of the century the dead had been relegated to a marginal position in culture, and the sense of connection between the living and the dead had been lost.” মৃত্যু একজন মানুষের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-আত্মীয়পরিজনের কাছে এক “বড় বেদনার মতো” স্মৃতি। আধুনিক মেডিসিনের কাঠামোর মধ্যে কেবলমাত্র একটি “কেস” মুছে যাওয়া।
এই টানাপড়েন এখনও অব্দি মেডিসিনের যে epistemology এবং ontology তাকে দিয়ে বোঝা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। অতুল গাওয়ান্ডে তাঁর Being Mortal (2014) গ্রন্থে বলছেন – “We’ve been wrong about what our job in medicine. We think our job is to ensure health and survival. But really it is larger than that. It is to enable well-being. And well-being is about the reasons one wishes to live.” (পৃঃ ২৫৯)
হ্যাঁ, এই well-being-এর মধ্যে রয়েছে সাফারিংকে বুঝতে পারার এবং প্রশমিত করার ক্ষমতা। সে ক্ষমতা আধুনিক মেডিসিন এখনও অর্জন করে ঊঠতে পারেনি। যেদিন পারবে সেদিন রোগীরা আর “কেস” নয়, মানুষী সত্তা হিসেবে গৃহীত হবে আধুনিক মেডিসিনের মূল কাঠামোর মধ্যে।
Very good 👏🏼👏🏼👏🏼👏🏼
এই বিচ্ছিন্নতা ভয়াবহ!
মৃতেরা হাঁটছে!
পরিবার কাদঁছে!
কর্পোরেট ব্যবসা ফাদছে।
মন, হারিয়ে যাচ্ছে !!!
অসাধারণ বিশ্লেষণ। আপনার প্রতিটি লেখায় আমি ব্যক্তিগতভাবে ঋদ্ধ হই!!!!!