ডিসক্লেইমার: এই লেখা আপাতদৃষ্টিতে নিজের পেশার বিরুদ্ধে। লেখাটি পড়ে যত পারেন গালাগালি দিন। কিচ্ছু মনে করবো না। লেখাটি অন্য কোন বিষয়ের ডাক্তারের প্রতি বিদ্বেষ থেকে লেখা নয়। বরং আধুনিক চিকিৎসকদের মধ্যে সমন্বয়ের যে মারাত্মক অভাব আছে, সেটা তুলে ধরার জন্যই এই লেখা।
****
বছর উনিশের মেয়েটির বিয়ে হয়েছে বছর খানেক আগে। একটি সন্তানও আছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, অতএব যেমন হবার কথা, তেমনি হয়েছে। কোন রকমে সংসার চলে, সেটা দেখলেই বোঝা যায়।
সে সব থাক।
মাস ছয়েক আগে থেকে তার ডান হাঁটুর উপরে বাইরের দিকে শুরু হয়েছিল ফোলা ফোলা ভাব। সাথে প্রচণ্ড ব্যথা।
আমাদের দেশে যা হয়, প্রথমেই জলপড়া তেলপড়া কবজ মাদুলি চিনির দানা ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে চেষ্টা চলে ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার। কিন্ত এক্ষেত্রে তা হয়নি! মেয়েটি এবং তাঁর স্বামী কোনভাবেই এসবের ধারে কাছে যায়নি। সোজা চলে গিয়েছে লোকাল এরিয়ার নামকরা একজন অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে।
হ্যাঁ, আধুনিক চিকিৎসা মতে সে ঠিকঠাক ডাক্তারের কাছেই গিয়েছে।
সবাই ভাবছেন, বাহ্! এই তো চাই! মানুষের বোধোদয় হচ্ছে। ঠিকঠাক চিকিৎসা পেয়ে মেয়েটি তার সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে!
আমরা যারা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছি বা করছি, হাততালি দিয়ে উঠবো! প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবো প্রায় অশিক্ষিত এই রোগীর জন্য।
দাঁড়ান! একটু সময় নিন।
তথাকথিত বিখ্যাত অর্থোপেডিক সার্জন (দয়া করে ভাববেন না, সেই অর্থোপেডিক সার্জনকে আমি চিনি বা তাঁর সাথে আমার কোন রকম সম্পর্ক আছে! না ভালো না খারাপ! তাঁকে আমি চিনিই না! অতএব প্রফেশনাল শত্রুতার প্রশ্নই ওঠে না!) কি করলেন?
আপনি নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছেন- তিনি আধুনিক চিকিৎসা মতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তারপর যা যা দরকার তাই করলেন, তাই তো?
উহু!
না। তিনি গরীবের ডাক্তার বলে খানিকটা নাম কিনেছেন, এটা আমি পরে জেনেছি। গরীবের ডাক্তার নামটি কেন ও কিভাবে পেয়েছেন তার নমুনা শোনা যাক অন্য একজন রোগীর কথায়- কি একটা স্প্রে করেন, কয়েক মিনিটের মধ্যে সব ব্যথা হাপিস! নমস্য ডাক্তার!
যাকগে।
নমস্য হোন তিনি। আমি গর্বিত হবো।
কিন্ত … সেটি হলো কোথায়?
এই রোগী, যার ফোলা ফোলা ভাব নিয়ে অন্ততঃ বার দশেক বিখ্যাত ডাক্তারের কাছে গিয়েছে, প্রতিবারই কোন রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা না করিয়ে তিনি ব্যথা দূর করতেন! হ্যাঁ, তাঁর সেই বিখ্যাত স্প্রে এর সাহায্যে!!
ব্যথা দূর করার স্প্রে কি জিনিস, সেটা জানার জন্য অধমের মত ডাক্তার হতে হয় না আজকাল। নানা কোম্পানির অমন স্প্রে এখন সাধারণ মানুষের ঘরেই থাকে।
সমস্যা হলো- খানিকটা ভগবান ভগবান ভাবমূর্তির সেই ডাক্তার বাবু, একবারও ভাবলেন না যে একটা ফোলা, যেটা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, সেটা থেকে ব্যথাও বাড়ছে, তার চিকিৎসায় এই ম্যাজিকাল স্প্রে কি কাজ করতে পারে??
আমি এমনিতেই ডাক্তারিটা করি আর কিছু জানি না বলে। তার উপর অন্য বিষয়ের উপর আমার জ্ঞানের পরিমাণ নেগেটিভে মাপতে হয়।
তবু সেই কবে, এমবিবিএস পড়ার সময় জেনেছিলাম- এই বয়সে হাঁটুর উপর বা নিচে যদি দীর্ঘদিন ধরে কোন ফোলা থাকে, একটু খানি হলেও সেটা ভয়ের। সাধারণতঃ বিনাইন বা ম্যালিগন্যান্ট টিউমারই হয় সেটা!
আমার মাথায় এলো না, বিশেষজ্ঞ সেই ডাক্তারবাবু, কোন ভগবানত্ব লাভের আশায়, এই রোগীকে বার দশেক ধরে শুধু স্প্রে করে গেলেন!!
বলে রাখি, আমাকে মুখ চেনে এমন একজন মানুষ কি ভেবে জানি না, রোগীকে শুধু দেখানোর জন্য একবার আমার কাছে নিয়ে এসেছে!
আমি হলাম এমন একটি বিষয়ের ডাক্তার, যাঁর কাছে রোগী আসে অন্যের প্রেসক্রিপশন নিয়ে!
অন্য ডাক্তারবাবু যা ভাবেন- ও তো আমার রোগীকে পরীক্ষা করবে শুধু! সেই ভেবে একটি ছদ্ম গর্বও অনুভব করেন! যদিও পৃথিবীর অন্য দেশে বিষয়টি মোটেই এরকম নয়। সেখানে রেডিওলজিস্ট শুধুমাত্র পরীক্ষা করে না, যথারীতি রোগীর ভালো মন্দ নিয়ে মতামত দেয়। দরকারে চিকিৎসাপদ্ধতিও পাল্টে দেয়। কিন্ত এদেশে সে সব হবার নয়।
না, কারো দোষ নেই! হ্যাঁ এ দোষ আমাদের কপালের। এ দোষ এই দেশে দোষই নয় হয়তো বা!
তো মতামত দিতে গিয়ে দেখলাম- সেই এমবিবিএস পড়ার নলেজ নিয়ে বুঝতে পারছি- এটি মোটেই স্প্রে দিয়ে সারানোর মত নয়! বরং একবার দেখলেই মনে হবে- এটি একটি টিউমার!
অতঃপর আমি নিজের ইচ্ছায় রোগীর একটা ইউএসজি আর এক্স-রে করালাম। যা সন্দেহ করেছিলাম, তাই। যে প্যাথোলজি পেলাম- সেটা দেখার পর যে কেউ বলবে- এটা একটি ম্যালিগন্যান্ট টিউমার!
আর আমার মত অজ্ঞ রেডিওলজিস্ট ও চোখ বন্ধ করে লিখে দিতে বাধ্য হলো- এটা ওস্টিওসারকোমা! না, অন্য কোন ডিফারেনশিয়াল ডায়াগনসিসও দেয়া যাবে না, এমনি ক্ল্যাসিকাল!লোকেশন থেকে শুরু করে টিউমারের ছড়িয়ে পড়া- সব লিখে যখন রিপোর্টটা সাইন করলাম, আমি সেই রোগীকে কিছুই বলতে পারলাম না!
প্যাথলজির একজন বন্ধুকে ডেকে নিজে থেকে এফএনএসি করে দিলাম।
প্রফেশনাল এথিকস মেনে- রোগীকে ফেরত পাঠালাম সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছেই! আমার এথিক্স সেটাই বললো আমাকে। ভুল ঠিক জানি না।
এবার প্রশ্ন হলো- এই ডাক্তার বাবু, যিনি আধুনিক চিকিৎসক, তার উপর আবার বিশেষজ্ঞ, তিনি এভাবে করতে পারেন কি?
ম্যাজিকের মতো কাজ করে এমন স্প্রে ব্যবহার করে, বার দশেক রোগীর থেকে ফি নিয়ে, নিজের ভগবান ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য যে কাজটি তিনি করলেন, সেটাকে কি বলবো আমি???
কি বলবেন আপনারা??
এখন রোগীর টিউমার ছড়িয়ে পড়েছে ফিমারের মেডুলারি ক্যাভিটি ধরে। একটা বড় অংশ ক্ষয়ে গেছে। হয়তো ছড়িয়েছে শরীরের অন্য অংশেও!
কি হবে এই রোগীর?
প্রায় ছ’মাস স্প্রে চিকিৎসা নিতে গিয়ে আজ সেই রোগী যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তারপর তার চিকিৎসা যে সহজ হবে না, সেটা সবাই জানি আমরা।
আমি জানি, এই রোগী ভগবানতুল্য ডাক্তারের বিরূদ্ধে টু শব্দটি করবে না। বরং ফের তাঁর কথা শুনেই চলবে।
আমরা খুব খুশি হবো যে- রোগী মরতে মরতেও ওই ডাক্তারকে ভগবান ভাবছে!! হাততালি দেব। আধুনিক চিকিৎসা সবার সেরা বলে বুক বাজিয়ে অন্য সবাইকে দাবিয়ে রাখবো। আরো যা যা করার করবো! বেশ তাই হোক।
****************
এই বিপরীত গল্পটি না লিখে পারলাম না, কারণ ঠিক একই রকম বহু আধুনিক চিকিৎসককে এখন দেখতে পাই আশেপাশে। এবং তাঁদের ম্যাজিকাল চিকিৎসা দেখে দেখে মাঝে মাঝে ডাক্তারি করা ভুলে যাই।
হ্যাঁ, তাঁদের চেম্বারে রোগীর লাইন রাস্তা ছাড়িয়ে যায় দিন দিন। বড় বড় দামী গাড়ির জানালায় উঁকি দেয় রোগীরা। ছায়া পড়ে কাঁচের জানালায়। পড়ে কি??
ভগবান ভেতরে ঘেমে নেয়ে একসা! সময় নেই! সময় নেই!
আমি সেই ভিড় ঠেলে কোন রকমে টোটো চেপে ঘরে ফিরি।
হ্যাঁ, বলতে লজ্জা নেই, এই দেশের সিস্টেমে আমার মতো তুচ্ছ ডাক্তার তাঁদের বদান্যতায় দিন কাটাই। কখন একজন রোগীর পরীক্ষা করবো। রিপোর্ট লিখবো। তারপর সেই রিপোর্ট দেখে বা না দেখেই ম্যাজিকের মতো চিকিৎসা হবে!
রেডিওলজিস্টকে মানেন, এমন ডাক্তার যে নেই তা নয়, কিন্ত এখনো যাঁরা সরাসরি রোগীকে দেখেন ,, চিকিৎসা করেন, তাঁদের অনেকের অ্যালার্জি আছে রেডিওলজিস্টকে মানতে! অথচ আধুনিক চিকিৎসায় সেটা কতবড় নির্বুদ্ধিতা, সেটা বোঝানোর পরিসর পাই না।
জানি না, এই রোগীর ভবিষ্যৎ কি হবে।
ভালো থাকুক।
নাস্তিকের প্রার্থনা পৌঁছে যাক কিছু কিছু ভগবানতুল্য ডাক্তারের কাছে।
পৌঁছাবে তো??
অসাধারণ। আবার লিখবেন। ভালো থাকবেন।